Thursday 19 May 2016

ব্লগারের দুরন্ত চোখে যেভাবে বাঁধা হল লাল কাপড়

প্রবাসের একাকিত্বে তখনও পুরো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি, পরিবার-পরিজন, বন্ধু, আড্ডা, সর্বোপরি ঢাকার দূষিত হাওয়ার অভাব তখনও খুঁজে ফিরছি। অন্তর্জালের আশীর্বাদে এ সময়ের আশ্রয় ছিল পাল টক, দেশি চ্যাট ইত্যাদি ভয়েস আড্ডা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রবাসী আর দেশিরা এক সাথে হয়ে, গান, কবিতা, আড্ডা কী না ছিল সেখানে। 
তখনও ওয়েবজিনে লিখি মাঝে মাঝে, পড়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেন, সেগুলো মেইলে আসে। সে সময় সামহোয়্যার ইন যাকে আমরা সামু বলি নিয়ে এল বিপ্লব। নিজে লিখে নিজেই পোস্ট করা যাবে, অন্যেরা পড়ে তার নিচে সরাসরি মন্তব্য করতে পারবে, কোনো সম্পাদক কিংবা কাটাছেঁড়ার ব্যাপার নেই— যাকে বলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন। ব্লগ শুরু হতে না হতেই বিস্তর ভিড় হল সামুতে। তারপর আস্তে আস্তে সচলায়তন, আমার ব্লগ, চতুর্মাত্রিক, আমরা বন্ধু, নাগরিক, নির্মাণসহ আরও কত কী। ওয়েবজিনের প্যাটার্ন পরিবর্তন করে মুক্তমনা, সদালাপও ব্লগে রূপান্তরিত হল।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঘা বাঘা প্রসিদ্ধ সাংবাদিক লেখকরাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন— ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, প্রয়াত লেখক মুহাম্মদ জুবায়ের, আহমাদ মোস্তফা কামাল, পাপড়ি রহমান, শওকত হোসেন মাসুম ইত্যাদি আরও অনেকে। যখন তারা আমাদের মতো সাধারণদের ব্লগ পড়ে, বানান, বাক্যরীতি, গঠন ইত্যাদি নিয়ে উপদেশ দিয়ে যেতেন, সাত আকাশে উড়ে যাওয়ার আনন্দে ভাসতাম। 
প্রায় সবই ছিল লেখকদের সবার নিজের জীবনে প্রত্যহ ঘটে যাওয়া ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স। বানানো গল্পও নয়, ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়, যা পড়তে ভাল লাগলেও আজকের সময়ে অচল। এ সময়ে ঘটছে, ঘটে যাওয়া রোজ দিনের সব গল্প। সত্য আর বাস্তবের নির্মোহ বিশ্লেষণ ব্লগকে তরুণ প্রজন্মের কাছে এত দ্রুত এত তুমুল জনপ্রিয় করেছে। কত শিখেছি, কত জেনেছি, কত পড়েছি। সেসব বাছাই করা লেখা দিয়ে বানানো হতো ই-বুক। শোভা পেত সে সব ই-বুক নিজের ল্যাপটপের ডেস্কটপের এক কোণায়।
প্রকাশকরাও চোখ রাখতে শুরু  করল ব্লগের পাতায়। বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চমৎকার সব লেখা লিখছেন একঝাঁক তরুণ মুখ যাদের মধ্যে ভণ্ডামি নেই, নেই মোহ। তারা জয়ের আনন্দেই লিখে চলেছেন। আমাদের মতোই আনকোরা কোনো ব্লগারের বই বের হলে আনন্দে আমাদের মধ্যে শোরগোল পরে যেত। এসএসসি’র সময় পাশের বাসার ভাইয়া ভাল রেজাল্ট করলে যেমন নিজের মধ্যেও পড়াশোনার অদম্য উৎসাহ চলে আসত, অনেকটা সেরকম। সাথে ছিল নানারকম সমাজসেবা ও সচেতনতামূলক কাজ— ব্লগাররা মিলে টাকা উঠিয়ে, শীতার্তদের বস্ত্র বিতরণ, রাজাকারদের বিচারের দাবি, যার সাম্প্রতিক আন্দোলন ছিল গণজাগরণ মঞ্চ। 
সেই একঝাঁক দুরন্ত ব্লগারদের চোখে বাংলাদেশের অযোগ্য শাসকশ্রেণি, আর ক্ষমতালিপ্সু শাসনব্যবস্থা বেঁধে দিল লাল কাপড়। ‘ব্লগার’ শব্দটি এখন ক্ষমতাসীনদের অসীম ক্ষমতার দাপটে, খুব নেতিবাচক কিছু, যাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। অকার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে কেউ লিখছেন শুনলেই অন্যেরা বাঁকা চোখে তাকায়। সেই চোখের তিন রকম অর্থ হয়—
১. ব্লগার নয় তো আবার
২. আপনাকে দেখে তো বোঝা যায় না আপনি ব্লগার
৩. আপনাকে দেখে কোনোদিন বুঝতেই পারিনি, আপনি ব্লগার
রূঢ় বাস্তবতা থেকে বিরাম নিতে যে পরিচয়টি সবচেয়ে ভালবাসার আর আনন্দের ছিল, সেটিই এখন বেদনার নীল ছোঁয়া দিয়ে যায়। 
সমাজে ব্লগারদের দুষ্কৃতকারীর ইমেজ তৈরি করে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাব কী করে? প্রতিকার চেয়ে লাভ নেই সে আমিও জানি। কিন্তু পরিত্রাণ, তাও কি পাবার উপায় নেই?
http://www.banglamail24.com/news/152100
১৮-০৫-২০১৬

No comments:

Post a Comment