Sunday 14 October 2012

সেই ছেলে ও মেয়েটির কথা



http://www.unmochon.com/2012/10/14/29795.html#.UHsgx65qCko

সকালে অফিস আওয়ারে রাস্তায় খুব রাশ থাকে তাই মেয়েটির ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করে না। প্রায়ই পথে কিছু না কিছু হয়, অনেকেই সকালের স্ট্রেস নিতে পারেন না, অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন আর ফলাফলে রাস্তা বন্ধ। দেখা যায় মেয়েটি অফিসে অনেক সময় এই কারণে দেরীতে পৌঁছায়। দেরীতে পৌঁছানো মানেই দেরীতে বের হওয়া আর সারাদিনের সবকিছুতে দেরী মানে মেজাজ খিঁচরে দিনভর নিজেকে স্ট্রেস করা। তাই সে আজকাল বাসেই অফিসে যাওয়াটাকে শ্রেয় ভাবে। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আরামে বাসে করে অফিসে যাওয়া। সকালটা শুরু হয় একটু ঢিলেঢালা ভাবে। আরামে মেয়েকে নিয়ে ঘুম থেকে উঠে, বিছানা গুছিয়ে, বাসি কাজ শেষ করে, নাস্তা সেরে রেডী হয়ে মা মেয়ে একসাথে বের হয় বাড়ি থেকে। আবার ফেরার পথের ড্রাইভিং স্ট্রেস থেকেও বেঁচে যায়। অনেক সময় স্বামী বাড়ি ফেরার পথে মাকে অফিস থেকে আর মেয়েকে ডেকেয়ার থেকে তুলে বাড়ি ফিরেন, নইলে মেয়েটি বাসে ডে কেয়ারে পৌঁছে মেয়েকে নিয়ে বেশ গল্প করতে করতে হেটে বাড়ি ফিরে আসে।

মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাসে উঠে শুরু হয় মোবাইলে ফেসবুকিং। তাতে বাস যাত্রার বিরক্তিও কাটে আর সারারাতে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটলো তার আপডেটও পাওয়া যায়। একই রুটে একই সময় একই বাসে যাতায়াত করলে অনেক সময় এক আধটা মুখ পরিচিত হয়ে যায়মেয়েটির বেলায় এটা একটু টাফ কারণ বাসে সে সহযাত্রীদের মুখ দেখে না বললেই চলে, সে দেখে ফেসবুক। এরকম এক রৌদ্রজ্জল সকালে বাস থেকে নেমে মেয়েটি নিজের মনে অফিস পানে হাঁটছিল। সহযাত্রী এক কালো যুবক যে কিছুদিন যাবত তার সাথে স্টেশন থেকে অফিস পর্যন্ত যায় তাকে বললো, নাইস ওয়েদার হ্যা? আগে হলে ঠিক এমন অপরিচিত সম্ভাষনে মেয়েটির কি প্রতিক্রিয়া হতো, বলা যায় না। কিন্তু আজকাল সব অচেনা লোকের মাঝে বসবাস করতে করতে কিছুই আর গায়ে মাখে না। মেয়েটিও মাথা নেড়ে হেসে তাতে সায় দিল। এরপর প্রায় প্রতিদিনই ছেলেটি টুকটাক কিছু কথা বলার চেষ্টা করতো হাটা পথে।

মেয়েটিও হ্যাঁ না টুকটাক জবাব দিত। মায়া লাগতো আহারে, কাছে কেউ নেই, কথা বলতে হয়তো পারে না। এবার জিজ্ঞেস করলো ছেলেটি, কখনো আফ্রিকা গিয়েছো। মেয়েটি মনে মনে ভাবলো আফ্রিকা যে কেউ সাধ করে বেড়াতে যায় সেটাইতো জানতাম না এখানে না এলে। তাও ভাগ্যিস আফ্রিকা বলেছে, নিজের নেটিভ কান্ট্রি ইথিওপিয়া বলেনি ছেলেটি। ইথিওপিয়া শুনলেই টিভিতে দেখা ভুখা নাঙ্গা চোখে ভেসে উঠে। নিজে যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে, আর এক ভুখা নাঙ্গা দেশের প্রতিনিধি, সে কথাতো আর মনে থাকে না। মুখে একটা সুশীল হাসি ফুটিয়ে বললো, নট ইয়েট, মে বি সাম ডে, হ্যাভ সীন পিকচারস, ভেরি বিউটিফুল ইনডিড। দু তিন সপ্তাহ, গোনা নেই, এভাবে ওয়েদার আর এশিয়া আফ্রিকা আলোচনার পর একদিন ছেলেটি মেয়েটিকে চট করে জিজ্ঞেস করে বসলো, ডু ইউ মাইন্ড টু হ্যাভ সাম কফি উইথ মি আফটার অফিস? এধরনের একটা প্রস্তাবের কোন সম্ভাবনা যে থাকতে পারে অপর পক্ষ থেকে তাই মেয়েটির মাথায় কোনদিন উঁকি দেয়নি। প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও, মেয়েটি মনে মনে হেসে ফেললো। স্বভাব রসিক মেয়েটি, চট করে ছেলেটিকে একটু নাড়িয়ে দেয়ার লোভ সামলাতে পারলো না। যতোদূর সম্ভব একটি নিষ্পাপ মুখ করে বললো, হোয়াই? উই ক্যান ড্রিঙ্ক কফি এ্যাট অফিস, ফ্রী অভ কষট, এজ মাচ এজ উই ওয়ান্ট। ছেলেটি এবার একটু অস্বস্ত্বিতে পরে গেলো মনে হয়। প্রায় অপরিচিত একটা মেয়েকে ডিনারে ডাকা কি ঠিক হবে? তাও ডিনার মানেই টাকা পয়সার ব্যাপার। ছেলেটি চুপ করে রইলো।

ছোটবেলা থেকেই ডানপিঠে স্বভাবের মেয়েটির মনের সুখে একটু হেসে নিল। ডানপিঠে স্বভাবের কারণে প্রায় কোন ছেলে বন্ধুই তাকে ঠিক ভরসা করে উঠতে পারতো না বলে, কখনো একান্ত আমন্ত্রনের ডাক সে পায়নি। যদিও বা কেউ তাকে কখনো কিছু ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছে, মেয়েটি তাকে নিয়েই উলটো এমন মজা করেছে যে, সেই ছেলে বন্ধু প্রায় পালিয়ে মান রক্ষা করেছে। তা নিয়ে পরিনত বয়সে তার অবশ্য একটু দুঃখবোধ ছিল। কিন্তু আজ এই প্রায় চল্লিশের দিকে ধাবিত হওয়া বয়সে তাকে কেউ কফি খেতে বলাতে সে অসাধারণ কৌতুক অনুভব করলো। বাদামী রঙের মানুষের বয়স আন্দাজ করা বেশ কঠিন। তাকে এখনো হয়তো কিছুটা বয়স আন্দাজে ছোট দেখায় কিন্তু এই ছেলে যে ত্রিশ পার করেনি তা মুখ দেখেই বোঝা যায়। কালো তা সেই যতোই কালো হোক, ত্রিশ আর চল্লিশের রয়েছে আলাদা চোখমেয়েটির হঠাৎ মনে হলো, ছেলেটি তাকেই কেনো এ প্রস্তাব দিলো? হয়তো কালো বলে বাদামী চামড়ার প্রতি আপনতার কারণে? নাকি বাদামী আর কালো চামড়ার দেশে একা একটি মেয়েকে দেখলে এ ধরনের অভব্য প্রস্তাব দেয়ার রীতি আছে বলে? একবার ইচ্ছে হলো বলে, আমার একটি প্রায় তোমার অর্ধেক বয়সী মেয়ে আছে জানো? পরের মুহূর্তেই আবার ক্ষমা করে দিলো, এতোটা কঠিন হতে ইচ্ছে করলো না, নাম না জানা সেই কালো যুবকের প্রতি। 

আপাততঃ ছেলেটির আর মেয়েটির গল্প এখানেই অসমাপ্ত আছে। 

তানবীরা
০৯.১০.২০১২

No comments:

Post a Comment