Friday 10 March 2017

আমার সৌমিত্র

“জীবনে কি পাব না ভুলেছি সে ভাবনা সামনে যা দেখি, জানি না সেকি আসল কি নকল সোনা” মান্নাদের এই গানটা ছোটবেলা থেকে অনেক বার শোনা, ক্যাসেটের বদৌলতে। ছোটবেলায় চটুল গানে আকর্ষিত হতাম এমনিতেই বেশি। তার অনেক পরে বাড়িতে যখন ভিসিআর এলো তখন দেখলাম সাদা কালো পর্দায় ছিপছিপে স্মার্ট অত্যন্ত সুর্দশন এক ছেলে টুইস্ট নাচছে এই গানের সাথে। হয়ত সে সময়ের বাংলা সিনেমার এই একমাত্র নায়ক সে টুইস্ট নেচেছেন। তাকে দেখা মাত্র প্রেম, মানে হাবুডুবু প্রেম, যাকে বলে “লাভ এট ফার্স্ট সাইট”। “তিন ভুবনের পারে” ছবিতে তনুজা’র ওপর তো রীতিমত রাগই হচ্ছিলো, এই মারাত্বক “হ্যান্ডশাম” বরকে এতো কষ্ট দিচ্ছে বলে। সারা বাংলা যখন উত্তম – সুচিত্রায় মগ্ন, আমি তখন মগ্ন “সৌমিত্র – অপর্ণা”তে। সত্যজিতের “অপুর সংসার” ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। সেখানে অবশ্য নায়িকা কিশোরী শর্মিলা ঠাকুর। তারপর হীরক রাজার দেশে। আস্তে আস্তে সাত পাঁকে বাঁধা, তিন কন্যার সমাপ্তি, চারুলতা, পরিণীতা ইত্যাদি। সৌমিত্রকে দেখার জন্যেই এতো সত্যজিত দেখা হয়ে গেলো এক সময়।

আমি কিশোরী থেকে তরুনী হয়েছি, তিনি যুবকেই থেকে গেলেন আজীবন, চির সবুজ। আজও বেলা শেষে বা প্রাক্তনে তাকে দেখে ভাল লাগে। সিনেমা’র বক্তব্যের সাথে একমত না হলেও তার উপস্থিতির কারণে মুগ্ধতা অস্বীকার করতে পারি না। সত্যজিত ছাড়া বাংলা সিনেমার আর এক দিকপাল মৃণাল সেনের সাথে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের সাথেও। তার নাটক দেখার সৌভাগ্য হয় নি কিন্তু মুগ্ধ হয়েছি তার আবৃত্তি শুনে, বার বার। এতোটা ভরাট কন্ঠ শুধু আবৃত্তি’র জন্যেই বোধ হয় তৈরী হয়। অরন্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, ফিফটিন পার্ক এভিনিউ, আবার অরন্যে, শাখাপ্রশাখা, গনশত্রু, মনিহার, আকাশ কুসুম কোথায় ভাল লাগে নি তাকে। বোধ হয় তার প্রতি বেশি আকর্ষন কাজ করেছে, তিনি ছকের বাঁধাধরা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন নি বলে, সেরকম মেকাপ গেটাপ নেয়ার চেষ্টা করেন নি বলে। তিনি যা তিনি তাই ছিলেন, অন্য ভাষায় বলতে গেলে একদম “ছাঁটকাট” সৌমিত্র। সত্যজিত কে এ জন্যে ভাল লাগে, তিনি নায়িকা অনেক বদলেছেন, কিন্তু নায়ক ততো নন। সৌমিত্র কে ছাড়া ফেলুদা কল্পনা করতে পারি না।

বহুমুখী প্রতিভা তাঁর। নিজে নাটক লেখেন, পরিচালনাও করেন, ছবি আঁকেন, কবিতা লেখেন। তার প্রথম কাব্য গ্রন্থের নাম “জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে”, ৮১৩ পাতার বই (২০১৪)। যদিও আনন্দ পাবলিশার্সের ইচ্ছে ছিলো প্রথমে তার নাট্যসংগ্রহ বের করার। অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে যতোটা আড়াল করেন, কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে ততোটাই প্রকাশ করেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ, সেই আমিকে প্রকাশ করতেই প্রথমে কবিতা লিখি। কবিতায় আমি মুক্ত। কবিতা সমগ্রের ভূমিকাতে আমি লিখেছি, আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম কৈশোরের নতুন জন্মানো প্রেম আকাঙ্ক্ষার আন্দোলনে। পরবর্তীকালে অবশ্য একটু একটু করে প্রকৃতি, সমাজ, বেঁচে থাকার অপরিহার্য অভিজ্ঞতাও কবিতার মধ্যে ফুটে উঠতে আরম্ভ হলো। কোন বড় ভাব বা আদর্শের প্রভাবে আমার লেখা শুরু হয়নি।“ স্ত্রী দীপাকে চিঠির বদলে কবিতা লিখতেন তিনি। কখনও বা চিঠির ফর্মে না দিয়ে আমার অনুভূতিগুলো কবিতার আকারে আমি ওকে পড়ে শুনিয়েছি। দীপা বরাবরই আমার কবিতার বড় শ্রোতা।“

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান 'Officier des Arts et Metiers' পেয়েছেন । সত্তরের দশকে তিনি পদ্মশ্রী পান কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি । পরবর্তী কালে তিনি পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১২ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেছেন।

ভাল লাগে ভাবতে, উই আর গ্রোয়িং ওল্ড টুগেদার। যতো বড় হয়েছি, ততোই মুগ্ধতা বেড়েছে, প্রেম দীর্ঘস্থায়ী থেকে চিরস্থায়ী হয়েছে।

টাক পড়ুক আর নাই পড়ুক তিনি সৌমিত্র,
সে জানুক আর নাই জানুক, প্রেম তার সাথেই দিবা রাত্র।

Image may contain: 1 person, smoking, outdoor and close-up

“জীবনে কি পাব না ভুলেছি সে ভাবনা সামনে যা দেখি, জানি না সেকি আসল কি নকল সোনা” মান্নাদের এই গানটা ছোটবেলা থেকে অনেক বার শোনা, ক্যাসেটের বদৌলতে। ছোটবেলায় চটুল গানে আকর্ষিত হতাম এমনিতেই বেশি। তার অনেক পরে বাড়িতে যখন ভিসিআর এলো তখন দেখলাম সাদা কালো পর্দায় ছিপছিপে স্মার্ট অত্যন্ত সুর্দশন এক ছেলে টুইস্ট নাচছে এই গানের সাথে। হয়ত সে সময়ের বাংলা সিনেমার এই একমাত্র নায়ক সে টুইস্ট নেচেছেন। তাকে দেখা মাত্র প্রেম, মানে হাবুডুবু প্রেম, যাকে বলে “লাভ এট ফার্স্ট সাইট”। “তিন ভুবনের পারে” ছবিতে তনুজা’র ওপর তো রীতিমত রাগই হচ্ছিলো, এই মারাত্বক “হ্যান্ডশাম” বরকে এতো কষ্ট দিচ্ছে বলে। সারা বাংলা যখন উত্তম – সুচিত্রায় মগ্ন, আমি তখন মগ্ন “সৌমিত্র – অপর্ণা”তে। সত্যজিতের “অপুর সংসার” ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। সেখানে অবশ্য নায়িকা কিশোরী শর্মিলা ঠাকুর। তারপর হীরক রাজার দেশে। আস্তে আস্তে সাত পাঁকে বাঁধা, তিন কন্যার সমাপ্তি, চারুলতা, পরিণীতা ইত্যাদি। সৌমিত্রকে দেখার জন্যেই এতো সত্যজিত দেখা হয়ে গেলো এক সময়।
আমি কিশোরী থেকে তরুনী হয়েছি, তিনি যুবকেই থেকে গেলেন আজীবন, চির সবুজ। আজও বেলা শেষে বা প্রাক্তনে তাকে দেখে ভাল লাগে। সিনেমা’র বক্তব্যের সাথে একমত না হলেও তার উপস্থিতির কারণে মুগ্ধতা অস্বীকার করতে পারি না। সত্যজিত ছাড়া বাংলা সিনেমার আর এক দিকপাল মৃণাল সেনের সাথে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন, তপন সিংহ, অজয় করের মত পরিচালকদের সাথেও। তার নাটক দেখার সৌভাগ্য হয় নি কিন্তু মুগ্ধ হয়েছি তার আবৃত্তি শুনে, বার বার। এতোটা ভরাট কন্ঠ শুধু আবৃত্তি’র জন্যেই বোধ হয় তৈরী হয়। অরন্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, ফিফটিন পার্ক এভিনিউ, আবার অরন্যে, শাখাপ্রশাখা, গনশত্রু, মনিহার, আকাশ কুসুম কোথায় ভাল লাগে নি তাকে। বোধ হয় তার প্রতি বেশি আকর্ষন কাজ করেছে, তিনি ছকের বাঁধাধরা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন নি বলে, সেরকম মেকাপ গেটাপ নেয়ার চেষ্টা করেন নি বলে। তিনি যা তিনি তাই ছিলেন, অন্য ভাষায় বলতে গেলে একদম “ছাঁটকাট” সৌমিত্র। সত্যজিত কে এ জন্যে ভাল লাগে, তিনি নায়িকা অনেক বদলেছেন, কিন্তু নায়ক ততো নন। সৌমিত্র কে ছাড়া ফেলুদা কল্পনা করতে পারি না।
বহুমুখী প্রতিভা তাঁর। নিজে নাটক লেখেন, পরিচালনাও করেন, ছবি আঁকেন, কবিতা লেখেন। তার প্রথম কাব্য গ্রন্থের নাম “জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে”, ৮১৩ পাতার বই (২০১৪)। যদিও আনন্দ পাবলিশার্সের ইচ্ছে ছিলো প্রথমে তার নাট্যসংগ্রহ বের করার। অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেকে যতোটা আড়াল করেন, কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে ততোটাই প্রকাশ করেন তিনি। আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ, সেই আমিকে প্রকাশ করতেই প্রথমে কবিতা লিখি। কবিতায় আমি মুক্ত। কবিতা সমগ্রের ভূমিকাতে আমি লিখেছি, আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম কৈশোরের নতুন জন্মানো প্রেম আকাঙ্ক্ষার আন্দোলনে। পরবর্তীকালে অবশ্য একটু একটু করে প্রকৃতি, সমাজ, বেঁচে থাকার অপরিহার্য অভিজ্ঞতাও কবিতার মধ্যে ফুটে উঠতে আরম্ভ হলো। কোন বড় ভাব বা আদর্শের প্রভাবে আমার লেখা শুরু হয়নি।“ স্ত্রী দীপাকে চিঠির বদলে কবিতা লিখতেন তিনি। কখনও বা চিঠির ফর্মে না দিয়ে আমার অনুভূতিগুলো কবিতার আকারে আমি ওকে পড়ে শুনিয়েছি। দীপা বরাবরই আমার কবিতার বড় শ্রোতা।“

No comments:

Post a Comment