Tuesday 4 January 2011

সেন্ট মার্টিন (দুশো বছর পরে) {শেষ পর্ব}

খাওয়া দাওয়া শেষ করে একদল যাবেন ডিস্কোতে। সেখানে স্প্যানিশ, ল্যাটিন, হিন্দী, ইংরেজি গানের সাথে থাকবে কিছু লোকাল নাম্বার। সেন্ট মার্টিনকে ঘিরে বানানো। এল আর বি কিংবা দলছুটের বানানো ওওও উই আর গোয়িং টু সেন্টমার্টিন, কিছু থাকবে র‍্যাপ আর রিমিক্স। ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা কিংবা রুপবানে নাচে কোমড় দুলাইয়া। আর যারা নাচতে ভালোবাসেন না তাদের জন্য আছে ঝলমল আলো সজ্জিত ক্যাসিনো। সুন্দরী মেয়েরা সেখানে বসে থাকবেন আর চলবে সারা রাত গেম্বলিং। জ়্যাকপটের আশায় অনেকেই মন উজার করে খেলবেন, কেউ পাবেন কেউ পাবেন না। যারা প্রকৃতির খুব কাছে থাকবেন, অন্যকোন কিছুই তাদের চাই না তারা ক্যাম্প ফায়ার করে তার পাশে গোল হয়ে আকাশের চাঁদকে প্রেয়সী করে কবিতা লিখবেন। সেই আলো আধারিতে রাত যখন ভোরের দিকে যাবে সবাই হোটেলের দিকে ফিরবেন। বিছানায় গড়িয়ে প্রস্তূত হবেন পরের দিনের জন্যে। এতো কিছু করার আছে এখানে।

সকাল হতেই একদল বেড়িয়ে পড়বেন ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ কিংবা নিঝুম দ্বীপের সন্ধানে। বাহন থাকবে ওয়াটার ট্যাক্সী কিংবা সাম্পান। ছেঁড়াদিয়া দ্বীপের অনেকটাই সংরক্ষিত এলাকা। সমস্ত প্রবালে সবার মাড়ানো নিষেধ। পর্যটকরা নিজেরাও এব্যাপারে মারাত্বক সচেতন, ভবিষ্যতের জন্য সব বাঁচিয়ে রাখতে হবেতো। তবে কিছুটা এলাকা পায়ে হেটে দেখতে পারেন। আর বাকিটা দূর থেকে সবাই দেখবেন। এই দ্বীপে দুটো মাত্র স্যুভেনীয়’র শপ। তাতে নানা ধরনের প্রবাল পাওয়া যায় হ্যালো সেন্টমার্টিন কিংবা ওয়েলকাম টু ছেঁড়াদিয়া লিখা। প্রবালের টুকরো লাগানো ওয়ালপ্লেট, চাবির রিং ইত্যাদিও আছে। আর আছে চা-কফি, সামান্য স্ন্যাকস, রেষ্ট রুম পর্যটকদের সুবিধার জন্যে। গরমের দিনে আরো থাকে ঠান্ডা ডাব, কোক, আইসক্রীম। দ্বীপের মধ্যে বড়ো একটা টাওয়ারের মতো আছে। সেখানে চারপাশ দেখার জন্যে বড় বায়নোকুলার টাইপ মেশিন গুলো বসানো আছে। যেগুলোতে পাঁচশো টাকার কয়েন ফেলে চারদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমুদ্রের ও আশপাশের প্যানারোমা শোভা দেখা যাবে। শপগুলোর পাশে পাশেই আছে কোন ইঞ্জিনিয়ার / আর্কিওলজিষ্ট কবে কি ডেভেলাপ করেছেন, কতো সালে কোন কাজ শুরু করেছিলেন, তাদের মূর্তি ও তাদের জীবনী। সমুদ্রের - বাংলাদেশের আগের ও পরের ল্যান্ডস্কেপ, কে কবে কি উদ্বোধন করেছেন তার ছবি ও বিবরন দেয়া বিরাট বিরাট ফলকখানা। পর্যটকরা শটাশট এগুলো তাদের ক্যামেরায় বন্দী করতে শাটার টিপবেন।

ছেঁড়াদিয়া থেকে অনেকেই নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন। যদিও নিঝুম দ্বীপে ঢোকার প্রবেশ মূল্য অনেক কিন্তু এতোটা দূর যখন এসেছেনই এতোটা পয়সা খরচ করে তখন দেখে যাওয়াই যাক। এতো নাম শুনেছেন এই দ্বীপটির। পুরো দ্বীপটিই যেনো অভয়ারন্য। হরিণ, বানর আর শীতকাল হলেতো কথাই নেই নানা রকম নাম না জানা অতিথি পাখির ভীড়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখানে খুবই সজাগ। কোনরকম শব্দ দূষন করে এখানকার পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। দূর থেকে ছবি তোলা যাবে। তবে হরিণ – বানরের সাফারী ট্যুর খুবই দামি। সেফটি লকের গাড়িতে করে একসাথে দশজনের সাফারি কার যায় ঘন্টায় একটি। কিছুটা এলাকা উন্মুক্ত আছে বিনে পয়সায় দেখার জন্যে। পর্যটকরা তাতেই খুশি। কতোবার কতো সিনেমার দৃশ্যে এই জায়গাগুলো দেখেছেন তারা আর আজ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য ঘটেছে। বিরাট নীল সমুদ্রের পাশে বিস্তৃর্ন জুড়ে সবুজের মেলা। তাতে অবাধে চড়ে বেড়াচ্ছে নির্ভয় হরিণের দল, গাছে গাছে দুষ্ট বানর আর নাম না জানা পাখির কিচির মিচির। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে আর কি চাই?

এখানের ভ্রমন শেষ করে অনেকেই ছুটবেন আকুয়া ডাইভিং, বানজি জ়াম্পের জন্যে। অনেকদিন ধরে তারা অপেক্ষায় আছেন। প্রথম দশ মিনিট ট্রেনিং আনাড়িদের জন্যে তারপর খেলা। কেউ কেউ সার্ফিং ও সেইলিং করতে পারেন। যারা এ্যাক্টিভ কিছুতে আগ্রহী না তারা বীচে যেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছেন। কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা যাদের সাথে থাকবেন তাদেরতো সেই সুবিধে নেই। তারা বাচ্চাদের নিয়ে লাইভ একুরিয়াম দেখতে যেতে পারেন। সেন্ট মার্টিনের একটা পাশ জুড়ে আছে লাইভ একুরিয়াম প্লাস মিউজিয়াম। আলাদা টিকেট কাটলে দাম বেশি আর দুটোতে ঢুকার টিকিট একসাথে কিনলে একটু সস্তা। একুরিয়ামে বড় বড় তিমি, হাঙর এসে এমন ভাবে দেয়ালে তাদের লেজ দিয়ে মারবে যে মনে হবে এখুনি সব ধসে যাচ্ছে। আসলে কিছুই না, বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্যে শব্দ আর আলো দিয়ে এধরনের পরিবেশ বানানো হবে। ছোট ছোট গ্লাস দেয়া জায়গায় রঙীন সব মাছেরা তাদের লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে ভেসে বেড়াবে। অবাক চোখে শিশুদের সাথে তাদের বাবা মায়েরাও নাম না জানা এতো মাছ প্রথম বারের মতো চাক্ষুস চোখে দেখবেন।

মিউজিয়ামে আছে বিলুপ্ত সব মাছের মমি ও ছবি। কিছু থাকবে মাছের কাঁটা, কঙ্কাল, দাঁত। আর থাকবে বিলুপ্ত সব মাছের ইতিহাস ও বিলুপ্ত হওয়ার কারন। মিউজিয়াম দর্শন শেষ হলে অবশ্যই সমুদ্র স্নান। তরুন তরুনীরা হয়তো ন্যুড বীচে বাকিরা ফ্যামিলি বীচে। জলকেলী শেষ হলে তাজা মাছের বাহারে আহার। একটু গড়াগড়ি করে রোদের তেজ কমলেই যেতে হবে সেন্টমার্টিনের এ্যাট্রাকশন পার্কে। রোলার কোষ্টারে চড়লে নাকি দ্বীপের এ মাথা ও মাথা সবটাই দেখা যায় আর চড়কিতেতো কথাই নাই। দারুন দারুন জিলিপী ভাজা পাওয়া যায় সেখানে সাথে নানা ধরনের মুরালী, কদমা। এতো দূরতো সহসা আসা হবে না, তাই পার্কের মজা না নিয়ে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। পার্কটি এভাবে সাজানো যে ফটোগ্রাফীর আর্দশ স্থান। সুন্দর সুন্দর সব ছবি তোলা যায় এখানে।

শেষ সন্ধ্যেটি কাটবে নানা ধরনের উন্মাদনায়। যেতে ইচ্ছে করবে না অপার সৌর্ন্দযকে ছেড়ে কিন্তু জীবিকা ইচ্ছের বিরুদ্ধে টেনে নিয়ে যাবে। স্যুটকেস গোছাতে হবে সাবধানে। বেরোবার মুখে কঠিন চেকাপ। দ্বীপ থেকে অবৈধভাবে প্রবাল, রঙীন মাছ কিংবা হরিনের চামড়া জাতীয় কিছু ব্যাগে পাওয়া গেলে সাথে সাথে জরিমানা ও জেল। এধরনের চিন্তা অবশ্য সাধারণ পর্যটকদের মাথায় নেই। তারা জীবনের অন্যতম সুন্দর দুটো কিংবা তিনটে দিন এখানে কাটিয়ে তাজা ভালো লাগা মাথায় নিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হবেন।

তানবীরা

০৪.০১.২০১১

No comments:

Post a Comment