Friday 7 September 2018

পাথরনদী কথন

প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম, শেখ তাসলিমা মুনের লেখা উপন্যাস “পাথরনদী কথন”। যদিও লেখক “মুখবন্ধ”তে বলেছেন, উপন্যাসটি প্রচন্ড একরৈখিক, রুপার কারণে অন্য কোন চরিত্র এটিতে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় নি। বইটি পড়তে যেয়ে রুপার মা শাহানা, ভাই সুমন, বোন শম্পা কিংবা রুপার নানা, রহিমা ফুপু, রুপার নাটক পাগল মুক্তিযোদ্ধা বাবা সবাইকে যেন আমি চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছিলাম। এরা আমাদের খুব চেনা, আমাদের আশেপাশের মানুষ।


আর দশটা এই আমাদের সাধারণ মেয়েদের মত রুপার সংগ্রাম এতটাই বাস্তব, এতটাই তিক্ত, রুঢ়, বইটি পড়তে শুরু করলে কখন এর সাথে মিশে যাবে পাঠক তা নিজেও অনুভব করবে না। একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা অনেক কঠিন হবে। রুপা একাই যথেষ্ঠ বইটি সামনে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কুয়াশা, দস্যু বনহুর, মাসুদ রানা কিংবা সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান বা বায়োনিক ওম্যান কারো কাছ থেকে রুপা কিছুতেই কম নয়, একটা বই টেনে নিয়ে যাওয়ার মত পুরো ক্ষমতা আর আর্কষন বইটিতে আছে। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে ক্লাশ সিক্স-সেভেনে প্রায় বিয়ে হয়ে হয়ে যাওয়া রুপার ডিভোর্সের পর একা ইংল্যান্ডে মাস্টার্স পড়তে আসার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে লোভনীয় ছোট বেলার প্রেম এসে ডাক দিয়ে গেছে, রুপা’র ভাষায়, “ছেলেটির প্রতি প্রেমের যে আগ্রহ তার জন্মেছিল সেটিকে দমন করার আত্মশক্তিও রুপা অর্জন করেছিলো”।


রুপার সাথে কোথাও আমার দেখা হয়েছিল। তপ্ত গ্রীস্মের এক সবুজ শ্যামল প্রকৃতি পুড়িয়ে দেয়া দুপুরে, ভারী পর্দা টেনে আধো আলো আধো অন্ধকার ঘরে যখন আমরা মুখোমুখি নির্ভেজাল টুকটাক গল্প করছিলাম, রুপা আমাকে বলেছে, ইংল্যান্ডে আসার পরের সংগ্রাম নিয়ে রুপার চতুর্থ বইটি লেখা হচ্ছে এখন। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, মেদহীন, বর্ণনার বাহুলতাহীন, ঝরঝরে ভাষায় লেখন পটিয়সী রুপার সেই সংগ্রামের ইতিহাস জানতে। কিছুটা তো আমরা সবাই কম বেশি, জানি। রুপা, অহনা, কিংবা আরও অনেকেই আছে যারা এই বিদেশে নিজের মাটি খুঁজে পেতে অহরহ কত লড়াই চালাচ্ছে, একাকী, ইথারে হয়ত কোথাও তার দাগ থাকবে না কিন্তু তারপরও তারপরও কোথাও কালির আচঁরটুকু অন্তত থাকুক।


পুরো বই জুড়ে মায়ের সাথে রুপার সম্পর্কের টানাপোড়েন আছে। যুদ্ধে বিধবা দিশেহারা তরুণী মা তিনটি সন্তান নিয়ে তার প্রায় সমস্ত “নিরাশা আর গ্লানি” রুপাকে মেরেই মেটাতে চেয়েছেন। তারপরও রুপা অনেক ভাগ্যবতী, বার বছর বয়সে প্রতিবেশী কাকুর দ্বারা “ধর্ষিতা” হওয়ার পর তার সহায় সম্বলহীন, একাকী মা পিছিয়ে যান নি, লোক লজ্জার ভয় পান নি, মেয়ের সো কলড ভবিষ্যত কি হবে সে ভেবেও পেছোন নি। আনুষ্ঠানিক ভাবে সে পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। সে যুগে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি একটি বিরল ঘটনা। ভাশুরের দ্বারা নির্যাতনের পরেও ডিভোর্সের জন্যে মেয়ের পাশে থেকেছেন। মায়ের মরু সম রুক্ষতা ভুলে যাওয়ার জন্যে হয়ত রুপার কাছে এগুলো ঝর্ণা’র কাজ করবে।


সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত লেখক সাসকিয়া নোর্ট ফোল্কসক্রান্তে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, তের বছর বয়সে প্রতিবেশীর ছেলের দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনাটি তিনি এতদিন প্রকাশ করার সাহস পাননি। “মি টু” ক্যাম্পেইনের কারণে এখন যখন তার বইতে এটি তিনি লিখেছেন, প্রায়ই তার নিজের ছেলে কিংবা মায়ের কাছ থেকে এ নিয়ে নানা তির্যক মন্তব্যের শিকার হন তিনি। দেশে বা বিদেশে, কোন পরিবারে, কোন সমাজে মেয়েরা নির্যাতিতা নয়? বৈষম্যের স্বীকার কোথায় হয় না? কোথাও বেশি কোথাও কম। কোথাও খালি চোখে দেখা যায় আর কোথাও দূরবীক্ষণ দিয়ে দেখতে হয়।


লাজুক মুখচোরা কিশোরী রুপার আত্মবিশ্বাসী রুপাতে পরিনত হওয়ার চিত্রও এসেছে খুব নির্ভরযোগ্য ভাবে। নিজেকে লুকাতে লুকাতে আর যখন লুকানোর কোন স্থান রইলো না, তখন ধীরে ধীরে লাজুক রুপা পরিবর্তিত হলো স্বনির্ভর এক তরুনীতে। যার অতীত নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, পেছনে কে কি বলছে সেই সংকোচ কাটিয়ে উঠেছে, শুরু করেছে দৃঢ় পায়ের পদক্ষেপ। কিশোর বেলার ভয়কে জয় করা শুরু করেছে তার তারুন্য।


আমি সবসময় আত্মজীবনী, ইতিহাস, বাস্তব থেকে তুলে নেয়া গল্পের প্রতি তীব্র আকর্ষন বোধ করি। বিখ্যাত সব মানুষদের সাজানো গোছানো, খুব পরিনতি পরিকল্পনা করে লেখানো আত্মজীবনী নয়, এরকম আমাদের পাশে থাকা লড়াকু মানুষদের, খুব আটপৌঢ়ে, নিজেকে খুলে বিছিয়ে দেয়া আত্মজীবনী। অনুপ্রাণিত হই, সাহস যোগায় মনে, এত হেরে যাওয়া গল্পের মাঝে কিছু কিছু বিজয়ীরা থাকুক আমাদের মুখ উজ্জল করে।


একশ চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠার পুরো বইটিতে অসংখ্য (বানান) মুদ্রণ প্রমাদ রয়েছে যা একটানা পড়ার সময় খানিকটা বিরক্তির উদ্রেক করে বই কি। রুপা কে রুপো, ওপো, সেগুলোকে সেগল বারবার করে হয়েছে। এটুকু মেনে নিলে, আশাপূর্ণা দেবী’র উপন্যাসের মত ঝরঝরে বাংলায় এই উপন্যাসের মাঝে নিজেদের আশপাশের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যায় ।