Saturday 1 June 2013

চৌধুরী আলমের গল্পখানা (দ্বিতীয় পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=d42674673d236f835ca995dc02d372c3&nttl=147292

আপনজনের নিকটে যেই স্নেহ ভালোবাসা আশা করিয়া আসিয়াছিল চৌধুরী আলম তাহার কোনো প্রতিফলন দেখিতে পাইলো না সে কোথাও। যাহা হউক মনের কষ্ট কাহাকেও বুঝিতে না দিয়া এক প্রকার হাসিমুখেই সে সকলের সহিত দিন কাটাইতে লাগিল। কিছুদিন বাদে পিতামাতা জিজ্ঞাসিলেন, কি অবস্থা, কয়দিনের ছুটি, কি করিতে চায়? সে বলিল, ছুটির সমস্যা নাই। কাজের জায়গায় বলিয়া আসিয়াছে, বিবাহ সম্পন্ন করিবে সুতরাং তাহার ফিরিতে বিলম্ব হইতে পারে। তবে কাজ না করিলে বেতনও পাইবে না। তাহাতেও সমস্যা নাই, সাথে যাহা নিয়া আসিয়াছে আপাতত: বিবাহ পর্যন্ত সে ম্যানেজ করিয়া লইতে পারিবে। এইবার পিতাজী বলিলেন, কতো লইয়া আসিয়াছে সাথে। কতো বলিতে গিয়া হঠাৎ চৌধুরী আলমের কি জানি মনে হইল, সে এদিক ঐদিক করিয়া হাত কচলাইয়া কেনো জানি কথা এড়াইয়া যাওয়ার চেষ্টা করিতে লাগিল। ইহাতে পিতাজী নাখোশ হইয়া কহিলেন, বিবাহের খরচ আর আয়োজনের ব্যাপারে যেনো সে তিনার আশা না রাখেন। মুখ ভোঁতা করিয়া চৌধুরী আলম চক্ষু নীচের দিকে নামাইয়া বসিয়া রহিলো অধোবদনে। পিতাও কিঞ্চিৎ রাগত হইয়া প্রস্থান করিলেন।


এদিকে চতুর্দিকে বার্তা রটিয়া গেলো এবার চৌধুরী আলম বিবাহ করিতে আসিয়াছে। সঙ্গে করিয়া বহু কিছু আনিয়াছেন তাহার হবু বধূর জন্যে। কে হইবে সেই ভাগ্যবতী। পিতা জড়াইবেন না জড়াইবেন না করিয়াও তাহার বিবাহে জড়াইয়া গেলেন। কিছুটা পুত্রস্নেহ আর কিছুটা বাহিরের মানুষের ধরাধরি। বাহিরের মানুষতো আর তাহাদের অন্তরের কথা জানেন না। নিকট আত্মীয়স্বজন হইতে শুরু করিয়া দুঃসম্পর্কীয়, পাড়া প্রতিবেশী হইতে শুরু করিয়া দশ গ্রাম দূরে প্রত্যেকের সন্ধানেই দেখা গেলো এক কিংবা একের অধিক সুকন্যা আছে। প্রত্যকেই তাহার ভাইঝি, বোনঝি-এর গুণগানের বিস্তারিত বিবরণ গাহিয়া গেলো। এরচেয়ে সুকন্যা যে আর কিছুতেই পাওয়া যাইবে না তাহাও জোর দিয়া বলিয়া গেলেন। কোনো কন্যা ম্যাট্রিক পাশতো কোন কন্যা ফেল করিয়া আবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আবার কেউ কেউ ক্লাশ সেভেন এইটে আছেন, উচ্চবংশ, সুন্দরী, রন্ধনে নিপুনা ইত্যাদি। তবে তাদের প্রত্যেকের মাঝেই একটা জিনিস আছে, তারা সবাই পর্দানশীন ও সবাই বার কয়েক করিয়া কোরান খতম দিয়াছেন। এই সমস্ত সম্বন্ধের মধ্যে হইতে পিতাজী বাছিয়া খুঁজিয়া যাহাকে যাহাকে পুত্রের উপযুক্ত মনে করেন তাহাকেই চৌধুরী আলম পিতাজীর সহিত দেখিতে যান। খানিকটা রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পের অপূর্বের মতোন সাজিয়া বাছিয়া তিনি বাহির হন। কিন্তু কিছুতেই তিনি তাহার মনের মতো পাত্রী খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না। ইহাদের মধ্যে কি জানি নাই যাহা তাহার চাই।


পিতাজী দিনের পর দিন পুত্রের মতি না খুঁজিয়া পাইয়া রাগান্বিত হইতেছিলেন। সম্ভ্রান্ত সমস্ত লোকদের তিনি কি জবাব দিবেন? উপায়ান্তর না দেখিয়া চক্ষুলজ্জা কাটাইয়া চৌধুরী আলম কহিয়া ফেলিলেন, তিনি শহুরে মেয়ে বিয়ে করিতে চান। গ্রাম্য ললনা তাহার প্রবাস জীবনে পোষাইবে না। পিতা আর কি করিবেন, একে ছেলে সাবালক তায় আবার প্রবাসী হইয়াছে। কিন্তু দুঃশ্চিন্তায় পড়িলেন শহরের লোকেরা প্রবাসী পাত্রের কদর কতোখানি বুঝিবেন কে জানে? মনের মতো যৌতুক আদায় করিবার বাসনা পিতাজীকে আপাতত শিকায় তুলিয়া রাখিয়া পুত্রের জন্যে শহুরে কন্যার সন্ধান করিতে হইতেছে। মনে মনে পিতাজী বাসনা রাখিয়াছিলেন, গ্রামের সম্ভ্রান্ত স্বচ্ছল ঘর দেখিয়া পুত্রকে বিবাহ করাইয়া দিবেন, পুত্র চলিয়া গেলে তিনি এইটা ওইটা উছিলা করিয়া পাত্রী পক্ষ হইতে জিনিসপত্র আদায় করিতে থাকিবেন। যাউক গুড়েতো বালি পড়িয়া গেলো, কি আর উপায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করিয়া, ঘটকদের মোটা টাকা সালামি প্রদান করিয়া শেষ পর্যন্ত পুরান ঢাকাতে চৌধুরীদের বংশ মর্যাদার সহিত খাপ খায় এমন একটি উচ্চবংশীয়, ইসলামিক ভাবধারার সুন্দরী গুণবতী কন্যার সন্ধান মিলিলো। কন্যা পর্দা ঢাকা রিকশায় করিয়া স্কুলে যাইতো আসতো, কাক পক্ষীও তাহার বদন দেখিতে পাইতো না। এইবার ম্যাট্রিক দেবার কথা ছিল কিন্তু বিবাহের পর আর মেয়েদের পড়াশুনার কি দরকার আছে? আর আলেমদের কথা মতো, স্বামীকে চিঠি লিখিবার মতো বিদ্যা থাকিলেই মেয়েদের জন্য যথেষ্ঠ, এর বেশি দরকার নাই। বেশি পড়াশোনা জানা কন্যা স্বামীকে মান্য করিবেন না, বেয়াদব হইবে এই ব্যাপারে কন্যার পিতা আর পাত্রের পিতা দুজনেই একমত পোষন করিলেন।


সকলের সম্মতিতে, আনন্দের সহিত চৌধুরী আলম দেশে ফিরিয়া আসার প্রায় তিন মাসের মাথায় শুভ পরিণয় সম্পন্ন করিলেন। কন্যার পিতা তাহার সাধ্যমতো মেয়েকে জামাইকে সাজাইয়া গুছাইয়া দিলেন। একে প্রবাসী পাত্র তায় আবার চৌধুরী বংশ। কন্যার পিতা কোন কসুর রাখলেন না। ঐদিকে বিবাহের খরচাপাতি নিয়া পিতা পুত্রের মধ্যে আর একদফা মনোমালিন্য হইয়া গেলো। চৌধুরী আলমের সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বিবাহে এইভাবে উৎসব করিবে যে দশ গ্রামের লোক জানে, জার্মান প্রবাসী চৌধুরী আলমের বিবাহ হইতেছে। অনেকদিন লোকের মুখে মুখে তাহার বিবাহ উৎসবের গল্প আলোচনা ফিরিবে। সেরকম বন্দোবস্ত তথা টাকার যোগাড়ও সে রাখিয়াছিল। কিন্তু পিতাজী চান যতোটা সম্ভব নিজেদের বাঁচাইয়া কন্যার বাপের ওপর দিয়া পার করিয়া দিতে। একেতো শহরে বিবাহ, পুলিশের ভয়ে যৌতুকের নাম মুখে আনিতে পারিতেছেন না তাহার ওপর পুত্রের এরকম নাদানী, কাঁহাতক সহ্য হয়। চৌধুরী আলম পিতার চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করিয়া যতোদূর সম্ভব ধুমধাম করিবার চেষ্টা করিলেন। পরে ভাবিলেন অশান্তি করিয়া কি লাভ? একবার বিবাহ হইয়া যাক, পিতাজীতো তখন কাছে বসিয়া থাকিবে না, তখন বউকে ইচ্ছামতো কেনাকাটা করিয়া দিলেই হইবে। বিবাহসম্পন্ন হওয়ার পর নানা উছিলায় নববধূকে নিয়া চৌধুরী আলম শ্বশুরালয়েই দিন কাটাইতে লাগিলেন। বাড়ির সহিত যোগাযোগ বলিতে মোবাইল ফোন। তবে তিনি নিয়ম করিয়া প্রত্যেক দিন মাতাকে ফোন করিতেন, এই নিয়ম চৌধুরী আলম কিছুতেই ভঙ্গ করিতেন না।


এদিকে চৌধুরী আলমের পিতাজী দুঃশ্চিন্তায় পড়িয়া গেলেন, চার মাস গত হইয়া পাঁচ মাসে পড়িতে চলিলো এখনো ছেলে ফিরিয়া যাবার নাম করিতেছেনা, ঘটনা কি? তিনি পুনঃ পুনঃ তাগাদা দেয়া সত্বেও পুত্র বাড়িতে আসিতেছে না উল্টা তিনাকে এড়াইয়া চলিতেছে, এহেন নাফরমানি পিতার সহিত পুত্রের কি করিয়া সম্ভব? মুখে প্রকাশ করিতে না পারিলেও ইহার জন্যে তিনি মনে মনে নতুন বউমার ওপর খানিক নাখোশ হইলেন। চৌধুরী আলমই বা কি করিবেন? বিবাহ করিয়াছেন মাত্র দুইমাস। নতুন বউকে ছাড়িয়া যাওয়া সম্ভব? আবার কবে না কবে আসিতে পারিবেন তাহার কি ঠিক আছে? কবে আবার বউয়ের মুখখানি করতলে লইয়া এইভাবে চুম্বনে আবিষ্ট করিতে পারিবেন? নতুন বউয়ের অনাঘ্রিত সুঘ্রাণ আহরণে চৌধুরী আলম এখন মাতোয়ারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তবু চলিয়া যাইতে হইবে। তাহার ছুটি প্রায় ছয় মাসে যখন পড়িল পিতা রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে তাহার শ্বশুরালয়ে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখা গেলো শ্বশুরও মুখে কিছু না বলিলেও ইষৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, প্রবাসী জামাইয়ের ঘরজামাই হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা লইয়া। পিতাজী শ্বশুরালয়ে এমন কুৎসিত দৃশ্যের অবতারণা করিতে পারেন তাহা যদি চৌধুরী আলমের ধারণায় থাকিতো তাহা হইলে বহু আগেই বাক্স প্যাটরা লইয়া সে উধাও হইয়া যাইতো। অপমানে লজ্জায় সে আর তাহার অর্ধাঙ্গীনি মাটিতে মিশিয়া গেলো।


নববধূকে অশ্রুজলে ভাসাইয়া দিয়া, নিজের অশ্রু কোটের খুঁটায় মুছিয়া ভগ্ন হৃদয়ে সকলের নিকট হইতে বিদায় নিয়া প্রায় ছয় মাস পর এক সকালে চৌধুরী আলম আবার জার্মারির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলেন। এবারের যাত্রা পুরাই ভিন্ন। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী আর আনন্দে ভরপুর। যদিও পুরা শরীর পুড়িয়া যাইতেছিল নবপরিনীতার লাগিয়া। বিরহ শব্দটি পুস্তকে পড়িয়াছিলেন বটে আজ উপলব্ধি করিলেন। জার্মানি পৌঁছিয়া শুরু করিলেন আবার সেই জীবনযুদ্ধ। কাজ খুঁজিয়া বাহির করো, বাসা খুঁজিয়া বাহির করো, মাথা গোঁজার ঠাই চাই ইত্যাদি। ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল। ইহার মধ্যে দেশ হইতে একখানা সুখবর আসিল। তাহাদের সন্তান হইবে। তিনি দেশে থাকিতে বুঝিতে পারেন নাই তাহার স্ত্রী কিন্তু এখন লক্ষণ একেবারেই স্পষ্ট। তিনি, তাহার পিতামাতা ও শ্বশুরকূল সকলেই আনন্দে ভাসিয়া যাইতে লাগিল। সকলেই পরম করুনাময়ের কাছে হাত উঠাইয়া কহিলেন, একখানা পুত্র সন্তান দিও খোদা। আনন্দে পাগল চৌধুরী আলম বারংবার করিয়া স্ত্রীকে নিজের স্বাস্থ্যের আর খাওয়া দাওয়ার প্রতি যত্ন রাখিতে বলিলেন। তিনি কাছে নাই, থাকিলে না জানি কি করিতেন এই সময়ে। কিছুতেই যেনো কোনো অবহেলা না হয় আর সাবধানে চলাফেরা করিতেও বলিলেন। টাকা পয়সার চিন্তা করিতে না করিলেন, তাহার জন্যে তিনি আছেন।


যথাসময়ে তাহাদের ঘর আলো করিয়া তাহার স্ত্রী ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। যদিও পুত্র সন্তানের জন্যেই কামনা ছিল কিন্তু কন্যা সন্তানেও তিনি খুশী হইলেন। তাহার শ্বশুরকূলও আনন্দিত হইলো। শুধু চৌধুরী আলমের পিতা একটু মনক্ষুণ্ন: হইলেন, বোউটি কোনো কর্মের নহে। চৌধুরী আলম প্রবাসে থাকেন বলিয়া বোউ মাঝেসাঝে শ্বশুরবাড়ি যাইয়া বেড়াইয়া আসিতেন, কিন্তু পাকাপাকিভাবে থাকিতেন বাপের বাড়িতে। শ্বশুর এই সুযোগ কাজে লাগাইয়া, বউয়ের খরচাপাতি সবই বউয়ের বাপের ওপর গছাইয়া দিতেন। এতোদিন চৌধুরী আলমের বউ লজ্জায় মুখ ফুটিয়া স্বামীকে কিছু বলিতে পারিতেন না আবার ঐদিকে পিতৃকূলের কাছেও ছোট হইয়া থাকিতেন, শ্বশুরের এইরকম ছোটলোকিপনায়। কিন্তু এখন সন্তানের জন্মের পরে খরচ বাড়িয়া গেছে কয়েকগুন, এখন আর স্বামীকে নালিশ না করিয়া উপায় রইলো না। নালিশ শুনিয়া চৌধুরী আলম তেলে বেগুনে জ্বলিয়া গেলেন নিজ পিতামাতার ওপর। বৌ আর কন্যার জন্যে তিনি আলাদা মানিঅর্ডার করিলেন। এই কথা আবার চার কান ঘুরিয়া চৌধুরী আলমের পিতাজীর কানে পৌঁছাইয়া গেলো। তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া ছেলের মুখ দর্শন না করার কথা ঘোষণা দিলেন। আর বউকেও ফোন করিয়া যাহা নয় তাহা কহিলেন। এমতো পরিস্থিতিতে চৌধুরী আলমের সাথে তাহার পরিবারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া গেলো। হতাশায় তাহার চোখ গড়াইয়া পানি বাহির হইতে থাকে, এতোকিছু করিবার পরও কোনো দোষে আজ সে পিতামাতার নিকট পাতক হইয়া গেলেন? এদূর প্রবাসে কাহাদের সুখের জন্যে পড়িয়া থাকিয়া তিনি এই কষ্ট করিতেছেন?


এদিকে তিনি কি খুব সুখে কালাতিপাত করিতেছেন? যেই রেস্টুরেন্টে তিনি কাজ করেন, সেইখানে প্রতিনিয়ত তাহাকে ঠকানো হইতেছে। তাহার ন্যায্য বেতন যদি হয় একশত টাকা, তাহাকে দেয়া হয় ষাট হইতে সত্তর টাকা। তাহাছাড়া খারাপ ব্যবহারতো আছেই। যেহেতু খুব ভালো করিয়া জার্মান বলিতে পারেন না তাই চট করিয়া অন্য কোনো ধরনের চাকরি পাওয়ার সম্ভবনাও খুব কম। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন? বয়স হইতে চলিল, এই অনিশ্চয়তার সহিত এই পরিশ্রম আর শরীর নিতে চাহে না। বেতন যে কম দেয় শুধু তাহাই নহে, এই কম টাকাখানি দিতেও মালিক প্রায় সময়ই গড়িমসি করিতে থাকেন। একমাসের বেতন দিতে তিনমাস ঘুরান। তাহা নিয়ে চৌধুরী আলম আর তাহার মালিকের মধ্যে মনোমালিন্য বাড়িতেই থাকিল। কিন্তু করিলেই বা কি করিবেন। সব মালিকপক্ষই এরকম, গরিব ঠকানোর তালে থাকেন। ঐদিকে দেশ হইতে স্ত্রী কন্যার খরচার চাপও আছে। শেষমেষ অনেক ভাবিয়া, বন্ধু বান্ধব আর পরিচিতজনদের নিকট বিস্তর ধার দেনা করিয়া নিজে একখানি মনোহারি দোকান দিয়া বসিলেন। বাংলাদেশের তাজা শাক সব্জি, মসলা আর মাছ বিক্রি করিবেন। বাঙালি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি তথা এশিয়ান আছে প্রচুর এ তল্লাটে, দোকান না চলার কোনো কারণ তিনি প্রথমে দেখিতে পান নাই। দোকান দিয়া তাহার পর বুঝিলেন, মানুষ আছে প্রচুর আর দোকানও আছে প্রচুর। পয়সা কামানো আসলে ততো সহজ কিছু নহে।


নানাবিধ ঝামেলায় পড়িয়া, বিভিন্ন প্রকারের ট্যাক্স, দোকানের মালামালের কোয়ালিটি চেক, এক্সপায়ারি ডেট চেক, সব্জি পঁচিয়া যাওয়া ইত্যাদির লোকসান সহকারে জানিলেন ব্যবসা আসলে সহজ চিজের নাম নহে। বাহির থেকে যেমন মনে হয়, আমার মতো আমি পসরা সাজাইয়া দোকান নিয়া বসিয়া গেলাম ঘটনাটা পুরোপুরি তাহা নহে। তাহার পরেও মুরুব্বিদের আশীর্বাদে বিস্তর জুঝিয়া শেষ পর্যন্ত মনে হয় টিকিয়া গেলো চৌধুরী আলম তাহার দোকান নিয়া। কিন্তু ইহার মধ্যে বছর কয় গত হইয়া গিয়াছে। এতো অত্যাধিক পরিশ্রম আর দুঃশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে কালাতিপাত হইয়াছে যে, কখন দিন গত হইয়া মাস আর মাস গত হইয়া বছরে পড়িয়াছে তাহার হিসাব চৌধুরী আলমের কাছে আর নাই। ইহার মধ্যে ছিল ক্রমাগত পাওনাদারদের তাগাদা। কিন্তু এখন দিন কিছুটা ঘুরিয়াছে। আস্তে আস্তে ঋণও শোধ হইয়া আসিয়াছে। এখন মাঝে মাঝে মন চাহিলে মুক্ত হাওয়ায় মন ভরিয়া নিঃশ্বাসগ্রহণ করিতে পারেন সে। দেশে যাইতে পারেন নাই আর এই সময়ের মধ্যে। টাকা পয়সার টানাটানিতো ছিলই, সাথে ভয় কাহার কাছে তাহার দোকান গচ্ছিত রাখিয়া যাইবেন? এই ব্যবসা তাহার সারাজীবনের সম্পদ, কামাই, ভবিষ্যত। কিন্তু টেলিফোনে সবসময় দেশের খবরাখবর রাখিতেন। তাহার কন্যার বয়স এখন ছয়। স্কুলে ভর্তি করিয়া দেয়া হইয়াছে। টেলিফোনে তাহার সহিত টুকুর টুকুর কথা কহে। ছবিতে ছবিতে পিতা কন্যার পরিচয়। আর কন্যার কথা কহিয়া কি লাভ? সেই সাত বছর আগে মাস তিনেকের সংসার স্ত্রীর সহিত। স্ত্রী স্বয়ং সামনে আসিয়া দোকান হইতে কেনাকাটা করিয়া গেলেও সে ছবি ছাড়া চিনিতে পারিবে কিনা সন্দেহ। বাকি ঘর সংসারতো সে টেলিফোনেই করিল। তবে টাকা পয়সার দুরবস্থা এখন কাটাইয়া উঠিয়াছে সে। এবার কিছুদিনের জন্যে বাড়ি যাইবে বলিয়া মনস্থির করিয়াছে। বিশ্বস্ত বন্ধু বান্ধবের দ্বারস্থ হইতেছে সে দোকান নিয়া। একটা না একটা কিছু উপায় হইয়া যাইবে এই আশা মনে রাখিয়া সে দেশে যাইবার যোগাড়যন্ত্রে আঁটগাঁঠ বাঁধিয়া নামিল।

No comments:

Post a Comment