Tuesday 15 March 2011

আমার কানে কিছু বলতে এলো সে, হাতছানি তার অজানায় বহুদূর

প্রবাস জীবনের ব্যস্ততায় আর তিতলির অবুঝপনায় ক্লান্ত হয়ে সায়ান আস্তে আস্তে তিতলির সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিল। মেইল, ফোন সবকিছু সে নিজে কমিয়ে দিল, তিতলির ডাকে সাড়া দেয়াও কমিয়ে দিল। ওদের মধ্যে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, প্রতি ভোরে দুজন দুজনকে সুন্দর একটা দিনের শুভকামনা জানিয়ে উইশ করা, সেটা সায়ান বন্ধ করে দিল। শুধু যে তিতলির অবুঝপনা আর ঝগড়া এটার কারণ ঠিক তাও নয়। আজকাল সায়ান ভবিষ্যৎ এর কথাও ভাবছিল। সামনের সুন্দর উজ্জল ক্যারিয়ার আর ভবিষ্যৎ ফেলে সে সহসা দেশে ফিরতে চায় না। আর তিতলিও তার পরিবারের খুব ন্যাওটা। তাদের ছেড়ে সে এই দূরদেশে আসার কথা ভাবতে পারে না। তাহলে এ লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপের ভবিষ্যৎ কি? কি দরকার এ মূল্যবান সময় আর শক্তি বৃথা নষ্ট করে তার রাত জাগার? তারচেয়ে আশেপাশের স্বর্ণকেশীদের দিকে মন দিলে কেমন হয়, সে ভাবনাও তার মনে ভাসে। তাহলে কি, আউট অফ সাইট – আউট অফ মাইন্ড, ব্যাপারটাই আবারো সত্যি হতে যাচ্ছে? না, তাইবা কেন হবে? দেশে থাকতে কি সে অন্য মেয়েদের দিকে কখনো তাকাতো না কিংবা সুযোগে অন্য মেয়েদের সাথে ফ্ল্যার্ট করতো না?

সায়ানের কোর্সমেট আছে একটি স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত মেয়ে, মাঝারী গড়নের, বাদামী চুল আর চোখ, অসাধারণ দেখতে। মেয়েটি কখনো সখনো তার পাশে বসলে তার আজকাল অন্যরকম লাগতে থাকে। মন দিয়ে ক্লাশে লেকচার পর্যন্ত ফলো করতে পারে না। স্বর্ণকেশী কি টের পায় তার হৃদয়ের এই উত্তাপ? ক্লাশের বাইরেও আজকাল তার সাথে দেখা হয়, কথা হয়, ক্যাফেতে একসাথে কফি খেতে যায় ওরা। পরিচয়টা ঘনিষ্ঠতায় বদলাতে থাকে দ্রুত, দুজনেই অনেকটা সময় একসাথে কাটায়। মেয়েটির বাংলাদেশী সংস্কৃতি নিয়ে বেশ আগ্রহ। আর অনেকটা আগ্রহ যে তাকে নিয়েও সায়ান তা বুঝতে পারে। এ আগ্রহ আজকাল তার মনেও রঙ ছড়াচ্ছে, সে সেটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। মনে মনে কিছু নির্দয় পরিকল্পনা করছে সে এই স্বর্ণকেশী ঘিরে। এমনিতে তিতলির মায়া কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। দিনরাত সে তিতলিতে অভ্যস্ত। মেইলে তিতলি, মোবাইলে তিতলি, ফোনে তিতলি। তিতলির মায়া তার চিরচেনা। তিতলির চুলের গন্ধ, ঠোঁটের স্বাদ, গলার ঘামের লবনাক্ততা তার অতি পরিচিত। কিন্তু এই স্বর্ণকেশীর মায়া দিয়ে তিতলির মায়াকে রিপ্লেস করতে সে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠছে দিন দিন। দরকার কি তিতলির এতো ন্যাগ সহ্য করার। বাঙ্গালী মেয়েগুলোতে যেমন মেয়েলিপনা ভর্তি তেমনি ন্যাগিং। তার এতো সময় নেই, জীবনে অনেক দূরে যেতে হবে।

মাঝখানে কিসের যেনো বন্ধ ছিল, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লং উইকএন্ডে সে আর স্বর্ণকেশী পাশের শহর থেকে ঘুরে এলো। একসাথে মাছ ধরলো লেকের পাড়ে বসে, সে মাছ ক্লীন করে সস দিয়ে মেরিনেটেড করে রেখে বারবিকিউ করে খেলো দুজনে। স্প্যানিশদের সাথে বাঙ্গালীদের অনেক মিল। এরাও বেশ ভাত খায়, দুবেলা খায় আর সমুদ্রের পারের মানুষ বলে মাছ ওরাও খুব ভালোবাসে। যতোই দিন যাচ্ছে সায়ানকে ততোই স্বর্ণকেশীর সাথে তার জীবনযাত্রার মিল আবিস্কারের নেশায় পেয়ে বসেছে। সায়ান নিজেও আজকাল অবাক হচ্ছে নিজের কর্মকাণ্ডে, নিজের আত্মবিশ্বাস তাকেই মুগ্ধ করে দিচ্ছে। যতোটা কষ্ট হবে ভেবেছিল তিতলি আসক্তি কাটাতে তার কিছুমাত্রই হয়নি। বরং দিনরাত যেন তার উড়ে চলছে। স্বর্ণকেশী তাকে অন্য জগতে নিয়ে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে। আর এই ছুড়ে ফেলাতে সায়ান আনন্দের সাথে নিজেকে সমর্পন করছে। শেষ বিকেলে নরম হয়ে আসা কমলা আলোর আভায় সে যখন বারবিকিউড ফিশ আর রেড ওয়াইন নিয়ে লেকের পাড়ে বসে পানির ওপর নাম জানা সুন্দর সমস্ত পাখির উড়াউড়ি দেখছিলো তখন তার সেলে তিতলির ফোন এলো। ইশারায় স্বর্ণকেশীকে সে বললো, “হোম”। হ্যালো বলতেই ঐপার থেকে তিতলির গলা। কি বিষন্নতা মাখানো ছিল তিতলির গলাটায়। আগেরদিন হলে সায়ান ভেঙ্গে যেতো সমুদ্রের ঢেউ হয়ে তিতলির তটে। সেদিন গলা শুনে এক মুহূর্তের জন্যে কেঁপে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছিলো সে।

সায়ানের এই এড়িয়ে যাওয়া তিতলি আজকাল বেশ টের পায়। সেই আকুলতা আর নেই, খুব দায়সারা ভাবে সারাদিন পর হয়তো তার অনেক কয়টা ম্যাসেজের জবাবে এক লাইন লিখবে, তুই খেয়েছিস কিংবা ব্যস্ত আছি, তুই কেমন আছিস টাইপ কিছু। সারাদিন ধরে ম্যাসেজ চেক করে করে সে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন এমন দায়সারা কিছু তার অভিমানকে আরো উস্কে দেয়। কিন্তু কার কাছে কাঁদবে। সবচেয়ে আপনজন যখন অচেনা আচরন করে তখন কার কাছে নালিশ করতে হয় তিতলিরতো তা জানা নেই। তার সমস্ত অনুযোগ আর অভিযোগের ঠিকানাইতো ছিল সায়ান। তিতলি কোথায় যেনো পড়েছিল, ছেলেরা প্লেটোনিক লাভ ধরে রাখতে পারে না, তাদের জন্য চাই রক্ত মাংসের কিছু। সায়ানের এই অবহেলা তীব্র হয়ে তাকে বিঁধে। নিরুপায় হয়ে নিজেকে সে শাস্তি দেয়। খায় না ঠিক করে, পড়াশোনায় মনোযোগ নেই, অকারণে বন্ধুদের সাথে কিংবা কখনো মায়ের সাথে ঝগড়া করে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে থাকে। বই ছিড়ে ফেলে, প্রিয় গানের সিডি ভেঙ্গে ফেলে কিংবা বারান্দার টবে তার নিজের হাতে লাগানো প্রিয় জুঁই – বেলিকে ছিঁড়ে তার রাগ কমায়। তার এই কষ্ট এই যন্ত্রনা কিছুই কি সাগরকে পার করে ঐপারে পৌঁছায় না? না জানে না তিতলি পৌঁছায় কি না। মনে হয় পৌঁছে না, তাহলে কি কেউ এতো নির্দয় হতে পারতো তার প্রতি?

ছোটবেলায় অবুঝ হয়ে সে যে নির্দোষ দুষ্টুমি করেছে তার শাস্তি কি তাকে এখন ভগবান দিচ্ছেন? খেলতে যেয়ে পিঁপড়ের ডিম ভেঙ্গেছে, কিংবা পাখির বাসা নষ্ট করেছে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে কি খোদা? সায়ানকেও কেন যেন আজকাল তার গডের সমার্থক মনে হয়। তার নির্ভেজাল অভিমান কিংবা অর্থহীন দুষ্টুমী ক'রে বলে কথাগুলোকে সে ইলাষ্টিকের মতো টেনে টেনে তা থেকে নানা রূপ বের করে যেভাবে তাকে বকে কিংবা ঝগড়া শুরু করে আর দিনের পর দিন তার সাথে কথা না বলে, তার চিঠির জবাব না দিয়ে তাকে শাস্তি দেয় তাতে অনেক কষ্টের সাথে হাসিও পায় তিতলির। সায়ানও খোদা হয়ে গেছে, সমস্ত ভুল আর অন্যায়ের জন্য শাস্তি দিতে ভালোবাসে সে তিতলিকে। অথচ দুজনেরই প্রেম দেয়ার কথা, ভালোবাসা দেয়ার কথা। অনেক কিছুতেই সে টের পায় সায়ান দ্রুত তার সাথে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে, তার দোষ ত্রুটিগুলো বড্ড বেশি চোখে পড়ছে সায়ানের। এতে সে আজকাল কুঁকড়ে যায়, আগের মতো তেড়ে উঠতে পারে না কেনো যেনো। তার সমস্ত অবুঝপনা নাক কামড়ে আদর করে দিয়ে ইগনোর কিংবা এঞ্জয় করে যাওয়া সায়ান কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সায়ান আর তিতলির অভিমান ভাঙ্গানোর খেলায় মাতে না।

আস্তে আস্তে তিতলি চিঠি লেখা কমানোর চেষ্টা করছে। ঐপার থেকে কোন জবাব না পেয়ে হতাশায় তার দিনরাত ডুবে যাচ্ছে। অথচ সারা দিনরাত কতো কথাই না জানাতে ইচ্ছে করে। সেদিন নীলক্ষেতে বই কিনতে গিয়ে একা একা বৃষ্টিতে ভিজে সে চুপসে গেলো, বৃষ্টি থামছে না তাকে দাঁড়াতেই হলো এক দোকানের সামনে। পাশ থেকে দুটো ছেলে কি লোভী চোখেই না তার ভেজা শরীরের দিকে তাকাচ্ছিলো। সে সময় সে সায়ানের তার পাশে না থাকাটা কতো মিস করছিলো সে, সেটা জানাতে ইচ্ছে করে। নতুন আমড়া উঠেছে বাজারে, লবন মরিচ দিয়ে আমড়া খাওয়ার সময়, দুজনের ভাগাভাগি করে একটা আমড়া খাওয়ার সেদিনগুলোর জন্য তার চোখে পানি আসে সেটা জানাতে ইচ্ছে করে। মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করতে গেলো, ছুরিতে পেঁয়াজ কাঁটতে গিয়ে বুড়ো আঙ্গুলটা এই এতোখানি কেটে গেল সেদিন। কি রক্তটাই না পড়লো। কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিলো না, চোখে অন্ধকার দেখছিলো সে, কিন্তু সে অন্ধকারের মধ্যেও তার অবাধ্য দুচোখ সায়ানকে খুঁজছিলো সেটা জানাতে ইচ্ছে করে। মহাদেব সাহা আর হেলাল হাফিজের কবিতার বইদুটো নতুন কিনেছে সে, রেখে দিয়েছে একসাথে পড়বে বলে, সেটা আজ আর তিতলি কেমন করে সায়ানকে জানাবে? দোষ তিতলিরও অনেক সেটা নিজেও জানে। এমনিতে ফটফট আগডুম বাগডুম অনেক কথা বললেও, লজ্জা ভেঙ্গে যে কথাটা সে সায়ানকে জানাতে চায়, তার মনের কথাটা সে কখনোই মুখে আনতে পারে না। বরং উল্টোটাই বলে সবসময়। এতোদিন আশা ছিল, সায়ান বুঝে নিবে তার না বলা কথাগুলো কিন্তু আজ জানে বুঝে নেয়ার সময় কারো আর নেই।

তিতলি আজকাল চিঠি লিখে বটে কিন্তু পাঠায় সে নিজেকে। এটাও একটা খেলা, সায়ানতো আসলে তার নিজেরই একটা অংশ, সে মানুক আর না মানুক তার মন জানে। তাই “টু”তে তিতলি নিজের এ্যাড্রেস দেয়। তবে কি সে একটু একটু পাগল হয়ে যাচ্ছে? তাই বা হবে কি করে? এ পৃথিবীতে আসলে কেউতো কিছু অন্যের জন্যে করে না। সবাই সব করে নিজের জন্যে। এই যে তিতলি ভাবে সে সায়ানকে ভালোবাসে, আসলে সে নিজেকে ভালোবাসে। সায়ানকে না পেলে তিতলির কষ্ট হয় তাইতো সে বার বার সায়ানের কাছে ফিরে ফিরে যায়। নিজের কষ্টে আকুল হয়ে কাঁদে। সায়ানের জন্য যে তা না সেটা বোকা তিতলিও জানে। সে ফিরে ফিরে সায়ানকে খোঁজে তার নিজের জন্যে। তিতলি সায়ানকে ছাড়া বেঁচে থাকা জানে না, সায়ানের ওপর তার বড্ডো মায়া পড়ে গেছে। আদতে যদি পুরো ব্যাপারটা তিতলি ভালো করে ভাবে, তাতে “সায়ান” কোথাও নেই। পুরোটাই তিতলির ভালো লাগা, তার বেঁচে থাকা, তার কষ্ট, তার যন্ত্রনা, নিজেকে রক্ষা করা। নিজেকে ভালো রাখবার প্রেষণাই তিতলিকে সায়ানের কাছে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। তবে সায়ানের দেয়া কষ্ট থেকে তিতলি একটা জিনিষ শিখে নিয়েছে, কষ্ট হলে লোকে কষ্ট পায় কিন্তু মরে যায় না। আগে তিতলি ভাবতো সায়ান পাশে না থাকলে সে মরে যাবে কিন্তু আজকাল দিব্যি দেখলো, সে এক রকম বেঁচেই আছে যদিও মরে যাওয়াটাই হয়তো বেটার সল্যুশন ছিল।

তানবীরা
১৪.০৩.২০১১

সায়ান
তিতলি

4 comments:

  1. I cant read bengali. May I know how can i make a translation of ur posts in this blog..please let me know?

    ReplyDelete
  2. If you don't know Bangla, it will be diffucult for you to read my posts.

    However, thanks anyway for showing interest in my write up.

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ রিফাত আপনাকে পড়ার জন্যে

    ReplyDelete