Saturday 22 May 2010

অহনার অজানা যাত্রা (চার)

চারদিকের নীরবতা এ পর্যায়ের যে একটি পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। কোথাও কেউ নেই। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে পার্কিং লট আরো ঠান্ডা। অবাক চোখে অহনা দেখছিল তার নতুন জীবন কোথায় শুরু হতে যাচ্ছে। অর্ন টেনে টেনে স্যুটকেস আর অন্যান্য জিনিসপত্র গাড়ি থেকে লিফটে ওপরে নিচ্ছিল। অর্নের পাশে পাশে সে হাটছে কিছুটা বিহ্বল হয়ে। বাইশ তলা এ্যাপার্টমেন্টের বারো তলায় অহনাদের ঠিকানা। ঢুকে দেখল ও আসবে উপলক্ষ্যে অর্ন আর তার বন্ধুরা এ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুম বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। সাথে ফ্রিজে কেকও আছে "Welcome to Holland'। কিন্তু সেটা এখন ধরতে না করলো অর্ন, সবাই শখ করে এনেছে, রাতে কাটা হবে সবার সাথে। বউকে কাছে পেয়ে উচ্ছাসে ঝলমল অর্ন কোম্পানী থেকে পাওয়া মোটামুটি আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত ফ্ল্যাটটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। কিন্তু ফ্ল্যাট ঘুরে দেখে অহনা বেশ দমে গেলো মনে মনে। যতই আধুনিক জিনিসপত্র থাকুক এই মাত্র বারো’শ স্কয়ারের ফ্ল্যাট! প্রথমে সুজুকি আলটো গাড়ির ধাক্কা তারপর ফ্ল্যাটের। মনে মনে ভাবলো অহনা বিদেশের চেয়েতো দেশেই ভালো ছিলো। যৌথ পরিবারে নিজের ভাগে যতোটুকুই আসতে কিন্তু বাড়িতো এর চেয়ে ঢেড় ঢেড় গুন বড় ছিল।

সেই ফ্ল্যাটের আবার জানালা শীতের জন্য কায়দা করে লাগানো, দেশের মতো পাট পাট করে খোলা যায় না। ফ্ল্যাটটা সিটি সেন্টারের কাছে হওয়ায় আশপাশে লোকালয় ভাব নেই। একই কম্পাউন্ডে কিছু ফ্ল্যাট আর কম্পাউন্ডের বাইরে আরো কিছু বড়ো বিল্ডিং এ নানা কোম্পানীর অফিস। এই পুরো জেলখানার মধ্যে একটু মুক্তি হলো বেডরুমের পাশের ব্যালকনি যেখান থেকে নীল আকাশটা দেখা যায়। কম্পাউন্ডের মধ্যে সব বিলডিং গুলো পাশে অনেক জায়গা রেখে ফাঁকা ফাঁকা করে বানানো, প্রায় পুরো ফ্ল্যাটের মধ্যে থেকেই আকাশ চোখে পড়ে। অর্ন এতো আগ্রহ করে তার নিজের হাতে সাজানো ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলো যে অহনা মনে মনে যাই ভাবুক মুখে বেশ একটা খুশী খুশী ভাব ধরে রেখেছে। বেচারার সাথে একটা ভদ্রতা আছে না। ফ্ল্যাট দেখা শেষ হলে সে গেলো ফ্রেশআপের জন্য। ততোক্ষনে অন্যদিকে ফোন বাজতে শুরু করেছে অর্নর বন্ধুদের, ওরা অপেক্ষায় আছে, কখন আসবে, তারপর পার্টি শুরু হবে।

এখন এখানে মোটামুটি সবারই ক্রিসমাস ঈভের ছুটি, সবাই বেশ অহনার নেদারল্যান্ডস আসাকে উপলক্ষ্য করে পার্টির আমেজে আছে। এরপরের বেশ কদিন ক্রিসমাস থেকে নিউ ইয়ার্স ঈভ পর্যন্ত হৈ হুল্লোড় করে আর পার্টি করে দাওয়াত খেয়েই কাটল তাদের। দেখতে না দেখতেই চোখের পলকে এছুটি শেষ হয়ে গেলো, অর্নেরও অফিস শুরু হলো। সে এখন সারা ফ্ল্যাটে একা। কি করবে কি করবে হঠাত একা হয়ে কিছু কাজ খুঁজে পাচ্ছে না সে। কিছুক্ষন বাড়ি ঘর গোছালো, টিভি দেখল। টিভিও কি দেখবে, সি।এন।এন, বি।বি।সি, এম।টি।ভি ছাড়া আর সব কিছুইতো ডাচ, ডয়েচ, ফ্রেঞ্চ কিংবা টারকি ভাষায় যার এক বর্ণও সে বুঝতে পারছে না। আর আছে ডিসকোভারী কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফীক চ্যানেল যা সব সময় তার কাছে এতো ইন্টারেষ্টিং না। একা একা একদিনও বাইরে যায়নি তাই বাইরে যাওয়ার অপশনটাও বাদ দিলো। আবার এই ঠান্ডার মধ্যে বেরোনো মানেই একগাদা জামা কাপড় চাপাও, সেটাতেও মন সায় দিচ্ছে না। কি করি আর নাকরি ভাবনার মধ্যেই অফিস থেকে অর্নের ফোন আসলে কথায় কথায় অহনা জিজ্ঞেস করলো, ‘রাতের খাবার কি হবে’? অর্ন বলল, ‘তোমাকে সে সব নিয়ে ভাবতে হবে না তুমি রেষ্ট নাও’। এ আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়ে সে ঘুমাতে চলে গেলো, কাজ যখন কিছু নেই এই শীতের মধ্যে তখন একটু ঘুমোনোই যাক এই ভেবে।

ঘুম ভাঙ্গল একেবারে অর্ন বাড়ি ফেরার পর, অর্নই জাগালো তাকে। এ কথা সে কথা, টুকটাক গল্প হলো তারপর যখন খাওয়া দাওয়ার প্রসংগ এলো সে রান্নাবান্না করেনি কিছু শুনে অর্নের মুখের আলোটা যেনো কোথাও চলে গেলো। তখন কেনো জানি তার মনে হলো অর্ন ভদ্রতা করে রান্নার কথা না করলেও মনে মনে হয়তো আশা করে ছিলো অহনা রান্না করে রাখবে। কিন্তু এ কদিনে চাল ডাল কোথায় কী কিছুই দেখিয়ে দেয়নি তাকে। সে কি করবে আর কি না বুঝেই পেলো না, এই নতুন পরিবেশে এখনও অহনার স্বাভাবিক বুদ্ধি কাজ করছে না। বিয়ের হুড়োহুড়ি বাদ দিলে একা এই পরিবেশে দু সপ্তাহ ধরে অর্নের সাথে তার পরিচয়। অন্য দেশে অন্য পরিবেশে অনেকটা অপরিচিত অর্নের কাছে অনেক সময় সে ততোটা স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করে না। অর্নই রান্না করতে গেলো, কিছু না বুঝতে পেরে সেও তার পিছু পিছু রান্নাঘরে গেলো। অপটু অহনা কি করবে বুঝতে না পেরে একবার এদিক যাচ্ছিল আর একবার অন্যদিকে। তারপর না পেরে গম্ভীর অর্নকে বলেই ফেলল সে এক সময় ভদ্রতা করে, ‘আমি কি কিছু করব’? বলে তার মনে হলো অর্ন হয়তো এই অপেক্ষাতেই ছিলো, ফস করে বলে উঠল, ‘তুমি আর একা একা দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে, চলো দুজন একসাথেই রান্না করি, তাহলে কিছুটা শিখবে আর তাড়াতাড়িও হবে’। বলেই ইয়া বড় একটা ছুরি আর আপেলের সাইজের একটা পেয়াজ অহনার হাতে ধরিয়ে দিলো।

এই সাইজের ছুরি অহনা কোরবানী ঈদের সময় ছাড়া আর কখনও তেমন দেখেনি আর এই সাইজের পেয়াজতো নয়ই, দেখেই ভয় পেলো সে। আনাড়ি অহনা ছুরি সামলাবে না পেয়াজ। নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে যাচ্ছ কিন্তু পেয়াজ সামলাতে পারছে না। কিন্তু অর্নকে তা বুঝতেও দিতে চাচ্ছে না যদিও অর্ন তা ঠিকই টের পেয়ে গেলো আর হতাশ গলায় বলে উঠল, ‘একটা পেয়াজ কাটাও কি আমাকে শেখাতে হবে’! লজ্জায় সে মাটির সাথে মিশে গেলো অর্নের এ কথায়। যদিও তার বিয়ের আগে যখন অর্নের সাথে কথা হয়েছিলো, বলেছিলো রান্নাবান্না সে বিশেষ কিছুই জানে না, অর্ন তখন বলেছিলো বউকে দিয়ে রান্না করানোর জন্য সে বিয়ে করছে না। কে জানে সত্যি না মিথ্যে বলেছিলো।

যে অহনা বাবা মায়ের কাছে থাকতে নাকের জ্বালায় অনেক সময় চোখে দেখতে পেতো না, এই অচিন ভূমিতে এসে সে মোটামুটি সিধা হয়ে গেলো। যে আনন্দের জন্য বিয়ে করেছিল, ভেবেছিল বিয়ে হয়ে বেঁচে যাবে সে ভুত মাথা থেকে নেমে গেলো অচিরেই। আসার দুমাসের মধ্যেই অর্ন তাকে ডাচ ভাষা শিখার স্কুলে ভর্তি করে দিলো। এখানে a,b,c উচ্চারন দিয়ে শুরু হলো আবার পড়াশোনা। গ্রামার, শব্দের বানান, বাক্যের গঠন, টেন্স......
মনে হচ্ছিল তার চেয়ে সেই ইংরেজিতে নোট মুখস্থ, ভাইভা, টিউটোরিয়ালই ভালো ছিল। সাথে আবার একা একা অপটু হাতে তাকে গোটা সংসার সামলাতে হয়। যার সবচেয়ে কঠিনতম অংশ হলো মেহমানদারী। অপরিচিত সব লোকজনকে হাসি মুখে সামলানো তার কাছে বিরাট এক চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে উঠলো। লোকজন এলে চা নাস্তা কী দিবে না দিবে না সেটাই বুঝতে পারে না আদ্ধেক সময়। কে ভদ্রতা করে না করছে আর কে সত্যিকারের না করছে, তার মুখ আর ভাবভঙ্গী থেকে আন্দাজ করা ত্রিকোনমিতি করার চেয়েও কঠিন আকারের সমস্যা হয়ে ওঠল। মোটামুটি হিমসিমের মধ্যে দিয়ে দিন যাচ্ছিল তার। যে বাড়ি প্রথমদিন দেখে অহনার ছোট পাখির বাসা মনে হয়েছিল সেই বাড়ি সামলানোই আজ তার কাছে বিরাট দক্ষ যজ্ঞ মনে হতে লাগল।

কতো দ্রুত জীবন অন্য অপরিচিত খাতে বইতে লাগল অহনা তার কোন নাগালই পাচ্ছিল না। এক সময় দিনের শুরু হতো খবরের কাগজ নিয়ে ভাইবোনদের কাড়াকাড়ির মধ্যে দিয়ে। আর এখন বিনা পয়সায় খবরের কাগজ পোস্ট বক্সের মধ্যে ফেলে দিয়ে যায়, কাড়াকাড়ির করারও কেউ নেই কিন্তু নিরক্ষর লোকের মতো তার ভেতরের ছবি দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারে না যে দিনের পর দিন খবরের কাগজ ছাড়াই সে বেঁচে বর্তে আছে। আগে খবরের কাগজের অফিসের ছুটির কারণে একদিন কাগজ না আসলে সে দিনে কমসে কম তিন বার খবরের কাগজের খোঁজ করতো। সেই জীবন কতো দ্রুত আলু - পটলের হিসাবের মধ্যে ডুবে গেছে।

স্বামী ছাড়া আর তেমন কোন বন্ধু তৈরী হয়নি তার এ দেশে। দেশ থেকে চিঠি আসতে বারো থেকে পনেরদিন সময় লাগে। স্কুলের পড়া আর চিঠি লেখার বাইরে একমাত্র কাজ তার সারাক্ষন ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে সেই আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকা। খুঁজ়ে দেখার চেষ্টা করতো এইযে মেঘটা ভেসে আসছে এটা কী বাংলাদেশ থেকে আসলো? এতে কি অহনার মায়ের চোখে তার জন্য লুকিয়ে থাকা মায়াটুকুর ছায়া দেখা যায়? নাকি বোনের ভালোবাসার গন্ধ পাওয়া যায়? নাকি এইযে মেঘটা যেটা এখন ভাসতে ভাসতে তার দৃষ্টি সীমার আড়ালে চলে যাচ্ছে, সে তার মায়ের কাছে তার খবর পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। বারো তলার ওপর থেকে নীল আকাশটাকে অনেক কাছের মনে হতে লাগল তার, বেশীরভাগ সময় মেঘাচ্ছন্ন থাকা এই আকাশের সাথে গল্প করে আর কিচেন ক্যালেন্ডার এর এক তারিখকেই দশবার দশ রঙের পেন্সিল দিয়ে কেটে একাকী তার দিন কাটতে লাগল। আকাশটাকেই নিরাপদ বন্ধু মনে হতো, আর অন্য যা করতেই যেতো তাতেই যেনো কেমন একটা বিভীষিকা মাখানো ছিল।

(চলবে)তানবীরাপরিশোধিত ২৩.০৫.১০

No comments:

Post a Comment