Wednesday 11 January 2012

“ক্লাশ” বলতে আসলে কোন ক্লাশ নেই

কিছুদিন আগে দুপুরে এক ঘরোয়া আড্ডায় বন্ধু কাম প্রতিবেশির বাসায় গিয়েছিলাম আমরা ক’জনা। আমরা পাঁচজন মেয়ে আর আমাদের পাঁচজনের সাথে আমাদের কন্যারা পাঁচজন। মাঝে সাঝেই রোববারের অলস দুপুরে আমরা আড্ডা দেই, “হাই টী” আর আমাদের মেয়েরা একসাথে খেলে। এতো কাছে বাড়ি সবার, ঘন্টা দুয়েকের জন্যে যাই, ওভারকোটে মোবাইল কিংবা বাড়ির চাবি নিয়ে যাই, তার বেশি কিছু নিইনা। কিন্তু মোবাইল ওভারকোটে থাকলে কেউ ফোন করলে আবার শুনি না। স্বামী অসুস্থ, বাসায় আছেন একা, তাই মোবাইলখানা ওভারকোটের পকেট থেকে বের করে টেবলের ওপর রাখলাম সবার সামনে।

আড্ডা শেষে আমি আসার আগে করিডোরে গেলাম। ফিরে এসে দেখি টেবিলে আমার মোবাইল সেটটা নেই। ভাবলাম হয়তো, মনের ভুলে সোফায় রেখে, টেবিলে খুঁজছি। তাই সোফার চিপায়, সোফার নীচে, কার্পেটে, টেবলের তলায় সব জায়গায় হাতিপাতি করে খুঁজতে লাগলাম, নেই নেই নেই তো নেই। একজন বন্ধু জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে, বল্লাম, সে সমানে তার ফোন থেকে আমার ফোনে কল করছে, কোথাও সেই পরিচিত বাজনা আর বেজে উঠছে না। একদম নীরব। অথচ ফোন বাজলে শুনিনা বলে রিঙার অলওয়েজ সবচেয়ে হাই ভল্যুমে দেয়া থাকে। কেউ কেউ বললেন, কোথাও পড়ে হয়তো ফোন অফ হয়ে গেছে তাই আওয়াজ শুনছি না। কিন্তু পরিস্কার রিঙ শুনতে পাচ্ছি অপর প্রান্ত থেকে। তারমানে ফোন অফ নয়।

এই করতে করতে প্রায় চল্লিশ মিনিট পার হল। অন্যেরা সবাই তখন যাই যাই করছে। বাসায় যেয়ে ডিনার রেডি করতে হবে, সকলেরই কাজ আছে। আমি কাউকে বলতেও পারছি না, আমার মোবাইল না পাওয়া পর্যন্ত তোমরা যেতে পারবে না। যদিও মোবাইল না পেয়ে আমার মনের মধ্যে অনেক ধরনের চিন্তাই আনাগোনা করছে, যার কোনটাই সুখকর নয়। মোবাইল সামান্য একটা জিনিস হয়তো কিন্তু এতো বছর ধরে ব্যবহার করতে করতে, সমস্ত টেলিফোন নাম্বার, প্রিয় গান, ছবি, কোনদিন কি করবো তার এ্যালার্ম, রিমাইন্ডার, নোটস সব এরমধ্যে। এছাড়াও এই মোবাইলের ইমোশোন্যাল ভ্যালু অনেক। এই পৃথিবীতে শর্তহীন প্রিয় ব্যাক্তির সংখ্যা আমার খুবই নগন্য। সে নগন্য সংখ্যার একজন আমাকে এই সেটটি দেশ থেকে বিদেশে উপহার পাঠিয়েছিলেন। আমার দশা প্রায় পাগলপারা। অন্যনোপায় হয়ে স্বামীকে ফোন করে বললাম, তিনি তার অসুস্থ শরীর নিয়ে এলেন আমার সাহায্যার্থে।

যার বাসা তার দামি সোফা উল্টে-পাল্টে, তাতে ভ্যাকুম মেশিন ঢুকিয়ে, কার্পেট তুলে ঝেড়ে একশা অবস্থা, তিনজন মিলে। অন্যদিকে আর একজন তার মোবাইল থেকে সমানে ফোন করে যাচ্ছে আমার মোবাইলে কোথাও যদি একটু আওয়াজ পাওয়া যায়। সবাই হতভম্ব। যার বাসায় এই কান্ড ঘটেছে আর যারা সেখানে আড্ডা দিচ্ছিলেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ চালান, স্ট্যান্ড ফ্রী বাংলো বাড়িতে থাকেন। সেখানে সামান্য একটা মোবাইল নিয়ে এই অসামান্য কান্ড!!! কারো মুখে কথা নেই। প্রায় দেড় থেকে দু’ঘন্টা মল্ল যুদ্ধ চলার পর সবাই যার যার বাসায় ফেরা মনস্থ করলাম। আমার স্বামী আমাকে প্রায় যেকোন বিপদ থেকে যেকোন মূহুর্তে রক্ষা করে ফেলেন, তিনি অকৃতকার্য হবেন এটা আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, তারপরও তাই মেনে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম।

আসার সময় রান্নাঘরে গিয়েছি গলা ভেজাতে। সারা দুপুরের হৈ চৈতে গলা শুকিয়ে কাঠ। হঠাৎ শুনতে পেলাম আমার সেই পরিচিত রিঙার। আমি এক চিল চিৎকার। সবাই দৌড়ে আমার কাছে এলো। এবার আর স্বামী ভুল করলেন না। রিঙারের শব্দকে অনুসরণ করে বাগানের বাউন্ডারীর পাতার নীচ থেকে আমার মোবাইল উদ্ধার করলেন। শতাব্দীর আর্শ্চয ঘটনা, লিভিং রুমের টি টেবল থেকে আমার মোবাইল কি করে সেখানে গেল! আর যে অবস্থা থেকে মোবাইলটা বের করা হলো তাতে মনে হচ্ছে, কেউ ছুড়ে মেরেছে যা ওখানকার পড়ে থাকা পাতার নীচে চাপা পড়ে গেছে। তারপর আমরা সবাই সুশীল ভদ্রলোকেরা আমাদের বাচ্চাদের দুষ্টমীর ওপর দোষ চাপিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসলাম। যদিও বাচ্চারা খুশিতে মোবাইল হারানো পার্টি করছে। এ উপলক্ষ্যে তারা আর বেশিক্ষণ একসাথে খেলতে পারলো।

সবাই তখন বেড়িয়ে এলেও, বাচ্চাদের দোষ দিলেও সবাই আমরা মনে মনে জানতাম, এ কাজ কিছুতেই কোন বাচ্চার নয়। আবার রাতে, দুপুরে শুরু হলো এ নিয়ে আলোচনা। কে বাগানের দিকে গিয়েছিল, কাকে দেখেছিলাম, কাকে সন্দেহমতো হচ্ছে। কাউকে দেখিনি, খেয়াল করিনি তাই বললাম। কিন্তু সাথে সাথে এও ভাবছি, এই যদি হয় আমাদের হাল তাহলে আমরা নিজেদের কি দাবী করবো? কিসের ক্লাশ আমরা? যারা আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম তাদের প্রায় প্রত্যেকের স্বামীরই সেখানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ডিগ্রীর সাথে আরো কিছু এ।বি।সি।ডি এক্সর্টা যোগ আছে। প্রত্যেকের সামাজিক অবস্থা ঈর্ষনীয়। বাবা-মা, ভাই, ছেলে-মেয়ে সবার অবস্থান সমাজে সুসংহত। সাধারণ শ্রেণী কিংবা শ্রেণীহীন মানুষের সংস্পর্শে তারা হয়তো কখনো যান না। এই তবে “ক্লাশ”!!!!! আসলে “ক্লাশ বলতে কোন ক্লাশ নেই”। কোট প্যান্টলুন, কিংবা লুঙি শার্ট, ভিতরে সবার সমান রাঙা। যার পাঁচ টাকা চুরি করার সামর্থ্য, সে পাঁচ টাকা চুরি করে যার পাঁচ মিলিয়নের সামর্থ্য সে পাঁচ মিলিয়ন করে।

কবি নজরুলের মতো, আমার জীবনের সব শিক্ষাই আমার অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। এক আড্ডায়, এক বন্ধু “ভদ্রলোকের” সংজ্ঞা বলেছিলেন, “যতোক্ষণ ধরা না পড়ে, ততোক্ষণ ভদ্রলোক। দি মোষ্ট রেসপেক্টেড ওয়ান। সৎ পয়সা তা যতোই হোক তাতে কখনো “মার্জিন” ক্রস করা যায় না। স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং এর মার্জিন কি? যার যার কাপড় অনুযায়ী তার তার কোট কি মার্জিন? তবে এটুকু জানি আজ, প্রদীপের তলার অন্ধকারটুকু দেখে ফেলা কখনোই কোন সুখময় অনুভূতি নয়। এটা যন্ত্রনাদায়ক। আর মাঝরাতে বসে আমিই এই নীতিকথা কেন লিখছি? আমি কি তাহলে অন্যায় করতে কিংবা ফাঁকি দিতে বা চুরি করতে চাই না? দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে বলছি, চাই অবশ্যই চাই। আজকে হিল্লি কালকে দিল্লী করতে কার না ভাল লাগে? ভিক্টোরিয়া সিক্রেট কিংবা রাফ লওরেন আমাকেও মুগ্ধ করে। আমি আসলে একজন ব্যর্থ, ভীরু, সুযোগের অভাবে সৎ থাকা মানুষ মাত্র। নীতিবান কেউ মোটেও না।

তানবীরা
২৭.১২.২০১২

2 comments:

  1. আমি আসলে একজন ব্যর্থ, ভীরু, সুযোগের অভাবে সৎ থাকা মানুষ মাত্র। নীতিবান কেউ মোটেও না।good

    ReplyDelete