সুপ্রীতিদি’র লেখা “অ্যাবিউজের শিকার হয়েছি আমি” পড়তে পড়তে
ফিরে গেছিলাম এক দশক সময়ের আগে। মেঘ কে নিয়ে তখন প্রায় দেশে যাই। বাড়িতে একমাত্র
শিশু, সবার আদরের। বাড়ির লোকজনের কোলে পিঠে তো ঘোরেই সাথে আছে বোনাস, ভাইয়ের
বন্ধুরা, বোনেদের বান্ধবীরা। মেঘ’কে দেখতে আসা “উপলক্ষ্য” করে প্রায়ই দুপুর বেলা,
সদ্য স্কুল পেরোনো ছোট বোনদের বান্ধবীরা আমাদের বাড়ি ভীড় জমাতো। দুপুরের খাওয়া
দাওয়া সেরে, ঘুম তাড়াতে হাতে গরম চা নিয়ে শুরু হত গল্প, ম্যারাথন গল্প।
তখনও এতো সব এ্যাপ, ফেসবুক এসব হয়ে ওঠেনি। তাতে কি, কখনও
কি কিছু আটকে থেকেছে? মোবাইলের “মিসড কল”
এর যুগ তখন। গল্পের মাঝে মাঝেই মাঝেই ফোন
বেজে ওঠে, স্ক্রীনে ভেসে
ওঠে নামঃ ডিস্টার্ব ১, ডিস্টার্ব ২, কুত্তার বাচ্চা ১, শুয়োরের বাচ্চা, মাঝ রাতের কুত্তার বাচ্চা। আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, এগুলো কি? বললো, নাম্বার গুলো এভাবে সেভ করে রাখলে
সুবিধা, জানা যায়, কার ফোন, ধরবে কি, ধরবে না। কোনটা থেকে দুপুরে বিরক্ত করে,
কোনটা থেকে রাতে বিরক্ত করে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেসব গল্প থেকে গল্প এগোতে এগোতে এসে থামলো, “এবিউজ” বা
“নির্যাতনে”র গল্পে। কে, কিভাবে, কোথায় কেমন করে নির্যাতনের ভুক্তভোগী। বেশী’র ভাগই
বাড়িতে হুজুরের দ্বারা, বাকি সব গৃহ শিক্ষক আর নিকট আত্মীয়ের দ্বারা। মায়েদের বললে
তারা বুঝতে পারতো না অনেক সময়, বিশ্বাস করে উঠতে পারতো না, মায়ে’রাও তখন অনেক ছোট,
অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে মা হয়েছে, সবসময় প্রতিকার করে উঠতে পারতো না। গল্পে গল্পে
দুপুর বিকেলে গড়াতো। দুপুরের ঘুম শেষ করে আম্মিও এসে বসতো আমাদের এই আড্ডায়, শুনতে
শুনতে নিজেও বলে ফেলতো, তাঁর ছোটবেলার জানা শোনা কিছু অভিজ্ঞতার কথা। কি সব অদ্ভূদ
দুপুর, বিকেল কাটতো। মধ্য চল্লিশের মা, তিরিশ ছুঁই ছুঁই আমি আর মেঘের থেকে একটু বড়
লাগতো আমার কাছে ওদের, সেই সদ্য কৈশোর পেরোনো সব বালিকা’র দল। সবাই যার যার
“লুকিয়ে রাখা কান্না”র ঝাঁপি খুলে বসতো। এমন হয়ে গেলো, বুক খালি করতেই এরপরে সবাই
গল্প মিস দিতে চাইতো না। রোজই আসতো সব এমনকি ছুটির দিনেও। বড় আপা, লেখে, তাকে
জানানো দরকার সব।
সুপ্রীতিদি’র লেখা’টা পড়তে পড়তে বেশ কয়েকবার ভাবলাম, লিখে
কি হবে? সেই শরৎচন্দ্র থেকে আশাপূর্ণা দেবী, সুচিত্রা ভট্রাচার্য থেকে তসলিমা
নাসরীন সবাই লিখে যাচ্ছেন। শরৎচন্দ্র তার বহু লেখায় লিখে গেছেন, বিধবা আশ্রিতা যখন
গর্ভবতী হতেন, তাকে ওষুধ খাইয়ে মেরে ফেলা হতো কিংবা কাশী নির্বাসনে পাঠানো হত,
এরপর তার কি হতো, তা কেউ জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। কিন্তু গৃহকর্তা থেকে
যেতেন বহাল তবিয়তে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত। নারী’রাই অচ্ছুৎ হয় চিরকাল, পুরুষে’রা না।
নারী’রা পতিতা হয় – পুরুষেরা???? আজও প্রশ্ন।
কিন্তু না লিখেই কি হবে? ঢাল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করলেই কি
সমাজ, মানসিকতা কি বদলাবে? নদী’র গতিমুখ পাল্টাতেও দশক পার হয়ে যায়। একটু একটু
বদলাতে বদলাতে কখন যে অনেকখানি বদলে গেছে সেটা অনুভব করা যায় এক-দুই দশক পরে। তাই
বরং হয়ত লেখাটাই শ্রেয়। দুই দশক আগেও হয়ত সুপ্রীতি’দি এভাবে লেখার কথা ভাবতেন না।
আমিও হয়ত আজকে এই লেখা লিখতাম না।
পুরুষের মধ্যে কেউ কেউ ধর্ষণের কাজ করে, সবাই
করে না, তবে সব পুরুষই সাম্ভাব্য ধর্ষণকারী।
- হুমায়ুন আজাদ
কিন্তু এরা অনেকেই হয়ত “সুপ্রীতি’দির লেখা
পড়ে জিঘাংসিত হয়ে যান। নিজেদের চেহারা এভাবে আয়নায় দেখতে কার’ই বা ভাল লাগে। শুরু
হয় নানা রকম ট্রল, তামাশা, কুৎসিত মন্তব্যের ঝাপ্টা।
যে সব মায়েরা এই “কাউকে না বলতে পারা”
নিদারুন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান, তারা তাদের মেয়েদের প্রতি কি নিস্করুণ রক্ষনশীল
হন, শুধু তারাই জানেন। সাত – আট বছরের বাচ্চা মেয়েটি যখন বেনী দুলিয়ে আবদার করে,
মা উঠোন পেরিয়ে দাদুর বাড়ি খেলতে যাই, ঐ মোড়ে যাই, ছাদে যাই, মা বার বার নিষেধ করে। মেয়েটি
ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানের কান্নায় ভেসে যায়। মা তাকে ভালবাসে না, খেলতে দিতে চায় না
ইত্যাদি ইত্যাদি কত চিন্তা তার ভাবনায় আসে। ঐটুকু বালিকা’কে অব্যক্ত ব্যথা মায়ের পক্ষেও বলে
ওঠা সম্ভব হয় না।
অনেক মা হার মেনে বলে, চল তোকে আমি নিয়ে
যাই।
অভিমানী গলায় মেয়ের কথা, কেন সব সময় আমি
তোমার সাথে যাবো? কেন অন্য কারো সাথে আমি যেতে পারি না।
--- এসব প্রশ্নের উত্তর জানা সত্বেও মা বলে
উঠতে পারে না ...............
https://www.youtube.com/watch?v=JBQ7NMm2faA
https://www.youtube.com/watch?v=mIiGry20tiI
No comments:
Post a Comment