প্রায় একটানে পড়ে শেষ করলাম ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর
আত্মজৈবনিক উপন্যাস “নিন্দিত নন্দন”। শব্দশৈলী থেকে ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত
১৯১ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়তে পড়তে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল। একটি “নারী” তার
সামাজিক অবস্থান যে পর্যায়েরই হোক না কেন, ভুল-ভ্রান্তি, আবেগ-অনুভূতির কী মূল্যই
না তাকে জীবনভর পরিশোধ করে যেতে হয়। তবুও তিনি কিছু জায়গায় সৌভাগ্যবতী,
ছেলেমেয়েদের ভালবাসা পেয়েছেন, বিয়ার ভাইয়ের মতো স্বামীকে পাশে পেয়েছেন, নিজের
যোগ্যতায় ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন, বহুজন কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন তার মত
পরিস্থিতিতে।
“আমাদের খন্ডকালীন সঙ্গীত শিক্ষক কিউ।এস।ইসলাম
বেশ আন্তরিক ছিলেন। তাঁর শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি খুব ভালো
গাইতেন। দেখতে ভালো ছিলেন না, তবে বয়সে তরুণ, বাচনে চৌকষ। এক পর্যায়ে খালাদের
কারণে-অকারণে শাসন আমার শৈশবকে ঝালাপালা করে ছাড়ল – উপায়ন্তর না দেখে গানের শিক্ষক
কিউ।এস।ইসলামকে বিয়ে করলাম মাত্র এক বছর প্রণয় শেষে। খুবই ভালোবাসলাম ওকে। প্রথম
প্রেম একটি কিশোর জীবনে! সত্যি ভালোলাগার ব্যাপার। ভুল খুঁজে বের করার মন ছিল না।
কিন্তু কুমারী জীবনের মুহূর্তগুলো যেন দ্রুতই সরে সরে যাচ্ছিল।“
“সন্ধ্যার পরে সিরাজ (আমার স্বামী) আমাকে ছাদে
ডেকে নিলেন। সেদিন আকাশে পূর্ণ চাঁদ। জ্যোৎস্নার রুপোলি আলোতে সারা প্রকৃতি স্নাত।
আমি যেন সেই আলোর সমুদ্রে স্নিগ্ধ সাগরিকা। প্রাণে গভীর স্পন্দন। মনে হলো এমন
রুচিবান সংস্কৃতিমনা স্বামী, তিনি চাঁদের আলোয় গান গেয়ে আমাকে বরণ করে নেবেন। যেন শকুন্তলার রাজা দুস্মন্ত আজ আমার এতদিনের
শৈশব-কৈশোরের যত কষ্ট যত ক্ষোভ সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে আমার জীবন পূর্ণতা দেবেন।
উনি সতীনাথ মূখার্জির গান শোনালেন। ও আকাশ প্রদীপ
জ্বেলো না .........অপূর্ব দরদ দিয়ে গানটি গাইলেন। আমি মগ্ন হয়ে শুনতে শুনতে হঠাৎ
দেখি ঝলমলে রুপোলি কাগজে মোড়ানো প্যাকেট থেকে একটি কাপড়ের তৈরী জিনিস বার করলেন
মুহুর্তেই বুঝতে পারলাম এটি একটি বোরকা, যে বসন সমগ্র নারী সমাজকে অবনত করেছে। এ
বসন জীবনকে কিছুই দেয় না শুধুমাত্র কুসংস্কার ছাড়া, ফতোয়ার সবক ব্যতীত অন্য কিছু
নয়। বোরকা ফ্যাশনের পোষাক হতে পারে কিন্তু ধর্মের পোষাক নয়। ধর্ম অন্তরে।“
“সিরাজ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হলেন, আমি
স্কুলে চাকরী করতে শুরু করি। সামান্য বেতনে চাকরী করে, স্বামীকে পড়াশোনার সম্পূর্ন
দায়ভার নিয়ে বিশাল সংগ্রামের পদক্ষেপ নিলাম। ৬০ টাকা বেতনে দুই শিফটে ১২০ টাকা এর
ফাঁকে দুটি টিউশনি শেষ করতাম। জীবন ঘন্টা মাপের যন্ত্র, যে সংগ্রামে শুধু শ্রমই
ছিল না কেবল কলঙ্ক, দুর্নাম, দারিদ্র্যের, স্বামীর অকারণ শাসন, সন্দেহ,
দুর্ব্যবহার কোনকিছুরই কমতি ছিল না। সিরাজ যেহেতু আমার উপরে নির্ভরশীল সে কারণে
তাঁর অন্যায়, হীনমন্য ব্যবহারগুলো আমি দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়েছিলাম। কারণ মানবিক
বিষয়টি বড় করে দেখতাম। তাঁর কাছে বিবাহিত জীবনের কোনো দাবিই যেন রাখতাম না।“
এরপর তার জীবনে “বিয়ার ভাই” এর আবির্ভাব। নানা
ঘাত প্রতিঘাত। বিয়ার ভাইয়ের সাথে প্রেমের আমেজ পুরো বইটিকে তরতর করে পড়তে অনেক
পাঠককে নিশ্চয় টেনে রেখেছে। সেই কিশোরী বয়স থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন শুধু
সংসার টেনে রাখতে। পড়ছি আর ভাবছি, কতো যুদ্ধ করলে তবে এমন একজন মহীয়সী হওয়া যায়।
যুদ্ধদিনের কথা আমি আর নাই লিখলাম, পড়ে নিবেন তার নিজের কথায়। স্যালুট ম্যাম,
জীবন্ত কিংবদন্তী আপনি।
বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন, মহামান্যা অদিতি
No comments:
Post a Comment