Sunday 11 February 2018

রানী পদ্মাবতী

অবশেষে দেখলাম সঞ্জয় লীলা বানসালি’র বহুল আলোচিত সিনেমা “পদ্মাবত”। কাহিনী যেমনই হোক সঞ্জয় লীলা বানসালি’র সিনেমা দেখা সবসময়ই আনন্দের। তিনি সিনেমাটোগ্রাফী, সেট, মিউজিক, করিওগ্রাফী, ড্রেস ডিজাইন ইত্যাদি’র ওপর খুব নজর রাখেন। তার ভাষায় বলতে গেলে, “Larger than life”. খানিক ক্ষণের জন্যে হলেও রঙিন কল্পনার জগত থেকে ঘুরে আসা, মন্দ নয়। এ ছাড়াও সঞ্জয়ের প্রতি সামান্য একটু দুর্বলতা কাজ করে তার “সারনেম” এর কারণে। সঞ্জয় মানেন তার জীবন এ অব্ধি আগানোতে তার মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। তাই তিনি তার মায়ের নাম “লীলা বানশালি” তার নিজের নামের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। উপমহাদেশ কেন পুরো পৃথিবীতেই মা’কে এভাবে সম্মান জানাতে ক’জন পারে।


সঞ্জয় বারবার আশ্বস্ত করেছে, "পদ্মাবত" ইতিহাস থেকে নয় বরং পনেরশ চল্লিশ সালে সুফি কবি মালিক মুহাম্মদ জয়াসীস এর "আওয়াধি" ভাষায় লেখা মহাকাব্য "পদ্মাবতী - চিতোরের রানী" কবিতা'র ওপর ভিত্তি করে বানানো।

“পদ্মাবত” সিনেমা’র গল্পানুসারে দিল্লী’র দ্বিতীয় শাসক আলাউদ্দিন খিলজী মেওয়ার এর রাজা রতন সিং বা সেন এর স্ত্রী রানী পদ্মাবতী কিংবা পদ্মিনী’র রুপের গল্প লোক মুখে শুনে দিশেহারা হন। তিনি মেওয়ার দখল করে রানী পদ্মাবতী’কে নিজের করে পেতে চান। রাজপুর রাজা রতন সিং তার রাজধানী চিতোরে তার রাজ প্রাসাদ এবং দূর্গ এভাবেই তৈরী করেছিলেন যে ব্যাপারটা খিলজী’র জন্যে ততটা সহজ হয় না। অতঃপর দিল্লী’র নিয়মনুযায়ী বিভিন্ন অসাধু কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া। সেই সময় একটি সংলাপে আমার কান আটকে যায়, দৃশ্যটি এরকম, আলাউদ্দিন খিলজী তার তাবুতে বসে মুরগী’র তান্দুরি সাথে আরও অনেক পদ দিয়ে যখন দুপুরের আহার সারছিলেন তখন তার খাস ক্রীতদাস “মালিক কাফুর” এসে বললো, সৈন্য’রা দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে বিদ্রোহ করছে, দয়া করে ওদের কিছু বলে ওদের মনোবল বাড়ান, ওদের শান্ত করুন।


আলাউদ্দিন খিলজী নিজের তাবু থেকে বেরিয়ে এসে সৈনিকদের বললেন, তিনি দিল্লী’র মসনদের সীমানা আরও বিস্তৃত করার স্বপ্ন আজীবন দেখে আসছেন। কে কে তার সাথে আছে? অনেক বিদ্রোহী শ্রমিকই তখন দেশভক্তি আর রাজভক্তির কাছে পরাজয় মেনে যায়। তখন থেকেই ভাবছিলাম যুগে যুগে একই প্রতারণা! সেই তেরশ চৌদ্দ সালেও যা আজকের দু হাজার আঠার সালেও তাই। এসেছে পেশী শক্তির বদলে নিজের লালসা চরিতার্থ করতে নাম দিয়েছে, দেশ প্রেম। কেউ একজন ও দিল্লী’র সুলতানকে জিজ্ঞেস করে নি, দিল্লী’র মসনদের সীমানা বাড়লে, সাধারণ সৈন্য’রা কি পাবে? তাদের কি জীবন যাত্রা’র মান বৃদ্ধি পাবে? তাদের বাচ্চারা দু’বেলা খেতে পারবে তো? নাকি সব সেই দিল্লী’র কোষাগারে জমা হয়ে কোষাগার উপচে পরবে আর তাদের লালসাময় জীবন ভোগের নিমিত্তে সেই অতল সীমানায় খাবি খাবে। সম্রাট শাজাহান যখন অমরত্বে’র বাসনায় “তাজমহল” তৈরী করছিলেন, তখন দিল্লীতে কিংবা ভারতবর্ষে কত মানুষ না খেয়ে দিন কাটাতেন? কেমন ছিলো তার সৈন্য সামন্ত কিংবা তাজমহল নির্মানে ব্যস্ত থাকা সেই সব নির্মান শ্রমিকদের জীবন?


যুগে যুগে যুদ্ধের লক্ষ্য মেয়েরাই হয়। রানী পদ্মাবতীই শুধু? তুর্কি বংশভূত খিলজী থেকে মুঘল সম্রাট, কার হাত থেকে নারীরা রক্ষা পেয়েছিলেন? যোধা বাই থেকে শুরু করে অসংখ্য রাজকন্যা মুঘল সম্রাটদের রানী হয়েছেন কিংবা হতে বাধ্য হয়েছেন। মুঘলদের নানাবিধ অত্যাচার আর ভোগ বিলাসের মধ্যে এটিও ছিলো উল্লেখযোগ্য। শুধু মুঘলরাই বা কেন? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনী’র বিরাট লক্ষ্য ছিল নারীদের ওপর অত্যাচার করা। হ্যাঁ, অত্যাচারকে অত্যাচারই বলবো, মানুষের জীবন যেহেতু তার ব্যক্তিগত অঙ্গে লুকিয়ে থাকে না তাই এর সাথে সম্মানকে জড়িয়ে ফেলারও কিছু নেই। এর থেকে কি এখনও পৃথিবী মুক্তি পেয়েছে? আজকের লুটেরা বাহিনী আইএস এর হাত থেকে যেসব মেয়ে’রা বেঁচে আসতে পেরেছে তাদের কাছে কি অসংখ্য রানী পদ্মাবতী’র গল্প আমরা শুনি নি? বোকো হারামের হেরেমে কি আজও অসংখ্য রানী পদ্মাবতী আত্মাহুতি দিচ্ছেন না?


হ্যাঁ, সেসব হতভাগীদের নিয়ে এ যাবত কালের সবচেয়ে ব্যয় বহুল সিনেমা’টি তৈরী হয় নি বটে। কিন্তু পৃথিবীর বহু জায়গায় আজও রানী পদ্মাবতী বাস্তব, কোন মাইথলজিক্যাল চরিত্র নয়। বহু মেয়ে নিজেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়ে জওহার না হলেও অন্যভাবে আত্মাহুতি দিচ্ছে। খিলজী’র মত পাপী রাস্তায় রাস্তায় মুখোশ ধরে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তাই ফসলের ক্ষেতে, নদীর পারে, বাড়ির পেছনে, আইএস কিংবা বোকো হারামের কালো কুঠুরীতে রানী পদ্মাবতীদের বিগলিত লাশ পাওয়া যায়।

১২.০২. ১৮ 

No comments:

Post a Comment