Thursday 3 May 2012

জীবন থেকে নেয়া (টুকরো টাকরা সুখের গল্প )


ঢাকা গেলে যা দেখি তাই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে নিউমার্কেট আর গাওছিয়া যাই শুধু খাওয়ার জন্যে। কিছুই কিনি না, এ দোকান ও দোকান ঘুরি তারপর খাই, আবার খাই। হালিম, মোরগ পোলাও, শিক কাবাব, জিলাপি যা পাই তাই। একদিন কি কি অনেককিছু খেয়ে শপিং শেষ করে বেড়োতে যাবো আজিমপুরের সাইডের গেট দিয়ে, দেখি ওমা ঐখানের গেটের পাশের ছোট দোকানটায় কোণ আইসক্রীম বিক্রি হচ্ছে, সেটা খাওয়া হয়নি। বল্লাম পাশের লোককে। তিনি মহা বিরক্ত হলেন। প্রবাসীরা আমরা দেশে এলে অতিরিক্ত সচেতন থাকি। কোথায় কে আমাদের টাকা ছিনিয়ে নিয়ে উড়ে যায় সেই দুশ্চিন্তায়। আর এ ভদ্রলোকের সাথে এ ঘটনা বেশ কয়েকবার হওয়াতে তিনি মহাসতর্ক। তিনি তিক্ত গলায় বললেন, রাত বাজে নয়টা, এখন সব টাকা আমি গুছিয়ে ফেলেছি, কে কোথায় কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোনদিক থেকে দেখবে, গুঁতা দিবে, আইসক্রীম খেতে হবে না, চলো বাসায়। আমি বল্লাম অসম্ভব আইসক্রীম না খেলে আমি আজ রাতেই মারা যাবো। আইসক্রীম আমাকে এখন খেতেই হবে। তিনি বুঝলেন আমি আজ রাতে আইসক্রীম না খেয়ে যাবো না। দোকানে যেয়ে বললাম, আইসক্রীম দেন। আর উনি দুই পকেট সাফ সুতরো করে ঝেড়ে যা খুচরো ছিল দোকানদারের তাকের ওপর রাখলেন। দোকানদার অসীম ধৈর্য্য সহকারে সেগুলো গুনে দেখলেন মাত্র সাতাশ টাকা। বিরক্ত গলায় বললেন, আইসক্রীম পঁয়ত্রিশ টেকা। আপনেতো মাত্র সাতাইশ টেকা দিলেন। তিনি বললেন ভাই, আপনাকে পঁয়ত্রিশ টাকার কোণ দিতে হবে না। আপনি সাতাশ টাকার কোণই দেন। আপনার মেশিন, আপনার স্বাধীনতা। আপনি জোরে চাপ দিয়েন না। অল্পচাপে যতোটুকু পড়বে, ততোটুকুই চলবে। চাইলে আপনে আরো কম দেন, পঁচিশ টাকার দেন। রাত নয়টায় দোকান বন্ধের সময় কোন উটকো চাপে পড়লো ভেবে দোকানদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর মেশিন চেপে কোণ দিয়েই দিলেন। আজ প্রায় সাত আট বছর আগের কথা। কিন্তু এখনো সেই রাতের কথা ভাবলে, দোকানদার ভদ্রলোকের প্রথমে হতভম্ব তারপর গম্ভীর মুখখানা মনে পড়লে অজান্তেই হেসে ফেলি। কি বিপদে না ফেলেছিলাম তাকে।
আমি রান্না করতে থাকলে, কাজ করতে থাকলে মেঘ খুবই নিঃসংগবোধ থাকে। ঘুরে ঘুরে বলে মা, আমি কি করবো? আমার খুব একা লাগছে। আমি মাঝে মাঝে আমার সাথে কাজ করতে ডাকি। আলু খুলে দেয়া তার প্রিয় কাজ, পেঁয়াজ খুলতে বেশি পছন্দ করে না। সালাদ বানায়। টেবল থেকে প্লেট গ্লাস এনে রিঞ্জ করে ডিশ ওয়াসারে ঢুকায়। একদিন নিজে নিজে ডিম ভাজতে চাইলো। সব নিজে করবে, আমি যেনো না ধরি। করলো একা একা সব। গরম প্যানে তেল দেয়া থেকে শুরু করে সব। এখন এক যন্ত্রনা হয়েছে, রোজ ডে কেয়ার থেকে ফিরেই বলবে, আমি আজকে ডিম ভাজা আর ভাত খাবো। আমি একা একা ডিম ভাজি মামা? এখানে ডাক্তার সপ্তাহে তিনটের বেশি ডিম খেতে না করে। ডিম ভাজা শিখে এখন নিত্য অশান্তি।
P1070365
মেঘ সপ্তাহে একদিন ক্ল্যাসিক্যাল ব্যালেট শিখতে যায়। ব্যালেট আমাদের দেশের নাচের কায়দা থেকে পুরোই আলাদা। তারপরও এখানে বৈশাখী কিংবা বিজয়া, স্বরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে নাচের ডাক আসলে বাংলা কিংবা কখনো কখনো হোলি দিওয়ালিতে হিন্দী নাচ শেখানোর চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে চেষ্টা কিছুটা উতরায়। এবার মনে হলো কিছুটা উতরেছে। মেঘের নৃত্যকান্ড
399022_210082155768338_209920182451202_325958_292986166_n
ডাচ বাচ্চাদের জন্য সাঁতার জানা বাধ্যতামূলক। সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচের দেশের লোকদের প্রতিনিয়ত পানির সাথে লড়াই করে এক সময় বেঁচে থাকতে হতো। এতোদিন সরকার অনুদান দিতেন স্কুল থেকে বাচ্চাদের সাঁতারে নিয়ে যাওয়া হতো। এখন সরকার অর্থনৈতিক মন্দার ভাব ধরে ক-স-ট কাটিং করছেন সবকিছুতে। সাঁতার শিখতে হবে তবে স্কুল আওয়ারে আর নয়, অবশ্যই সরকারি পয়সায় নয়। বাবা – মাকে নিজের পয়সায় স্কুলে টাইমের বাইরে করাতে হবে। মেঘ বেসিক সাতার আগেই শিখেছিলো। চৌদ্দ তারিখে নৃত্য দিয়ে পনেরো তারিখে বেসিক প্লাস সাঁতারের পরীক্ষা দিয়ে ডিপ্লোমা নিয়ে আসলো। এখন রেস ক্যু টিমের সাঁতারে যাচ্ছে। কাপড় টাপড় পড়ে সাঁতার করে, কেউ ডুবে গেলে কি করে টেনে আনবে, ঝড় বৃষ্টিতে কি করে সাহায্য করবে অন্যদেরকে, সে ক্লাশ করছে। ভাবি ঘরে বসে বসে টিভি দেখবে, নড়বে না চড়বে না, থাক। সাঁতারের উছিলায় নড়ুক চড়ুক।
P1070446
P1070402
নেদারল্যান্ডস মানেই সাইকেল। দেড় কোটি জনগনের এক কোটি সত্তর লক্ষ সাইকেল। বাচ্চারা একটু বড় হলে সাইকেল নিয়ে বের হয়। ট্রাফিক আইন জানা থাকা নিতান্ত জরুরী। স্কুলে প্রথমে থিওরি শিখায় ক্লাশ টুতে। তারপর টিচাররা সাথে নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে হেঁটে প্র্যাক্টিকাল করায়। হাটার বেসিক রুল জানার পর সাইকেল। এরপর ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্র্যাক্টিস করানোর পর আসে পরীক্ষা। স্কুলে সাইকেল নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ডিপ্লোমা নিতে হয়। ষোল তারিখে ময়না পাখি সাইকেল ডিপ্লোমা পেলো। এক নৃত্য ছাড়া কোনটাতেই মা-বাবা সাহায্য করিনি। তারপরো সে নিজে নিজে সব করে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি তোমাকে একটু প্রাউড করেছি মামা?
P1070458
অনেক কষ্টাকষ্টির দিনের মধ্যে এগুলো হলো এক টুকরো সুখের ছায়া, বন্ধুদের ছাড়া আর কার সাথে ভাগ করবো এগুলো?
তানবীরা
০২/০৫/২০১২

4 comments:

  1. কত দেশ কতভাবে এগিয়ে গেল! আমরাই পিছনে পড়ে থাকলাম অথচ মাদের মানুষের মত বুদ্দিমান মানুষ দুনিয়াতে কম আছে...

    শুধু দেশ এখনো একজন ভাল প্রধানমন্ত্রী পায় নাই...।

    আপনার লিখা গল্পের মত মনে হল। আমার সন্তানও বেড়ে উঠছে...। ভাবছি...।

    ReplyDelete
  2. আপনি আমার লেখা পড়েছেন জেনে সম্মানিতবোধ করছি। দেশভর্তি
    বুদ্ধিমান মানুষেরা একজন ভালো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারছে না? অবাক কান্ড। ভাল থাকুন আর আপনাদের বাচ্চাদের প্রতি আমার আমার ভালবাসা রইলো।

    ReplyDelete
  3. অনেক.................... সুন্দর। অনেক..........! অনেক.....! অনেক..! ভাল লাগল । এই রকম অসাধারন একটা পোস্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আসা করি এই রকম পোস্ট আরও পাব। সময় থাকলে আমার desh online store সাইটে ঘুরে আস্তে পারেন।

    ReplyDelete
  4. মাঝে মাঝে এসে আমার ব্লগ বাড়ি ঘুরে যাবেন।

    ReplyDelete