Tuesday 30 October 2012

দিন যায় কথা থাকে



নিয়মমতো অক্টোবরের শেষ রোববারে ঘড়ির কাটা ঘুরে গেলো। অফিসিয়ালি এখন হেমন্ত আর এখানে শীতকালীন সময়সীমা শুরু হয়ে গেলো। উত্তর গোলার্ধের খুব কাছের দেশগুলোতে নভেম্বর থেকে শুরু করে তারপর পুরো টানা প্রায় ছয় মাস অন্ধকারে লোকজন বাড়ি থেকে বেরোবে আবার অন্ধকারে বাড়িতে ঢুকবে। সূর্য্যি মামা শীতনিদ্রায় যাবেন। যদিও বিশেষ দিনক্ষন দেখে সূর্য মামা কখনো কখনো এখানে উঁকি দিবেন তবে সেটাও বয়ে আনবে দুঃসংবাদ। বেশির ভাগ সময় দেখা যায় এরপরই বরফ পড়তে শুরু করে। সেই বরফে পড়ে যেয়ে কারো কারো হাত পা ভাঙ্গবে, আর প্যাচপ্যাচে কাঁদাতো আছেই। নিকষ কালো অন্ধকারের ভার সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ ডাক্তারের শরনাপন্ন হবেন, এন্টিডিপ্রেসন মেডিসিনের জন্যে। হিম হিম ঠান্ডা পড়ছে, তাপমাত্রা দুই অঙ্ক থেকে এক অঙ্কে নামা শুরু করেছে, মাঝে মাঝে রাতে শুণ্যের নীচেও নামছে।

শীতের আগমনে সেই কাঁচা খেজুরের রসের গন্ধ, ঠান্ডা খেজুরের রস খেতে খেতে সোয়েটার পরা গায়েও কেঁপে কেঁপে ওঠা, স্কুলের ফাইন্যাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার সুবাদে গ্রামে বেড়াতে যাওয়া,  সেই বেড়ানোকে উপলক্ষ্য করে গ্রামে সদ্য বন্ধুত্ব হওয়া নাম না জানা তুতো ভাইবোনদের সাথে ফসল ভরা জমিতে বেড়াতে যাওয়া। জমি থেকে টেনে তোলা শিশির ধোয়া ধনেপাতা দিয়ে তাজা কূল আর তেঁতুল মাখা ভর্তার গন্ধ, চারদিকে হলুদ সর্ষের চাদর বিছানো, কাঁচা সর্ষে শাকের গন্ধ, মাটি তোলা নতুন আলু আর মটরশুটি। জমি থেকে তুলে আনা টমেটো – ধনেপাতা দিয়ে ছোট মাছের চর্চরি। ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা আর পাখি শিকারীদের ভীড়। বন্দুক কিংবা এয়ারগান নিয়ে এদিকে একজনতো অন্যদিকে অন্যজন। তেল ভরা বালিহাঁস আর ভুনা খিচুড়ি।

গ্রাম্য সেসব তুতো ভাইবোনদের আজ আর নামও মনে নেই। সামনে দেখলেও কেউ চিনিয়ে না দিলে চিনবো কি না জানি না। অথচ সেসময় এই শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে আসা তুতো ভাইবোনদের মনোরঞ্জন করার কি চেষ্টাই না তারা করতো। নানুর বাড়ির আশপাশের বাড়িতে থাকা মায়ের কাজিনদের ছেলেমেয়ে ওরা। নানুর বাড়িতে থাকার সেই তিন চার দিনে তাদের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে যেতো। শ্যাওলা পড়া পুকুর ঘাট, গাছে গাছে জড়াজড়ি করে থাকা গ্রাম্য জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া এবড়ো থেবড়ো পায়ে চলা মেঠো পথ, এ বাড়ি ও বাড়ির আঙ্গিনা ডিঙিয়ে কোন মাঠে গিয়ে মিশেছে। সেই মাঠ আবার মিশেছে আকাশের সাথে। প্রত্যেক বাড়ির সামনে বিরাট বিরাট উঠোন, সীমের মাচা, লাউয়ের মাচা, পাশেই গরুর ঘর। কি শান্ত অলস যেনো পটে আঁকা ছবি। প্রায় শুকিয়ে আসা খালের পাড়ে বাঁধা নৌকা, মসজিদের পিছন দিকে জঙ্গল। ঐদিকে যেতে হয় না। জায়গাটা নষ্ট। সেখানে ওনারা থাকেন। তাদের রাগিয়ে দিলে আর উপায় নেই। রেগে গিয়ে কবে তিনারা জানি কার কার ঘাড় মটকে দিয়েছিলেন, পরে অনেক খোঁজাখুজি তাদেরকে পাওয়া গেছে মধ্য পুকুরের মাঝে বসা অবস্থায়। এগল্পটা যখন হচ্ছে, তখন নাম না জানা কিছু পাখি ডেকে উঠবে মাঝে মাঝেই। অতি প্রাকৃতিক সেই গল্পগুলোকে তখন পাখির গা ছমছমানো ডাকে সত্যি মনে হতে শুরু হবে।

পুরো পরিবেশটাই রোজকার জীবনের সাথে এতো অবাস্তব আর স্বপ্নসম যে মনে হয় সেখানে যে কারো সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যেতে পারে। বন্ধুত্ব করার জন্যে সামাজিক স্ট্যাটাস মিলানোর, স্কুল কিংবা ক্লাস মিলানোর, গান নাটক সিনেমার রুচি মেলানোর কোন দরকার পড়ে না। প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে যখন তাদের সাথে মিশে যেতাম, তখন গায়ে ধূলো মেখে, সেই পরিবেশে হাডুডু, দারিয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বউচি, এক্কা দোক্কা খেলতে আর বাধো বাধো লাগতো না। গোল্লাছুটের সময় অন্য পক্ষের খেলোয়ারকে টানাটানি করতেও আর খারাপ লাগতো না, মাটিতে বসে পড়াটাও স্বাভাবিক লাগতো। সেই শীতেও ঘেমে নেয়ে লাল হয়ে উঠতাম এক একজন। নানুর বাড়ি থেকে আবার বাসায় ফিরে এলে দাদু আর আব্বু বলতেন, নানুর বাড়ি যেয়ে একেবারে “কালা” হয়ে ফিরেছি। এখন অবশ্য বুঝতে পারি, মাকে খোঁচা দেয়ার ব্যাপার হয়তো ছিল সেখানে। কিন্তু আমাদের কাছেতো সেই শীতেও কলাগাছের ভেলায় চড়ে পুকুরের পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝাপাঝাপি করার আনন্দটাই মূখ্য ছিল, কে কাকে কোথায় খোঁচায়, তা দিয়ে আমাদের কি আসে যায়। ঢাকা এলে প্রথম কয়েকদিন গ্রামের খেলার সাথীদের কথা বেশ মনে পড়ত। তারপর নতুন বই, নতুন ক্লাশ আবার অতি দ্রুত ভুলে যেয়ে চেনা গন্ডীতে মিলে যেতাম। এই শীতের শুরুতে সেসব দিন খুব মনে পড়ছে। আহা সেই নাতিশীতোষ্ণমন্ডলের দিন এই কনকনে উত্তর গোলার্ধে আমি কোথায় পাবো? কিন্তু জনম জনম তারে আমি খুঁজিব।

তানবীরা
৩০/১০/২০১২

No comments:

Post a Comment