Wednesday 21 January 2015

রাত ভ’রে বৃষ্টি

অনেক দেরিতে হলেও পড়লাম বুদ্ধদেব বসুর বহুলালোচিত আর প্রকাশের আগে কিছুটা সময়ের জন্যে নিষিদ্ধ উপন্যাস ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’নিজের বাড়ির বুক শেলফের কোনায় কোনায় কতো না-পড়া বই পড়ে আছে দেখে নিজেই অবাক হই। খুব ছোট বই, খুব অল্প সময়ে পড়া হয়ে গেলো।

পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, সেই সময়ে তিনি বিভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা, অনুভূতি কী অন্য চোখেই না দেখতেন! নিঃসন্দেহে তিনি গতানুগতিকতার থেকে আলাদা ভাবনা ধারণ করতেনসে-সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর এই লেখাটি আলোচনায় আসার মতো ছিলো বই কিতখন নারীরা নিজেরাই তাঁদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন, লজ্জা পেতেন, দ্বিধা করতেন। সে-জায়গায় তিনি পুরুষ হয়ে তাদের না-বলা কিংবা চেপে-যাওয়া অনুভূতিগুলো নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন। সেই অনুভূতিগুলো ন্যায় কী অন্যায় সেটার বিচার করবে সময়।

এই উপন্যাসের যথার্থতা বিচার করার মতো বোদ্ধা আমি হই নি হয়তো এখনো, তবু নারী হিসেবে উত্তম পুরুষে কথা বলে-যাওয়া এর মূল নারী চরিত্র মালতীর সাথে আমিও একাত্ম হয়েছি অবচেতনায়। ভালো-লাগা শব্দটা বেশ হালকা মনে হয়, আমি মনে-দাগকাটা কিছু কথা অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চাই।

উপন্যাসের নায়িকা মালতীর আত্মোপলব্ধি,

“আমার ছোট্ট শরীরটার তলায় অমন প্রকাণ্ড একটা কালো মেঘ কোথায় লুকিয়ে ছিলো এতদিন? তবে কি নয়নাংশুকে আমি কখনোই ভালবাসিনি? বাসিনি তা নয়, কিন্তু ওকে আমি পুরোপুরি কখনো দিইনি নিজেকে–এতোদিনে সেটা বুঝতে পারছি–একটা অংশ সরিয়ে রেখেছি না জেনে– সেই গোপন গভীর চরম অংশ তোমারই জন্যে আমি জমিয়ে রেখেছিলাম, জয়ন্ত। সে আমার স্বামী, রাতের পর রাত বছরের পর বছর আমি শুয়েছি তার পাশে, তার আর আমারই সন্তান বুন্নি–কিন্তু ও সবে কিছু এসে যায় না। কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে, বিনা চিন্তায়, বিনা ইচ্ছায় বিনা ভালোবাসায় কি স্ত্রীলোকের গর্ভে সন্তান আসে না? আমি এখন বুঝতে পারছি যে সাত সন্তানের মা হ’য়েও কোনো মহিলা কুমারী থেকে যেতে পারেন–হয়তো ঘরে ঘরে এমন গৃহিণী অনেক আছেন যাঁরা একটা বোবা শরীর নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবন। আর তা তাঁরা জানেন না পর্যন্ত। আমিও কি জানতাম আমার গোপন রহস্য, জয়ন্তর সঙ্গে দেখা না হ’লে? অংশু পারেনি–নতুন বিয়ের পরেও কখনো পারেনি আমাকে নিজের মধ্য থেকে এমনি ক’রে টেনে বের ক’রে আনতে, ভাসিয়ে নিয়ে ডুবিয়ে দিতে যেন অঝোর মেঘ ঝ’রে ঝ’রে পড়লো–নিঃশেষে নিঃশেষে।”

অভিমানী স্ত্রী মালতী বলেছে,

“নয়নাংশু আমাকে সভ্যভব্য মালতী ব’লেই ডাকে, আদরের সময় নিজে অনেক কিছু বানিয়ে নেয় কিন্তু লোটন বলে ডাকে না, তার মতে ওটা নাকি মানায় না আমাকে, ওটা ‘ন্যাকা’ নাম, অর্থাৎ আমার বিয়ের আগেকার কুড়ি বছরের জীবনটাকে সে উড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু তুমি নিলে আমার জীবনের অংশ, আমার অতীতের আর বর্তমানের, আমার কথা শুনে-শুনে ক্লান্তি নেই তোমার; আমি বুঝতে পারলুম তোমার জীবন এখন আমাকে ঘিরে–ঘিরে ঘুরছে। সেটা তুমি খুব সরলভাবে সহজভাবে মেনে নিয়েছো, তা নিয়ে কোনো ভয় নেই তোমার, লজ্জা নেই- কত সহজে আমার হাত ধরেছিলে তুমি, কানে কানে ‘লোটন’ বলে ডেকেছিলে, আড়ালে যখন ‘তুমি’ বলো মনে হয় যেন চিরকাল আমি তা-ই শুনেছি, আর তাই তো যেদিন প্রথম আমাকে জাপটে ধরে চুমু খেলে আমি অবাক হলাম না, ভাবলাম না এটা ভালো হলো না মন্দ হলো, শুরু সারা শরীরে থরথর করে কেঁপে উঠলাম যেন আমি ষোলো বছরের কুমারী।”

আত্মগ্লানিতে ভোগা মালতী বলছে,

“কেউ যেন না ভাবে আমি নয়নাংশুর দুঃখ দেখতে পাইনি বা চেষ্টা করিনি তাকে সান্ত্বনা দিতে। তখন পর্যন্ত জয়ন্তর সঙ্গে কিছুই হয়নি আমার, কিন্তু আমি দেখছি নয়নাংশু কেমন অদ্ভুত বদলে যাচ্ছে, হাসি কমে গেছে মুখের–আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে ভালো করে জবাব দেয় না–অন্তত একজন মানুষের কাছে আমি যে তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি এইটেই ভালো লাগছে না তার। আমি কি তখন কম চেষ্টা করেছি নয়নাংশুকে খোশমেজাজে রাখতে? রাঁধতে আমি ভালোবাসি না, উনুনের আঁচে আমার মাথা ধরে, কিন্তু এই সময়ে আমি নিজের হাতে রান্না করেছি যা-যা তার বিশেষ পছন্দ, ঝি-চাকর থাকা সত্বেও তার শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি ক’রে দিয়েছি নিজের হাতে, জুতো পালিশ ক’রে দিতেও পরোয়া করিনি। সে আরামপ্রিয় মানুষ, তার উপর একটু পরিচ্ছন্নতার বাতিক আছে–আমি অনেক খেটে অনেক যত্নে ঝকঝকে রেখেছি ফ্ল্যাটটিকে, আলোয় নতুন শেড আর সোফায় নতুন ঢাকনা পরিয়ে উজ্জল রেখেছি বসার ঘর–কিন্তু সে-সব যেন চোখেই পড়েনি তার। অথচ আমার হাতের কোনো একটি ছোটো কাজও জয়ন্তর চোখ এড়ায় না, যদি কোনদিন কানের দুল বদল করি তা পর্যন্ত লক্ষ করে সে, আমি যখন টিপট থেকে চা ঢালি তখন টের পাই তার দৃষ্টি আমার হাতের উপর।”

নিজের পক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে মালতী ভেবেছে,

“ও-সব ভালোবাসাবাসি অংশুর মতো লোকদের বানানো ব্যাপার-একটা ধারণা, কল্পনা, হয়তো একটা আদর্শ যার কাছাকাছি পৌঁছতে পারে না কেউ, আর সেই আপসোসে তা নিয়ে শুধু কথা বলে। এমন মানুষ কে আছে যে অন্য একজনের সব ইচ্ছে মেটাতে পারে? অল্প বয়সে এক ধরনের মন থাকে, চনচনে চাঙ্গা থাকে অব্যবহৃত শরীর, হঠাৎ কোনো একজনের সব-কিছুই ভালো লেগে যায়। অন্য সব মানুষ থেকে আলাদা ক’রে নিই তাকে, মনে হয় তাকে পেলে আর-কিছু চাই না-কিন্তু তখন তাকে পাওয়া গেলো, ধরা যাক তারই সঙ্গে বিয়ে হ’লো যখন, তখন মোহাচ্ছন্ন ভাবটা এক গ্রীষ্মেই ঝ’রে পড়ে, এক বর্ষার জলেই ধুয়ে যায়। তারপর থাকে স্বার্থ, থাকে একত্র বসবাসের ফলে মমতা, থাকে অভ্যাস, পুরানো চটিজুতোর আরাম-আর থাকে শরীর। কিন্তু শরীরও কত সহজে ক্লান্ত হয় বিমুখ হয়, কত সহজে অন্য সুখের স্বপ্ন দ্যাখে-যদি না কারো বোকা হ’য়ে জন্মাবার মতো সৌভাগ্য হয়, কিংবা চোখে থাকে এমন ঠুলি যাতে সামনের মানুষটিকে ছাড়া আর-কিছুই সে দেখতে পায় না, জয়ন্ত আমাকে যত কথা বলেছে, তারমধ্যে ‘ভালোবাসা’ কথাটা একবারও উচ্চারণ করেনি-আমি সেজন্য কৃতজ্ঞ তার কাছে...”

স্বামী নয়নাংশুর অভিমানও কাচের বাসনের মতো ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গেছে,

“হায় ভালোবাসাযেন তা মুখের কথার উপর নির্ভর করে-যেন তা চোখে ভেসে ওঠে না, ধরা পড়ে না গালের রঙে, হাতের নড়াচড়ায়, এমন কি পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকার ধরনে, নিচু হ’য়ে চা ঢেলে দেবার ভঙ্গিটুকুতে পর্যন্ত। তা আলোর মতো সহজ, রোদের মতো নির্ভুল-সেখানে কোনো তর্ক নেই, তা চিনে নিতে এক মুহূর্ত দেরি হয় না। এই কথাটাই আমি বলার চেষ্টা করেছিলাম মালতীকে অনেক কষ্টে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে–তুমি যদি সত্যি আমাকে ভালবাসো আমি কেন তা অনুভব করি না? কেন করো না তা আমি কী ক’রে বলবো! ব্যস, এর উপর আর কথা নেই। একটা দেয়াল, বোবা দেয়াল, মাথা ঠুকলে শুধু মাথা ঠোকার প্রতিধ্বনি বেরোবে।”

প্রতি দিনের জীবন পরিক্রমায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কতো অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যায়। এই ক্লান্তিকর নাগরিক ব্যস্ততায় নর-নারীর একান্ত চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব এখন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ব্যক্তিগত হতাশা কতকিছুই আসলে তার কারণ হতে পারে। কোনো জয়ন্ত এখানে একটি উপলক্ষ্য মাত্র তাই বারে বারে মালতী আর নয়নাংশুর অংশ আমরা জানতে পাই, জয়ন্তের অনুভূতি নিয়ে কিন্তু একটি কথাও লিখেন নি লেখক। আমার চোখে দাম্পত্য জীবন নিয়ে মালতীর হতাশা বের করে আনতে জয়ন্তকে সামনে এনেছেন মাত্র লেখক। পতি পত্মী অউর বোহ বা থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বারেরা কারোর কাছে নিমিত্ত মাত্র, কারোর কাছে নিয়তিরাত্রি

প্রসঙ্গত, কদিন আগে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড নোট’ পড়লাম। প্রথম অর্ধেকটা বেশ টেনে রেখেছিলো, শেষের দিকটা বিরক্তিকর ছিল। একই কথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এতো বার লেখা। অনেকটা জনপ্রিয় সিনেমা বানানোর জন্যে চিত্রনাট্যকাররা যেমন ‘স্পাইসি মশলা’ ঢোকান সেইরকম। আর এতো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যে নোট লিখবে সে কখনো আত্মহত্যা করতে পারবে না। আত্মহত্যা করে মানুষ ঝোঁকের মাথায়, চিন্তা ভাবনা করে আত্মহত্যা করা আমার দৃষ্টিতে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তারপরও একটা জিনিস আমার মনে হয়েছে, একজন স্বামীর কাছে উপেক্ষিত স্ত্রী, প্রেমিক বা বন্ধুর কাছে অবহেলিত হলে কী ধরনের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যেতে পারে সেধরনের মানসিক অবস্থা চিত্রণে তিনি বেশ অনেকটাই সফল হয়েছেন। যেমন বুদ্ধদেব সফল হয়েছেন, উপেক্ষিত স্ত্রী মনের গুঞ্জরিত গোপন ভাবনাগুলো সামনে বের করে আনতে।

যাঁরা সবকিছু শুধু ন্যায়-অন্যায়ের পাল্লায় বিচার করেন না, যাঁরা জীবনের সাদা-কালোর বাইরের গ্রে পার্টটা অনুভব করেন তারা বইটা পড়তে পারেন। মানুষ যে শুধু আদর্শ বা শুধু অপরাধের রূপকথার চরিত্র নয়, রাক্ষসও হতে পারে শ্রেক আর রাজকুমারও হতে পারে ময়ূরবাহন, সেই বাস্তবতার ঘরোয়া স্বরূপ জানতে কিংবা হৃদয়ের পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থার যুগযুগ সঞ্চিত যাত্রীদল যে-সামাজিক মানুষ, তার অন্তরের অন্দরমহলের ওঠাপড়ার কাহিনি জানতে চাইলেও এই বইটা একটা আবশ্যিক পাঠ্য হতে পারে। প্যাস্কেলের সেই কথাটাও বলে নিতে পারি, হৃদয়ের আছে যুক্তি, যা কেবল হৃদয়ই জানে।

তানবীরা

১৮/০১/২০১৫

Friday 16 January 2015

শীত আসে বাবার গন্ধ নিয়ে


শীতকাল মানেই দেশে অন্যরকম একটা উৎসব উৎসব ভাব।

দেরি করে সকাল হয়, সূর্যের তাপ তখন আর খরখরে দজ্জাল রমণী নয় বরং মিষ্টি লাজুক কিশোরী। গায়ে এলিয়ে পড়লে কী ভালোটাই না লাগে! বিকেলে আকাশটা লাল হতে না-হতেই টুপ করে সন্ধ্যায় মিলিয়ে যাবেসকালে ভাপ-ওঠা ভাপাপিঠে কিংবা চিতই, পুলি নইলে ছিটারুটি, মানে ঘুরেফিরে এমন কিছু যা সচরাচর হয় না। খেজুরের রস আর গুড়তো আছেই।

গ্রামে বেড়াতে গেলে দেখা যেতো প্রায় বাড়িতে মাচা আর তাতে উঁকি দিচ্ছে বেগুনি কিংবা সাদা সিমের ফুল, কোথাও কোথাও আবার ফুলের পাশে পাশে সিমও ঝুলে আছে। চারপাশের সবুজ মাঠে আগুন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সর্ষে গাছগুলো, হলুদে আর সবুজে মিশে একাকার, ব্রাজিলের জার্সি হয়ে কিংবা কাঁচা আর পাকার প্রতিচ্ছবি হয়েপ্রকৃতিতেও নিত্যনতুন ফুল যেগুলো সারা বৎসর চোখে পড়ে না। নতুন আলু দিয়ে মুরগি, টমেটো ধনেপাতা মাখিয়ে ছোট মাছের চচ্চড়ি, নতুন-ওঠা সিমের ভাজি, বরই-এর ডাল, শিকার করে-আনা পাখির মাংস, কী নয়!

স্যুটকেসে বা আলমারিতে আলাদা কিছু দিয়ে পেঁচিয়ে যে-কাপড়গুলো সযতনে মোড়া থাকতো সেগুলো তখন নামতো। সোয়েটার, জ্যাকেট, আলোয়ান, লেপ, কম্বল। অনেক বাড়িতেই বিয়ের উৎসব। স্কুলে পিকনিক, পাড়ায় পিকনিক, ছাদে পিকনিক, পাড়ার উঠোনে উঠোনে কোট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা, রাতে লাইট ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে। শুক্রবার মানেই রাস্তা দিয়ে হইহই করে পিকনিকের বাস যাবে, নতুন রিলিজের আপাত হিট হওয়া কোন হিন্দি গান বাজিয়ে। স্কুলে স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিলে নতুন ক্লাশে-ওঠা ছেলেমেয়েদের হাসি মুখ আর নতুন বই পুরনো ক্যালেন্ডারের সুন্দর ছবিটি দিয়ে মুড়িয়ে নেয়ার ধুম আর আনন্দ।

শীতের রাতে বাবা বাড়ি ফিরতেন সাধারণ সময়ের থেকে কিছুটা আগে। ঢাকায় শীতের রাতে দ্রুত রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। বাবা বাড়ি এলে আমাদের কী আনন্দ আর স্বস্তি! ঘরে ঢুকেই হাত মুখ ধুয়ে আমাদেরকে নিজের আলোয়ান দিয়ে মুড়ে দিতেন। আমরা তখন রাত নটার টিভিতে ব্যস্ত। একদিন ম্যাকগাইভার তো অন্যদিন সাপ্তাহিক নাটক নইলে সিরিজ নাটক। আমাদের নড়াচড়ার সময়তো নেইই আর সে সময় নড়া প্রায় অসম্ভব। কোন কিছু মিস করা যাবে না।

কোনদিন যদি বাবা সন্ধ্যে থেকে বাসায় থাকতেন, রাত নটার দিকে তাঁর আলোয়ান যখন আমাদের গায়ে, সেটা থেকে বাবার গায়ের বাবা বাবা গন্ধের সাথে মিষ্টি একটা বাবা বাবা ওম মিশে থাকতো। বাবার সেই চিকন বর্ডার দেয়া খয়েরি, বাদামি উলের আলোয়ানগুলো সাধারণ আলোয়ানের থেকে লম্বায় আর চওড়ায় অনেক বড় হতো। কত পুরনো ছিলো সেগুলো কে জানে। সেগুলোর কিছু বোধহয় তিনিও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন।

ছোটবেলায় একটা আলোয়ান দিয়ে দুজনকে পেঁচিয়ে ফেলতে পারতেন, বড় হওয়ার পর অবশ্য আলাদা আলাদা দিতে হতো। কিন্তু পেঁচিয়ে দিতেন সবাইকে, নিজের গুলোর সাথে দাদুর আলোয়ানও নিয়ে আসতেন। আলোয়ান পেঁচিয়ে প্যাকেট করে তারওপর কম্বল এনে দিতেন যেনো ঠান্ডা তার আগ্রাসী আঙুলে তাঁর সন্তানদের স্পর্শ করতে না পারে।  

কী অকিঞ্চিৎকর সেই সময়, সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসার আমাদের। গিজার নেই, হিটার নেই, এয়ারকন্ডিশনার নেই। গরম কাপড়, সুন্দরবন থেকে বিশ্বাসী কাউকে দিয়ে আনানো মধু, গ্রামের বাড়ি থেকে বানিয়ে-আনা খাঁটি ঘি, বেসিনে, বাথরুমে গরম পানি বালতিতে করে এই আমাদের ভরসা।

খাবার সময় মানে আনন্দবাজার। বড় একটা বোলে বাবা ভাত, তরকারি, মাছ, মাংস, ডাল, গরম ঘি, সালাদ, লেবু, আচার সব একসাথে মেখে নিতেন। মেখে নিতেন বললে আসলে ভুল বলা হয়, ছোট বাচ্চাদের যেমন খিচুড়ি খাওয়ানো হয় সেরকম ক্বাথ বানিয়ে ফেলতেন। আমরা চারধারে কার্পেটের ওপর গোল হয়ে বসতাম, হাত আলোয়ানের ভিতর আর পা কম্বলের নিচে, চোখ টিভির ওপর আর সন্তানদের প্রতি একাগ্র আমার বাবা ঘুরে ঘুরে সবার মুখে লোকমা তুলে তুলে দিতেন।

অনেকসময় মুখে নিয়ে বসে থাকতাম ঠিক বাচ্চাদের মতো, তখন বাবা বকা দিতেন, চিবানোর তো কিছু নেই তাহলে মুখে নিয়ে চিন্তা করিস কী? মুখে যাবে গিলে ফেলবি, বাকি যা করার তো আমিই করে দিয়েছি।

রান্নাঘরে গরম পানি ফুটছে, আমাদের মুখ মুছিয়ে দেবেন বাবা নিজের হাতে আর একটু গরম পানি জগে মিশানো হবে, সবাই খাবে। ইউনিভার্সিটি পড়া অব্ধি কটা শীতের সন্ধ্যে নিজের হাতে খেয়েছি আঙ্গুলের কড়ে গুনে বলে দিতে পারবো। শীত বাদেও বহু সন্ধ্যে বাবা খাইয়ে দিতেন, তবে শীতের দিনে সেটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত ছিলো।
খাবার প্লেটে নিয়ে আমরা এতো দেরি করতাম যে খাবার প্লেটে ঠান্ডা হয়ে যেতো। অনেকসময় দেখা গেছে, গরুর মাংস প্লেটে ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে। মা চ্যাঁচামেচি করতেন ছেলে মেয়েগুলোকে নষ্ট করছেন আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে এই বলেবাবা শুনতেন কিনা জানি না, মুখ টিপে হাসতেও পারেন

সকালে সোয়েটার, মোজা লেপের ভেতর দিয়ে যেতেন বাবা সোয়েটার গরম হবে তবে সেটা পরে বিছানা থেকে নিচে মেঝেয় পা দেবো। কিছুতেই ঠান্ডা লাগা যাবে না তাঁর সন্তানদের গায়ে। আহ্লাদী মেঘ আমার কাছে বায়না করে আমি যেমনটা করতাম, মা, আমি উঠতে পারবো না, আমার ঠান্ডা লাগে আমাকে পানি এনে দেবে, জুস এনে দেবে, মুড়ি মেখে দেবে আরো কত কীখুব মায়ায় মনটা ভরে যায়। নিজেকে দেখি মেঘের মাঝে, নিজের শৈশবকৈশোরবেলা

গ্রীষ্মের দুপুরে গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়েছি, ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। কিছুক্ষণ পরেই আবার একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। উঠে আবার চাদরখানা গায়ে টানতে কতো রাজ্যের যে আলস্য! অপেক্ষা করে থাকতাম কখন বাবা এইদিকে আসবেন। আমাকে কিংবা দাদুকে কাউকে না কাউকে দেখতে, কথা বলতে। দেখামাত্রই বলতাম, একটু চাদরটা দিয়ে দিবেন। কতো রাগতো বাবা, তুই এতো বড় হয়েছিস, তুই সবারটা দেখবি, না তোর চাদর আমাকে দিয়ে দিতে হয়!

আমি সেসব থোড়াই শুনেছি! গল্পের বইয়ে ডুবে নিদারুণ আরামে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়েছি, কখন হাত থেকে বই পড়ে গেছে খসে, টেরই পাই নি।

শীতের দিনে কিংবা ঠান্ডার দিনে খিচুড়ি বাবার খুব পছন্দ তারমধ্যে সব্জি খিচুড়ি আরো বেশি পছন্দ। খিচুড়ি রান্না করার জন্যে সব্জি ধুতে ধুতে ভাবছিলাম বাবা কি কখনো ভেবেছিলেন তাঁর কন্যারা কোন সুদূরে সাত সমুদ্দুর সতের নদী পাড়ি দেবে? বরফ শীতল ঠান্ডা পানি ঘেঁটে ঘেঁটে সাংসারিক কাজ করবে?

ঠান্ডা আমার সহ্য হয় না, কিন্তু নিয়তির কারসাজিতে শীতের দেশে বসবাস। সারা শীত ধরতে গেলে সর্দি, কাশি, জ্বরে ভুগি। প্রায় দিন সূর্য দেখা যায় না, অন্ধকার চারদিক, টিপটিপ বৃষ্টি নয়তো বরফ আর সাথে উত্তরের হাওয়াতো আছেই। ঘুরেফিরে সংসারের কাজ করি আর পুরনো স্মৃতি কারণে অকারণে জাবর কাটি। বয়স হচ্ছে তারই লক্ষণ হয়তো।

ভেবেছিলেন কখনো বাবা আপনি, আমরা বরফের মধ্যে জুতো পরে অফিসে যাবো, বাজার করবো, মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাবো? মোটা জ্যাকেট আর মাফলার ভেদ করে কনকনে শীতের হাওয়া আমাদের হাড়ে ঢুকে যাবে আর চকিতে সেই ঠান্ডার আড়াল এড়িয়ে মনে পড়বে, আপনি কতো যত্নই যে করেছেন আমাদের প্রত্যেককে একটু ঠান্ডা যেনো আপনার বাচ্চাদের ছুঁতে না পারে, সেজন্যে আপনার নির্দেশে সকালে পানি গরম করে মগে দিয়ে যেতো, মুখ ধোওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ গরম পানিতে হবে।

ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলেই আপনাকে মনে পড়ে বাবা, আপনার ওম, আপনার গন্ধ, আপনার যত্ন আর ভাবি আপনি এখানে থাকলে আপনার আত্মজাদের রক্ষা করতে কী করতেন! আরো ভাবি আপনার সাধ্যের মধ্যে থাকলে কী না করতেন! শঙ্করের একটা লাইন আছে, কোথায় জানি না। সেটা এরকম, পৃথিবীর সব ভালোবাসাতেই স্বার্থ থাকে। এমনকি ছেলের জন্যে মায়ের ভালোবাসাতেও কিছুটা স্বার্থ মিশে থাকতে পারে। একমাত্র যে ভালোবাসাটা নিঃস্বার্থ, সেটা হলো মেয়ের জন্যে বাবার ভালোবাসা।

এই লেখাটি তাঁদের জন্যে যারা বলে যাচ্ছেন অনেকদিন কিছু লিখছি না কেনো কোথায় ডুব মেরেছি। মনখারাপের পেন্সিল হাতে নিয়ে বোবা বরফ ভেঙে কিছু স্মৃতিকাচের টুকরো রেখে গেলাম এখানে, অনেকটুক ভালোবাসা আর অনেকটা অসহায়ত্ব সঙ্গী করে।


১৬/০১/২০১৫

Tuesday 6 January 2015

গ্রন্থালোচনাঃ "নিন্দিত নন্দন”

প্রায় একটানে পড়ে শেষ করলাম ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর আত্মজৈবনিক উপন্যাস “নিন্দিত নন্দন”। শব্দশৈলী থেকে ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ১৯১ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়তে পড়তে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল। একটি “নারী” তার সামাজিক অবস্থান যে পর্যায়েরই হোক না কেন, ভুল-ভ্রান্তি, আবেগ-অনুভূতির কী মূল্যই না তাকে জীবনভর পরিশোধ করে যেতে হয়। তবুও তিনি কিছু জায়গায় সৌভাগ্যবতী, ছেলেমেয়েদের ভালবাসা পেয়েছেন, বিয়ার ভাইয়ের মতো স্বামীকে পাশে পেয়েছেন, নিজের যোগ্যতায় ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন, বহুজন কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন তার মত পরিস্থিতিতে।

“আমাদের খন্ডকালীন সঙ্গীত শিক্ষক কিউ।এস।ইসলাম বেশ আন্তরিক ছিলেন। তাঁর শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি খুব ভালো গাইতেন। দেখতে ভালো ছিলেন না, তবে বয়সে তরুণ, বাচনে চৌকষ। এক পর্যায়ে খালাদের কারণে-অকারণে শাসন আমার শৈশবকে ঝালাপালা করে ছাড়ল – উপায়ন্তর না দেখে গানের শিক্ষক কিউ।এস।ইসলামকে বিয়ে করলাম মাত্র এক বছর প্রণয় শেষে। খুবই ভালোবাসলাম ওকে। প্রথম প্রেম একটি কিশোর জীবনে! সত্যি ভালোলাগার ব্যাপার। ভুল খুঁজে বের করার মন ছিল না। কিন্তু কুমারী জীবনের মুহূর্তগুলো যেন দ্রুতই সরে সরে যাচ্ছিল।“

“সন্ধ্যার পরে সিরাজ (আমার স্বামী) আমাকে ছাদে ডেকে নিলেন। সেদিন আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জ্যোৎস্নার রুপোলি আলোতে সারা প্রকৃতি স্নাত। আমি যেন সেই আলোর সমুদ্রে স্নিগ্ধ সাগরিকা। প্রাণে গভীর স্পন্দন। মনে হলো এমন রুচিবান সংস্কৃতিমনা স্বামী, তিনি চাঁদের আলোয় গান গেয়ে আমাকে বরণ করে নেবেনযেন শকুন্তলার রাজা দুস্মন্ত আজ আমার এতদিনের শৈশব-কৈশোরের যত কষ্ট যত ক্ষোভ সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে আমার জীবন পূর্ণতা দেবেন।

উনি সতীনাথ মূখার্জির গান শোনালেন। ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না .........অপূর্ব দরদ দিয়ে গানটি গাইলেন। আমি মগ্ন হয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎ দেখি ঝলমলে রুপোলি কাগজে মোড়ানো প্যাকেট থেকে একটি কাপড়ের তৈরী জিনিস বার করলেন মুহুর্তেই বুঝতে পারলাম এটি একটি বোরকা, যে বসন সমগ্র নারী সমাজকে অবনত করেছে। এ বসন জীবনকে কিছুই দেয় না শুধুমাত্র কুসংস্কার ছাড়া, ফতোয়ার সবক ব্যতীত অন্য কিছু নয়। বোরকা ফ্যাশনের পোষাক হতে পারে কিন্তু ধর্মের পোষাক নয়। ধর্ম অন্তরে।“

“সিরাজ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলেন, আমি স্কুলে চাকরী করতে শুরু করি। সামান্য বেতনে চাকরী করে, স্বামীকে পড়াশোনার সম্পূর্ন দায়ভার নিয়ে বিশাল সংগ্রামের পদক্ষেপ নিলাম। ৬০ টাকা বেতনে দুই শিফটে ১২০ টাকা এর ফাঁকে দুটি টিউশনি শেষ করতাম। জীবন ঘন্টা মাপের যন্ত্র, যে সংগ্রামে শুধু শ্রমই ছিল না কেবল কলঙ্ক, দুর্নাম, দারিদ্র্যের, স্বামীর অকারণ শাসন, সন্দেহ, দুর্ব্যবহার কোনকিছুরই কমতি ছিল না। সিরাজ যেহেতু আমার উপরে নির্ভরশীল সে কারণে তাঁর অন্যায়, হীনমন্য ব্যবহারগুলো আমি দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়েছিলাম। কারণ মানবিক বিষয়টি বড় করে দেখতাম। তাঁর কাছে বিবাহিত জীবনের কোনো দাবিই যেন রাখতাম না।“

এরপর তার জীবনে “বিয়ার ভাই” এর আবির্ভাব। নানা ঘাত প্রতিঘাত। বিয়ার ভাইয়ের সাথে প্রেমের আমেজ পুরো বইটিকে তরতর করে পড়তে অনেক পাঠককে নিশ্চয় টেনে রেখেছে। সেই কিশোরী বয়স থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন শুধু সংসার টেনে রাখতে। পড়ছি আর ভাবছি, কতো যুদ্ধ করলে তবে এমন একজন মহীয়সী হওয়া যায়। যুদ্ধদিনের কথা আমি আর নাই লিখলাম, পড়ে নিবেন তার নিজের কথায়। স্যালুট ম্যাম, জীবন্ত কিংবদন্তী আপনি।


বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন, মহামান্যা অদিতি  

গ্রন্থালোচনাঃ বোবাকাহিনী

ক্রীসমাসের ছুটিতে কিছুটা কাউচ পটেটো হয়ে বাইরের তুষারপাত দেখেছি আর হাতে ছিলো গরমা গরম সবুজ চায়ের সাথে পড়া না পড়া কয়েকটি বই আর কিছু দুর্দান্ত সিনেমা। ছোটবেলা থেকে পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের কবিতা পড়েছি তবে সেগুলো বেশীরভাগই টেক্সট বইয়ে। সহজ সরল জীবন কথা, গ্রামীন রুপ এই তার লেখার প্রধান উপজীব্য বলে ধারনা ছিলো। নিজেদের শহুরে জীবনের সাথে অনেক সময় রিলেট করতে পারিনি বলে বেশীর ভাগ সময় আগের যুগে গ্রামে এমন হতো এই মনোভাব নিয়ে পড়ে গেছি।

আমার বাড়ি যাইও ভোমর, বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব, বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা গামছা বাঁধা দই।

কিংবা

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।

নয়তো

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!


আমাদের আটপৌরে শহুরে জীবনে আমরা কাকেইবা এমন উদাত্ত আহবান করি? কোথায় বা তাদের আপ্যয়নের জন্যে শালি ধানের চিঁড়ে। ভেন্না পাতার বাড়িই বা আমরা কোথায় দেখেছি? এসমস্ত মিলিয়ে পল্লীকবি সর্ম্পকে ধারনা ছিলো সহজ সাধারণ কাব্যকথা লিখে গেছেন তিনি। বইয়ের তাক এপার ওপার করতে যেয়ে হাতে পরলো তার “বোবাকাহিনী” উপন্যাসটি। অনেক আগে একবার পড়েছিলাম, হালকা হালকা মনে ছিলো। আবারো পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ধরতে গেলে প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম বইটি। হাতে নিয়ে আর ছাড়তে পারিনি, এভাবে কাহিনী আর ভাষা দুইই আবার টেনে নিয়ে গেছে।

ছোটবেলায় শুধু মুগ্ধ পাঠিকা হয়ে পড়ে গেছি কিন্তু এবার পড়তে পড়তে পল্লীকবির দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ভাবছিলাম। এতো এতো আগের দিনে বইটি লেখা যেটাতে তিনি বার বার ধর্মের নামে গরীবকে শোষণ করা, ধর্মের আফিম খাইয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করিয়ে দেয়ার ব্যাপারগুলো তুলে এনেছেন। দেখিয়েছেন গ্রামে যেমন ছিলো শোষন তেমন ছিলো ভালবাসা, শহুরে হঠকারিতা। স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে, নিজের প্রয়োজনের জন্যে ধর্মকে ব্যবহার শিক্ষিত রাজনীতিবিদদের সূক্ষন চালকে তার দক্ষ লেখনীর মাধ্যমে তুলে এনেছেন। কতো চাতুরতার সাথে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিয়ে পাশাপাশি বাস করা প্রতিবেশীকে শত্রু করে তোলা যায় উঠে এসেছে তার লেখায়। এই জিনিসটি যে তিনি ততো আগে উপলব্ধি করেছেন এবং তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেছেন সেটি তার এই বইটি না পড়লে আমার জানাই হতো না তার সম্পর্কে। পল্লীকবির জীবনকে দেখার দৃষ্টি আর তার তা নিয়ে তার চিন্তা – ভাবনা, বইটি পড়ে তার সম্পর্কে আমার ধারনা বদলে গেছে। তিনি এতোটা অসাম্প্রদায়িক আর মুক্তমনা ছিলেন, কোন ধারনাই ছিলো না।  

বইটির সবচেয়ে বেদনার্ত অংশ ছোটবোন বড়ুই আর ভাই বছিরের ভালবাসা।আমাকে বারবার পথের পাঁচালীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো, অপু-দুর্গা। দরিদ্র সংসারে নিদারুন অভাব কিন্তু আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় দুই ভাইবোন মনের সুখে, ফল কুঁড়িয়ে খায়, ফুল কুঁড়িয়ে মালা গাঁথে। আছে পথের পাঁচালীর সেই বিষন্নতা, প্রকৃতির অবাধ স্বাধীনতার কোলে কিশোর কিশোরীদের উদ্দাম বেড়ে ওঠা অনেক ক্ষেত্রেই অনায়সে শহুরে ছেলে মেয়েদের হিংসার কারণ হতে পারে। কিন্তু কলেরায় ভুগে ডাক্তার আর ওষুধের অভাবে বড়ুই এর মৃত্যু দুর্গার মতোই বড্ড করুণ। কাঁদিয়ে আকুল ভাসায়। আমি যেনো চোখের ওপর সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম, কি নিপুন ভাষায় না বর্ননা করে গেছেন সেই দুঃখ গাঁথা। ভাই বছির প্রতিজ্ঞা করলো, যেভাবেই হোক তাকে ডাক্তার হতেই হবে। বড়ুই এর মতো আর কাউকে যেনো অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে না হয়। গরীবের পাশে থাকবে সে, ডাক্তার যেনো আর শুধু শহর আর ধনী লোকদের জন্যে না হয়। ফুলির ভালবাসা অগ্রাহ্য করে চলে যায় বছির গ্রামের লোকদের তার পানে আশা করে থাকার কথা ভেবে, বোন বড়ুইয়ের কবরে করা তার প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে ......... যদিও আজকেও বাংলার গ্রামে গ্রামে ডাক্তার আর ঔষধের দৈন্যতা ঘুচেনি। বহু বছিরের বলিদানও রক্ষা করতে পারছেনা বাংলাদেশকে।


সব মিলিয়ে অন্য এক জসীমউদ্দিন ......... অন্য এক জগত ......। এতোটাই বাস্তব সেই পৃথিবী যেনো আমি নিজের চোখে সব দেখতে পাচ্ছিলাম ......... অসীম মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা লেখকের জন্যে


লেখাটি উৎসর্গ করা হলো আমাদের শান্তকে