Sunday 22 June 2014

বৃষ্টি ভেজা পুরনো শহরে একদিন

সেই সন্ধ্যে থেকে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাধারণ দিন বাড়িটা সরগরম থাকে, দাদু, নাতি, নাতনী, চাচা, কাকিদের হৈ চৈ এ। আজ অস্বাভাবিক নিরিবিলি। রান্নাঘরটা একদম বাড়ির পিছনের দিকে। তারপাশেই খাবারের ঘর। বৃষ্টি সাথে আছে অন্ধকার, রান্নাই হয়নি ঠিক করে। তাই আজকের রাতের খাবার একদম সাধাসিদে। বাচ্চাদের সবার জন্যে আলুর ভর্তা, ডিমের কোর্মা আর ডাল। বড়দের জন্যে হয়তো কোন একটা মাছ টাছ কিছু ভাজা টাজা হয়েছে। খাওয়া হওয়া মাত্রই সবাইকে ওপরে যার যার ঘরে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে, নীচে নামা, লাফালাফি দৌড়াদৌড়ি সব কঠিনভাবে নিষেধ। বৃষ্টির ছাঁট লম্বা টানা বারান্দার গ্রীল ভেদ করে এসে সিড়ি, বারান্দা, বারান্দার কাছাকাছি কোন কোন ঘরের কিছু অংশ ভিজিয়ে একদম পিচ্ছিল করে দিয়েছে। বাড়িতে ফুট ফরমাশ খাটার ছোট ছেলেটা যে নুরু, বৃষ্টির ছাঁট আটকানোর জন্যে সব ঘরের জানালা বন্ধ করতে যেয়ে দুবার পা পিছলে আলুর দম হয়েছে। কিন্তু ওদের সেসব ব্যথা পাওয়া কষ্ট পাওয়া অভ্যেস আছে, তাই নুরুর পরে যাওয়া নিয়ে কেউ তেমন ব্যস্ত নয়। ওকে উঠে আবার বাড়ির কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে। কিন্তু বাড়ির বাচ্চাদের সেসব অভ্যেস নেই তাই, তাদের নড়াচড়া বারণ।
ঘর থেকে বৃষ্টি একটানা ঝরে যাওয়ার টুপটাপ শব্দ কানে আসতে থাকে। গাছের পাতা ছুঁয়ে যে জলকণা টুকু ঝরে পরে তার শব্দটা একরকম, আবার ছাদের কার্ণিশের গা বেয়ে যে জলকণাটুকু ঝরে তার শব্দটা অন্যরকম। খোলা আকাশ থেকে যারা ঝরে যাচ্ছেন তাদের ধ্বনিতে আছে আবার কাউকে ছুঁতে না পারার বেদনা। এই নিকষ কালো অন্ধকার, নড়াচড়া বারণ সময়ে সব তুতো ভাইবোনরা মিলে বানানো কিন্তু সত্যিকারের ভূতের গল্প বলে শুনে এক একজনকে তাক লাগিয়ে দেয়া কিংবা বোকা বানিয়ে দেয়ার একটা প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। কখনো কখনো হারিকেনের মৃদ্যু ভুতুড়ে আলো পাশের দেয়ালে তাদের ছায়া বানিয়ে দেয়। নিজেদের ছায়ার ওপর চোখ পড়ে গেলে মনের অজান্তেই একটা গা ছমছমানো ভাব এসে যেয়ে সেই অতিপ্রাকৃতিক গল্পগুলোকে সেসময় খানিকটা সত্যি করে দেয়। তারপর আস্তে আস্তে ঘুম নামে এই বৃষ্টি ভেজা শহরের কোনায় একটি প্রায় নিঃশব্দ নিঝুম বাড়িতে।
সকাল হয় খুব ঢিমে লয়ে। রোদ নেই, সেই থেমে থেমে আকাশের একটানা ক্রন্দন। কাকগুলো ভিজে একশা কিন্ত নিয়মভংগ করতে পারেনি আজো, তাই বারান্দার কার্নিশে বসে ক্ষুধার্ত ক্লান্ত গলায় কেঁদে জানিয়ে যাচ্ছে “ভোর হলো দোর খোল”। বাচ্চাদের সেই ওপরে আটকে থাকতে হবে। সারারাত একটানা বর্ষণে রাস্তায় পানি জমে গেছে, রিক্সা গাড়ি সব বন্ধ, নিঃস্তব্ধ এই পারাপার। বাড়ির উঠোনে পানি, চার সিড়ি পার করে উঠতে হয় যে একতলার বারান্দা, সেটাও প্রায় ছুঁই ছুঁই অবস্থা। সেই পানিতে রাজ্যের পোকা মাকড়, বিচ্ছা, ছ্যাঙ্গা, চ্যালা, বিষ পিঁপড়া, গুবরে পোকা, গাছের মরা পাতা, পুরনো ময়লা কাগজ, লজেন্সে খেয়ে ফেলে দেয়া লাল মোড়কটা, টফির রাংতা, বাতাসে অন্য জায়গা থেকে উড়ে এসে উঠোনের ঘাসের মাঝে সারা বছর এলেমেলো সগর্বে লুকিয়ে থাকা আর কতো টুকিটাকি। যেগুলো আজ ভেসে উঠে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। খাতার কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে বারান্দার গ্রীল গলিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেলার প্রতিযোগিতায় শিশুরা, নীচে নামার বারণ, বড়দের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করা হচ্ছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে একটানা বর্ষণে ক্লান্ত আকাশ মাঝে মাঝে দম নেবার জন্যে যেন থামে। কিছুটা সময় আকাশ থম ধরে আছে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উঠোনের পানি একটু একটু শুকাতে শুরু করেছে। বাজার নেই, কেউ ঘর থেকেই বের হয়নি আজ এই বৃষ্টিতে। সকালের নাস্তা ছিল খিচুড়ী ডিম ভাজা, এখন দুপুরে কী হবে তাই দেখছে দাদী আর কাকীরা। বৃষ্টি উপলক্ষ্যে বাড়ির পুরুষরা আজ বাড়ি আছে তাই ফ্রিজ খুঁজে ভালো কিছুতো বের করতেই হবে। সাধারণতঃ এই বাড়ীর পুরষরা দুপুরে বাড়ীতে খান না।
হঠাৎ নুরুর চিৎকারে প্রায় নিঃশব্দ বাড়িটিতে একটু জেগে উঠলো। উঠোনে দুটো সাপ নড়ছে। হলুদ আর কালো ডোরা কাটা। খুব বড় নয় মাঝারী কিন্তু সাপ বলে কথা। উঠোনের একপাশে একটি পুরনো কুয়া আছে, যেটাতে এখন তেমন পানি নেই, বাচ্চারা খেলতে কিংবা দুষ্টমী করতে যেয়ে কুয়োতে পরে যেতে পারে বলে ওটার মুখটাকে খুব ভাল করে পুরনো টিনের টুকরো, কাঠের টুকরো দিয়ে বন্ধ করে দেয়া আছে যদিও কিন্তু তবুও ধারনা করা হচ্ছে, সাপ সেই উৎস হতেই বৃষ্টিতে উঠোনে উঠে এসেছে। বাড়িতে থাকে অন্যেরা যারা আছে, দারোয়ান ড্রাইভার সবাই মিলে বিশাল উত্তেজনায় সো-উৎসাহে সাপ দুটোকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মারলো। বাড়ির বৌ ঝিয়েরা আর বাচ্চারা নীচের আর ওপরের বারান্দা থেকে সেই নৃশ্বঃস দৃশ্য অবলোকন করলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সাপের জন্যে কেউ ততো মমতা বোধ করছিল বলে মনে হয় না কিন্তু নিরিবিলি বৈচিত্র্যহীন এ জীবনে ফর আ চেঞ্জ এই ব্রেকটুকুই মন্দ কী। সাপগুলো নিজেদের প্রতি কতোটুকু মমতাবোধ করছিল কে জানে। বেশী নড়াচড়া করে প্রতিবাদ করতে তাদের দেখা যায়নি, বরং অনেকটা পিঠ পেতে চুপচাপ মার খেয়েই নীরবে মরে গেলো তারা। আবার যাতে কিছুক্ষণ পর টম এন্ড জেরী হয়ে গা ঝাড়া না দিয়ে ওঠে বসে সেই কারণে। অনেকক্ষণ ধরে নানা পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া হলো। তারপর তাদের মৃত দেহ কী করে সৎকার করা হবে তা নিয়ে বিরাট আলোচনা হলো, কুয়োর মাঝেই ফেলে দিবে নাকি কবর দিবে, নাকি বাইরে কোথাও ব্যবস্থা করা হবে। শেষ পর্যন্ত বাইরে ফেলে দেয়াই চূড়ান্ত হলে, নুরু যখন সাপগুলোকে কাঠিতে ঝুলিয়ে বাইরের রাস্তায় ময়লা ফেলার ডাষ্টবিনের দিকে যাচ্ছিলো তখন অনেকেই বাড়ির বারান্দা ছেড়ে আবার ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
ফের আকাশ মুখ গোমড়া করে টিপটিপ কান্না ঝরাতে লাগলো। কেন আকাশ মুখ গোমড়া করছো, পৃথিবীর এ সমস্ত অনাচার অনাসৃষ্টি দেখে। আর কত কাঁদবে তুমি এই দেখে, এ পাপাচার যে এখন পৃথিবীর নিয়মে পরিনত হয়ে গেছে। কতদিন কত জল ঝরিয়ে তুমি এর প্রতিবাদ করবে? এক সপ্তাহ দু সপ্তাহ নাকি দুমাস .........
তানবীরা
২৫/০২/২০১৪
২২/০৬/১৪

No comments:

Post a Comment