Wednesday 9 February 2011

হয়তো জরুরী নয় তবুও

কঠিন, তাত্বিক কিছু লেখার জন্য যে ধরনের একাডেমিক পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনার গভীরতার প্রয়োজন হয় তা আমার নেই। লেখালেখি, নাচ, নাটক এগুলো আমার বেঁচে থাকার রসদ, নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া যে না আমি মরে যাইনি, বেঁচে আছি এখনো। তাই আমি এগুলো থেকে আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করি। সারাদিনে অনেক ধরনের স্ট্রেন যায় যেগুলো এড়ানোর কোন রাস্তা নেই, তাই যেই ঝামেলাগুলো এড়ানো সম্ভব সেগুলো অন্তত এড়িয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করি। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, একটা খারাপ সম্পর্ক মেনটেন করতে যতোটা এফোর্ড দিতে হয়, ভালো সম্পর্ক মেনটেন করতে ততোটা দিতে হয় না। তাই তাত্বিক কিছু নয়, কিছু উপলব্ধি লিখতে কেন যেন আজ ইচ্ছে করছে। ছোটভাইসম গৌতমকে অনেক বার বলেছিলাম নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে লিখবো। মেয়ের স্কুলকে খুব কাছে থেকে ফলো করেছি একটা সময়, নিজেদের স্কুল জীবনের সাথে পদে পদে তুলনা করেছি কিন্তু লিখবো লিখবো করে কয়েক বছর চলে গেছে লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আসলে লিখে ফেলা খুবই দরকার ছিল মনে হয় এখন।

মেয়ের স্কুল থেকে বছরে তিন বার রেজাল্ট দেয়। এটা প্রাথমিক স্কুলের নিয়ম। প্রত্যেক সাধারণ প্যারেন্টস সময় পান দশ মিনিট আর যাদের বাচ্চাদের সমস্যা আছে তারা বেশি সময় কিংবা আলাদা এ্যাপয়ন্টমেন্টও পান। সমস্যা মানে, বেশি মারামারি করে, পড়ায় অমনোযোগী, স্কুলে দেরীতে আসে, বেশি কামাই করে অসুস্থ হওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য স্কুল আর প্যারেন্টসকে একসাথে কাজ করতে হয়। ফলাফল থাকে চারটা ভাগে ভাগ করা। সিলেবাসের পড়াশোনা, সিলেবাসের বাইরে কি জানে, সোশ্যাল ইমোশোনাল ডেভেলাপমেন্ট ও গ্রস মোটর স্কিলস। প্রতি বছর সরকার থেকে সিলেবাস, এক্সাম পেপার সব প্রত্যেক স্কুলকে দেয়া হয়, সেই এক্সামের ওপর ভিত্তি করে বাচ্চাদেরকে এ, বি, সি থেকে এফ পর্যন্ত গ্রেডিং দেয়া হয়। তারপর থাকে সিলেবাসের বাইরে কি জানে। বাচ্চাদের মেধানুযায়ী সিলেবাসের বাইরে অংক, গ্রামার ইত্যাদি দেয়ার নিয়ম আছে। সেটা দিয়ে তারা মাপে ডেভেলাপমেন্ট আর ইন্টারেষ্ট। কোন বাচ্চা বেশি আঁকতে ভালোবাসে, কেউ অঙ্ক করতে আবার কেউ বই পড়তে। আর একটা পার্ট হলো সোশ্যাল এন্ড ইমোশোনাল ডেভেলাপমেন্ট পার্ট। বাচ্চারা বন্ধুদের সাথে কিভাবে আচরন করে, কোন বন্ধু খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে কিভাবে সাহায্য করে, নিজের অঙ্ক করা হয়ে গেলে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে সাহায্য করে কীনা সে সমস্ত টীচারকে নোট রাখতে হয় প্রতিটি বাচ্চা সম্পর্কে। গ্রস মোটর স্কিলসে থাকে বাচ্চা জিমে, খেলায়, শারীরিক ব্যাপারগুলোতে কেমন রেসপন্স করছে। এনাফ ফিট কীনা। শারীরিকভাবে ফিট না হলে সে ঠিকভাবে স্কুল এঞ্জয় করবে না তাই এটাও সমান গুরুত্বপূর্ন।

ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি পশ্চিমে সব ফ্রী। সেক্স থেকে জীবন, যা ইচ্ছে তাই করা যায়। সাদা চোখে তাই দেখা যায় বটে। এখানে এডাল্টারী প্রমান করতে পারলে পার্টনারের বিরুদ্ধে, এনি থিং ক্লেম করতে পারে হিসাবের বাইরে। বিশ্বাস ভঙ্গ এখানে সবচেয়ে বড় শাস্তি। সম্পর্ক মানে সম্মান। আর সম্মান ভঙ্গের কোন ক্ষমা নেই। এখানে স্কুলের বাচ্চাদের কোন নির্ধারিত স্কুল ড্রেস নেই, বাচ্চাদেরকে ছোটবেলা থেকে ফ্রীডম উপভোগ করার সুযোগ দেয়ার জন্যে কোন স্কুল ড্রেস সিষ্টেম রাখেনি তারা। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই প্রত্যেকের “ন্যাক” আর “স্বভাব” সম্বন্ধে কাগজে কলমে অফিসিয়ালি নোট রাখা হয়। কিছুদিন আগে অব্ধি অলিখিতভাবে মেয়েদেরকে ডাক্তারী পড়তে দেয়া হতো না। মেয়েদের নার্ভ দুর্বল এ কারণে। নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে এখনো আমরা নারী ডাক্তারদেরকে হা করে চেয়ে দেখি কারণ জানি ইনি অনেক ঘাটের জল খেয়ে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। ওনাকে আটকানো যায়নি, আটকাতে পারলে আটকে দিতো। এই নার্ভ সংক্রান্ত রিপোর্ট আসে স্কুল থেকে। ডাচ এডুকেশনে কোন ধরনের প্রাইভেটাইজেশন নাই বলে প্রাথমিক স্কুলের এই রিপোর্ট অনেক গুরুত্বপূর্ন। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের সেজন্য অনেক ট্রেইন্ডও হতে হয়। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চার বছর বাচ্চাদের সাইকোলজি ও টিচিং এর ওপর আলাদা পড়াশোনা করতে হয়।

যখন আমি এখানে পড়তাম আমার কাছে এদের অনেক কিছুই হাস্যকর লাগতো। গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের মধ্যে হাউ টু ট্রীট ক্লায়েন্ট ব্যাপার থাকতো। ব্যাপার হলো, কোন একটা সমস্যা সিলেক্ট করে দুজন করে পার্টনার করে দিতো। একবার আমি ক্লায়েন্ট হবো আর একবার আমার পার্টনার। আমরা একজন একজনকে ফোন করবো কিংবা অফিসে যেয়ে দুপক্ষ সেজে সেগুলো আলোচনা করবো। এগুলোর পরীক্ষাও হতো ভিডিও রেকর্ডিং সিস্টেমে। আমি বাসায় এসে বলতাম কি শ্যালো ব্যাপার স্যাপার এগুলো বলো। আমার স্বামী যিনি আমার খুব ভালো বন্ধুও অনেক সময় তিনি আমাকে বোঝাতেন। পড়া এক ব্যাপার আর পড়াটাকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করা আলাদা ব্যাপার। আমাদের দেশে কেউ কেউ নিজ থেকে শিখে নেয় কি করে জীবনে সারভাইভ করতে হবে। আর এদেশে একজন যখন শিখে নিয়েছে তার বিদ্যাটা সবার সাথে শেয়ার করে কি করে প্র্যাক্টিক্যালি পড়াটাকে ব্যবহার করতে হবে কিন্তু তখনো আমি ঠিক করে বুঝিনি আসলে কি বোঝাতে চাইতো। আমি অবাক হতাম, একজন গ্র্যাজুয়েট কি করে একটা ফোন রিসিভ করতে জানবে না, এটা কি শিখানোর বিষয়? আজ জানি হ্যা এটাও একটা শিক্ষা, হাউ টু ট্রীট এ কল, বরং বিরাট শিক্ষা। বিরাট ডিগ্রী থাকলেই সামান্য কল হ্যান্ডল করা যায় না।

আমি ইন্টার্নী করতে ফিলিপ্সে ঢুকেছিলাম, ইন্টার্নী শেষ করার পর সেখানেই চাকরি হয়ে যায়। এদেশের সরকারের নিয়মানুযায়ী বছরে মিনিমাম ষাট ঘন্টা প্রত্যেক কর্মচারীকে আত্ম উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক কোম্পানী কিছু ডেভেলাপমেন্ট কোর্স দিতে বাধ্য। সেটা একাডেমিক হতে পারে কিংবা কম্পিউটার এনি থিং। কিন্তু দিতে হবে। আর অনেক কোম্পানী দক্ষ কারিগর তৈরী করার জন্য নিজেই অনেক সেমিনার ট্রেনিং এর আয়োজন করেন। ফিলিপ্স এর মধ্যে অন্যতম। এদের ট্রেনিং তৈরী করার কায়দাও মজার। অনেকগুলো ফিলিপ্সের অফিস থেকে, বিভিন্ন দেশ থেকে, সেম র‍্যাঙ্কে কাজ করা লোকদের নিয়ে ট্রেনিং সেশনের আয়োজন করেন। কর্তৃপক্ষ ভাবেন যাদের সাথে সারাক্ষণ মেইল আর ফোন হয় তাদের মধ্যে কখনো সামনা সামনি দেখা হয়ে যাওয়া বিরাট ব্যাপার। ফোন বা মেইলে আমরা যে একটা মুখ কল্পনা করি সামনা সামনি বেশির ভাগ সময়ই সেই মুখ কল্পনার সাথে মিলে না। ফিলিপসের এই সেশনগুলোতে অনেক আঙ্কেট থাকতো। একই প্রশ্ন সামান্য একটু অদল বদল করে পাঁচ বার ছয় বার করা হতো। শুধুই মানসিকভাবে কর্মচারীদেরকে যাচাই বাছাই করা। কোম্পানী তাদের থেকে ভবিষ্যতে কতদূর কি আশা করতে পারে। কাকে ছেঁটে দিতে হবে, কে টিকে যাবে। একজন লোক কতবার ফাঁকি দিতে পারবে, নিজের মনোভাব একবার হলেও প্রকাশ হবে সেভাবেই আঙ্কেট সাজানো। কে লীড করতে পারবে, কে ডেস্কে ভালো করবে, কে ক্লায়েন্ট হ্যান্ডল করতে পারবে, কাকে কোথায় সরাতে হবে ঠিক করতো এই আঙ্কেট। ফিলিপ্সে অলিখিত নিয়ম আছে চল্লিশের আগে কাউকে গ্রুপ লিডিং দিতে দেয়া হয় না। একটা গ্রুপকে হ্যান্ডেল করতে যে মেন্টাল ট্র্যাঙ্কুলিটির প্রয়োজন তা নাকি চল্লিশের আগে একজন মানুষের আসে না। এ তথ্যও সব আঙ্কেট গবেষনা করে মনোবিদরা বের করেছেন।

একবার আমি ফিলিপ্স একাউন্টিং প্রিন্সিপালস কোর্সে ডাবলিন ছিলাম এক সপ্তাহ। সপ্তাহের শেষের দিকে এই অন্ধকার ঘরে বসে থেকে প্রজেক্টরে দেয়া প্রেজেন্টশন আমি আর নিতে পারছিলাম না। আমি কিছুই করিনি, রিভলবিং চেয়ার দেয়া হয়েছে সবাইকে। আমি চেয়ারটা অনেক ঘুরাচ্ছিলাম ডান পাশ আর বা পাশ। যথাসময়ে কোর্স শেষ হলে সনদ নিয়ে বাড়ি ফিরে আমি একথা ভুলেও গেছিলাম। কিন্তু বছরের শেষে ইভিলিওন মীটিং হচ্ছিলো বসের সাথে। আমায় জিজ্ঞেস করলেন, কোর্স কেমন এঞ্জয় করেছি, আমি স্বভাবসুলভ মিথ্যে কথা বল্লাম, দারুন। বস বললো, তুমি শিওর। আমিও মাথা নেড়ে, এবস্যুলুট। তিনি তখন আমার কোর্স আচরনের রিভিউ দেখালেন যে আমি অমনোযোগী ছিলাম শেষটায়। এটা কোর্স কোর্ডিনেটর রিভলবিং চেয়ার মোচড়ানো থেকে বের করেছেন এবং আমার ধৈর্য্য সম্বন্ধে রিপোর্ট করেছেন আর আমি জানি, তিনি ভুল বলেননি।

এখন কথা হলো জীবন ভর এতো সোশ্যাল এন্ড ইমোশোন্যাল ডেভেলাপমেন্ট কোর্স করে কি কিছু শিখেছি? না শিখিনি, যা শিখেছি তা শিখেছি ঠেকে।

ফিলিপ্সে চাকরী হওয়ার পর ভাবলাম এখন ড্রাইভিং শিখি। আমার স্বপ্ন, চিন্তা আর পা তখন সাত আসমানে, আমি তখন রীতিমতো হাওয়ার উড়ি। জীবনে প্রথম নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে তখন আমি দিশেহারা। গাড়িতে চাবি দিয়ে এমন জোরে টান দেই যেন এরোপ্লেন। আমার ড্রাইভিং ইন্সট্রাক্টর আমায় অনেকদিন সর্তক করেছেন। আমি মনে মনে ভাবি তখন, শালা বুড়া চুপ থাক। তুই বুঝিস কি? ত্রিশ টাকা আওয়ার নে আর পাশে বসে দেখ। অনেকবার বলার পরও আমার কোন পরিবর্তন না দেখে ডেনিস আমায় একদিন বললো, তানবীরা, গাড়ি কতো জোরে চালাও তার এক্সাম কিন্তু তোমার হবে না। চাবি ঘুরিয়ে, গিয়ার দিয়ে এক্সিলেটারে পা চাপলে গাড়ি চলবেই। এটা সব্বাই পারে। পরীক্ষা হবে নিয়ম মেনে, কতোটুকু নিরাপদভাবে তুমি গাড়ি চালাতে পারো। তুমি নিরাপদ কীনা, রাস্তায় অন্যরা তোমার থেকে নিরাপদ কীনা সে পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই তোমার লাইসেন্স পাওয়ার প্রশ্ন আসে। যাকে আমি অশিক্ষিত ড্রাইভার বলে অবজ্ঞা করতাম, সেই সন্ধ্যায় বলা তার এ কথাটা আজ দশ বছর বাদেও আমি রোজ মনে করি। জীবনের প্রত্যেক খাতায় এই হিসাব। একাউন্টেসী সবাই জানে। দুইএর সাথে দুই যোগ দিলে চার হবে। কিন্তু নিয়ম মেনে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে, ঠিকভাবে খাতা ম্যানিপুল্যাট করাকে বলে একাউন্টেসী। প্রত্যেকটা ফাঁকি হতে হবে নিয়ম মাফিক।

আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে মা কোমা থেকে ফেরৎ এলেন, পরে জানলাম অপারেশন করতে হবে, তাতে অপারেশন টেবল থেকে মা ফিরতেও পারেন নাও ফিরতে পারেন। কিন্তু অপারেশন এর কোন বিকল্প নেই। ভাই ইজিপ্টে এম এস করছেন। ঠিক হলো আমরাই যাবো মায়ের পাশে। মেয়ের স্কুল থেকে ফাইট দিয়ে গেলাম। প্রতিবার কেউ না কেউ প্লেনের দোর গোড়ায় থাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। ভাই তার যথাসাধ্য ইন্সট্রাকশন দিয়ে রেখেছে দেশে, বোনের যাতে সমস্যা না হয়। প্লেনের দোর গোড়া থেকে এবার অনাত্মীয় কেউ যখন বাইরে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন, সেই প্রথম বার মনে হলো আমি বড় হয়ে গেছি কারণ আমি এখন একা। ছোট দুইবোন গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে আর কেউ নিতে আসার নেই। মা হাসপাতালে, বাবা জ্বরে কাহিল, ভাই বাইরে। আমাদের বহুদিনের পুরনো ড্রাইভার সালাহউদ্দিন এসে আমার হাতের লাগেজটা নিতে নিতে বড্ড নরম গলায় বললো, বড় আপা আসেন। সেই বলার মধ্যে কী জানি একটা ছিলো। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারে সালাহউদ্দিন কেমন চোখে জানি আমার দিকে তাকিয়েছিল। ওকি আমার ভিতরটা তখন পড়তে পারছিলো। দেখছিলো এর আগে প্রতিবার যখন আমি আসতাম এয়ারপোর্টেই উৎসব শুরু হতো। নিরাবরন নিরাভরন এই আগমন আমার আজ। একটা কাকতালীয় ব্যাপার ছিল, এতো বছরে কোনদিন আমার প্লেন সন্ধ্যাবেলায় থামেনি দেশে। শুধু সেই একবার মন খারাপ করা বিষন্ন সন্ধ্যায় আমার প্লেন ল্যান্ড করেছিল। প্রকৃতিও কি বুঝতে পেরেছিল কিছু?

প্রথম সেদিন আমার মনে হলো সালাহউদ্দিন শুধু ড্রাইভার না, যাকে নিয়ে আমরা আড়ালে হাসাহাসি করি। কি মডেলের মোবাইল ওর, কেমন ঘড়ি পরে, ড্রাইভার হলেও স্টাইল আছে সানগ্লাসের আর কাপড় চোপড়ের। এতো ফুটানি কোথা থেকে করে তেল চুরি করে বিক্রি করে কিনা, আমাদের আড়ালে গাড়ির এসি চালিয়ে সিডি বাজায় কিনা। সেদিন আমার প্রথম মনে হল সালাহউদ্দিন আসলে সেই ব্যক্তি যে আমাকে বউ বেশে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে দিনরাত আনা নেয়া করেছে, কলেজে ইউনিতে নিয়ে গেছে, সকল ঝামেলা বাঁচিয়ে। ও আর সেই ছেলেটি নয় যে গাড়ি চালানো শিখতে যেয়ে দিনরাত আমার বাবার বকা খেতো, গাড়ি এদিকে ওদিকে গুঁতো লাগিয়ে এনে ভয়ে ভয়ে থাকতো। আমাদের বাড়ি থাকতে থাকতে ও আমাদের সুখে দুঃখের একজন হয়ে গেছে যাকে এখন আমাদের দুঃখ কষ্ট ভাবায়। সেই প্রথম ওকে আমার ড্রাইভার সালাহউদ্দিন না মানুষ সালাহউদ্দিন মনে হয়েছিল।

মনে হয়েছিল, শুধু বাবা মা ভাইবোন নয়, যারা দিনরাত আমাদের পাশে থেকে আমাদেরকে দেখে শুনে যাচ্ছে তারাও আমাদেরই পরিবার। শুধু বেতন দেয়া আর কাজ করা নয়। মায়ের অসুখ উপলক্ষ্যে অনেকে বাড়িতে এসেছেন, হাসপাতালে এসেছেন দেখা করতে, আমার ভিতরটা তির তির করে কাঁপতো। অনেকেই হয়তো আমাদের থেকে অন্যদিকে অনেক কষ্টে ঝামেলায় আছেন। কিন্তু আমাদেরতো সব থেকেও সব কিছু নাই হয়ে গেলো। আমি বাড়ি এসেছি কি খাবো, কোথায় শোব কেউ দেখার নেই। কেউ নেই আর দিন রাত আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করে। সেদিনে আফিয়া এসে যখন আমার বাবাকে নরম গলায় বললো, খালু বড় আপার জন্যে শুঁটকি মাছ এনে দেন, সাথে দিয়ে দিবো। তখন আমার মনে হলো, আফিয়া শুধু সে নয় যে সেজেগুজে সালাহউদ্দিন আর দারোয়ানের সাথে টাঙ্কি মারে বলে আমরা হাসি। সে আমার বোনের মতোই কেউ, যে আজ আমার মা বাড়ি নেই বলে, বাবার কাছে আমার জন্যে শুটকির আবদার করে দাঁড়িয়ে। মায়ের অসুখ আমাকে একটা জিনিস শিখালো, রোজ দিনের চেনা মুখগুলোকে মানুষ ভাবতে। তাদের পজিশন, শিক্ষা দীক্ষা ছেড়ে দিয়ে তারা যে মানুষ রক্ত মাংসের, আর সে জন্যই যে তাদেরকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিৎ প্রথম বারের মতো সেটা আমি অনুভব করলাম।

মায়ের অসুস্থতার কারণে পুরো চেনা পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে গেলো। পরিচিত মুখগুলোও অপরিচিত হয়ে গেলো। কঠিন কঠিন বাক্য অবলীলায় লোকে বলতে লাগলো। আমাদের যে বুক পিঠ এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে কোন জায়গায় লাগে কথাগুলো, সেটা লোকে অনুভবই করতে পারে না। মা মৃত্যু শয্যায় ঐদিকে পারলে লোকে বাবার বিয়ের পাত্রী খুঁজে। তখন জীবনে প্রথম শিখলাম আসলে কোন কথাগুলো কখনো কাউকে বলতে হয় না। কেনো কথা বলার আগে মানুষের মনের কোথায় বাঁজবে সেটা ভাবা জরুরী। তার চোখে চোখ রাখা জরুরী। কেনো সোশ্যাল আর ইমোশোন্যাল ডেভেলাপমেন্ট জীবনে জরুরী। কেনো নাকের আগে চোখে দেখা জরুরী। সামান্য দুটো কথা যেকোন লোককে সারা জীবনের শত্রু তৈরী করতে পারে। ভুলে গেছি তোমার কঠিন কথা ভাব দেখাব কিন্তু ভুলবো না কখনো। কথা বলার আগে ভাবতে হয়, যে শুনবে তার কেমন লাগবে। নিজে কতো বড় তা জাহির করার আগে অন্যকে কেন ছোট ভাবছি তার কারণগুলো খাতায় গুছিয়ে লেখাও জরুরী। আরেকজনকে হার্ট করে ক্ষণিকের পাশবিক নোংরা আনন্দ কতোটুকু স্বাস্থ্যকর। কি দিচ্ছি আর কি পাচ্ছি তা জানাও জরুরী। ভালোবাসা ভালোবাসা আনবে নোংরামি আনবে শত্রুতা।

কিংবা হয়তো জরুরী নয় তবুও

তানবীরা
০৭.০২.১১

No comments:

Post a Comment