Monday 21 May 2018

সে যে বসে আছে একা একা

এক সওদাগরী আপিসে সে কেরানি ছিলো, জীবন মানে সপ্তাহে পাঁচ দিন, ভোর সাড়ে ছয় ঘটিকায় নিদ্রা হইতে জাগিয়া বৃষ্টি-বরফ ঠেলিয়া তাহাকে আপিসে যাইতে হইতো। সেইখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ঘরে’র আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত কুরসী’তে বসিয়া সারাদিন রাজ্যের মাইনষের প্যানপ্যান, ভ্যানভ্যান শোনাই ছিল তাহার কাজ। এইসব রসকষহীন কঠিন হিসাবের কথা শুনিতে শুনিতে বেলা গড়াইয়া দ্বিপ্রহর।


অথচ ইহার মধ্যেই ঐ দূর নীল আকাশে কত শত শাদা মেঘ ডানা মেলিয়া উড়িয়া যাইতো। সেই দৃশ্য অবলোকন করিয়া কিছু পাখি কলকাকলি করিয়া তাহাদের সুমিষ্ট সুরে গান গাহিয়া উঠিতো। হঠাৎ হঠাৎ আকাশ ভীষম রাগিয়া কাঁদিয়া উঠিতো। মাঝে মাঝে তাহাতে রাস্তায় জল জমিয়া যাইতো। দুষ্ট মিষ্টি ছেলের দল তাহাতে লাফাইয়া উঠিয়া ব্যস্ত পথিকের জামা কাপড় ভিজাইয়া দিতো। লাজুক কোন মায়াবতী কিশোরীর দুই চোখ আচমকা কোন বিপ্লবী তরুণের হৃদয় ছুঁইয়া তাহাকে আর্দ্র করিয়া তুলিতো। আরও কত শত কিছু ঘটিয়া যাইত এই বিশাল ধরাধামে যাহার কোন ছোঁয়া এই সওদাগরী আপিসে আসিয়া পৌঁছাইত না। সেইখানে সারাক্ষণ চলিত কঠিন লাভ আর লোকসানের বাণিজ্যিক খেলা।


মানুষের দুঃখ কষ্ট লাঘবের সাধ্য তাহার ছিল না। তাহাকে চলিতে হইত কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়া। তবুও তাহাদের খানিক সত্যি আর খানিক মিথ্যা সহমর্মিতা দেখাইয়া সান্ধ্য ছয় ঘটিকার দিকে সে বাটি ফিরিতো। ফিরিয়া তাহাকে বাধ্যতামূলক রান্নাবাটি খেলিতে হইত। সেই খেলা সাঙ্গ হইলে শুরু হইত পিতা-কন্যার যুগলবন্দী ঘ্যান প্যান। এই সমস্ত কিছুর মাঝেই সে তাহার মুঠোফোন খানি ব্যবহার করিয়া মুখবহিতে প্রবেশ করিত, সেইখানে রাজ্যের হাসিখুশী মানুষ তাহাদের সুখ আনন্দের ছবি বা বার্তা পোস্ট করিয়া রাখিয়াছে, দেখিয়া তাহারও ভাল লাগিত। সেই ভাল লাগা সে এইদিক সেইদিক কিছু “লাইক” কষাইয়া যথাসাধ্য প্রকাশ করিত আর তাহার পর ঘুমাইতে যাওয়ার আয়োজন করিত কারণ পরদিন তাহাকে আবার একই রুটিনে চলিতে হইবে।


,
রাঁধার পরে খাওয়া, আর খাওয়ার পরে রাঁধা
বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা।


রবি ঠাকুর তাহাকে ভাবিয়াই হয়ত এই পদ্যখানি রচিয়া ছিলেন। এই সংসার বেড়াজাল হইতে তাহার কোন মুক্তি ছিল না। অথচ কত কি করিবার ছিল, কত দেশ-বিদেশ ঘুরিয়া দেখিবার ছিল, কত সহস্র বই তাহার না পড়াই রহিয়া গেলো, কত লক্ষ সঙ্গীত রহিল অশ্রুত, সিনেমার কথা না হয় নাই বা কহিলো, এ ছাড়াও আরও আরও আরও কত শত কত কি


সে যে বসে আছে একা একা, রঙ্গীন স্বপ্ন তার বুনতে,
সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে, জানালার ফাঁকে মেঘ ধরতে।
তার গুণগুণ মনে গান বাতাসে ওড়ে, কান পাতো মনে পাবে শুনতে,
তার রঙের তুলির নাচে মেঘেরা ছোটে, চোখ মেলো যদি পারো বুঝতে।
সে যে বসে আছে একা একা, তার স্বপ্নের কারখানা চলছে,
আর বুড়ো বুড়ো মেঘেদের দল, বৃষ্টি নামার তাল গুনছে।
তার গুণগুণ মনের গান বৃষ্টি নামায়, টপটপ ফোঁটা পড়ে অনেকক্ষণ,
সেই বৃষ্টিভেজা মনে দাগ দিয়েছে, ভেজা কাক হয়ে থাক আমার মন।

১১/০৪/২০১৮

No comments:

Post a Comment