Wednesday 23 February 2011

খুঁজবো কোথায় তাকে, দুচোখে হারাই যাকে

যখন থেকে সায়ান পড়তে গেলো এ্যামেরিকা তখন থেকেই দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি চরম আকার ধারন করেছে। ঝগড়া করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তিতলি। দুজনের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান আর সময়ের ব্যবধানতো আছেই তার সাথে আছে নিদারুন মানসিক চাপ। চব্বিশ ঘন্টা যার ভাবনায় সে বুঁদ হয়ে থাকে সারা পৃথিবী থেকে তাকে লুকিয়ে রাখার যন্ত্রনা। সারাদিন মনে মনে যাকে ভেবে তার সময় কাটে, মুখে কখনো তার নাম উচ্চারন না করতে পারার ব্যাথা। প্রাত্যহিক জীবনের সাথে লুকোচুরি খেলে কতো কষ্টে সায়ানের জন্য সময়টুকু সে যোগাড় করে রাখে তা সায়ান যেন আজকাল বুঝতেই পারে না। সায়ানের সবকিছুতেই দেরী হয় নইলে সে ব্যস্ত, সময় নেই, নাকি তিতলিকে এড়িয়ে যাওয়ার বাহানা এগুলো তার। তবে কি বদলে যাচ্ছে তার সায়ান একটু একটু করে? আগেতো এতো ইনকনসিডারেট ছিল না, তিতলির সুবিধাই ছিল সায়ানের বড় চাওয়া, তিতলির সান্নিধ্যই ছিল তার বড় পাওয়া। কি করবে সে? সেই মিষ্টি সময়গুলোর কথা ভাবলেই তিতলির কান্না পায় আজকাল। কখন যে নিজের অজান্তে চোখ ভিজে ওঠে, সে বুঝতেই পারে না। যখন লোনা জল তার গাল বেয়ে ঠোট স্পর্শ করে তখন খেয়াল হয়, সে কাঁদছে। অস্থির লাগে আর নিজের চারপাশে আরো বেশি করে সায়ানকে হাতড়ে বেড়ায় সে।

এখনতো আর চাইলেই সায়ানকে হাতের কাছে পায় না যে রেগে গেলে দুই হাতে ওর ঝাকড়া চুল মুঠো করে ধরে ওর মাথা ঝাঁকিয়ে দিবে কিংবা কান মলে মলে লাল করে দিবে। সারাক্ষণ মনে মনে রেগে থাকে আর ভাবে পাইতো তোকে একবার হাতের কাছে, খবর করে দিব বাঁদর ছেলে কোথাকারের। আগে ঝগড়া হলেই সায়ানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো সে, নখ দিয়ে আঁচড়ে, পিঠে কিল মেরে সায়ানকে শুইয়ে ফেলতো। মুখে সায়ান লাগছে লাগছে বললেও আসলে মজা পেতো, হাসতো। এমনিতেতো তিতলিকে কাছে টানা যায় না, হাতটা ধরলেই ঝট করে ছাড়িয়ে নিবে, আমায় ধরবি না বলে। কিন্তু মারামারির সময় তার হুঁশ থাকতো না। এলোচুলের খোঁপা খুলে পড়ছে, কি গা থেকে ওড়না খসে পড়ছে, কিংবা সায়ানের মুখের কতো কাছে তিতলির মুখ তখন সেদিকে তার নজর নেই। মারামারিতে হাপাতে হাপাতে তিতলির বুকের দ্রুত ওঠানামা আর রাগে নাকের পাটা কাঁপানো দেখতে সায়ানের ভীষন ভালো লাগতো। সে তখন আলতো করে তিতলিকে জড়িয়ে নিতো, ঠোট চেপে আদর দিয়ে রাগ কমিয়ে দিতো। আচমকা এ আদরে তিতলি লজ্জা পেয়ে তখনের মতো মারামারি থামিয়ে দিতো। সায়ান সারাবেলা সেই শান্ত তিতলির হাত নিজের মুঠোয় ধরে থাকতো। ঘেমে যেতো তিতলির হাত তার মুঠোর উত্তাপে কিন্তু তারপরও কখনো ছাড়িয়ে নিতো না।

পড়াশুনা, চাকরি আর নিজের রান্নাবান্নাসহ সমস্ত কাজের চাপে জেরবার সায়ানের কাছে মাঝে মাঝে তিতলির এই অবুঝপনা বেদনাদায়ক লাগে। সারাটাদিন কিসের মধ্যে দিয়ে ও যায় মেয়েটা কি একবারও বোঝার চেষ্টা করে। এই কি সেই তিতলি যে তার ঘুম খাওয়া নিয়ে অস্থির হয়ে যেতো। কি বদলে যাচ্ছে মেয়েটা। ম্যাসেঞ্জারে আসতে দেরী হলে, মেইল করতে ভুলে গেলে কিংবা এস,এম,এস বা ফোনের সময় একটু এদিক সেদিক হলে বেহুশের মতো রাগারাগি করে, কেঁদে কেটে সীন করে ফেলবে। অনেক সময় ফোনের লাইন পাওয়া যায় না, সব কি সায়ানের ইচ্ছে আর হাতে থাকে? আজকাল আর এক নতুন বাতিক যোগ হয়েছে, সন্দেহ। সায়ানের কি কোন বিদেশিনীর সাথে ভাব হয়েছে কি না এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত। ম্যাসেঞ্জারে কথা হলেই সেটা একভাবে না একভাবে ঝগড়ায় যেয়ে পৌঁছাবে আর কথা না হলে মনে হয় আজ দিনটা কাটছে না। খেয়ে শুয়ে বসে কিছুতেই সে শান্তি পায় না। চরম ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে তার জান। এতো মায়া হয় মেয়েটার জন্য তার। মেয়েটা দিনরাত তাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না, এই সত্যিটা জানে সে। বাইরে থেকে দেখাবে অনেক শক্ত, ভেতর ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে গেলেও মুখে কখনো স্বীকার করবে না, একা একা নিজে কষ্ট পাবে। কিন্তু তার কাছেতো তিতলির আর কিছু লুকানো নেই, সেতো জানে ওপরে যতো শক্ত ভাবই দেখাক, ভিতরটা পুরো হাওয়াই মিঠাই। তার স্পর্শ পাওয়া মাত্র গলে গলে পড়ে।

এ সমস্ত ঝগড়ার মূলে যে শুধুমাত্র তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করে সেটা আজকাল বেশ বুঝতে পারছে সায়ান। তিতলিকে তার ওপর, তিতলির নিজের ওপর আস্থা আর বিশ্বাস রাখতে হবে। এজন্য তিতলিকে তাকে হেল্প করতে হবে। মেয়েটাকে শক্ত করে তৈরী করতে হবে নইলে অসুস্থ হবে পাগল হবে মেয়েটা তার জন্য। অনেকদিন ভেবে ভেবে একদিন ভাবল অনেক দেরী হয়ে যাওয়ার আগে এটা বলা দরকার। সায়ান তিতলিকে ফোন দিল, আস্তে ধীরে তিতলির মুড বুঝে অনেক গল্প করলো। তিতলির মনের মেঘ যখন দূর হয়ে সে একটু স্বতঃস্ফূর্ত হলো, সহজভাবে ওর সাথে স্বভাবসুলভ চপলতায় কথা বলছিলো আর দুষ্টুমি করছিলো, সায়ানের পৃথিবী আবার দুলছিলো হারানো তিতলিকে কাছে পেয়ে। কিন্তু তাকে নরম হলে চলবে না। আস্তে আস্তে বললো সায়ান, শোন জান, তোর সাথে একটা কথা আছে, আর কথাটা তোকে মানতেই হবে। সায়ানের গলায় একটা কিছু ছিল যা তিতলিকে অকারণ ভয় পাইয়ে দিল। ভীতা হরিণীর গলায় বললো সে, আগে বল কি কথা। হেসে ফেললো সায়ান ঐপারের ত্রস্ততা টের পেয়ে। বললো, তোর জান তোকে যাই বলুক তুই সেটা রাখতে পারবি না, আগেই জানতে হবে কি কথা?

তিতলি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। নিজেকে সামলে নিয়ে মনে শক্তি যোগাড় করে বললো, বল পারবো রাখতে। সায়ান গভীর গলায় বললো, আজ থেকে রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পঁচিশবার বলবি, এ পৃথিবীতে আমার হারানোর কিছুই নেই, বরং যে আমাকে হারাবে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লুজার। আয়নায় নিজের চোখে চোখ রেখে বলবি এটা। হঠাৎ একী বলছে সায়ান। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। দমকে ওঠা কান্নাটাকে সে গলায় আটকে নিলো, মরে যাবে কিন্তু সায়ানকে তার ভিতরের যন্ত্রনা টের পেতে দিবে না, কিছুতেই না। যতোটা সম্ভব গলাটা পরিস্কার করে বললো, এ কথা কেনো বলছিস, জান কি হয়েছে? সায়ান বললো হাসতে হাসতে, আমার কিছু হয়নিরে, রোজ রোজ তোকে যে ভূতে তাড়া করে বেড়ায়, এটা তার চিকিৎসা। ওতো শক্ত হসনি, একটু ইজি হ গাধি। তিতলি এবার আর সামলাতে পারলো না। সায়ানের তিরস্কার যদিও বা সহ্য করতে পারে কিন্তু আদরে সে গলে যাবেই। সায়ানের ভালোবাসার উত্তাপে তিতলি মোম হয়ে গলে সারাবেলা। কেঁদে কেঁদে বলে, সে ভাবনা আমি সারা পৃথিবীর জন্য রাখতে পারবো কিন্তু তোকে ছাড়াতো আমি বাঁচবো না। তুই জানিস না এ পৃথিবীর কে আমায় পেল আর কে না তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না কিন্তু তোর সমস্ত কথা, ভাবনায় আমার সারা পৃথিবী দুলতে থাকে। সায়ান এবার শক্ত গলায় বললো, তা হবে না তিতলি সোনা, তোকে মনে জোর আনতে হবে, ভাবতে হবে, এ পৃথিবীতে নোবডি ইজ মোর ইর্ম্পট্যান্ট দ্যান ইউ, নেভার। ইউ আর এ জেম, আর এ জেম যে লুজ করবে, হি ইজ এ লুজার। ইভেন ইফ ইট ইজ মি দ্যান আই এ্যাম এ লুজার টু।

তিতলি বললো, আমিতো তোর কথা ভাবছি না, আমি ভাবছি আমার কথা। তোর ভাবনায় আমার দিনরাত যায়, আমার জীবনতো তোকে ঘিরে শুরু হয় তোর কাছেই এসে শেষ হয়। আমি বাঁচবো কি করে তোকে ছাড়া। আমার স্বপ্নেও তুই আমার বাস্তবেও তুই। বিষন্ন গলায় সায়ান বললো, এরকম করলে তুইতো মরে যাবি সোনা। কাউকে এতো ভালোবাসতে আছে নিজেকে ছাড়া। নিজেকে শক্ত কর, আমাদেরকে অনেক দূর যেতে হবে। পড়াশোনা শেষ করতে হবে, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বাবা মায়ের আশা আকাঙ্খার দিকেওতো দেখতে হবে। তিতলি নরম গলায় বললো, আমাকে কি করতে বলছিস? আমি কি তোর বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি। সায়ান হেসে ফেললো, দূর বোকা তাই বললাম বুঝি। বললাম, এতো টেন্স থেকে নিজেকে অতো কষ্ট দিস না সোনা। ভালো করে পড়াশোনা আর খাওয়া দাওয়া কর। যে হারাবে সে হারবে, তুই না। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখ বোকা মেয়ে।

যখন সায়ানের সাথে কথা হয়, গলার শব্দ পায় তখন তিতলির মনের ভেতরে রঙীন প্রজাপতি নাচে। এক ধরনের সজীবতা কাজ করে, অনেক নরম থাকে সে, একদম কাঁদামাটি। তাতে যা আঁকতে চায় তাই আঁকা যায়। কিন্তু ফোনের লাইন কেটে যাওয়া মাত্রই মনে হয় হারিয়ে ফেললো সে আবার তাকে। ফোন ডিসকানেক্ট হওয়া মাত্রই আবার আস্তে আস্তে তিতলির কেমন যেন লাগতে শুরু করে। পৃথিবীটা উলটে পালটে যেতে শুরু করে। সবচাইতে প্রিয় মানুষটিকে প্রচন্ড মিস করতে শুরু করে, হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করে বেড়ায়। কথা হওয়ার পর ঘন্টা দুই তিনেক মনটা ফুরফুরে থাকে। আবার শুরু হয় পরের বারের অপেক্ষা। অসহ্য লম্বা সেই দুঃসহ প্রতীক্ষা। সায়ানকে ছুঁয়ে দিতে না পারার এই অক্ষমতা, এই দূরত্বে তার মাথা গরম হতে শুরু করে, উলটা পালটা লজিক কাজ করে। ইনসিকিউরিটি আর বিরহ তাকে দিয়ে যা করতে চায় না তাই করিয়ে নেয়। সায়ানকে দুম করে উলটো পালটা একটা ম্যাসেজ পাঠায় কিংবা মেইল করে। যা বলতে চায় তা বলতে পারে না, বলে ঠিক তার বিপরীতটা। আগে সায়ান এগুলোতে ভীষণ টেন্সড হয়ে যেতো কিন্তু আজকাল বেশ বুঝতে পারে। সে হাসে আর আদর করে আবার উলটো ম্যাসেজ পাঠায়। ভালোবাসা যেখানে অসীম, ভুল বোঝাবুঝি আর রাগতো সেখানে সামান্য সময়ের দমকা হাওয়া মাত্র। যতো দ্রুত ধেয়ে আসে তারচেয়ে দ্রুত ওড়ে যায়।

তানবীরা
০৫.০২.২০১১

উৎসর্গঃ “জয়িতা” ও “নুশেরা”
মালতীলতা
হায় রাম

No comments:

Post a Comment