Monday 17 May 2010

অহনার অজানা যাত্রা (তিন)

বিশাল এয়ারপোর্টের এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না। চারধারে আলোর খেলা। বড় বড় গ্লাস দিয়ে আটকানো পুরো বিল্ডিং এর গ্লাসের মধ্যে দিয়ে বিশাল বিশাল পেট মোটা প্লেনগুলোকে দেখা যাচ্ছে যারা অলস পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো ক্লান্ত হয়েছে নেমেছে নতুবা জিরিয়ে আবার ওড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কোনদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে সে তার কোন ধারনা নেই। ইউনিফর্ম পরা এক অফিসারের পাশে পাশে হেটে চলছে তারা। অফিসারটি অহনার সাথে টুকটাক হাসির আর মজার কথা বলে যাচ্ছে, অহনা তার কথা কিছু শুনছে কিছু না। কিছু বুঝতে পারছে আবার কিছু না। ইউরোপীয়ান ইংরেজী উচ্চারন তার জন্য নতুন। তারপরও কিছু সামান্য ছোটখাটো কথার জবাব সে দিয়েছে চেষ্টা করে।। অনেকক্ষন হেটে একটি মোটামুটি বেশ বড় ঘরে উপস্থিত হলো, যেখানে আরো বেশ কজন ভিনদেশী লোক দাঁড়িয়ে ও বসে আছে। অহনাকেও বসতে বলা হলো সেখানে, সে অফিসারটি এসে ইঙ্গিত করতেই অন্য আর একজন অফিসার এসে অহনাদের পাসপোর্ট নিয়ে ভিতরে আর একটা ঘরে চলে গেলো। যে ঘরে বসে আছে অহনা ঠিক সে ঘরের আবহাওয়াটা বুঝতে পারছে না। ঘরে মিউজিক বাজছে, পুলিশ আর অফিসাররা নিজেদের মধ্যে টুকটাক গল্প করছে নিজেদের ভাষায় (ডাচ ভাষায়)। গল্পের একবর্ণও অহনা বুঝতে পারছে না সেটা ঠিক। কিন্তু মনে হচ্ছে নিশ্চয় খুব মজার কিছু কারণ লোকগুলোর মুখগুলো খুব হাসিহাসি আর তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও করছে। বসে বসে ভাবছে অহনা কিংবা হতে পারে চাকুরীর ট্রেনিং দেয়ার সময় নেদারল্যান্ডসে তাদের এমন কিছু করা হয় যে তারা যখন কাজে যোগ দেয়, তাদের মুখ সর্বক্ষন শুধু হাসি হাসিই দেখায়। তাদেরকে দেখলেই মনে হয় এ পৃথিবী চির সুখের, এখানে দুঃখ বলতে কিছু নেই আর তারা যা করছেন তার চেয়ে আনন্দদায়ক পেশাও পৃথিবীতে আর নেই।

তারা তাদের কথাবার্তা বলার ফাঁকে ফাঁকে কফি খাচ্ছিলো আর মাঝে মাঝে এসে সেখানে থাকা ভিনদেশীদের ধরে ধরে বেশ জোরে হাত মুচরে দিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জোরে মারছিলো। মাথা দেয়ালে ঠুকে দিয়ে, নাকে চোখে মুখে এলোপাতাড়ি ঘুষি। মারার সাথে সাথে সেসব ভিনদেশীদেরকে কিছু প্রশ্ন করা হচ্ছিলো যেমন তাদের পাসপোর্ট কোথায়, তারা কি যুগোশ্লাভিয়া থেকে এসেছে কিনা, কি জন্যে এসেছে? ভিসা কোথা থেকে যোগাড় করলো ইত্যাদি ইত্যাদি। ছেলেগুলো কিছুক্ষন চুপ থাকে আবার কিছুক্ষন কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ছেলেগুলো যাইই বলছে তা তারা শুনছে কি শুনছে না বোঝা যাচ্ছে না, কারন তারা ছেলেগুলোকে মেরেই যাচ্ছিলো। এমনভাব করে মারছিলো যে ও কিছু নয়। কিন্তু ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো অহনা কারণ অহনার চোখের সামনে এ ধরনের কঠিন পদ্ধতির মারধোর এই প্রথম। তার সহযাত্রী ভদ্রলোকের পাসপোর্ট নিয়ে ইউনিফর্ম পরা লোকগুলো তাকে সমানে জিজ্ঞেস করে চলেছে কেনো সে নেদারল্যান্ডসে এসেছে, কে তাকে ভিসা যোগাড় করে দিয়েছে, কি চায় সে ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি যাই বলছিলেন তাতেই অফিসারদের গলা আরো চড়ছিলো, অফিসাররা তার জবাব মেনে নিতে পারছিলেন মনে হচ্ছে। অফিসাররা তার সহযাত্রীকে তখনও না মারলেও প্রায় মারার পর্যায়েই চলে এসেছে এখন ঘটনাটি। অন্যএকজন অহনাকে একটু দূরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সে এই ভদ্রলোককে চেনে কি না? ভয়ে আধমরা অহনার মুখ দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো সত্যি কথাটা বেরিয়ে গেলো, “না”। হয়তো দুদেশের পাসপোর্ট ভিন্ন হওয়ায় তারা অহনার কথা বিশ্বাস করে নিলেন আর তাকে তারা ঘাটালেন না।

তার চেয়েও বিস্মিত সে, তার প্রতি তাদের সৌজন্যের কোন ঘাটতি নেই। অহনাকে দিব্যি জিজ্ঞেস করল কফি খাবে কিনা, ঠান্ডা লাগছে কিনা ইত্যাদি। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অহনাকে এই ফাঁকে একজন বলল তার চোখ খুবই সুন্দর কালো, এটাকি সত্যিকারের চোখের রঙ্গ না লেন্স লাগিয়েছে সে !! হকচকানো অহনা তার সামান্য জ্ঞান দিয়ে এইলোকগুলোকে কি ভালোর দলে ফেলবে না খারাপের তাও বুঝতে পারছে না। তখন ভিতর থেকে সেই অফিসার ফিরে এসে অহনাকে তার পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে বললেন, ‘It’s alright, you may go”. অহনা উঠলো বসা থেকে বটে কিন্তু এখন তার কী করনীয়, কোনদিকে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মুখচোখ দেখে হয়তো সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। একজন ইউনিফর্মধারী এগিয়ে এসে তাকে বলল তুমি জানো তোমার লাগেজ কোন বেল্টে আসবে? মাথা নেড়ে সে বলল, ‘না’। তখন লোকটি বলল, ‘চলো আমার সাথে’। সেই লোকটি যেয়ে অহনার লাগেজ খুজে বের করল, দেরী দেখে বেল্ট থেকে সুটকেস তুলে কেউ একপাশে রেখে দিয়েছে। তিনি অহনার ভারী সুটকেস ট্রলিতে তুলে কাষ্টমস পার করে একেবারে দরজার সামনে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, অর্ণকে কোথাও দেখা যাচ্ছে কী না। অন্য পরিবেশ প্রথমে অর্নকে চিনতেই পারছিলো না সে। অনেকক্ষন তাকিয়ে অহনা দেখলো অর্ণ দাঁড়িয়ে আছে অস্থির এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। সে মাথা নেড়ে অফিসারকে জানাতে, তিনি তাকে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন।

যাত্রার ধকল আর স্বামীর কাছে আসার আনন্দ নিয়ে অহনা সামনে আগালো। মনে মনে ভাবছে তাকে দেখে অর্ন না জানি কতো খুশী হবে। কিন্তু অহনাকে দেখে বেশ একটু যেনো রেগেই বলল, ‘তুমি এতোক্ষন কোথায় ছিলে? সব্বাই চলে গেলো আর তোমার কোন পাত্তা নেই। আমি বারবার লষ্ট পারসানে যাচ্ছি তারা বলছে একঘন্টা না হলে লষ্ট পারসন ঘোষনা করার নিয়ম নেই’। অহনাতো আকাশ থেকে পড়ল, ‘তারমানে? আমি আবার কি করলাম’? সে তার জীবনের সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা শুরু করতেই অর্ন থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি কেনো পুলিশকে বললেনা তোমার বর বাইরে দাঁড়ানো, তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, তাহলেইতো তারা তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতো’। অহনাতো আরো অবাক, এরমধ্যে পুলিশ আসলো কোথা থেকে? কোনটা পুলিশ? তারচেয়েও বড় ‘আমি কেনো শুধু শুধু তোমার কথা বলতে যাবো? তারাতো জানতে চায়নি তোমার কথা’? তুমি আসলে কোথা থেকে এরমধ্যে? এরকম অনেক কথার পর অহনা জানতে পারলো যে আসলে অহনাকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটকে নিয়ে গিয়েছিলো এবং এতোক্ষন তাদের হেফাজতে ছিলো সে। অহনা কি ছাই তা জানে? সেতো ভেবেছে ইমিগ্রেশনের বুঝি এই নিয়ম এভাবেই সকলকে আন্তর্জাতিক ভ্রমন করতে হয়। পুলিশ যদি অহনাকে ধরে নিয়েই যাবে তবে কেনো সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে আর কফি খেতে সাধবে? সিনেমায় যে দেখি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তার সাথে কোন মিল থাকলে তবেই না বুঝবো যে কি হয়েছিলো???!!!

একথা সেকথা বলতে বলতে, বিশাল ঝকঝকে সুসজ্জিত এয়ারপোর্টের চারিধার দেখতে দেখতে হেটে অহনা অর্নের সাথে এয়ারপোর্টের পার্কিং এ এলো। অর্ন যে গাড়ির লক খুলছে তা দেখে অহনার চক্ষু যাকে বলে চড়ক গাছ, সুজুকি গাড়ি, তাও আলটো!! বি, এম, ডব্লিও, মার্সিডিজ দূরে থাক ওপেলও না। মোহ ভঙ্গের এই ছিল শুরু। বিদেশ এসেছে অহনা সুজুকি চড়তে! অনেক কষ্টে সৃষ্টে আলটোতে মালপত্র ঢোকানো হলো। তারপর শুরু হলো যাত্রা বাড়ির পথে। পার্কিং এর বাইরে বেরিয়ে দেখল চারদিক ধূসর হয়ে আছে, হাইওয়ের পাশে সারি সারি গাছ লাগানো আছে যেগুলোকে গাছ কম আর শুকনো খড়ি মনে হয় বেশী। কোন গাছেই কোন পাতা নেই শুধু ডাল গুলো নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পুরো রাস্তা ছাই রঙ্গা, স্থবির একই রকম ঘোলা ঘোলা ছবি দেখতে দেখতে অহনা বাড়ি এলো। যদিও এ ধরনের ছবি অহনা এর আগে ভিউকার্ডে বা ক্যালেন্ডারের পাতায় অনেকবার দেখেছে, তখন দেখলে বুকের ভিতরে একটা শিরশিরানি অনুভব হতো, মনটা বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক লাগতো, মনে হতো আহা না জানি কি শান্তি, কি সুন্দর। কিন্তু এখন এর মাঝে এসে পরে একে বড় বেশী প্রাণহীন মনে হচ্ছিল। আকাশ দেখে অহনার মনে হচ্ছিলো ভোরবেলা যদিও হাতের ঘড়ি জানান দিচ্ছিল দুপুর বেলা। গাড়ি এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পাকিং লটে এসে পৌঁছলো, চারিদিক ফাঁকা কোথাও কেউ নেই।

(চলবে)
তানবীরা
পরিশোধিত ১৮.০৫.১০

No comments:

Post a Comment