Wednesday 14 December 2011

এ বিজয়ের উৎসবকে আমি ঘৃনা করি

বাংলাদেশে খুব ঘটা করে চল্লিশ বছরের বিজয় দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। টিভিতে, ফেসবুকে, ব্লগে, পত্রিকায় দেশপ্রেমের ঘনঘটার বাহার, মৌসুমী দেশপ্রেম আর বিজয়ের উল্লাসে মাতাল সুশীল সমাজ। কিন্তু আসলে “বিজয়” মানে কি? এক টুকরো ভূমিকে নিজের অধিকারে রেখে তাতে যা খুশি তাই করা? নাকি সেই ভূমিতে বসবাসকারি মানুষদের জীবনধারনের জন্যে সাধারণ নিম্নতম চাহিদাগুলোকে মিটানোর দায়িত্ব কাধে নেয়া? তাই যদি হয় তাহলে কি আমাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে আজো? আর যদি আমরা সেই লক্ষ্যমাত্রায় না পৌঁছে থাকি তাহলে কিসের এই আনন্দ উৎসব? চল্লিশ কেন, চারশ বছরেই কেন উৎসব করতে হবে? যেই বিজয় নেই, তার আবার উৎসব কিসের? অনেক সময় গুরুজনেরা আফশোস করে বলেই ফেলেন, এর থেকে পাকিস্তান আমলই অনেক ভালো ছিল। এতো চোর ডাকাত ছিল না, শান্তিতে রাস্তাঘাটে চলতে পারতাম, ইত্যাদি। এই কি শেষ অব্ধি আমাদের বিজয়ের উপলব্ধি? এই নিরাশা, হতাশা, ক্রনিক মনোবেদনা?

স্বাধীনভাবে রাস্তায় চলার নিরাপত্তা নেই, কর্মস্থল থেকে জীবিত বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা নেই, বাড়ি ফিরলেও সে কখন ফিরবে তার কোন ঠিকানা নেই। অসহ্য যানজট, শেয়ার বাজারের লীলাখেলায়, হতাশায় সাধারণ মানুষের আত্মহত্যা, রাষ্ট্রপক্ষের লোকদের দ্বারা গুপ্তহত্যা। স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করলে দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়া এইই কি আজ বিজয়ের রুপ?

হ্যাঁ আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি
আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়ে
যার জন্মের সময় কোন শাঁখ বাজেনি
জন্ম থেকেই যে জ্যোতিষীর ছঁকে বন্দী
যার লগ্ন রাশি রাহু কেতুর
দিশা খোঁজা হয়েছে না, তার নিজের জন্য নয়
তার পিতার জন্যে আর ভাই এর জন্য
কিন্তু যার গর্ভ থেকে আমার জন্ম
সেই মায়ের কথা বলেনি কেউ ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে বলছি, হ্যাঁ আপনাকে, যখন জলপাই সরকার আপনাকে দেশে ফিরতে দিতে চায়নি, আটকে দিয়েছিলো বিদেশের মাটিতে, আপনি কেন বিশ্ব কাঁপালেন প্রতিবাদ করে? দেশে ফেরা আপনার নাগরিক অধিকার? বিরোধীদলীয়নেত্রী আপনাকেও বলছি, আপনার ছেলে বিদেশে মন খারাপ করে থাকে, দেশের ফেরার জন্যে সে ব্যাকুল, তাই আপনি ঘটা করে তার জন্মদিন পালন করে, ওয়েবকাষ্ট করেন, কেনো? আপনারা বড় মানুষ, আপনারা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচতেন, রাজ রাজা তাই? আর আমরা, যাদের দেশ ছাড়া আর কিছুই যে নেই? আমরা কি সব নর্দমার কীট? আমাদেরকে নর্দমার কীট মনে হলেও, দেশের আকাশ ছোঁয়ার জন্যে, আলো হাওয়ার স্পর্শ পাওয়ার জন্যে, আমরা ঠিক এমনই ব্যাকুল থাকি আপনাদের মতো। আমাদেরও ইচ্ছে করে পতাকা হাতে নিয়ে খালি পায়ে ছুঁটে যাই স্মৃতিসৌধে ।

কেনো মেয়েটিকে দেশে ফিরতে দেয়া হবে না? কি করেছে সে? তার যা সত্যি মনে হয়েছে, কোন সুশীলতার আশ্রয় না নিয়ে, অলংকরনবিহীনভাবে সে তার সব সত্যিকে প্রকাশ করেছে। এটা কি অপরাধ? সেতো আপনাদের যা ইচ্ছে করছে আপনারাও তাই করছেন, নয় কি? ঢাকাকে এককথায় জন্মদিনের কেকের মতো দুটুকরো করে দিলেন, জনমত উপেক্ষা করে শামীম ওসমানকে সমর্থন দিলেন, মেয়র লোকমানকে হত্যা করিয়ে দিলেন, কসবার গ্যাস নিয়ে যাচ্ছেন অন্যদিকে, স্থানীয় মতামত উপেক্ষা করে, পার্বত্য চট্রগ্রামের লোকদের সাথে বেঈমানী, টিপাইমুখি বাঁধ নিয়ে অস্পষ্টতা, ট্রানজিট নিয়ে ফাজলামি। এগুলো অপরাধ নয় তবে? সেই মেয়েটি কি এর থেকেও জাতি কিংবা জাতীয় স্বার্থের প্রতি বেশি হুমকি স্বরুপ? জাতির কি এরচেয়েও বেশি ক্ষতি হওয়ার আছে?

তার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে বাপ-বাপান্ত, নোংরা ঘাটাঘাটির চূড়ান্ত। কেন? সেকি কিছু লুকিয়েছে? না অস্বীকার করেছে? নাকি বে-আইনী কিছু করেছে? যারা আজকে সমাজের অত্যন্ত উঁচু প্রতিষ্ঠিত জায়গায় আছেন, সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের ব্যাক্তিগত জীবনের পঙ্কিলতা নেই? তাদের বেলায় চুপ কেন? একশ মেয়েকে রেপ করা আত্মস্বীকৃত অপরাধী, দুধর্ষ চাঁদাবাজ, সিরিয়াল কিলার, ফতোয়াবাজ সবার জায়গা হয় বাংলার মাটিতে শুধু এই নিরস্ত্র মেয়েটিকে ছাড়া? যারা বোমা মারে তারা থাকতে পারবে, বাংলা ভাই- ইংরেজি ভাই- আরবি ভাই থাকতে পারবে, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামী প্রাক্তন মন্ত্রী প্রকাশ্যে আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীকে হুমকি দিচ্ছেন আবার আসছি ক্ষমতায় বলে। কিন্তু থাকতে পারবে না এই মেয়েটি কারণ প্রকাশ্যে কিছু প্রচলিত নিয়ম ভেঙ্গেছে সে, লুকিয়ে ভাংগলে অবশ্য ঠিক ছিল। তাই কি?

আর ধন্য এই বাংগালী জাতি। এই মেয়েটির নাম ভাঙ্গিয়ে অর্থনৈতিক ফায়দা, রাজনৈতিক ফায়দা, সামাজিক ফায়দা থেকে এমন কোন ফায়দা নেই যা এদেশের মানুষেরা দেশ এবং বিদেশ থেকে ব্যাক্তিগতভাবে নেয়নি। কিন্তু কাজের শেষে তাকে কেউ আর মনে রাখেনি। ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে যত দূরে চোখ যায় তত দূরে। স্বাধীনতাবিরোধীদের বাঁচাতে দেশে মিছিল হয়, হরতাল হয় কিন্তু সেই মেয়েটির কথা কেউ বলে না। তাদের চেয়েও কি ক্ষতিকর এই মেয়েটি? পঞ্চাশে পৌঁছে গেছেন তিনি, দেশে আসার আঁকুতি নিয়ে দেন দরবার করতে করতে। কেঁদে মরছে একবার আমাকে আমার বাবার ভিটেয় পা রাখতে দাও

আমি ফিরব, ফিরব ভালবাসতে, হাসতে জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারীর বইমেলা
আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে কফোঁটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতালক্ষ্যায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রক্ষপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুন্ড পাহাড় ---- আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।

এতো নিস্তরংগ মানুষের হাহাকার নিয়ে যদি হয় বিজয়ের উৎসব, তাহলে সে উৎসবকে আমি ঘৃনা করি। নিরস্ত্র, ক্ষমতাহীন মানুষের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহারের নাম যদি হয় বিজয় উৎসব তাকে আমি ঘৃনা করি। শীতের মৌসুমে সুশীলদের এই বিজয়ের নাটক নাটক খেলাকে আমি ঘৃনা করি।

তানবীরা
১৪/১২/২০১১

4 comments:

  1. হ্যাঁ আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি
    আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়ে
    যার জন্মের সময় কোন শাঁখ বাজেনি
    জন্ম থেকেই যে জ্যোতিষীর ছঁকে বন্দী
    যার লগ্ন রাশি রাহু কেতুর
    দিশা খোঁজা হয়েছে না, তার নিজের জন্য নয়
    তার পিতার জন্যে আর ভাই এর জন্য
    কিন্তু যার গর্ভ থেকে আমার জন্ম
    সেই মায়ের কথা বলেনি কেউ ।

    এটা কার এবং কোন কবিতা তা জানতে পারলে উপকৃত হতাম। আর কোনো লিঙ্ক পেলে ভালো হতো...

    ReplyDelete
  2. কবিতা সিংহের লেখা, "আমিই সেই মেয়েটি" কবিতা থেকে অংশটুকু নেয়া হয়েছে

    ReplyDelete
  3. ছঁকে নয়, ছকে । ছুঁটে নয়, ছুটে। আঁকুতি নয়, আকুতি।
    অনাবশ্যক চন্দ্রবিন্দুযোগ আবার যেখানে আবশ্যক, সেখানে বাদ -- বাংলাদেশের ভাষায় অজস্র ভুলের মধ্যে এগুলো একটা বড় অংশ । বাংলা ব্যাকরণ না বোঝার ফল।
    কোরান, আরবি, বাংলা - এতকিছু কি একসঙ্গে সঠিক শেখা যায়?!

    ReplyDelete