Tuesday 15 March 2011

জীবন থেকে নেয়া (মরে গেলেও)

কথায় কথায় মরে গেলেও এটা আমি করবো না, খাবো না, এভাবে কথা বলা আমার স্বভাব। এভাবে কথা ছোটরা বলে বড়’রা না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি কিন্তু বড় আর হচ্ছি না। সবাই এটা নিয়ে অনেক বকে বকে এখন ক্ষ্যান্ত দিয়েছেন। তোর মানসিক বয়স কোথাও আটকে আছে, তোর মানসিক ডেভেলাপমেন্ট হচ্ছে না, বলতে বলতে সবাই ক্লান্ত। আমিও মেনে নিয়েছি একরকম যে বড় হওয়া হয়তো আর হবে না এ জীবনে। সবচেয়ে বেশি বলেছেন এক ভদ্রলোক। যার সাথে ঝগড়া করতে করতে এতো বছর পার হয়ে গেছে টের পাইনি। তারপরও এখনো কিছু না হতেই ঘাড় বেঁকিয়ে ঐটাই বলি, মরে গেলেও তোমার সাথে থাকবো না। তিনি আজকাল বলেন, মরারতো আর দেরী নাই, এতোদিন যখন থাকলা কষ্ট করে, বাকি কয়টা দিনও থাকো। এতোদিন যে যেভাবেই বলেছে, সেগুলো শুনতে একরকম লাগতো। কিন্তু এজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন মানুষটা, “তোমার জন্য মরতে পারি, ও সুন্দরী তুমি গলার মালা” যখন বলেন সেটা, তখন অন্যরকম লাগে।

স্কুলে টিফিন না খাওয়ার একটা বড় প্রবনতা মেয়ের মধ্যে আছে। একদিন রাগ করে কিছু দেখিয়ে বললাম, ভেবেছিলাম তোকে এটা দিব, কিন্তু এখন আর দিব না। আমার জানের জান বলে ওঠলো, মরে গেলেও দিবে না? আমি চমকে তাকালাম। আমার মুদ্রা দোষের বীজ কি চারা হয়ে গজিয়েছে দেখার জন্যে। স্বভাবসুলভ মোষ গলায় বললাম, না মরে গেলেও দিব না। তিনিও আজকাল আর বাচ্চা নেই। তলে তলে বহুত পাকতেছে। কোনটা মাকে বলতে হয় আর বলতে হয় না সে ট্রেনিং তিনি স্কুলের বন্ধুদের থেকে ভালোই পান। কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব না দিয়ে মোচরান। স্কুলে কে কার সাথে প্রেম করছে জিজ্ঞেস করলেই লজ্জা লজ্জা হাসি দিয়ে মাথা নাড়তে থাকেন, আমি জানি না, সত্যি জানি না। এরমানে হলো জানি কিন্তু তোমায় বলবো না। কার্টুন ফ্লিমে ছেলে মেয়েকে চুমু দিলে ওনি লজ্জা পেয়ে টিভির চ্যানেল বদলে দেন। তো সেই তিনি কি আর সেখানে থামবেন। তিনি বললেন, কিন্তু তুমি মরে গেলে আমি নিয়ে নিব। আমি অবাক তার উত্তরে, আমি মরে গেলে সে আমার জিনিসপত্র নিয়া টানবে? তাই বলে কি আমিই কি থামবো? আমিও বললাম, পারবি না, মরার আগে ওটা আমি কাউকে দিয়ে যাবো। তিনি বললেন, জানিতো কাকে দিয়ে যাবে। আমি বিস্ময় গোপন করার বৃথা চেষ্ট করে বললাম, কাকে? কাকে আবার ছোটমাকে।

হাসি গোপন করে বললাম, কিভাবে জানলে? তিনি আমার নির্বুদ্ধিতায় অবাক। কিভাবে আবার? আমার পর তুমি ছোটমাকে বেশি ভালোবাসো, তবে অসুবিধা নাই। ছোটমা মরার সময় আমি ছোটমার কাছে থেকে নিয়ে নিবো। মোট কথা নিয়েই ছাড়বেন। তবে আমার মেয়ের চিন্তাধারা মহৎ। তিনি সিরিয়ালি আমাকে বললেন, এরপর আমি মরার সময় তাহিয়াকে দিয়ে দিব আর তাহিয়া মরার সময় পারিসাকে। আমার পঞ্চাশ ইউরো দামের ঘড়ি যেটা স্টক ক্লিয়ারেন্স সেলে পঁচিশ ইউরোতে কিনেছি, এর বংশ পরম্পরার রোলিং দেখে আমি মুগ্ধ। আজকাল শরীর জানান দিচ্ছে, মানসিক বয়স না পাকলেও কলকব্জায় জং ধরছে। কোন কিছু নিয়ে খুব মন খারাপ হলে বুকে একটা চাপ অনুভব করি। অনেক সময় সে চাপ শ্বাসকষ্টে রুপ নেয়। একদিন দুপুরবেলা তেমন শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। মেয়ে খুব ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এখন মরে যাচ্ছো, মা? বললাম বুঝতে পারছি না। সে কেঁদে ওঠলো, মা প্লীজ তুমি এখন মরো না, বাসায় কেউ নেই, আমার একা ভয় লাগবে। আমি হাসলাম বললাম ঠিক আছে, তুমি বলো কখন মরলে তোমার সুবিধা হবে।

তিনি আমাকে বিকেলে জানালেন, এখন আমি মরতে পারি। আমি মরলে তিনি গায়ত্রীর বাড়ি চলে যাবেন। আমি অবাক বল্লাম, সেখানে কেন? তিনি জ্ঞান জ্ঞান বানী দিলেন, বন্দনা আন্টি ওনাকে আর গায়ত্রীকে একসাথে স্কুলে নিয়ে যাবেন, ওদের দুটো কার সীট আছে, অসুবিধা হবে না। রুটি ভাত খেতে দিবেন কোন সমস্যা নাই। আমি একটু না নাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। বললাম, আমি আর বন্দনা আন্টিতো একই বয়েসী, আমরা যদি একসাথে মরে যাই? তাহলেও সমস্যা নাই, আমি আর গায়ত্রী একসাথে থাকবো। একসাথে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাবো। আমি হাসি চেপে বললাম খাবে কি, রান্না করবে কে? ওনি বললেন রাঁধতে হবে না, পিজা খাবো। পিজা কে কিনে দিবে, পয়সা? তিনিও অবলীলায় উত্তর দিচ্ছেন পয়সা পাপা দিবে। আমি দেখলাম দুনিয়াতে কারো ছাড়া কারো চলবে না এচিন্তা কতো ঠুনকো। যার জন্যে জীবনের এমন কিছু নাই ত্যাগ করতে পারি না, সে আমাকে ছেড়ে তার জীবন কতো ইজি রাখা যায় সে পরিকল্পনা এক ঘন্টায় করে ফেলেছে। এভরি থিং ইজ এ্যারেঞ্জড শুধু আমার মরার অপেক্ষা। তো বাবার কাছে থাকবে না কেনো, জানতে চাইলাম। দেখলাম বাবার কাছেও যে থাকা যায় এ অপশনটা ওনার মাথায় আসে নাই। বাবা ওনার কোন কাজে হাত না দিতে দিতে যে ওনার জীবনে অপ্রয়োজনীয় একটা টাকা দেয়ার মেশিন হয়ে গেছেন, সেটা বাবা বোধহয় নিজেও জানেন না। তবে আমার কন্যা ভদ্র। বললো তুমি এখন মরো না মা, তাহলে তোমাকে আমি খুউউউউব মিস করবো, মাঝে মাঝে আমার কান্না পাবে তোমার জন্যে। বুড়ি হয়ে তারপর মরো, যখন তোমার হেয়ার গ্রে হবে।

এই হাফ বিদেশিনী যখন আমাকে মাঝে মাঝে বলেন, এখন তুমি আমার মুখে মুখে কথা বলছো মা, কিযে ভালো লাগে শুনতে সে শাসন। জীবন যদি পারমিট করে মা, তাহলে তোর সুবিধামতোই মরবো, কথা দিলাম তোকে। আমার মা তার মাকে ছেড়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে এসেছেন। আমি আমার মাকে ছেড়ে অন্য মহাদেশে থাকি, তুই তোর মাকে ছেড়ে কোন গ্রহে থাকবি কে জানে।

একটা গান কদিন থেকে প্রচন্ড পাগলের মতো মাথায় বাজছে।

যে জানার সে জানে

No comments:

Post a Comment