Monday 1 November 2021

"সর্দার উধাম সিং" -- প্রাসঙ্গিক কথকতা

সুজিত সরকারের পরিচালনায় ভিকি কৌশাল অভিনীত অধুনা বহুল আলোচিত ইতিহাসভিত্তিক সিনেমা "সর্দার উধাম সিং" দেখলাম। ইতিহাস বইয়ে ঠাই পাওয়া কুখ্যাত "জালিওয়ানওয়ালাবাগ" হত্যাকান্ডের ওপর ভিত্তি করে এই সিনেমা। একদিনে দুই হাজার মানুষকে হত্যা করার কালো ব্রিটিশ ইতিহাস। একশো সৈন্য আর দুইটি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে বৃটিশরা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। সিনেমাটি নিয়ে অনেক রিভিউ অলরেডি লেখা হয়ে গেছে, আমি রিভিউ নয়, লিখতে বসছি অন্য কিছু। ঠান্ডা মাথার এই হত্যা দৃশ্য দেখে গুগল করছিলাম, কারা এতোটা নৃশংস, কি করে পারলো! পেলাম কিছু চমকপ্রদ তথ্য, আমার ধারনা, আমার মতো অনেকেই হয়ত এ সম্পর্কে বিশদ জানে না। বৃটিশ কর্মকর্তাদের আদেশে এই হাজার হাজার মানুষের ওপর যারা গুলি চালিয়েছিলো, সব সৈন্য ছিলো গোর্খা। গোর্খারা আসত মূলত নেপালের চারটি সম্প্রদায় থেকে। গুরুঙ, মাগার, রাইস ও লিম্বুস। প্রথম দুটোর বাস ছিল মধ্য নেপালে আর শেষের দুটোর পূর্ব নেপালে। নেপালের ৭৫টি জেলার একটির নাম গোর্খা জেলা। অধিকাংশ গোর্খা সৈনিক হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হয়। এদেরকে বলে, ‘Mercenary Soldier’। মার্সেনারি সোলজার হলো তারা যারা কোনো প্রকার রাজনৈতিক কারণ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র বা জাতির পক্ষে লড়ে। অর্থাৎ, ভাড়াটে সৈন্য। গোর্খারা মূলত ব্রিটেন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে থাকে। সিঙ্গাপুরের পুলিশ ফোর্সেও গোর্খাদের নিয়োগ করা হচ্ছে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৮১৪ সালে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারত শাসন করছে। কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির খেয়াল হলো নেপাল সাম্রাজ্য আক্রমণের। তিনি তার প্রশিক্ষিত, চৌকস ২২,০০০ সেনাকে সেদিকে অগ্রসর করলেন। বিরোধী পক্ষে তেমন ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাদল নেই। প্রায় বিনাযুদ্ধেই ব্রিটিশ সেনাদলের জয় হবে এমনটাই ভেবেছিলেন অক্টারলোনি। কিন্তু ময়দানে হিসেব এত সহজে মিলল না। বাইশ হাজার চৌকস সেনার নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল স্থানীয় ১২০০০ গোর্খালী। উচ্চতাও বেশি নয় এদের। ৫ ফুট ২ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। গোর্খাদের একটি জাতীয় অস্ত্র আছে। একে তারা ‘কুকরি' বা ‘খুকরি' বলে ডাকে। কুকরি হচ্ছে প্রায় ১৮ ইঞ্চির একটি বাঁকানো ছোরা। কাঠ কাটা থেকে শুরু করে যুদ্ধ প্রায় সবক্ষেত্রেই কুকরি ব্যবহার করা হয়। এই কুকরি দিয়েই গোর্খালীরা ব্রিটিশ সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করেছিল। কুকরিকে নিয়ে একটি মিথ প্রচলিত আছে। গোর্খার খাপ থেকে কুকরি বের হলে তাকে রক্তপান করিয়ে তবেই ওটাকে আবার খাপবদ্ধ করা যাবে। শত্রুর রক্ত না পেলে বাহকের নিজের রক্তেই রঞ্জিত করতে হবে তাকে। যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয় হলেও গভর্নর জেনারেল গোর্খালীদের অসীম সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি যেচে তাদের প্রস্তাব দিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দেওয়ার। টানা দুই বছরের যুদ্ধের অবসান হলো একটি চুক্তির মাধ্যমে। এটি Treaty of Sugauli নামে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে গোর্খারা পাকাপাকিভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। “If a man says he is not afraid of dying, he is either lying or is a Gurkha” ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক পাঁচ তারকা সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ গোর্খা সৈন্যদের ব্যাপারে এ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ফিল্ড মার্শাল খেতাব অর্জনকারী দুজন অফিসারের একজন। ভারতের মতো বহুজাতিক রাষ্ট্রে প্রায়ই গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সক্রিয় দেখা যায়। সেরকম ঘটনাগুলোতে ইন্ডিয়ান জেনারেল ও নীতিনির্ধারকগণ গোর্খা রেজিমেন্টগুলোর ব্যবহারই সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করেন। চীন ও পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধেও ভারত প্রতিবারই গোর্খাদের এগিয়ে দিয়েছে। ১৮৫৭ থেকে এ পর্যন্ত গোর্খা ব্রিগেড মোট ২৬টি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদক ‘দ্য ভিক্টোরিয়া ক্রস’ লাভ করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত গোর্খাদের ট্রেনিং হয় ভারতের হিমাচল প্রদেশের সাবাথু অঞ্চলে। ভারতেও বীরত্বের পদক প্রাপ্তির দিক থেকে পিছিয়ে নেই গোর্খারা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সামরিক পদক পরম বীর চক্র (Param Vir Chakra) পেয়েছেন এপর্যন্ত ২১ জন যার মধ্যে তিনজন গোর্খা রেজিমেন্টের। গোর্খা ড্রেসকোডের আবশ্যিক অংশ গোর্খা হ্যাট। বিখ্যাত ‘গোর্খা হ্যাট'। মাথার ডানদিকে খানিকটা বাঁকা করে পরা হয় টুপিটি। গোর্খারা একটি মটোতে বিশ্বাস করে– ‘কাথার হন্নু ভান্ডা মারনু রামরো।' ----- ‘It is better to die than to be a coward.’ সিনেমানুসারে গোলাগুলির পর বৃটিশ গোর্খা সৈন্যরা জায়গাটি ছেড়ে চলে গেলে, হতাহতদের মধ্যে থেকে আহতদের রক্ষা করতে সর্দার উধাম সিংকে যতটা তৎপর দেখা গেছে অন্যদের ঠিক ততোটা নয়, আরও মানুষ যদি তৎপর হতো তাহলে কি আরও কিছু প্রাণ বাঁচতো? তানবীরা হোসেন ০১/১১/২০২১

No comments:

Post a Comment