Thursday 6 January 2011

অহনার অজানা যাত্রা (নয়)

সরকারী এজেন্সি থেকে বাড়িভাড়া নেয়া যতো সোজা হবে ভেবেছিলো অহনা, দেখা গেলো ব্যাপারটা ততো সোজা আসলে না। সরকারের বাড়ি ভাড়া যেহেতু সরকারের ধারনা ন্যায্য, সেটা পাওয়ার জন্য লাইনও অনেক লম্বা। আর ওলন্দাজ অর্থনীতি আর সমাজনীতির মূল মন্ত্র হলো দুর্বলকে রক্ষা করো, আর সেটা করবে কারা, সবলরা। যাদের ট্যাক্সেবল বেতন গড়পড়তা বেতনের চেয়ে অনেক বেশি তারা কখনোই সরকারের বাড়ি ভাড়া নেয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন না। বেতনের উল্লেখ করাই আছে, কতো টাকা বেতন অব্ধি লোক বাড়ি ভাড়ার আবেদন করতে পারবেন এবং কে কোন ধরনের বাড়ির জন্য আবেদন করতে পারবেন। দেখা যায়, একজন নিম্ন আয়ের টার্কিশ কিংবা মরোক্কান ভদ্রলোক যার পাঁচখানা সন্তান আছে, সে আরামসে সরকারের কাছ থেকে একটা ছয় বেডরুমের বাসা নিয়ে আছে। আর একজন মাঝারি কিংবা উচ্চ আয়ের ডাচ ভদ্রলোক যার দুটি বাচ্চা, তিন রুমের একটা ছোট বাসায় আছে। মজার ব্যাপার হলো, তার যেহেতু পাঁচটি বাচ্চা, তার খরচ বেশি তাই সে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করবে কম, সরকার তাকে এইখাতে ভর্তুকী দিবে আর যার বাচ্চা কম তার কাছ থেকে সরকার বেশি ভাড়া আদায় করবে। মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তরা বাড়ি ভাড়া নেয়ার থেকে কেনায় বেশি আগ্রহী, তাহলে সরকার থেকে কিছুটা আয়কর মাফ পাওয়া যায়। তাই সরকারের কাছে সেই রেঞ্জের বাড়ির সংখ্যাও কম ভাড়ার জন্য।

এদেশে একারনে বিদেশীদের মধ্যে বাচ্চা নেয়ার প্রবনতা অনেক বেশি। ধরতে গেলে বিনা পয়সায় বিরাট একটা বাড়িতে থাকতে পায়। যাতায়াত, স্কুল, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রে সরকারের অনুদান পায়। বছরের শেষে ইনকাম হিসেব হয় তখন আরো অন্যান্য বাড়তি খরচের খাত প্রমান করতে পারলে, ইনকাম ট্যাক্সের একটি অংশ সরকার থেকে তারা ফেরত পায়। প্রতিটি বাচ্চা জন্মের পর সরকার এখানে বাচ্চাদের মাথা পিছু একটা মাসিক খরচ দেন, আঠারো বছর পর্যন্ত। বাচ্চার বয়স যতো বাড়ে, পয়সাও ততো বাড়ে। ডাচেরা যেহেতু উন্নত জীবন যাপন করেন, বাচ্চাদের পয়সা তারা বাচ্চাদের পিছনে খরচ করেন, রেষ্টুরেন্টে যান বাচ্চাদের নিয়ে, এ্যমুউজমেন্ট পার্কে যান, সিনেমায় যান, ভ্যাকেশনে যান, বাচ্চাদের নানা রকম দামী আধুনিক খেলনা কিনে দেন। কিংবা বাচ্চাদের নানা রকম এক্টিভিটিজের জন্য পয়সাটা খরচা করেন, সাঁতার শেখানো, হর্স রাইডিং, ড্রয়িং, মিউজিক কিংবা ডান্স। সরকারের ভর্তুকির পয়সায় তাদের কিছুই হয় না। উলটো নিজের পকেট থেকে একটা বড়ো খরচা বেরিয়ে যায়। আর বিদেশীরা সে পয়সাটা জমিয়ে দেখা যায় নিজ দেশে বাড়ি বানান বা ফ্ল্যাট কিনেন। অবৈতনিক শিক্ষার বাইরে খুব কম বিদেশীকেই দেখা যায় পয়সা খরচ করে বাচ্চাদের কিছু শিখাতে। ভারতীয়রা এখাতে বেশ পয়সা ব্যয় করেন কিন্তু মুসলমান বিদেশীরা সাধারণত অবৈতনিক মসজিদ আর স্কুলের বাইরে খুব একটা আগ্রহ দেখান না।

ওলন্দাজ নীতি মেনে অহনার বাড়ি ভাড়ার লাইনও আর শেষ হয় না। দিনরাত সে অপেক্ষায় থাকে কখন একখানা চিঠি আসবে। কিন্তু কোন খবর নেই। অহনার বাড়ি ভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে বাড়তি অনেক কিছু করার স্বপ্ন বাসি ফুলের মতো শুকিয়ে আস্তে আস্তে মুচমুচে হওয়ার পথে রওয়ানা দিলো। আবার বিষন্নতা ভর করতে লাগলো। বড়োই আটপৌঢ়ে জীবন এখানে। কাজ করো খাও, ঘুমাও আবার কাজে যাও। স্কুলে নানান জাতির লোকজন আসে। তাদের কারো সাথে একদিন বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গে আলাপ হতে, সে অহনার বোকামিতে খুবই অবাক হলো। সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠাতে গেলে এজীবনে সম্ভব না তার ইঙ্গিত দিয়ে সে বেশ কয়েকটা বাঁকা বুদ্ধি দিলো তাড়াতাড়ি ঘি খাওয়ার জন্যে। তার কাছ থেকে সে জানতে পেলো, সাধারন লিষ্টের বাইরে হাউজিং কোম্পানী একটি প্রায়োরিটি লিষ্ট মেইনটেইন করে। যাদের ইমার্জেন্সী বাড়ির প্রয়োজন তাদেরকে তারা আলাদাভাবে বিবেচনা করেন। যেমন, ডিভোর্স হচ্ছে এধরনের যুগল, প্রেগন্যান্ট যুগল, মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি বলে যদি ডাক্তারের সার্টিফিকেট আদায় করে জমা দেয়া যায় তাহলে দ্রুত একটা হিল্লে হওয়ার সম্ভবনা আছে। প্রায়োরিটিতে আসার পদ্ধতি শুনে অহনার কালো মুখ আরো জাম কালো হয়ে গেলো। ডিভোর্স বা প্রেগন্যান্সীর সম্ভাবনা আপাততঃ নেই আর অন্যান্য চোট্টা পদ্ধতি অবলম্বনে অর্ন কতোদূর রাজি হবে কে জানে। অহনা সাধারণ জ্ঞানে জানে অর্ন চুরির রাস্তায় হাটার লোক না।

অর্ন প্রথমে হাসলো অহনার স্কুল থেকে নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ন সব তথ্য শুনে। সে খুবই ধীর স্থির, সহসা কোন কিছু নিয়ে অস্থির হওয়ার মানুষ সে না। বউকে বললো, এসব চিন্তা ছাড়ো। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। নিজেকে তৈরী করো সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। বাড়ি যখন আমাদের নাম্বার আসবে তখনই পাবো, নইলে দুজনে মিলে যখন আয় করবো তখন তোমার পছন্দের বাড়ি কিনে নিবো। শুরুতে সবারই অনেক কিছু নিয়ে সমস্যা হয় কিন্তু আস্তে আস্তে সেগুলো সবারই ম্যানেজ হয়ে যায়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির আলোকে আপাত হিসাবে গড়পড়তা মধ্যবিত্তের চেয়ে বেশি স্বচ্ছলতায় ব্যবসায়ী পরিবারে বড়ো হওয়া অহনার পক্ষে কোন কিছু নিয়ে পরিকল্পনা করে ধৈর্য্য ধরে তার প্রতি আগানো একটা নতুন শিক্ষা। এ সম্পর্কে তার কোন ধারনাই নেই। চাহিবা মাত্র হাজির হওয়া আবহাওয়ার মানুষ সে জ়ানেই না কি করে কোন কিছুর জন্যে ধৈর্য্য ধরতে হয়। সে কিছুটা ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো যা অর্নকে বিরক্ত করলো। এতো অস্থির কেনো অহনা সেটা অর্নও বুঝতে পারে না। বাড়ি যখন হবে তখন হবে আর লন্ডন, প্যারিস কিছুতো পালিয়ে যাচ্ছে না। সবেতো জীবন শুরু হলো দুজনের। চুপচাপ পড়াশোনা করা আর ঘর সংসার করায় সমস্যা কি সেতো খুঁজে পায় না।

এরমধ্যে ঘুরতে ঘুরতে অহনার জন্মদিন এলো। সিনেমায়, নাটকে, গল্পের বইতে অহনা বউদের জন্মদিনে স্বামীদের সারপ্রাইজ দেয়ার অনেক ধরনের সিকোয়েন্স দেখেছে। মনে মনে তার প্রথম জন্মদিনে অর্নের কাছ থেকে সেধরনের কিছুই সে আশা করে রেখেছে। কিছুদিন আগেই অর্নের জন্মদিনে অহনা তার সাধ্যমতো ফুল, কেক, উপহার আর রান্না বান্নার সারপ্রাইজের চূড়ান্ত করেছে। জন্মদিনের দিনে দেখা গেলো কারো কিছুই মনে নেই। অর্ন স্বাভাবিক ভাবেই সকালে ঘুম থেকে ওঠে অফিসে গেলো এবং আর কোন খবর নেই। অনেকক্ষণ সে অপেক্ষায় থাকলো এই বুঝি অর্নের তরফ থেকে কিছু হলো কিছু হলো কিন্তু না, কিছুই না। তারজন্যে বছরের এই অত্যন্ত বিশেষ দিনটি খুবই সাধারণভাবে ঘড়ি টিকটিকিয়ে কেঁটে যেতো লাগলো মূহুর্ত, মিনিট আর ঘন্টা। অনেকদিন থেকে আঁকা স্বপ্নের এমন চুরচুর পতন অহনাকে মানসিকভাবে টুকরো টুকরো করে ফেললো। বিছানায় শুয়ে কেঁদে কেঁদে বিছানার বালিশ চাঁদর ভিজিয়ে ফেললো সে। আর কাকে বলবে সে এই কষ্টের কথা? লজ্জা আর অপমানের কথা? রাগে যন্ত্রনায় কাঁপতে কাঁপতে অত্যন্ত সাদামাটা কিছু রান্না করলো, অর্ন এলো খাওয়া দাওয়া হলো। অর্ন খেয়ালও করলো না খাবারের মেন্যু কেনো এতোটাই সিম্পল আজকে। সন্ধ্যের দিকে বাংলাদেশ থেকে অহনার বোনেরা ফোন দিলো। তারা প্রথমে ফোন করতে পারছিলো না আব্বু বাসায় এসে লাইন বুক করতে হবে পরে ভাবলো আরো একটু দেরি করি, অহনা অর্ন নিশ্চয় বাইরে খেতে টেতে গেছে।

ফোন প্রথমে অর্নের হাতেই পড়লো। অহনার বোনেরা ফোন ধরেই কলকলিয়ে অর্নকে জিজ্ঞেস করলো বাজিকে কি গিফট দিলেন? কোথায় খাওয়াতে নিয়ে গেলেন ভাইয়া? অর্ন প্রথমে বেশ বোকা হয়ে গেলো। কি ব্যাপার সেটা বুঝতেই তার অনেক সময় গেলো আর বুঝে সে কোন উত্তর দিতে পারলো না। অহনার বোনেরাও এঘটনায় যারপর নাই ব্যাথিত হলো কি করে কেউ বউয়ের প্রথম জন্মদিন ভুলে যেতে পারে। অর্ধ কান্না মিশ্রিত গলায় অহনা জন্মদিনের প্রায় শেষ প্রহরে তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথম শুভেচ্ছা জানলো। তার একটু পরই অহনার ছাত্র ভাই ফোন করলো ভারত থেকে, প্রানের চেয়ে প্রিয় বোনকে শুভেচ্ছা মালা জানাতে। তারা কার্ড পাঠিয়েছিলো সবাই কিন্তু তখনো সেগুলো অহনার হাতে এসে পৌঁছেনি। তখনো অহনা জানতো না কিছু কিছু কার্ড আর চিঠি বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের মাঝখানে গুম হয়ে যায়, কখনোই হাতে পৌঁছায় না। অর্ন খুবই হতবুদ্ধি হয়ে অহনাকে জিজ্ঞেস করলো, আজ অহনার জন্মদিন সেটা কেনো সে তাকে জানালো না? অহনাও পালটা জিজ্ঞেস করলো, তাকেই কেনো যেয়ে অর্নকে জানাতে হবে যে তার জন্মদিন আজ? অহনার কাবিনে, পাশপোর্টে, সার্টিফিকেটে কোথাও তারিখটি কি লেখা নেই? না অর্নের নিজের কোন গরজের খাতায় পরে না অহনার জন্মদিন কবে সেটা জ়েনে নেয়া। অভিমানী অর্ধ কান্না এখন পুরো কান্নার দিকে ধাবিত হলো। ঢাকাতে বান্ধবী, কাজিন, ভাই বোনদের সাথে সে ঈদের খুশিতে জন্মদিন উদযাপন করতো।

ঈদেও এতো আনন্দ হতো না জন্মদিনে যা হতো। মনের মতো উপহার বাবা মায়ের কাছে থেকে, চাচা, মামা, দাদুর কাছ থেকে টাকা আর বান্ধবীদের কাছ থেকে ফুল সহ হরেক রকম উপহার সামগ্রী, খানাপিনা, মাস্তি কি না ছিলো। এখানে বাড়ি থেকে দশ হাজার মাইল দূরে একা নিভৃতে সে তার প্রথম জন্মদিন উদযাপন করলো। কোন কার্ড নয়, ফুল নয়, উপহারতো নয়ই। এর ওপর অর্নের জেরা। শ্বশুর বাড়ির জিজ্ঞাসাবাদে নাস্তানাবুদ অর্নও লজ্জায় কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিলো না। সে খুবই দুঃখ প্রকাশ করে বললো, জন্মদিন তারা একদিন পর সেলিব্রেট করবে এবার। কাল বাইরে খাবে, সিনেমা দেখবে এবং অহনাকে কিছু পছন্দ করে রাখতে, সে যা চাইবে তাই কিনে দিবে। অহনা যেনো রেডি থাকে, অর্ন অফিস থেকে তাড়াতাড়িই বেরোবে এবং অহনাকে তুলে নিবে। অহনা আর কোন গরজ দেখাতে রাজি না। তার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। জীবন যে সিনেমা না এটা রোজ রোজ তার চোখে চব্বিশ ঘন্টায় আট চল্লিশ বার আঙ্গুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবারের ঝগড়া যেকোন ইস্যুতে অর্নের আপার হ্যান্ড থাকে, অহনা বুঝে না, আবেগী কিংবা ইমম্যাচিওর। কিন্তু আজ অহনা বিজয়িনী, এবং হাতে নাতে ধরা অর্ন। তার বাবার বাড়ির কাছেও কি কষ্টে অর্ন তার বউকে রেখেছে সেই টুকু প্রকাশ হলো আজ। আপাততঃ সেই সুখ নিয়ে অহনা ঘুমাতে যাচ্ছে।

তানবীরা

০৬.০১.২০১১

No comments:

Post a Comment