Saturday 1 June 2013

চৌধুরী আলমের গল্পখানা (৫ম পর্ব)

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=c6818bf727a5e052517e1fd9e1dcc7ff&nttl=20130519033242197402

এইবার আল্লাহতায়ালা চৌধুরী আলম আর তাহার পত্নীকে বিমুখ করিলেন না। আল্ট্রাসনোর দ্বারা খবর আসিয়া গেলো ঘর আলো করিয়া এইবার চৌধুরী জানে আলম আসিবেন। আনন্দের পরিসীমা নাই, ডাক্তার এর নিকট হইতে ফিরিয়া সাথে সাথে ওজু করিয়া দুই রাকাত নফল নামাজ নিজে পড়িলেন আর তাগাদা দিয়া স্ত্রীকেও পড়াইলেন। বাড়িতে টেলিফোন করিয়া বাবা মাকে এই সুসংবাদ জানাইলেন। তাহারাও অত্যন্ত খুশি হইয়া খোদার দরবারে শোকরিয়া আদায় করিতে লাগিলেন। আনন্দের জোয়ারে ঘর ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

চৌধুরী আলমপত্নী গর্ভজনিত নানা কারণে অসুস্থ থাকিতে লাগিলেন। রান্নাবান্নাসহ গৃহকর্ম করিবার মতো শারীরিক সুস্থতা তাহার নাই। ইহাও তেমন সমস্যা না। চৌধুরী আলম ঘরকন্না সামলাইবার মতো যথেষ্ঠই পটু, অনেক বছরের অভিজ্ঞতা, তাহার ওপর স্ত্রী এইবার পুত্র সন্তানের মা হইবেন আনন্দের সহিতই তিনি সব করিতে চাহেন। কিন্তু অবাক হইয়া চৌধুরী আলম দেখিলেন আশেপাশের বাসার ভাবীদের নিকট হইতে বহু খাবারদাবার রান্নাসহ অন্যান্য সাহায্য আসিতেছে। তাহার রান্নাবান্না করিবার বিশেষ প্রয়োজনই পড়িতেছে না। তিনি একা এইখানে বহু বছর নিজে রান্নাবান্না করিয়া, অসুখ বিসুখে কাটাইয়াছেন, সেইভাবে কেহ তাহার খোঁজ নেয় নাই, তিনিও নেন নাই অন্যদের কিন্তু এইবারের ব্যাপারটা যেনো অন্যরকম।

আরো একখানা ব্যাপার তিনি হঠাৎ করিয়াই খেয়াল করিলেন, তিনি এতোদিন এইখানে থাকিয়া যতোটা না সখ্যতা গড়িতে পারিয়াছিলেন সবার সহিত, বউ মাত্র কয়দিন না আসিয়াই তাহার চাইতে অনেকগুন বেশি সামাজিক নেটওয়ার্ক গড়িয়া তুলিয়াছেন। সারাদিনই টেলিফোন কানে লাগাইয়া গুটুরমুটুর করে। এই বাসার ভাবী ঐ বাসার ভাবী সবার সাথেই সবাই। ধরিতে গেলে সপ্তায় সপ্তায় তাহাদের কাহারো না কাহারো বাসায় কোন না কোন উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করিয়া দেখা হইয়া থাকে তাহারপরও কি কথা তাহাদের সারাদিন একজন একজনের সহিত টেলিফোনে তাহা তিনি বুঝিয়া পান না। সেইভাবে কিছু স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করিতে পারেন না মুখ ঝামটার ভয়ে। এই যে তাহারা সারাদিন টেলিফোনে এতো গল্প করিয়া থাকেন, সামনাসামনি দেখা হইলে একজন আর একজনের গায়ে হাসিয়া লুটাইয়া পড়েন, তাহা দেখিয়া যে কেহ ভ্রমে থাকিতে পারেন, একজনের সহিত অন্যজনের কতো না ভাব, কতো না বন্ধু বটে তাহারা। আদপে সেইরকম কিছু নহে, প্রায়শই তাহারা দেখা যায় একজন একজনকে পছন্দ করেন না, প্রায় প্রত্যকেই প্রত্যেকের অগোচরে নানান কথা কহিয়া থাকেন। তবে আজকাল স্ত্রীর নিকট হইতে বহুবিধ খবর পাইয়া কিংবা বলা চলে গোপন খবর পাইয়া তাহার পিলে চমকাইয়া উঠে। এইখানে এতো বছর থাকার পরও তিনি যাহা জানিতেন না, স্ত্রী আসিয়া ছয়মাস না গড়াইতেই তাহার চাইতে অনেকবেশি জানেন।

কে কে এখানে সরকারের ঘরে অফিসিয়ালি ডিভোর্স দেখাইয়া আলাদা আলাদা স্বামী স্ত্রী দুইগুন ভাতা – বাড়িভাড়া আদায় করিয়া থাকেন, একবাড়ি আবার অন্যকাহারো কাছে ভাড়া দিয়া, সেই ভাড়ার টাকা দিয়া ঢাকার বিলাসবহুল এলাকাতে ফ্ল্যাট কিনিয়াছেন তাহা স্ত্রী না জানাইলে হয়তো সারাজীবন তাহার অজানা থাকিতো। আবার সেইদিন শুনিলেন আলিম ভাই নাকি বিবাহিত আর তিন সন্তানের পিতা হিসেবে কেইস করিয়াছিলেন। সন্তানদের জন্যে যেই ভাতা তিনি সরকারের ঘর হইতে এতোদিন পাইয়াছেন তাহা জমাইয়া জমাইয়া নিজেদের জেলা শহরে জমি কিনিয়া আলিশান বাড়ি করিয়াছেন। আশেপাশে এলাকার বহুলোক শুধু বাড়িটাকে এক নজর দেখিতেই সেই এলাকায় আসেন। কিন্তু বিপত্তি বাঁধিল যখন তিনি নিজে সত্যিকারের বিবাহ করিয়া স্ত্রীর জন্যে ভিসা চাহিতে গেলেন। নকল স্ত্রী, ডিভোর্স পেপার ইত্যাদি লইয়া এম্বেসীর সহিত তাহাকে বিস্তর হাঙ্গামা পোহাইতে হইয়াছিল। প্রায় ফাঁসিয়া গিয়াছিলেন গিয়াছিলেন অবস্থা হইতে তিনি উদ্ধার পাইয়াছিলেন। এই সমস্ত গল্পের সহিত আজকাল জোটে স্ত্রীর গঞ্জনা। তিনি নিতান্তই বেকুব কিসিমের জীবন যাপন করিয়াছেন জার্মান দেশে। এইদেশে এতো সুযোগ সুবিধা তিনি বুদ্ধি করিয়া কিছুই ভোগ দখল করিতে পারেন নাই তাই তাহাদের আজ এতো কষ্ট। নহিলে কি এইখানে টাকা পয়সা কোন ব্যাপার? তাহাদেরকে এতো সাধারণ জীবন যাপন করিতে হয়? টাকা রোজগারের পথতো জানিতেন না এখন পারেন শুধু স্ত্রী কন্যার সহিত কলহ করিতে, খরচ কমাও খরচ কমাও।

আগে চৌধুরী আলম সামাজিকতায় এতোটা জড়িত ছিলেন না। নিজের মতো নিজের কাজ লইয়া থাকিতেন। মাঝে সাঝে ঈদের কিংবা জুম্মার নামাজ পড়িতেন, ঈদের সেমাই খাইতে এর তাহার বাসায় কদাচিৎ যাইতেন। বউ আসিবার পর হইতে তাহার সামাজিক কাজের গতিবিধি ব্যাপক দ্রুততায় বিরাট বাড়িয়া গেলো। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে এইদিক সেইদিক দাওয়াত লাগিয়াই থাকে। নইলে নিজের বাড়িতে ডাকিয়া খাওয়ান। দুইহাতে খরচ হইতে লাগিল কিন্তু কি আর করা। বউ মেয়েরা বাঙ্গালী, সামাজিকতা সান্নিধ্য ছাড়া থাকিতে পারেন না, তাহাদের লোক দরকার। এদিকে বাবা মায়ের প্রতি সংসার খরচা পাঠানোতে টান পড়িতে লাগিলো কিন্তু সাহস করে সহসা মুখ খুলিয়া তাহা বলিতে পারেন না, স্ত্রী কন্যা ঝাঝিয়া ফেলিবে তাহাকে। একেইতো অন্যদের তুলনায় তিনি অর্থনৈতিকভাবে এতো দুর্বল তাহার ওপর তিনি যাহা রোজগার করেন সবই বাবা মা ভাইবোনের পিছনে উড়াইয়া দিয়াছেন কিংবা দেন, রাবনের গুষ্টি টানিয়া নিয়া যাচ্ছেন, এই খোঁটা অহরহ শুনিতে হয়। টাকা পয়সার ব্যাপারে সবাই তাহার ওপর অসন্তুষ্ট, না তিনি বাবা মায়ের কাছে এই ব্যাপারে জায়গা পান, না স্ত্রী কন্যা তাহা বুঝিবার চেষ্টা করে। একপক্ষ মুখ ফিরাইয়া লইয়াছেন আগের মতো পুত্র তাহার দায়িত্ব পালন করিতেছেন না বলিয়া আর অন্যপক্ষ ঝাজিয়া থাকে সব লুটাইয়া দিয়াছেন বলিয়া।

এই অবস্থার মধ্যেই সেই সুখের দিন আসিয়া গেলো। প্রসব ব্যথায় কাতর স্ত্রীকে লইয়া তিনি হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওয়ানা হইলেন। হাসপাতালে যাইয়া স্ত্রীকে ভর্তিতো করাইয়া দিলেন কিন্তু আবার এক নতুন সমস্যার সম্মুখে পড়িতে হইলো তাকে। স্ত্রী এক বর্ণ জার্মান কহিতে বুঝিতে পারেন না, ইংরেজিও একই অবস্থা। অন্যান্য ভাবীরা যাহাদের সহিত তাহাদের দিনরাতের ওঠাবসা তাহাদেরও অবস্থা প্রায় কাছাকাছি। কেউ কেউ ভুলভাল উচ্চারণে ভাঙা ভাঙা জার্মান কহিয়া থাকেন বটে কিন্তু এই সময় চৌধুরী আলম আর ভাঙা ভাঙা জার্মান ভাষার ওপর ভরসা রাখিতে পারিতেছেন না। কি করিবেন কি করিবেন ভাবিয়া উতলা হইতেছিলেন। হঠাৎ তাহার টিচার আপার কথা মনে পড়িল। টিচার আপা বাংলাদেশেরই মানুষ, মাঝে সাঝে তাহাদের দোকানে দেশি মাছ, সব্জি, মশলা কিনিতে আসেন। ভাই একটা জার্মান কোম্পানিতে চাকুরি করেন আর আপা স্থানীয় একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ান। আপা অনর্গল জামার্ন কহিতে পারেন, অবিকল জার্মানিদের মতো। অনেকেই ভাষা সংক্রান্ত দরকারে তাহাদের বাটিতে যাইয়া থাকেন। সহসা তাহারা কাউকে ফিরান না এই গুণ তাহাদের আছে। এমনিতে যদিও খুব একটা যাওয়া আসা তাহাদের সহিত হয় না, সবাই বাংলাদেশী হইলেও দেখা যায়, চাকুরীজীবীরা নিজেদের মধ্যে আবার ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে মিলামিশাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

কিন্তু কপাল ঠুকিয়া চৌধুরী আলম আর একজনের কাছ হইতে নম্বর যোগাড় করিয়া টিচার আপাকে ফোন করিয়া তাহার প্রয়োজনের কথা জানাইলেন। আপা জানাইলেন তিনি শীঘ্রই হাসপাতালে আসিয়া উপস্থিত হইতেছেন। ইহা শুনিয়া চৌধুরী আলম হাফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন যেনো। আপা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হাসপাতালে আসিয়া তাহার স্ত্রীর পাশে দাঁড়াইলেন। কোন জটিলতা ছাড়াই স্ত্রী যথাসময়ে ফুটফুটে স্বাস্থ্যবান এক পুত্রের জন্ম দিলেন। ভাষাগত ব্যাপারগুলি আপা সামলাইয়া দিলেন। নার্স যাহা যাহা কহিতেছিলো তিনি বাংলায় চৌধুরী আলমের স্ত্রীকে বুঝাইয়া দিতে ছিলেন। বিরাট কোন সমস্যা হয় নাই। চৌধুরী আলম নাড়ি কাটিয়া দিতেই নার্স তোয়ালে মুড়াইয়া পুত্র সন্তানকে তাহার কোলে দিলেন। তিনি সম্বিত ফিরিয়া পাইয়া পুত্রের কানে আজান দিয়া আল্লাহর নাম শুনাইলেন। টেলিফোনে চৌধুরী আলমের মাতা বারবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যেনো পুত্রের কানে আজান দিয়া আল্লাহর নাম জানাইতে ভুল না হয়। স্ত্রীও মোটামুটি সুস্থ আছেন। দিন দুই হাসপাতালে কাটাইয়া স্ত্রী পুত্র নিয়া তিনি বাটিতে ফিরিলেন। আশেপাশের ভাবীরা এই উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করিয়া ছোটখাটো আয়োজন করিয়া, বাড়িঘর সাজাইয়া দিয়াছেন নীল রঙের সামগ্রী দিয়া। পুত্র হইয়াছে তাই নীল।

আনন্দে ভাসিয়া যাইতে লাগলো সুখের সংসার। সকলকে তিনি অকাতরে মিষ্টি বিতরণ করিলেন। কিন্তু সকলেই জানাইলো শুধু মিষ্টিতে তাহারা সন্তুষ্ট না কাচ্চি চাই। যদিও দেশে তিনি একবার ছেলের আকিকার জন্যে বাবা মায়ের নিকট টাকা পয়সা পাঠাইয়া দিয়াছেন, কিন্তু এখানে সকলের অনুরোধে তিনি পুত্রের নাম করিয়া আবার ছোটখাটো একখানা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করিলেন। প্রবাসীরা সাধারণত খুবই ধর্মভীরু হইয়া থাকেন। যেকোন উপলক্ষ্যেই তাহারা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করিয়া আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করিয়া থাকেন। হালাল দোকান হইতে বাজার সদাই করিয়া থাকেন। হালাল খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপারেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়া থাকেন। দৈনন্দিন জীবনে ইসলামি রীতিনীতি বজায় রাখিতে তাহাদের চেষ্টার সীমা পরিসীমা থাকে না। সেই কারণে দেখা যায় অনেকে জার্মান দেশে বসবাস করিয়াও, জার্মানিদের সহিত বন্ধুত্ব করাতে অনাগ্রহী থাকেন। যদিও এইসব খ্রিষ্টান নাসারাদের দেশে ধর্ম পালন করা কোন সহজ কথা না তবুও চেষ্টা না চালাইলে শেষ দিন আল্লাহকে কি জবাব দিবেন? সে কারণেই হয়তো বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মিলাদ মাহফিল করার প্রবণতা প্রবাসীদের বেশি। সৃষ্টিকর্তাকে জানানো, যেখানেই থাকুন না কেনো তাহারা, সর্বদা অন্তরে আল্লাহর নাম। কিংবা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সবর্দা সৎ পথ অবলম্বন করেন না বলিয়া মনের পাপবোধ কাটাইতেও এইরকম করিয়া থাকিতে পারেন, কে জানে। অনেক সময় দেখা যায় পয়সা রোজগারের জন্য হেন কোন অন্যায় নাই যাহা প্রবাসীরা করিয়া থাকেন না। বহু দরিদ্র দেশের নাগরিকরাই এই দোষে দূষিত।

স্ত্রী ও তিনি পুত্র পালন লইয়া মহাব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। এইদিকে কন্যার ভাষা শিক্ষার স্কুল আরম্ভ হইয়া গেলো, কোন বাহানা দিয়াই আর কোনভাবেই তাহার স্কুলে পাঠানো ঠ্যাকাইয়া রাখা গেলো না। কন্যাও নিজের একখানা জগত পাইয়া আনন্দিত। সে তাহার নিজের জগতে ডুবিয়া যাইতে চাইলেও প্রতিনিয়ত বাবা মায়ের সহিত এই নিয়া বচসা বাঁধিয়া যাইতে লাগিলো। স্কুলে সে তাহার অন্যান্য সহপাঠী বন্ধুদের ন্যায় কাপড় চোপড় পরিধান করিতে চায়, সাজগোজ করিতে চায়। কখনো কখনো অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সহিত সিনেমা, পিকনিক কিংবা এইদিকে ঐদিকে বেড়াইতে যাইতে চায়। যে বয়সের যাহা। ধর্মভীরু, রক্ষনশীল মানসিকতার বাবা মায়ের কাছে এইগুলো সবই বাড়াবাড়ি। সব ছেলেমেয়ে সাইকেল চালাইয়া স্কুলে গেলেও তাহাকে যাইতে হবে হাঁটিয়া কিংবা বাসে কারণ তাহার বাবা মায়ের চোখে ইহা বেপর্দা কাজ জাতীয় কিছু। কন্যা বুঝিয়া পায় না সাইকেলের সহিত পর্দার কি সম্পর্ক! প্রায় প্রত্যেকটি জার্মান ছেলেমেয়ে এবং অন্যান্য বিদে‍শিরাও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে কলেজে আসা যাওয়া করে, ইহা এই দেশের একটি চরম স্বাভাবিক ঘটনা।

ইহাতেই শুধু শেষ নয়। নিজের ইচ্ছামতো দুইটা বড় ফ্যাশনের কানের দুলও সে কিনিতে পারে না। বাবার চোখে তাহা ফিরিঙ্গিপনা,
বাবা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করিলেন, কানে এইগুলা কি পড়িয়াছো?
সে মিনমিন গলায় জবাব দিলো, এইগুলা এইখানে সবাই পরে।
বাবা বলেন, সবাই পড়ুক, সবাইতো আর চৌধুরী বাড়ির কন্যা না। তুমি বংশের সম্মানের দিকে খেয়াল রাখবা না। সবসময় চলাবলায় তোমাকে খেয়াল রাখিতে হইবে তুমি কোন বংশের সন্তান,  তাহাছাড়া তুমি একজন মুসলমান। নাছারাদিগোর মতো সাজগোজ তোমাকে মানায় না। খোল এইগুলা খোল। কেমন দেখায়।

সে মুখ কালো করিয়া আস্তে আস্তে খুলিয়া ফেলিয়া বাবার সামনে হইতে সরিয়া যায়।

চৌধুরী আলম গলা হাকাইয়া গিন্নীকে কহেন, তাহাকে চৌধুরী বাড়ির ইজ্জতের সহিত মিলে এইরকম গয়নাগাটি পরা শিখাইতে ও কিনিয়া দিতে। আর ধর্মীয় শিক্ষা দিতে, অন্তরে যাহাতে আল্লাহর ডর থাকে।

তাহাকে মায়ের সহিত দোকানে যাইয়া বাছিয়া বাছিয়া পুরাতন ফ্যাশনের ছোট ছোট দুল কিনিতে হয়, মাথায় হিজাব বাঁধিতে হয়। কিছুতেই সে নিজেকে ক্লাশের আর সকলের মতো করিয়া তুলিতে পারিতেছিল না। ক্লাশে তাহাকে লইয়া মাঝে মাঝে হাসাহাসি হয়, লজ্জায় তাহার মাথা কাটা যায়। তাহার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী জুটিল সোমালিয়ান, সেও কম বেশি একই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়া যাইতেছিল, সে তখন তাহাকে উপায় বাতলাইয়া দিলো। বাটি হইতে বাহির হইবার সময় বাবা মায়ের পছন্দমতো সাজিয়া বাহির হইবে কিন্তু হাল ফ্যাশনের সব কাপড় গয়না মেকাপ তাহার স্কুল ব্যাগে লইয়া বাহির হইবে। স্কুলে আসিয়া সরাসরি ক্লাশে না ঢুকিয়া লেডিস রুমে চলিয়া গেলেই হইলো। সেইখানে ইচ্ছামতো সাজিয়া গুজিয়া ক্লাশে আসিলেই চলিবে। শুধু একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে আসিলেই ল্যাঠা চুকিয়া যাইবে। কিন্তু হাল ফ্যাশনের সাজের  জিনিসপত্র সে পাইবে কোথায়? এই দুঃশ্চিন্তার কথা তাহার বান্ধবীকে জানাইতেই সে সমাধান করিয়া দিলো। স্কুল ছুটি হইলে তাহারা দুইজনে বাটিতে না ফিরিয়া দোকানে যাইবে। একদিনেতো আর সব কিনিতে পারিবে না, আস্তে আস্তে কিনিলেই হইবে। তাহাতে স্কুলের পর বাইরে বেশি দেরিও হইবে না, বাটিতে জানিবেও না।

কিন্তু টাকা? ইহারও উপায় পাওয়া গেলো। আস্তে আস্তে পিতার মানিব্যাগ বা মাতার ভ্যানিটি ব্যাগ হইতে সরাইতে হইবে। একদিনে বেশি সরাইলে ধরা পড়িয়া যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, তাই প্রতিদিন দুই টাকা পাঁচ টাকা সরাইলেই চলিবে। চৌধুরী আলমের কন্যাও দেখিলো ইহা একটি উৎকৃষ্ট পন্থা সবদিক রক্ষা করিবার। আপাতত সে এই রাস্তা অবলম্বন করিয়াই গৃহ শান্তি বজায় রাখিবে মনস্থ করিলো। বাবা মা ছোট ভাইটিকে লইয়া যে পরিমাণ আহ্লাদিত আর ব্যস্ত, সহসা ইহা তাহারা টের পাইবেন না, সেই ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিন্ত ছিলো। ধর্ম সংস্কৃতি সময় সর্বোপরি সার্বিক পরিবেশের কারণে কন্যা আস্তে আস্তে পিতামাতা হইতে অনেক দূরে সরিতে ছিলো, অধিক শাসনে মনোযোগী পিতামাতা তাহা কিছুই লক্ষ্য করিলেন না।



No comments:

Post a Comment