Tuesday 6 January 2015

গ্রন্থালোচনাঃ বোবাকাহিনী

ক্রীসমাসের ছুটিতে কিছুটা কাউচ পটেটো হয়ে বাইরের তুষারপাত দেখেছি আর হাতে ছিলো গরমা গরম সবুজ চায়ের সাথে পড়া না পড়া কয়েকটি বই আর কিছু দুর্দান্ত সিনেমা। ছোটবেলা থেকে পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের কবিতা পড়েছি তবে সেগুলো বেশীরভাগই টেক্সট বইয়ে। সহজ সরল জীবন কথা, গ্রামীন রুপ এই তার লেখার প্রধান উপজীব্য বলে ধারনা ছিলো। নিজেদের শহুরে জীবনের সাথে অনেক সময় রিলেট করতে পারিনি বলে বেশীর ভাগ সময় আগের যুগে গ্রামে এমন হতো এই মনোভাব নিয়ে পড়ে গেছি।

আমার বাড়ি যাইও ভোমর, বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব, বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা গামছা বাঁধা দই।

কিংবা

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।

নয়তো

এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা!


আমাদের আটপৌরে শহুরে জীবনে আমরা কাকেইবা এমন উদাত্ত আহবান করি? কোথায় বা তাদের আপ্যয়নের জন্যে শালি ধানের চিঁড়ে। ভেন্না পাতার বাড়িই বা আমরা কোথায় দেখেছি? এসমস্ত মিলিয়ে পল্লীকবি সর্ম্পকে ধারনা ছিলো সহজ সাধারণ কাব্যকথা লিখে গেছেন তিনি। বইয়ের তাক এপার ওপার করতে যেয়ে হাতে পরলো তার “বোবাকাহিনী” উপন্যাসটি। অনেক আগে একবার পড়েছিলাম, হালকা হালকা মনে ছিলো। আবারো পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ধরতে গেলে প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম বইটি। হাতে নিয়ে আর ছাড়তে পারিনি, এভাবে কাহিনী আর ভাষা দুইই আবার টেনে নিয়ে গেছে।

ছোটবেলায় শুধু মুগ্ধ পাঠিকা হয়ে পড়ে গেছি কিন্তু এবার পড়তে পড়তে পল্লীকবির দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ভাবছিলাম। এতো এতো আগের দিনে বইটি লেখা যেটাতে তিনি বার বার ধর্মের নামে গরীবকে শোষণ করা, ধর্মের আফিম খাইয়ে দিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করিয়ে দেয়ার ব্যাপারগুলো তুলে এনেছেন। দেখিয়েছেন গ্রামে যেমন ছিলো শোষন তেমন ছিলো ভালবাসা, শহুরে হঠকারিতা। স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে, নিজের প্রয়োজনের জন্যে ধর্মকে ব্যবহার শিক্ষিত রাজনীতিবিদদের সূক্ষন চালকে তার দক্ষ লেখনীর মাধ্যমে তুলে এনেছেন। কতো চাতুরতার সাথে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিয়ে পাশাপাশি বাস করা প্রতিবেশীকে শত্রু করে তোলা যায় উঠে এসেছে তার লেখায়। এই জিনিসটি যে তিনি ততো আগে উপলব্ধি করেছেন এবং তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেছেন সেটি তার এই বইটি না পড়লে আমার জানাই হতো না তার সম্পর্কে। পল্লীকবির জীবনকে দেখার দৃষ্টি আর তার তা নিয়ে তার চিন্তা – ভাবনা, বইটি পড়ে তার সম্পর্কে আমার ধারনা বদলে গেছে। তিনি এতোটা অসাম্প্রদায়িক আর মুক্তমনা ছিলেন, কোন ধারনাই ছিলো না।  

বইটির সবচেয়ে বেদনার্ত অংশ ছোটবোন বড়ুই আর ভাই বছিরের ভালবাসা।আমাকে বারবার পথের পাঁচালীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো, অপু-দুর্গা। দরিদ্র সংসারে নিদারুন অভাব কিন্তু আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় দুই ভাইবোন মনের সুখে, ফল কুঁড়িয়ে খায়, ফুল কুঁড়িয়ে মালা গাঁথে। আছে পথের পাঁচালীর সেই বিষন্নতা, প্রকৃতির অবাধ স্বাধীনতার কোলে কিশোর কিশোরীদের উদ্দাম বেড়ে ওঠা অনেক ক্ষেত্রেই অনায়সে শহুরে ছেলে মেয়েদের হিংসার কারণ হতে পারে। কিন্তু কলেরায় ভুগে ডাক্তার আর ওষুধের অভাবে বড়ুই এর মৃত্যু দুর্গার মতোই বড্ড করুণ। কাঁদিয়ে আকুল ভাসায়। আমি যেনো চোখের ওপর সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম, কি নিপুন ভাষায় না বর্ননা করে গেছেন সেই দুঃখ গাঁথা। ভাই বছির প্রতিজ্ঞা করলো, যেভাবেই হোক তাকে ডাক্তার হতেই হবে। বড়ুই এর মতো আর কাউকে যেনো অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে না হয়। গরীবের পাশে থাকবে সে, ডাক্তার যেনো আর শুধু শহর আর ধনী লোকদের জন্যে না হয়। ফুলির ভালবাসা অগ্রাহ্য করে চলে যায় বছির গ্রামের লোকদের তার পানে আশা করে থাকার কথা ভেবে, বোন বড়ুইয়ের কবরে করা তার প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে ......... যদিও আজকেও বাংলার গ্রামে গ্রামে ডাক্তার আর ঔষধের দৈন্যতা ঘুচেনি। বহু বছিরের বলিদানও রক্ষা করতে পারছেনা বাংলাদেশকে।


সব মিলিয়ে অন্য এক জসীমউদ্দিন ......... অন্য এক জগত ......। এতোটাই বাস্তব সেই পৃথিবী যেনো আমি নিজের চোখে সব দেখতে পাচ্ছিলাম ......... অসীম মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা লেখকের জন্যে


লেখাটি উৎসর্গ করা হলো আমাদের শান্তকে 

No comments:

Post a Comment