Friday 22 June 2018

দ্যা সিক্রেট বাঙ্কার



http://www.banglatribune.com/lifestyle/news/335481/%E0%A6%AF%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B2%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A6%AC-%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF



শীত কেটে গিয়ে সূর্য উঠলে শুরু হয় ইউরোপে বসন্ত। আমরাও শীতনিদ্রা থেকে বের হয়ে শুরু করি ইতি উতি ঘোরাঘুরি। বন্ধুদের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম পাশের দেশ জার্মানীর সবচেয়ে গোপনতম বাঙ্কারটি দেখতে যার অফিসিয়াল নাম  "Dokumentationsstätte Regierungsbunker"  জার্মানী'র বন শহর থেকে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দক্ষিনে আহর (AHR) পাহাড়ের উপত্যাকায় Ahrweiler এবং Dernau এই দুই শহরের মাঝখানে এর অবস্থান। "কোল্ড ওয়ার" এর সময় এটি নির্মিত হয়, জার্মান সরকার, সংসদ সদস্য, উচ্চ পদস্থা সরকারী কর্মকর্তা'রা যেন জরুরী অবস্থায় কাজ চালিয়ে যেতে পারে সে উদ্দেশ্যে জার্মানীর সর্বকালের গোপনতম এই বাঙ্কারটি তৈরী। গোটা পৃথিবীর কাছে জার্মানী’র লুকিয়ে রাখা একটি গোপনতম সত্যি ছিলো এটি।

ন্যাটো এবং ওয়ার্শাও প্যাক এর বিরোধিতায় আনবিক যুদ্ধ যখন আসন্ন, রাজধানী বন হতে পারে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থল তখন আনবিক বোমার ভয়ে জার্মান'রা পরিকল্পনা করলো আনবিক বোমা থেকে বাঁচার জন্যে আশ্রয়স্থল  নির্মান করবে। সেখান থেকে বাকি রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনা করবে। উনিশো পঞ্চাশ সালের দিকে বাঙ্কারটি তৈরীর পরিকল্পনা শুরু হয়। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী কর্নাড আডেনাওয়ার আর জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এই পরিকল্পনা করেছিল। বছর ধরে একটা ভাল আর উপযুক্ত জায়গা খোঁজাখুঁজি করার পর বনের খুব কাছেই কিন্তু আবার শহর নয়, উপশহরও ঠিক নয় Bad Neuenahr এর কাছে Ahrweiler এই  Ahrtal এই জায়গাটি তাদের পছন্দ হয়। তারা ভাবলো শত্রুরা কখনো এত পল্লী জায়গায় বোমা ফেলার কথা ভাববে না। কখনো কাজ শেষ না হওয়া দুটো রেললাইন ছিলো এই বাঙ্কারটি তৈরীর প্রাথমিক উপাদান। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না বলে রেললাইনটি কখনো চালু করা হয় নি। প্রথমে এতে মাশরুম চাষ হয়েছিল পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে কিছু অস্ত্র তৈরীর কারখানা এই টানেলটি দখল করে তারও পরে Lager Rebstock (Camp Vine) এই কোড নাম দিয়ে রাজনৈতিক বন্দীদের দিয়ে জোর করে এর রক্ষনাবেক্ষণের কাজ করানো হত।  

রেললাইন থেকে শুরু করে একশ দশ মিটার মাটির নীচে আসে বাঙ্কারটি'র প্রবেশ পথ। উনিশো বাষট্টি সালে কাজ শুরু হয়ে, টানা নয় বছর চলে রিগিয়ারুংস বাঙ্কারটি'র কাজ, উনিশো একাত্তর সালে এটি সম্পূর্ণ হয়। সতের দশমিক তিন কিলোমিটার দৈঘ্য'র এই বাঙ্কারটিতে স্বাভাবিকভাবে নয়শ ছত্রিশ জনের ঘুমের ব্যবস্থা আর আটশো সাতানব্বইটি অফিস রুম আছে, দরজা’র সংখ্যা পঁচিশ হাজার। জরুরী অবস্থায় বাইরের পৃথিবী’র সাহায্য ছাড়া তিন হাজার মানুষ যেনো অন্তত ত্রিশ দিন বেঁচে থাকতে পারে সেরকম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভারী স্টিলের পাত দিয়ে বানানো দরজাগুলো মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেনো পৃথিবী থেকে বাঙ্কারটিকে আলাদা করে ফেলতে পারে সেভাবেই এটি তৈরী। তাজা বাতাস, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা সহ এই বাঙ্কারটি তৈরীর ব্যয় ধরা হয়েছিল তিন বিলিয়ন ডয়েচ মার্ক যদিও শেষ পর্যন্ত কত খরচ হয়েছিলো প্রচন্ড গোপনীয়তার কারণে কেউ তা আজও জানতে পারে নি   
মানুষজন যেনো মাটির নীচে নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে কাজকর্ম করতে পারে ও বসবাস করতে পারে তার জন্যে যত ধরনের সুযোগ সুবিধা দরকার তার সব কিছু'র ব্যবস্থাই এখানে আছে। ডাক্তার চেম্বার ও রোগী দেখার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, দাঁতের ডাক্তার, চুল কাটার সেলুন, বিয়ার খাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরাট এই স্থাপনা হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে আমরা বেশ ক্লান্ত হলাম বাইরে তাপমাত্রা বিশের ঘরে থাকলেও বাঙ্কারটি'র তাপমাত্রা সবসময় বারো ডিগ্রী সেলসিয়াসে রাখা হয়, হালকা জ্যাকেট গায়ে রেখেও বেশ শীত শীত লাগছিলো।

শীতল যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক দিন পর পর্যন্তও এই বাঙ্কারটির কথা জনগনকে জানানো হয় নি। তিন শিফটে পালা করে একশ আশি জন কর্মী বাঙ্কারটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করত। হিরোশিমা’র সমপরিমান মানে বিশ কিলোটন বোম ব্যবহার করলে এটি ধ্বংস করা যেতো। এটি জানা সত্বেও রাজনৈতিক কারণে এটিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যখন জার্মানরা মোটামুটি যুদ্ধের আর প্রয়োজন হবে না বলে নিশ্চিত হলো তখন তারা জনসম্মুখে বাঙ্কারটি'র কথা প্রকাশ করলো। দুই হাজার এক সাল থেকে দুই হাজার ছয় পর্যন্ত আস্তে আস্তে বাঙ্কারটি ধ্বংস করতে শুরু করলো তারা। তাদের যুদ্ধ দিনের আশ্রয়স্থলের একটি অংশকে তারা যাদুঘরে রুপান্তর করেছে, যার নাম Dokumentationsstätte Regierungsbunker এক পাশের খুব সামান্য অংশই খোলা হয়েছে জনগনের জন্যে বাকি কিছুটা পরিত্যক্ত আর অনেকটাই সীল মোহর করে দেয়া হয়েছে। তাই চাইলেও পুরো সত্য জানার উপায়  কারো নেই।

দুই হাজার আট সালে রিগিয়ারুংস বাঙ্কারটি জনসাধারণের দেখার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। জার্মানীর ইতিহাসের সবচেয়ে গোপনতম বাঙ্কারটি হয়ে উঠলো দর্শনার্থীদের ঐতিহাসিক দর্শন স্থান। জার্মানীতে এটি বেশ  চিত্তাকষর্ক দর্শনীয় স্থান। একটি বিপুলাকৃতির স্থাপনা, যার অসংখ্য প্রবেশদ্বার, অসংখ্য যন্ত্রপাতি, নানা ধরনের বৈদ্যুতিক কার্য কলাপ, বের হবার দরজা কি নেই সেখানে। সব কিছু দেখতে পাওয়া যাবে এক জায়গাতেই। অবাক বিস্ময়ে দেখতে হয় আনবিক যুদ্ধের সময় নিজেদেরকে বাঁচাবার র যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জার্মান সরকারের কি বিশাল প্রস্তূতি ছিলো।

গাইডের মুখে শুনতে পেলাম, বার্থ ডে পার্টি, পিজামা পার্টি, অফিসিয়াল ডিনার, কনফারেন্স এর কাজে এখন বাঙ্কারটিকে ভাড়া দেয়া হয়।

বাঙ্কারের পাশেই দর্শনার্থীদের জন্যে চা,কফি, বিয়ার কিংবা ছোটখাট স্ন্যাক্স খাওয়ার জন্যে ফ্রাইস, হট ডগ ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। ঠান্ডা থেকে বের হয়েই সাথে সাথে গরম গরম জার্মান ফ্রাইস আর কফি খেলাম তার সাথে বন্ধুরা মিলে আড্ডা তো আছেই।

বাঙ্কারটি দেখা শেষ কিন্তু ফিরে আসবো? কিছুতেই নয়। ভ্যালিটি অত্যন্ত মনোরম, হেঁটে চলার পথের সাথে আছে গাড়ি চলার পথও। বেশির ভাগ পর্যটকই অবশ্য হেঁটে চলার পথটি দিয়ে আঙ্গুর বাগান, আপেল বাগানের মাঝ দিয়ে একদম চূড়োতে চলে যান, সাথে আছে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, চোখ ফেরানো দায়। আমরাও হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। অনেক ওয়াইন কোম্পানী তাদের লোগো বসিয়ে রেখেছে আঙুর বাগানে আবার অনেক  আপেল কোম্পানী তাদের প্যাকেট সাজিয়ে রেখেছে তাদের আপেল বাগানে, হাঁটতেই হাঁটতেই দেখতে পেলাম যে কোম্পানীর জুস খাই তার আপেল কোথা থেকে আসে।

ভ্যালি'র ওপর থেকেই দেখতে পাওয়া যায় সুন্দরতম Ahrweiler শহর,  Ahr নদী'র কিছু অংশ আর অপরূপ কারুকাজ করা Ahrweiler এর টাউন হল, চার্চ ইত্যাদি। না দেখে ফিরে আসা মহা অপরাধ সমতূল্য। পুরো একটি দিন ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম বন্ধুদের নতুন কেনা ডেরায়। সারা সন্ধ্যে তুমুল আড্ডা আর গান-কবিতার আসরের মাঝেও বার বার মনে উঁকি দিয়ে গেলো “দ্যা সিক্রেট বাঙ্কার”

তথ্যসূত্রঃ অন্তর্জাল



No comments:

Post a Comment