Friday 11 September 2015

জলছবি হয়ে রয়েছো চোখের তারায়



তিতলির বন্ধুরা, মা, ভাইয়ের ছোট্ট পরী মেয়েটা সবাই তার ওপর সময় সময় বেশ বিরক্ত হয়। কারণ একটাই তিতলী খুব আনমনা থাকে, একা একা নীরবে কি ভেবে চলে সারাদিন সেই জানে। সবার সাথে হাসছে, কথা বলছে, বসে আছে হঠাৎ সাড়া নেই। সবার মাঝে থেকেও সে যেনো লক্ষ যোজন দূরের কোন প্রাণীটি। কিন্তু তিতলীই বা কি করবে? কোন মুখে মুখ ফুটে সে কাউকে বলবে কিংবা বোঝাবে আসলে সে কোথায় হারায়? সায়ানের সাথে কি তার একটা দুটো কথা হয়েছিলো? তাদের যে লক্ষ কোটি কথা বিনিময় হয়েছে, অগনিত সব মুহূর্ত কেটেছে। কোন সে বিষয় ছিল না যা নিয়ে দুজনের খুনসুঁটি না হয়েছে? সেসব দিনে তো তাদের আলাদা পৃথিবী ছিল, যেখানে শুধু তারা দুজন ছিলো। অন্যদের সাথে গল্প করতে করতে তার যে মনে পরে যায় কোন কথায় সায়ান কী বলেছিলো? কী করে হেসেছিল, ওকে খেপিয়ে লাল করেছিল। চৌদ্দশ আলোকবর্ষ দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলেই কি কাউকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়?

মন যে বাঁধা পড়ে আছে মনে
হৃদয় যে শুধু তার দিকেই টানে
ভ্রুকুটি চোখ রাঙানো সে যে না মানে
কী বাঁশি বেজে যায় সারা বেলার গানে

তিতলির চোখের পাতায় সায়ানের ঠোঁটের স্পর্শ, তিতলির বুকে জমে আছে সায়ানের নাকের ঘাম, ঠোঁট আছে সায়ানের আজন্ম ভালবাসার তৃষ্ণার সাক্ষী হয়ে, কোন সে সাবান সে স্মৃতি মুছতে পারে? শরীর দিয়ে তারা শরীরকে ছোঁয়নি ছুঁয়েছে হৃদয় দিয়ে দুজন দুজনের হৃদয়কে। হারাবেতো তিতলি কোথায় হারাবে? হারাতে চাইলে হয়তো সারা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া কিন্তু নিজের কাছে হারানোর রাস্তা সে জানে না। সায়ানতো ছিলো তার দ্বিতীয় সত্ত্বা।

উড়েছে তিতলি সায়ানের টানে
সকাল সন্ধ্যা সারাবেলার গানে
নিষেধ মানেনি কোন তার এ হৃদয়
সায়ানের সবকিছু কি তারও নয়
কালের হিসাব দিবে কোন সঞ্চয়
পুড়েছে কোন আগুনে কোন সে প্রাণে।

তিতলি বাচ্চাদের মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো। পড়াশোনা, বাড়ি, লাইব্রেরী আর সায়ান এই ছিলো তার জীবন। একেই শ্বাশত বলে ধরে নিয়ে সে প্রজাপতি হয়ে হাওয়ায় উড়ে সামনের দিনের স্বপ্ন বুনছিলো। যখনই ভাবতো পাশ করে গেলেই সায়ানের পাশে থাকার সামাজিক অধিকার এসে যাবে তার পড়াশোনার উৎসাহ আরো বেড়ে যেতো। স্বপ্নের হাতে ডুবন্ত পরী যার গালে সবসময় লজ্জার গোলাপী আভা মেখে থাকতো। সারাদিনতো সে সায়ানের পাশে পাশে থাকতোই রাতেও ধরতে গেলে স্বপ্নে তার পাশেই থাকতো। কিন্তু সময় এক জায়গায় থেমে থাকে না। তিতলি বাচ্চা কিন্তু সায়ানতো পরিনত। তিতলির মত চোখ বুঁজে থাকা তার পোষায় না, তার পৃথিবী অনেক বড়। তুখোড় ছাত্র সে, ভাল বক্তা। বন্ধু বান্ধবীতে পরিবেষ্টিত থাকে সে, থাকতে ভাল বাসে। সকলেই তার বন্ধু হতে চায়, সেও উদার। আড্ডা দিতে গল্প করতে তার প্রাণ উচ্ছাসের কোন কমতি নেই। এ নিয়ে ছোটখাট নিত্য মান অভিমান, কখনো সখনো বড় ঝগড়া হয়ে গেছে তাদের মধ্যে।

সায়ান বলত, তোর জন্যে কি আমি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া বন্ধ করে দেবো নাকি?
তোর সাথে ছাড়া আমি অন্যদের সাথে গল্প করতে, আড্ডা দিতে পারবো না?

তোর জন্যে অন্য মেয়েদের সাথে গল্প করবো না নাকি আমি?

তিতলির ইচ্ছে করতো চিৎকার করে বলে, না পারবি না। আমিতো আর কারো সাথে গল্প করতে, আড্ডা দিতে চাই না। তুই বাদেতো কারো কথা আমার মনে আসে না। আমার মন শুধু নয় প্রাণও তোর মধ্যে সমাহিত। তোর কেন সবসময় অন্যদেরকে চাই।

যা ভাবে তাতো আর সবসময় বলা যায় না। কাউকেই যায় না এমনকি সায়ানকেও নয়। মুখে আর অন্তরে এক কথার মেয়ে সে, যখন অন্তরের কথা লুকিয়ে মুখে অন্য কথা বলতে হত তখন সে আর সায়ানের সাথে সহজ হতে পারতো না, একটা দূরত্ব তাকে তিল তিল পুড়িয়ে মারতো।

সামাজিকতার রাস্তা ধরে বলত, কথা বলা আর গল্প করা কী এক জিনিস?

সায়ান বলত, বাহ! লোকে গল্প করতে এলে আমি গল্প করবো না? আমার ভদ্রতা নেই। 
অন্য মেয়েদের সাথে সায়ানের ভদ্রতায় মাটিতে মিলিয়ে যাওয়া ছাড়া তিতলির করার আর বেশি কিছু থাকতো না। ভিতরের জ্বালা লুকিয়ে সে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতো। খুঁটিনাটি আর জিজ্ঞেস করত না, ভাবতো কী হবে আর নিজেকে তার কষ্ট দিয়ে। ভাল থাকুক সবাই যার যার জায়গায়।

এক আধ সময় সায়ানের আদরে গলে পুড়েও ভিতরের অভিমান মুছে যেতো। সায়ানের ঠোঁট যখন চোখ ছুঁয়ে, চোখের জল ছুঁয়ে, চোখের পাতা ছুঁয়ে নীচে নামে তখন সারা শরীরে অন্য শিহরণ খেলা করে। শরীর থেকে শরীরে আশ্বাস আসতো, না আমার সায়ান আর কারো হয়ে যায়নি, আমারই আছে। সায়ানের নাক যখন তার নাক চেপে ধরতো, তিতলি আর অভিমান ধরে রাখতে পারতো না। খামচে ধরতো তার সুহৃদের পিঠ, ঘাড়, বুক, গলা। পাগলের মত আদর খেতে খেতে বলতে থাকতো, আরো চুমু খা আমায়, আমাকে আরো চুমু খা। তিতলিকে উত্তপ্ত করতে সায়ান বড্ড ভালবাসতো। আদর খেলার সময় সে তার দুচোখ তিতলির ওপর থেকে একবারও সরাতো না। তিতলি কোন পজিশনটা, কোন আদরটা বেশী উপভোগ করছে সেটা সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখতো। তিতলিকে চরম আনন্দ পেতে নানাভাবে সাহায্য করতো।

তিতলির বুকের কালো আঙুর দুটো মুখে পুরে চুষতে চুষতে, ডান হাতের মধ্যের আঙুলটা তিতলির চটচটে যোনিতে আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে তিতলিকে চরম জায়গায় নিয়ে যেতো সে, সায়ানের মাথার চুল খামচে ধরে ছটফট করতে করতে সেই আনন্দ উপভোগ করতো তিতলি। মাঝে মাঝে তিতলির পায়ের বুড়ো আঙ্গুল চুষতে থাকতো সায়ান তিতলিকে গরম করার জন্যে। নানাভাবে আনন্দ দিতে আর আনন্দ নিতে পছন্দ করতো সে, আনন্দের পূজারী। কিন্তু এই আনন্দ নিয়েও মনোমালিন্য এসে যেতো দুজনের মাঝে। সায়ানের ঘুরে ফিরে “তোকে খেতে চাই” এক কথা। ডেট মানেই যেনো এই। যখনই দেখা হবে তখনই জোর করবে, এক বার, তিনবার, পাঁচ বার। দিনে দশ বার করে এই এক কথা কিন্তু তিতলির পছন্দ গল্প করা, ছুঁয়ে থাকা। বহুবার ঝগড়া এড়াতে তিতলি তার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও মেনে নিতো।

যখন প্রেমের উন্মত্ততা কমে এলো তখন এ ছোট ছোট ব্যাপারগুলোও খুব বড় হয়ে উঠলো। উত্তাল প্রেমের সময় যে মান অভিমানের বয়স ছিলো দু ঘন্টা থেকে তিন ঘন্টা, সে সময় তখন সপ্তাহে গড়িয়ে যায়। তিতলি মন খারাপ করলে যে সায়ান অস্থির হতো, তিতলির অভিমান ভাঙিয়ে তাকে পাশে রাখতে, সমস্ত কিছু উজার করে ঢেলে দিয়ে নিজেকে সমর্পন করতো। সে সায়ান আর নেই। অভিমানী তিতলি অনেকবার করে সেল চেক করে দেখলো, কেউ কী ডেকেছে তাকে। না কেউ ডাকেনি। কোথাও তার নামে কোন, চিঠি, বার্তা, ফোন কিছু নেই। ছটফট করতে করতে তিতলি আস্তে আস্তে ঠান্ডা হলো। মেনে নিলো এই হয়, এই নিয়তি। বাহ্যিক ভাবে আপাত ঠান্ডা ভাব দেখালেও ভিতরে ভিতরে সে কাউকে প্রচন্ড ভাবে তার পাশে চাইতো। একসাথে এতো এতো কবিতা, মুভি দেখা, আনমনা গল্প, খুনসুটি ঝগড়া এগুলো কী এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে? শেষ বলতে কি আসলে কিছু আছে?

না নেই, শেষ বলতে আসলেই কিছু নেই। নদীর গতি, মুখ পরিবর্তন হয় মাত্র, কিন্তু পানি বয়ে চলা বন্ধ হয় না। সায়ানের উচ্ছলতা, চঞ্চলতা তিতলি জানে। এ শেষ হওয়ার নয়। এ শুধু দিনে দিনে বেড়ে চলার। 

প্রথম প্রথম লজ্জার মাথা খেয়ে, তিতলি কয়েক বার বলেছে,

তুই আর আগের মত নেইরে। আমার প্রতি তোর সে টান নেই। অনুভব করা যায়।
সায়ান গম্ভীর মুখে বার বার একই জবাব দিয়ে গেছে, তোর কারণেই নেই। তুই ভালবাসা ধরে রাখতে জানিস না। তাই হারিয়ে গেছে।

তীরের মত বিঁধতো কথাটি তিতলির বুকে। এর অনেক জবাব হয়। কিন্তু জবাব দিয়ে কি হবে? ভালবাসা বিনি সূতোর মালা। যেখানে ভালবাসা নেই সেখানে অধিকার খাটাবে কোন জোরে সে। জোরতো শুধু ভালবাসারই ছিলো। চোখের জল লুকিয়ে সে সরে আসতে থাকলো। সরতে সরতে তিতলি অনেকটাই সরিয়ে নিয়েছে। এখন তাই আর আনমনা থাকার কাল। তিতলির ধরে রাখতে না পারা ভালবাসা সায়ান কাকে দিয়েছে জানতে মাঝে মাঝে খুব উচাটন লাগে। কিন্তু বহু কষ্টে মনকে শান্ত রাখে, যাকে তার পছন্দ তাকেই দিক, সুখী হোক। তিতলি শুধু সায়ানের সুখ চেয়েছে, কোন শর্ত রাখেনি। দাবীহীন শর্তহীন তার ভালবাসা। বেচারা ভালমানুষ ছেলেটা, তাকে সুখী করছে এমন কাউকে খুঁজে পেয়েছে যাতে তার মন মজেছে, এরচেয়ে বেশি আনন্দ তিতলির জন্যে আর কী হতে পারে? মাঝে মাঝে বুকে জ্বলুনি হলে, নিজেকে শাসিয়ে দেয় “যোগ্য কাউকে নিয়ে সে আনন্দে থাকুক” ...... সায়ান ভাল আছে জেনে তিতলি ভাল থাকবে, শিখে নেবে তিতলি ভাল থাকা।

দেয়ালের ছায়ায় , কবিতার ছন্দে, রেস্টুরেন্টের গরম কাপচিনো, হুড ফেলা বৃষ্টির রিক্সায়, লেকের নীল জলের ধারে, ঐ সাদা মেঘের আলিংগনে জড়ানো নীল আকাশে,  তিতলির চোখের কাজলে, কোথায় নেই সায়ান? তারপরেও এটাই সত্যি সে নেই, তার পাশে আর নেই। বিনি সূতোর মালা পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেছে সে। দিন দিন কথা কমে যেতে যেতে একদিন কথাগুলো হারিয়েই যেতে লাগলো। যে সায়ানকে তার দিনের প্রতিটি মুহূর্তের বয়ান না দিতে পারলে তার পেটের ভাত হজম হতো না, সায়ানের অমনোযোগিতা টের পেতে পেতে অনেক সময়ই তিতলির মনে হতে থাকলো, থাক কী হবে বলে, ওরতো কিছু মনেই থাকে না। কথারা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করলো তারপর পালিয়ে যেতে লাগলো। ছন্দ কাব্যও উড়ে গেলো অন্য কোন গ্রহে। হয়তো অন্য কোন পুরুষ তার একান্ত নারীকে সেই ছন্দ দিয়ে তখন আপন করতে ব্যস্ত। উদাত্ত কন্ঠে তি-ত-লিইইই ডাকের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে এক সময় সে অভ্যস্ত হয়ে গেলো এই নীরবতায়, নিসংগতায়। আনমনা তিতলি ভাবে কী অদ্ভূদ এই জীবন, আপাতভাবে দুজন এক সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে জীবন কাটানোর যে প্রতিশ্রুতি তারা প্রকৃতিকে দিয়েছিলো সে কোথায় মিলিয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই দুজনের চলার পথ নীরবে নিঃশব্দে আলাদা হয়ে গেলো।

ঝুম বৃষ্টি তিতলির খুব পছন্দ। জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে বৃষ্টিতে হালকা ভিজতে ভিজতে সেতো সায়ানকেই ভাবে আর ভাবে  

তোর বাড়ির পথে যুক্তির সৈন্য
যতটা লুকিয়ে কবিতায়
তারও বেশি ধরা পড়ে যায়
তোর উঠোন জুড়ে বিশাল অঙ্ক
কষতে বারণ ছিল তাই


কিছুই বোঝা গেলনা প্রায় 
কতবার তোর আয়না ভেঙেচূরে ঘুরে তাকাই
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই
কতবার তোর কাঁচা আলোয় ভিজে গান শুনাই
আমার মতে তোর মতন কেউ নেই।


এসব কিছুর পরেও তিতলি জানে সায়ানের মত কেউ নেই। আলাদা পথে পরিক্রমা তাদের কিন্তু ভালবাসা কখনো চিরতরে হারায় না অন্তত তিতলির হারায়নি। সায়ানের ভালবাসা তিতলি ধরে রাখতে পারেনি কিন্তু তিতলির ভালবাসা তিতলি তার প্রিয় আঁচারের বোয়ামে জমিয়ে রেখেছে। রোদে দিয়ে দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবে সে তার একলা বেলায়। ক্ষণিক বেলার জন্যে হলেও তাকেতো সর্বস্ব দিয়ে সে কাছে পেয়েছিলো এই তার আনন্দ ।

০৬/০৯/২০১৫



1 comment: