Sunday 9 January 2011

আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে

http://ratjagapakhi.blogspot.com/2011/01/blog-post_05.html

http://www.amrabondhu.com/mir/2304


প্রতিটি দিন প্রতিটি মূহুর্ত কি লম্বা যায়। চব্বিশ ঘন্টা এতো লম্বা হয় কেনো তিতলি ভেবে পায় না। সপ্তাহের ছয়টা দিনকে তিতলির মাঝে মাঝে বছরের চেয়েও লম্বা মনে হতে থাকে। মনে হয় এ নিদারুন সপ্তাহ আর শেষ হবে না সায়ানের সাথে আর তিতলির দেখা হবে না। শুধু সায়ান যখন পাশে থাকে ঘড়িটা তখন উড়ে চলতে থাকে। এতো আনফেয়ার কেনো এই পৃথিবীটা। অপেক্ষার সময়টা এতো লম্বা আর .........। সায়ান পাশে থাকলে সেই ঘন্টাগুলো যেনো মিনিট থেকে সেকেন্ড - মাইক্রো সেকেন্ড হয়ে উড়ে যায়। কতো কি ভেবে রাখে, দেখা হলে সে সায়ানকে এটা বলবে ওটা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু ও সামনে এসে দাঁড়ালে এমন ঝড়ের কাঁপন শুরু হয়, সময় কোথা দিয়ে ওড়ে, ভেবে রাখা কিছুই আর মনেও থাকে না, বলাও হয় না। আর তিতলির মাথাটাকে সায়ানতো কাজও করতে দেয় না। হলে ফিরে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে তিতলির আবার রাগ হতে লাগলো। একটু দ্বিধায়ও পরে গেলো। রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে সে। বাবা মা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন, অনেক বিশ্বাস করে তাই তাকে ঢাকা পড়তে পাঠিয়েছেন। এভাবে বন্ধুর হাত ধরে বেড়াতে যাবার কথা তাদের কানে গেলে তারা কি ভাববেন? বিশ্বাস ভংগের অভিযোগ আনবেন না তার বিরুদ্ধে?

তিতলির কি এটা ঠিক হবে? কিন্তু যখনই অপর পিঠটা ভাবছে, সায়ানের এতো কাছাকাছি কদিন থাকতে পারবে, অজানা একটা ভয় আর আনন্দ তাকে ব্যাকুল করে তুলছে। নিজের মনেই অনেকক্ষন নিজের যুক্তিগুলোকে সাজালো সে । সেতো পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে না, বেশ মনোযোগী ভালো ছাত্রী সে, ফার্ষ্ট ক্লাশ পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে তার। আর সায়ানের সাথে তার সম্পর্কটা একান্তই তার নিজের ব্যাপার। বাবা মায়ের মেয়ে হয়েছে বলে কি তার নিজের কোন পছন্দ থাকতে নেই। যুক্তিগুলো সাজাচ্ছে বটে কিন্তু নিজের মনই বলছে এগুলো ঠিক ততোটা জোরালো যুক্তি নয়। অস্থির লাগছে ভিতরটা। তিতলির দেরি দেখে ওদিকে সায়ান বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভিতরেই অধৈর্য্য হয়ে ওঠলো সে। চার পাঁচবার কল মিসড হবার পর ফোন ধরে বললো সে, আর আধ ঘন্টা জান, প্লীইইজ। সায়ান একটু ক্ষুন্ন হয়ে বললো, বাস কি তোর আমার জন্যে অপেক্ষা করবে নাকি? দ্রুত বাকি জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে ফেললো তিতলি তারপর ঢুকলো বাথরুমে। খুব ভালো করে গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে খুব সাজাতে ইচ্ছে করছে সায়ানের জন্যে কিন্তু সাজগোঁজে অপটু সে আর কি করবে ভেবে পেলো না। সায়ানের কিনে দেয়া জীন্স আর ফতুয়া আর পছন্দের সুগন্ধী মেখে বেরোল।

সায়ান অপেক্ষা করছিলো হলের কাছাকাছি, তিতলি বেরোতেই ওকে টেনে নিয়ে সি।এন।জি ধরে বাস ডিপোর দিকে প্রায় উড়ে চললো। সি।এন।জিতে ওঠেই সায়ানের ধৈর্যহীন কন্ঠ বলে ওঠলো, মেয়েদের কেনো যে এতো দেরী হয়, বাস মিস করিয়ে দিচ্ছিলি প্রায়ই। তিতলির মধ্যে অচেনা একটা অনুভূতি কাজ করছে । চোখে পানি এসে যাচ্ছে, কেনো সে নিজেই জানে না। মুখ ঘুরিয়ে রাখলো, সায়ানকে তার চোখের পানি দেখতে দিতে চাইছে না। উত্তর না দিয়ে রাতের ঢাকা দেখতে থাকলো। সোডিয়াম আলোর নীচে রাতের ঢাকাকে অচেনা লাগে। বাসের টেনশনে তিতলির এই পরিবর্তন সায়ান লক্ষ্যই করলো না। বাস কাউন্টারে যেয়ে নিজেদের ব্যাগ তাদের হাতে তুলে দিয়ে ভাবলো সামান্য কিছু স্ন্যাকস খেয়ে নেয়া যাক। দুপুরে এতো দেরিতে খাওয়া হয়েছে দুজনেরই যে ভাত খাওয়ার ইচ্ছে কারোই নেই এখন। সায়ানের কাপোচিনোর প্রতি খুব দুর্বলতা আছে তিতলি জানে সেটা। সামনেই সুইস বেকারী তাই তিতলি সেখানে যেতে চাইলো। এই জন্যেই মেয়েটাকে এতো ভালো লাগে সায়ানের। ওর সামান্য থেকে সামান্য জিনিসের প্রতি তিতলির ভালোবাসা মাখা যত্ন অনুভব করা যায়। মুখে কখনো বলবে না, স্বীকারও করবে না যে, ওকে ভালোবাসে। বরং ঠোঁট উলটে বলে দিবে, আমার ঠেকা পড়েছে তোকে ভালোবাসতে। তিতলির এই ঠোঁট উল্টানো ভঙ্গীটা দেখতে এতো ভালো লাগে। সায়ান কাপোচিনো আর বীফরোল নিলো, তিতলি মাফিন আর কফি। খাওয়ার মাঝেই বাসের হর্ণ, দৌড় লাগালো দুজনে।

বাসটা বেশ নতুন, সীটগুলো বেশ ভালো। ডান পাশের রোতে মাঝের দিকে সীট পড়েছে দুজনের। রাতের বাসে বেশির ভাগ যাত্রীই ঘুমিয়ে আছেন। ঘুম নেই এই যুগলের। জানালা দিয়ে দুজন বাইরের দিকে তাকিয়ে তারা ভরা আকাশ দেখছে। প্রতিদিনের চেনা এই আকাশটা আজ খানিকটা যেনো অচেনা। রোজ যেনো আকাশটাকে ধূসর আর কালো লাগতো। আজ লাগছে খাপছাড়া গাঢ়ো নীল। মনে হচ্ছে পুরো আকাশ আজ চাঁদের প্রেমে মজে আছে। কাত হয়ে বেহায়া আকাশটা চাঁদের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে। জ্যোস্নার আলো বাসের জানালা গলে তিতলির মুখে এসে পড়েছে। আলো মাখা তিতলিকে অচেনা লাগছে সায়ানের। এই তিতলি তার পুরোই অদেখা। সায়ানের হাতের মুঠোয় তিতলির হাত। এতো মায়া এই চোখে আগে কোনদিন কি খেয়াল করেছিল সে? মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলার একটা তীব্র ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যদি কখনো এ সময় হারিয়ে যায় ভাবতেই সায়ান নিজের অজান্তে জোরে চেপে দিলো তিতলির হাত, তিতলি শব্দ করতে পারলো না শুধু নড়ে ওঠলো। তিতলি খানিকটা সহজ হয়ে ওঠেছে এখন। তিতলির কানের কাছে মুখ এনে সায়ান বললো, একটা গান গাইবি, প্লীইইজ? চোখ নেড়ে না করে সাবধানে সায়ানের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো সে। সায়ানের গায়ের গন্ধে একটা অচেনা মাদকতা সব সময়, যেটা তিতলিকে সারাবেলা মাতাল করে রাখে। এখন সে নিঃশব্দে চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে সায়ানের গায়ের গন্ধে ডুবে থাকতে চাইছে। ফিসফিস করে কথা বলে কিংবা গুন গুন করে গান করে এই নিঃশব্দতার সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইছে না।

কারো চুলের গন্ধ এমন পাগল পারা কি করে হয়, কোন ধারনাই ছিলো না সায়ানের। সব সময় তিতলির পাশে বসলে, তার গায়ের গন্ধের চেয়েও চুলের গন্ধ তাকে টানে বেশি। এতো কাছে এভাবে আর কোনদিন তিতলিকে পায়নি সে। সবার চোখ এড়িয়ে আস্তে করে তিতলির কপালে আর মাথায় তার ঠোঁট ছোঁয়ালো। সারা শরীরে এক অজানা কাঁপুনি টের পেলো তিতলি। সায়ানের হাতে রাম চিমটি বসালো তার লম্বা নখ বসিয়ে। তারপর মুখ তুলে মিষ্টি করে হাসলো সায়ানের চোখে চোখ রেখে। সায়ানের সারা পৃথিবী সেই হাসিতে দুলতে লাগলো। তিতলি আর পুরো পৃথিবী এক মোহনায় মিশে গেলো তার। তিতলির বুকে আবার ধ্রিম ধ্রিম মাদলের বাজনা শুরু হলো। মনে হতে লাগলো সময় যেনো এখানেই থেমে যায়, এ বাস যাত্রা যেনো কোনদিনই শেষ না হয়। ভোরের দিকে দুজনের কখন চোখ লেগে এসেছিলো টের পায়নি। স্বপ্ন আর বাস্তবে, বাস্তব আর স্বপ্নের ঘোরে রাস্তা কখন ফুরিয়ে গেলো টের পেলো না দুজনই। বাস যখন থামলো চারপাশে তখন নরম আলো পৃথিবীকে ছুঁয়ে দিয়েছে। চারপাশটাকে অন্যরকম স্নিগ্ধ লাগছে। ভোরের আলোয় এক ধরনের পবিত্রতা থাকে। এ আলো গায়ে মেখে নিজেকে কেমন যেনো শুদ্ধ শুদ্ধ মনে হতে থাকে।

বাস ডিপো থেকে বেরোতেই রিকশাওয়ালারা জেকে ধরলো, কোথায় যাবেন কোন হোটেল। ভীড়ে পড়তে ইচ্ছে করলো না এসময়। খুব সাবধানে তিতলির হাত ধরে ভীড় বাঁচিয়ে সায়ান ডিপো থেকে বের হয়ে আসলো। ঐতো দূরে ক্যাব দেখা যাচ্ছে। হাত নেড়ে ক্যাবকে ওদের দিকে আসতে বললো। তিতলি রাগ দেখিয়ে বললো, কেনো অযথা এতোটা খরচা করবি শুনি? রিকশায় আরামে চলে যেতাম। সায়ানের চোখে দুষ্টমির হাসি খেলা করে ওঠলো, হেসে বললো, ঠিকাছে চল না। রোজতো আর করছি না। তিতলি রাগতে গিয়েও হেসে ফেললো। খুব ইচ্ছে করছিলো সায়ানের কোঁকড়ানো চুল গুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতে। আজ প্রথমবারের মতো ওরা দুজন দুজনার এতো কাছে, ব্যস্ত নগরীর পরিচিত মুখ আর ভীড়কে ফাঁকি দিয়ে। জীবনটা এতো সুন্দর কেনো? নিজেকে চিমটি দিয়ে দিয়ে দেখছে, সব কি স্বপ্ন নাকি সত্যিই সে সায়ানের এতো কাছে আজ? যদি স্বপ্নই হয় তাহলে সে হাত জোড় করে প্রার্থনা করছে, এ ঘুম যেনো ভেঙ্গে না যায়, তার স্বপ্ন যেনো হারিয়ে না যায়। পাতালপুরীর রাজকন্যা হয়ে সে ঘুমিয়েই থাকুক, যাক হারিয়ে তার সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি। সে অন্ততকাল সায়ানের হাত ধরে হাটবে, দূর থেকে দূরান্তে।

তানবীরা
০৯.০১.২০১১

No comments:

Post a Comment