Thursday 22 December 2016

সেদিন এক ডাচ বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রন ছিলো। অনেক রকম মাছ খাইয়েছে, বিভিন্ন পন্থায় রেঁধে, বেকড, গ্রিলড, কুকড, স্মোকড। যেমন মাছের স্বাদ, তেমন সস আর পরিবেশন। সবাই খুব আনন্দ করে খেয়েছি। বিশেষ করে মেঘের উচ্ছাস ছিলো দেখার মত। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে এদিক ওদিক নিমন্ত্রনে ভাল মন্দ খেয়ে খেয়ে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে, এগুলো যে বিশেষ কিছু তা আর সেভাবে অনুভবই করতে পারে না।

সেই অভ্যস্ত গলি থেকে বের হয়ে, কয়েকবার বললো, ওরা অনেক খেটেছে, হ্যাঁ না মা? কি ভাল রান্না আর কি সুন্দর পরিবেশন। আমাদের বাড়িতে যখন ওদের ডাকবে আমিও তোমাকে সাহায্য করবো, অনেক সুন্দর করে সব সাজাবো, ওকে মা?

পরদিন আমি ঘরে রান্না করার জন্যে প্লাইস মাছ বের করে তাতে লবন হলুদ মাখাচ্ছি।

মেঘ কি জন্যে জানি রান্নাঘরে এসেছিলো, দেখেই বললো, সব মাছ তুমি বাঙলা রাঁধো কেন মা?

আমি বললাম, সব মাছের আমি অন্য রান্না জানি না তাই।

মেঘ বললো, জানো না তো কি হয়েছে? ইউটিউব করে, গুগল করে শিখতে পারো না? এগুলো কি বাংলা মাছ যে বাংলা রাঁধো? বাংলা রাঁধলে আমাকে মাছ খাও, মাছ খাও বলবে না। তুমি জানো বাংলা মাছ আমার ভাল লাগে না।

আমি বললাম, তুমি তো শিখছো বাংলা মাছ খাওয়া।

মেঘ বললো, চিংড়ি, রুপচাঁদা, স্যামন, টুনা, শারদিল, পাঙ্গাশ ফিলেট, পোলাক, পালিং, হারিং আর ইলিশ ছাড়া অন্য বাংলা মাছ মজা নয় কিছু।

এর একটু পরেই কানাডা থেকে মণিকা আন্টি আর তারেক আঙ্কেল ফোন করেছিলো আমাদের। মণিকা যখন এই ঘটনা শুনলো, দারুন একটা যুক্তি দিলো। বললো, মাছ মানেই বাংলা। আমরা মাছে ভাতে বাঙালি, তাই সব মাছই বাংলা খাওয়া যায়। মণিকা তাৎক্ষনিক ভাবে দারুন যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারে। মেঘ অবশ্য চুপচাপ শুনে গেলো, কিছু জবাব না দিয়ে।

খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে পর যথারীতি একটু পড়াশোনা দেখাচ্ছি মেয়েকে। কথায় কথায় চাকরীর কথা আসলো। 

আমি বললাম, আমাকে তোর কাছে রেখে দিস, তুই সারাদিন অফিস করে ফিরে এলে, তোকে রাঁধতে হবে না, আমি রেঁধে তোদের খাওয়াবো। তোর আর তোর বাচ্চাদের জন্যে, রুই মাছ, কেঁচকী মাছ, পাবদা মাছ রাঁধবো।

মেঘের আর্ত চিৎকার, না, কিছুতেই না।

আমি হাসতে হাসতে শেষ গজালটা দিলাম, কিছুতেই না মানে কি? তুই বাংলা হলে তোর বাচ্চারা বাংলা হবে না?




আর আমার বাচ্চা যদি, কেঁচকি, রুই, পাবদা খেতে পারে, দেখিস, তোর বাচ্চাও পারবে।  ম্যা হু না :D

22-12-2016

Sunday 18 December 2016

কুলে কিক্কার মেঘ

আমাদের দেশে স্কুলে ক্লাশে টীচার বলে, “কথা বলবে না, চুপ করে থাকো”
সে কথাটাই এখানের টীচাররা বলে, “দেখি কে কতক্ষণ ক্লাশে কথা না বলে চুপ থাকতে পারে”? যে সবচেয়ে বেশি সময় থাকতে পারবে তার জন্যে একটা উপহার আছে কিংবা সারপ্রাইজ আছে।


মেঘ যখন ক্লাশ ওয়ানে, তখন ওদের স্কুল থেকে শুরু করলো, যে ক্লাশে দুষ্টুমি করবে না, টিচারের কথা শুনবে, লক্ষী থাকবে, সে সপ্তাহ শেষে, ওদের ক্লাশের সফট টয় “কুলে কিক্কার”কে বাসায় নিয়ে এসে পুরো সপ্তাহান্ত রাখতে পারবে। সবুজ রঙের সে ব্যাঙ আকৃতির “কুলে কিক্কার” কে ঝুলিয়ে গর্বিত মুখে মেঘ যখন ডে কেয়ার থেকে বের হয়ে আসতো, মেঘের সাথে সাথে আমিও অনেক গর্বিত ও আনন্দিত হতাম। তবে শর্ত হলো, পুরো সপ্তাহান্ত মেঘ আর “কুলে কিক্কার” কি করলো সেটা আমাকে কুলে কিক্কারের সাথে পাঠানো ডায়রীতে লিখে পাঠাতে হবে। সোমবারে সকালে যখন ক্লাশ শুরুর আগে সবাই এক সাথে গোল হয়ে বসে যার যার সপ্তাহান্তের গল্প বলবে, তখন টিচার ডায়রী দেখে, জোরে জোরে মেঘ আর কুলে কিক্কারের সপ্তাহান্ত সবাইকে পড়ে শোনাবে। দিস ইজ দ্যা অনার।


প্রথম প্রথম আমারও ভাল লাগতো, লিখে পাঠাতে। এরপর দেখলাম এটা প্রায় একটা নিয়মিত রুটিনে পরিনত হয়ে গেছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহের শেষ দিনে মেঘ কে ডে কেয়ারে আনতে যেয়ে, যেই বলতাম, যাও লকার থেকে তোমার জিনিস পত্র আনো, সে তার বানানো নানা খেলনা পাতি,  আঁকা ছবির সাথে সেই সবুজ রঙের কুলে কিক্কার কেও ঝুলিয়ে নিয়ে আসতে লাগলো। আমি বানিয়ে বানিয়ে ডায়রী লিখতে লিখতে ক্লান্ত। রেগে বলতাম, তুই আবার এটা পেয়েছিস! ক্লাশে সবচেয়ে বোকা হলি তুই। সব বাচ্চা দুষ্টুমী করতে পারে, তুই পারিস না? তোর সাহস নেই? মেঘ বুঝতে পারতো না, মা কেনো এতো রেগে যেতো কুলে কিক্কার দেখলে। সে তো গুড করেছে।


আজকে মেঘ ত্রয়োদশ শেষ করে চর্তুদশে পা দিলো। ছোট স্কুলের সেই লক্ষী কুলে কিক্কার সে এখন আর নেই। ভাল দুষ্ট হয়েছে। কথায় কথায় তর্ক, বায়না, কান্না বয়সের সব দোষ গুন বর্তমান। যদিও বাসায় এটা অনেক প্রবল, বাইরে সে অনেকটাই আগের কুলে কিক্কার রয়ে গেছে। দিদু, খালামনি, বান্ধবী, টিচারদের কাছে বড়ই আদুরে তিনি।


হ্যাপি বার্থ ডে, আমার কুলে কিক্কার। বাসায় বড় বড় চোখে জল এনে, মাকে যতই বলো, “আমাকে তুমি ভালবাস না, কিছু তুমি আমাকে আমার ইচ্ছে মত করতে দাও না।“  আমি জানি তুমি জানো, মায়ের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন তুমি। চির আয়ুষ্মতী হও। লাভিউ – লাভিউ লট।



Friday 2 December 2016

গ্রন্থালোচনাঃ “জলদস্যুর কবলে জাহান মনি”

বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই, মুভি আমাকে বরাবরই খুব টানে। একটানে পড়ে শেষ করলাম জলদস্যুদের কবলে পরা বাংলাদেশের জাহাজ “জাহান মনি” র চীফ ইঞ্জিনিয়ার মতিউল মাওলা’র একশ পাঁচ দিনের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা “জলদস্যুর কবলে জাহান মনি” – খুব সাদামাটা ভাষায় লেখা হলেও বিষয়ের গুনেই বইটি হাত থেকে নামাতে পারি নি আর বইটিও মাত্র চৌষট্টি পৃষ্ঠার।

এর আগে এ বিষয়ে ওপর একটা মুভি দেখেছিলাম ক্যাপ্টেন ফিলিপস। টম হ্যাঙ্কস অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ঐ সিনেমাটিতে। একাডেমি এওয়ার্ড ফর বেস্ট পিকচার নমিনেশান পেয়েছিলো সিনেমাটি। সেখানেও সোমালিয়ান দস্যুদের কবলে একটি এমেরিকান জাহাজের আক্রমনের ঘটনাই ছিলো। তবে তারা জাহাজটিকে ছেড়ে দিয়ে শুধু ক্যাপ্টেনকে নিয়ে যায় মুক্তিপনের জন্যে। আর এখানে পুরো জাহাজটিকে সোমালিয়া নিয়ে যাওয়া হয় এর ক্যাপ্টেন আর ক্রু সব সহ। আর এমেরিকারন সরকার বা মালিক পক্ষ তাদের নাগরিক বা কর্মচারীদের জন্যে যে কেয়ার করবেন সেটা তো বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশী মালিক পক্ষ থেকে আশা করা যায় না।

https://www.youtube.com/watch?v=AAZ0Su_iqYA

শেষে বাংলাদেশ সরকার আর জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষই তাদের উদ্ধার করেন। সে কারণেই হয়ত মতিউল মাওলা যতটা কম নেতিবাচক পেরেছেন তাদের সম্পর্কে ততটাই বলেছেন। নেহাত যতটুকু না বললেই নয়। আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন এটিএন এর সাংবাদিক মুন্নী সাহাকে। এও জানিয়েছেন তাদের দুর্ভোগ নিয়ে রিপোর্ট করা নিয়ে মুন্নী সাহার ওপর বাংলাদেশ সরকার আর জাহাজ মালিক পক্ষের চাপ ছিলো। জন সম্মুখে ভাবমূর্তি যেনো ঠিক থাকে।

বইটি থেকে জানলাম, আরাকানের মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুর আক্রমনে একদিন উপকূলীয় এলাকা বিরান হয়ে গেছিলো। তাদের হটিয়ে, আগা বাকের খাঁ বসতি স্থাপন করেন বাকেরগঞ্জে। বাকের খাঁ ও তার স্ত্রী খনি বেগমের নামে এখন বাকরখানি রুটি প্রসিদ্ধ।

আরো জানলাম, ওমানের সালালাহ বন্দরে যেখানে জাহাজ জাহান মনি সোমালিয়া থেকে এসে নোঙর করে তার কাছেই নাকি সে জায়গাটা যেখানে ইউনুছ নবীকে মাছ তার পেট থেকে লাউ গাছের তলায় রেখে গিয়েছিলো, সেখানে তিনি ও তার স্ত্রী গিয়েছিলেন জাহান মনির মালিকের স্ত্রীর সাথে।

মতিউল মাওলা প্রচন্ড রকম ধার্মিক। পুরো বইতেই এই বিপদের দিনে তিনি বা পুরো জাহাজের সবাই কীভাবে আল্লাহর কাছে দিনরাত প্রার্থণা করেছেন তার বর্ননা আছে। সারা দিনরাত বন্দুকের নলের সামনে থাকলে সেই মানসিক অবস্থায় এটা খুব স্বাভাবিক বটেই। তবুও সে আমলে ওমানে লাউ গাছ ছিলো কিংবা এখনো সেখানে লাউ গাছ আছে, সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি। তবে সোমালিয়ানরা মুসলমান বলে তাদের ওপর কম অত্যাচার করেছে সেটা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন। ধর্ম কোথায় না কাজ করে! যেমন রাজনীতিতে ঠিক তেমন ডাকাতিতেও।

তবে এই জলদস্যুতা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যে কিছু সিন্ডিকেট আর ব্যবসা জমে গেছে সেটার ওপর তিনি অল্প সল্প আলোকপাত করেছেন। কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, এমেরিকার, মাফিয়া- গড ফাদার-অনেকেই এতে জড়িত। জলদস্যুদের থেকে নিরাপত্তা দিতে কেউ কেউ আলাদা কোস্ট গার্ড সাপ্লাই করবেন পয়সার বিনিময়ে, কোন কোন ব্যাঙ্ক নগদ ডলার দেবেন, কেউ কেউ তেল, খাবার পানি সাপ্লাই করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। দিনের শেষে সকলই পয়সার খেলা, সকলই ব্যবসা। পেশাদার লেখক তিনি নন, খুব গুছিয়ে বিস্তারিত লিখতে তিনি পারেন নি, হয়ত সে উদ্দেশ্যও তার ছিল না। তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক অংশটিকে সকলের সামনে তুলে ধরা হয়ত তার উদ্দেশ্য ছিলো। {এই ঘটনার ভয়াবহ একটা পরিনাম তার পরিবার ভোগ করেছে, তার স্ত্রী মাঞ্চু তার সাথে সে সময় জাহাজে ছিলেন, এবং এই যাত্রা থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই তার মৃত্যু হয়। অনেকেই মনে করেন, একশ পাঁচ দিনের এই ভয়াবহ টেনশান তার অকাল মৃত্যুর কারণ।} এই অংশ টুকু বই থেকে নয় ব্যক্তিগত সোর্স থেকে পাওয়া।

এই বছরই অক্ষয় কুমার অভিনীত একটি দূদার্ন্ত সিনেমা মুক্তি পায়,  ইরাকের কুয়েত আক্রমনের সময় সেখানে আটকে পরা ভারতীয়দের উদ্ধার করার সত্যি ঘটনা অবলম্বনে “এয়ারলিফট”। অনেক বাংলাদেশিও সে সময় সেখানে আটকে ছিলেন, পরে তাদেরকে সরকার কি ভাবে উদ্ধার করলো, তারা কিভাবে সেখানে সময় পার করলেন, সে সম্পর্কে বাংলাদেশে কেউ কিছু লিখেছেন কি না, জানতে ইচ্ছে করে।

বন্ধু সম দীপন একবার তার ব্যবসা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলো, বই বিক্রি এত কম। আমি তাকে বলেছিলাম, তার প্রকাশনার বইয়ের লিস্ট দিতে আর সাজেস্ট করতে পড়ার মত কি কি বই আছে। সে আমাকে বলেছিল, অনেক দেশ বিদেশ বেড়াও তুমি, এ বইটা পড়ে দেখতে পারো, তোমার ভাল লাগতে পারে।

বইটা আসলেই ভাল লেগেছে দীপন। অনেক দূরে যেখানেই থাকো, শুভেচ্ছা তোমাকে।
জাগৃতি প্রকাশনী

০২/১২/২০১৬