কার্ড খেলা শিখেছিলাম
আব্বু’র কাছে বেশ ছোট বয়সে। তবে প্রথমে আব্বুকে
“প্রমিজ” করতে হয়েছিলো, কখনো কোথাও টাকা দিয়ে কার্ড খেলবো না। আমাদের স্কুল-কলেজ
তথা পুরো ছাত্র জীবনই কেটেছে, হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও এর মাঝে। শহুরে মধ্যবিত্তের
মাথায় তখনও এপার্টম্যান্ট ব্যাপারটি সেভাবে গেঁথে যায় নি, তাই এই শহরে তখনও ইট কাঠের দালান ভেদ করে ঐ আকাশ দেখা যেতো। ঢাকা’র সেন্টার
পয়েন্টে বাড়ি বলে ছাদে উঠলেই ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজের
ছাত্রদের রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, টিয়ার শেল মারা, কি তুমুল উত্তেজনা, সবই শুধু চোখে দেখা
যেতো। একমাত্র বিনোদন ছিলো বোকা সরকারী টিভি’তে ফিল্টার করা খবর,
ভিসিআর আর পরে এসে ডিশ যোগ হলো আর এর বাইরে ছিলো বই। রাস্তার পরিস্থিতি
সব সময় বাসা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া’র অনুকূলে থাকতো না বলে
কার্ড খেলা শিখিয়ে দিয়ে আব্বু’র তেমন কিছু লস হয় নি। আব্বু’রও সময় আমাদের সাথে ভালই কাটতো।
আমাদের সময়
গড়পড়তা মধ্যবিত্ত জীবনে “মেয়ে মাইনষের কার্ড” খেলাকে যারপর নাই ঘৃণা’র এবং
তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হত। একদল কাজিন খেলতো আর একদল কঠোর “গুনাহ” এর দৃষ্টিতে
দেখতো। আমাদেরকেও ঠারে ঠুরে কথা শুনতে হয়েছে, “কি
জানি (একটা লম্বা নিশ্বাসের পজ হবে) তারপর
এখনই কেয়ামত হয়ে মাথায় আকশ ভেঙে পরবে এই রকম উদাসি সুরে টেনে টেনে খানিকটা নাকে আর
খানিকটা গলা দিয়ে বলা হতো, “কিয়ের জানি কি দিনকাল পরছে, কি
জমানা আইছে গো, মাইয়ারা বলে টাসটুস খেলে”। এই কথাগুলো শুনেছি আমরা পরিবারের একান্ত
আপনজনদের কাছ থেকে, এক হাত দূরত্বের মাঝে থেকে। শুধুমাত্র স্বয়ং আব্বু আর ভাইয়া এতে সরাসরি জড়িত
ছিলো বলে আমাকে বা আমাদেরকে “ক্রসফায়ার”এ দেয়া হয় নি। আমি আজও ভেবে পাই না, আমাদের
সংস্কৃতিতে মেয়েদের যেহেতু বাসা থেকে বেরোনো’র সমস্যা, কার্ডের মত একটা বুদ্ধির
খেলায় তাদের এত নেতিবাচক মনোভাব কেন? এরমধ্যে পাপপুণ্য কোথায় জড়িত? অল্প টাকায় আর অল্প জায়গায় যে কোন জায়গায় লুডু’র মত এটিও খেলা
যায়। তবে অনুমান করতে পারি, ক্লাব ব্যাপারটা আমাদের দেশে খুব নেতিবাচক ভাবে
উপস্থাপণ হয় নাটক, সিনেমা কিংবা মিডিয়াতে, ক্লাব মানেই এলকোহল আর কার্ড, সুতরাং এ
জিনিস মানষের চেতনায় খারাপ ভাবে আঁকা হতে বাধ্য। বাজে দিকও অবশ্য আছে, যখন প্রথম দিকে খেলার খুব নেশা, বান্ধবীরা মিলে ক্লাশ
ফাঁকি দিয়ে খেলতাম, প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কাছে ধরাও খেয়েছি,
সেসব কত কথা।
বাসায় সবাই মিলে
যখন খেলতে বসতাম, মানে, আমি, আব্বু, ভাইয়া আর সুমি তখন
দুটো খেলা বেশি খেলতাম, স্প্রেডসট্রাম বা কল ব্রীজ আর ব্রে। কল ব্রীজে
চ্যালেঞ্জ কম, ক্রিকেটের মত, ভাল কার্ড হাতে এলে ছক্কা মারা যায় আর মন্দ কার্ড
হাতে এলে পিটিয়ে খেলে এক দুই রান যা তোলা যায় আর কি। ব্রে হলো একটু চ্যালেঞ্জিং, ফুটবলের
মত, গোল খেলেই হারলে, যত গোল
খেলাম মানে পয়েন্ট পেলাম ততই ব্রে হলাম। পয়েন্ট পাওয়া মানেই
বোকা। হাতের কার্ড যত ফেলে দেয়া যায় মানে যত অন্যকে গছিয়ে দেয়া যায় সেটা হলো এই খেলার মুন্সীয়ানা। কার্ড খেলা
মোটামুটি আয়ত্বে এসে গেছে, কি করে কার্ড গুনতে
হয়, কার হাতে কি কার্ড আছে কি করে ধারনা করা যায়, কে কিভাবে সাজাচ্ছে অনুমান করতে
শিখে গেছি, দেখা যেতো অনেক সময় ভাগ্যই অনুকূল থাকতো না। এমন সব কার্ডই হাতে এমন আসতো
যে সব বুঝেও হার মেনে নেয়া ছাড়া কিংবা খেলার দিক পরিবর্তন করার কোন সুযোগই আসতো
না। বাস্তব জীবনে বহু পরিস্থিতি, আমাকে এই কার্ড খেলা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে,
পরিবেশের কাছে মাঝে মাঝে আমরা কতটা অসহায়। সব জেনে বুঝেও ধৈর্য্য ধরে খেলাটা খেলে
যেতে হয়, সময়ের অপেক্ষায়। আবার এমনও হয়েছে উচ্চাভিলাষী হয়ে কিংবা
আনমনে দুটো দান ভুল খেলেছি, সেই যে গেইমটা হাত থেকে চলে গেলো, আর কিছুতেই রিকভার
করতে বা সামাল দিতে পারলাম না। যা হারালো তা হারালোই, ফিরে পাওয়া গেলো না।
এরকম সময়ে
খুব সর্তক হয়ে যেতাম, বার বার ভাবতাম, কার্ড দিতে খুব হিসেব করতাম, সময় নিতাম।
আব্বু মজা করে বলতো, এত দেরী কর কেন, খেলো খেলো, খেললেই পাবে, চাললেই পাবে। খুব
রাগ হত, অনেক রেগে যেতাম, আমি হেরে যাচ্ছি আর আব্বু মজা পাচ্ছে। এখনও সে আগেরই মত জীবন
ভর নানা খেলায় শুধু আমি হেরেই যাচ্ছি, কত ভুল হয়ত বুঝতে পারি কিন্তু সংশোধনের
সুযোগ জীবন আর দেয় না। তবুও টিকে থাকার লড়াইয়ে খেলে যেতে হয়, হরদম খেলে যেতে হয়। আব্বু’র
মজা করে, হেসে, দুষ্টুমি করে বলা কথা গুলোও এখন কত গভীর অর্থ নিয়ে ধরা দেয়।
তবে, আব্বুর
একটি কথা আজও রেখেছি, পয়সা দিয়ে কখনো কারো সাথে কার্ড খেলিনি। বড় কারণ অবশ্য কেউ
কখনো অফারই করেনি, তাই নিজেকে পরীক্ষা করাই হয়ে ওঠেনি।
বাবা দিবসের
অনেক অনেক শুভেচ্ছা আব্বু, লাভিউ আব্বু (সামনাসামনি তো কখনো বলে উঠতে পারি না,
লেখা পড়েই আপনি জেনে নিন)
পৃথিবীর সব ভাল বাবা,
দুষ্ট বাবা, মিষ্টি বাবা, পঁচা বাবাদেরকও বাবা দিবসের অনেক অনেক
অভিনন্দন। আর যে সকল মায়েরা বাবা এবং মায়ের দুটো দায়িত্ব বিপুল বিক্রমে পালন করছো সে
সব কমরেডদের লাল স্যালুট।
০৬/০৬/২০১৮
No comments:
Post a Comment