Monday 7 December 2009

মানুষ কি জাত সংসারে?

নিশি আজকাল ধরতে গেলে কিছুই খেতে পারছে না। সব খাবারে গন্ধতো লাগেই এই গন্ধ থেকে আবার উদ্ভদ উদ্ভদ জিনিসও মাথায় আসে। গরুর মাংসকে মনে হয় ঘোড়া বা গাধার মাংস আর মনে হলেই তিন গুন বেগে বমি বেরিয়ে আসে। নিজে রান্না করলে খাওয়ার প্রশ্নতো আসেই না কারন রাধতেই রাধতেই সে বমি করতে করতে কাহিল হয়ে যায়। অয়ন যদিও বলে, তুমি রেঁধো না নিশি, অফিস থেকে ফিরে আমিই করে নিবো। তুমি একটু আমাকে এগিয়ে দিও আর দেখিয়ে দিও। নিশি্র মর্ণিং সিকনেসও প্রচন্ড। বেলা বারোটা অব্ধি মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারে না বলতে গেলে। টুথপেষ্ট মুখে তুলতে পারে না, পেষ্টের গন্ধেই নাড়িভূড়ি উলটে আসে। পৃথিবীর সব কিছুতেই গন্ধ পায় সে। খাবার, টুথপেষ্ট, সাবান, ঔষধ। ডাক্তার বলেছেন, কারো কারো তীব্র মর্ণিং সিকনেস থাকে। এখন সবেতো আট সপ্তাহ যাচ্ছে, যতোদিন যাবে আস্তে আস্তে এগুলো কমে যাবে। সে যখন কমবে তখন কমবে। এখনতো আর কমছে না। প্রান যায় যায় অবস্থা এখন। কিন্তু তারপরো সারাদিন নিশি ঘরে শুয়ে বসে থাকবে আর বেচারা অয়ন খেটে খুটে ফিরে এসে রাধবে ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়, তাই কষ্ট হলেও নিশিই রেঁধে ফেলে। তবে আচার মেখে নিশি দু' এক লোকমা ভাত মুখে তুলতে পারে। ডাল আর আঁচার মাখা নয়তো শুধু আঁচার মাখা ভাত এই হলো নিশির খাদ্য। নিশির এই দুরবস্থা দেখে আশে পাশে থাকা বন্ধু বান্ধবেরা মাঝে মাঝে খাবার দিয়ে যায়। অন্যের হাতের রান্না হলে নিশি একটু খেতে পারে। মূল সমস্যাতো রান্নার গন্ধে। অন্যে রেধে আনলে গন্ধটা ততো তীব্র ভাবে পায় না। এ পরবাসে নিশির বেশ বন্ধু অনিতা। দুজনের মধ্যে ধর্ম থেকে শুরু করে ভাষার অনেক কিছুর পার্থক্য যেমন আছে তেমনি আবার অনেক চিন্তা ভাবনার মিলও আছে। সেই মিলগুলোই পার্থক্য ছাড়িয়ে দুজনকে দুজনের কাছে নিয়ে এসেছে। অনিতার শাশুড়ি এসেছেন দেশ থেকে। যখন নিশি বেশ সুস্থ ছিল দু বন্ধুতে বেশ গল্প হতো অনিতার শাশুড়ি এলে কি কি করবে তাই নিয়ে। এদিকে এখন উনি এসে গেছেন কিন্তু নিশি দেখাই করতে যেতে পারলো না। অনিতার শাশুড়ি আসার সময় দেশ থেকে অনেক আঁচার আর খাবার দাবার নিয়ে এসেছেন। ছেলে বৌ নাতনীদের জন্যে। অনিতা আচার দেখে খুব খুশি। শাশুড়িকে বন্ধুর কথা বলে বললো, চলুন মা ওর সাথে দেখা করে আসি আর ওকে আচারও দিয়ে আসি। বেচারী চারটা খেতে পারবে তাহলে। অনিতার শাশুড়ি দেশ থেকে এসে এখানে বোর হচ্ছেন। উইকএন্ড ছাড়া বেড়াতে যাওয়া নেই, উইকডেজে সবাই যার যার মতো কাজ আর স্কুল নিয়ে ব্যস্ত। যাক তাও কারো বাড়ি যাওয়া হচ্ছে।

কিন্তু যখন শুনলেন মুসলমানের বাড়ি যাওয়া হবে তখন উনি দ্বিধায় পরে গেলেন। কি করবেন, কি করেন? তিনি ময়মনসিংহের কুলীন ব্রাক্ষন ঘরের মেয়ে, সারা জীবন নিষ্ঠার সাথে আচার পালন করে গেছেন। শেষ বয়সে তিন মাস ছেলের বাড়ি বেড়াতে এসে তার ধর্ম নষ্ট করবেন, তা কি করে হয়? অনিতাও ঝামেলায় পরে গেলো। বিদেশেতো সবার প্রধান পরিচয় বাংলাদেশি, মুসলমান - হিন্দু ব্যাপারটাতো ততো সামনে আসে না। এখন কি করে? নিশি তার এতো বন্ধু যে না গেলেও মুখ থাকবে না তার কাছে। পরে শাশুড়ির সাথে রফা হলো, শাশুড়ি আসবেন তার মুসলমান বন্ধুর বাসায় এক শর্তে, তাকে এখানে জল স্পর্শ করতেও বলা হবে না। অনিতা সেভাবেই নিশিকে ফোন করে জানালো। বন্ধুর দুঃখ বন্ধু না বুঝলে আর কে বুঝবে? নিশি বলল, ঠিকাছে আমি জলও সাধবো না। অনিতা আর তার শাশুড়ি বাসায় ঢুকলে নিশি পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে প্রনাম করল, তিনি নিশিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনেই দুজনের কুশল জিজ্ঞাসা করল। আস্তে আস্তে গল্প জমে উঠল। গল্প করতেতো ভালোই লাগে কিন্তু বেশি কথা বললেই আবার শরীর খারাপ করতে শুরু করে। এর মধ্যেই আবার নিশির বমি শুরু হয়ে গেলো। নিশির শরীর যেমনি থাক অনিতাকে সময়মতো বাড়ি ফিরতে হবে, বাচ্চাকে আনতে হবে স্কুল থেকে। অনিতা নিশিকে তাই বাই করে পড়িমড়ি ছুটল শাশুড়িকে নিয়ে বাচ্চার স্কুলে। কিন্তু এরকম অসুস্থ একটা মেয়েকে একা বাড়িতে ফেলে যেতে উনার মন টানছিলো না। বাচ্চা মেয়েটা প্রথম বার পোয়াতী হয়েছে, কেউ কাছে নেই। একা বাড়িতে পরে রয়েছে, খেতে পারছে না কিছু। আজ দেশে থাকলে মা থাকতো কিংবা শাশুড়ি থাকতো কাছে, এটা সেটা রেঁধে খাওয়াতো। মাথায় হাত বুলাতো। আহারে, কার না কার মেয়ে এখানে এভাবে পরে আছে। নিশি উনাকে বিদায় দিতে গাড়ির কাছে আসতেই উনি নিশিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে বেশ কয়েকটা চুমু খেলেন। নিশি সসঙ্কোচে বাক্যহীন। নিশির হাতে ছোঁয়া এক গ্লাস পানি উনি খাবেন না, পবিত্রতা নষ্ট হবে সে জায়গায় উনি দেদারসে নিশিকে চুমু খেয়ে ফেললেন!

এরপর প্রায়ই উনি নিজে এটা সেটা নিরামিষ রান্না করে নিশির জন্য নিয়ে আসতে লাগলেন। ছেলে বৌ এর জন্য আনা নিজের হাতের বানানো আচারও নিয়ে আসতে থাকলেন। ব্যস্ততায় অনিতা অনেক সময় আসতে না চাইলে উনি জোর করে অনিতাকে নিয়ে চলে এসে নিশিকে আদর করে খাইয়ে যেতেন। কিন্তু উনি নিজে নিশির হাতের ছোঁয়া এক গ্লাস পানিও কখনো এ বাসায় স্পর্শ করেন নি। আর নিশিকে তিনি মিষ্টি গলায় শাসন করতেন নিজের যত্ন নেয়ার জন্যে। নিশি কেনো ওর মাকে বলে না, ওর কাছে এসে থাকার জন্যে। এখনিতো মাকে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মাকে যেনো বলে সে কথা বার বার তাগাদা দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যেতেন। যাওয়ার সময় বার বার নিশির কপালে চুমু খেয়ে, নিশির সারা মাথার চুল লন্ড ভন্ড করে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বিদায় নিতেন। উনি যখনি বিদায় নিতেন, নিশির মনে একটা আলাদা অনুভূতি খেলা করতো। যাকে এতোটাই কেউ ভালোবাসে যে বার বার চুমু দিয়ে মাথা মুখ ভিজিয়ে দেয় তার হাতের স্পর্শে এমন কি বিষ থাকতে পারে? কি হবে তার হাতের ছোঁয়া পেলে? মাসির এই ভালোবাসায় যে আন্তরিকতার কোন খাঁদ নেই সে কথা নিশির অন্তর জানে, ভালোবাসা অনুভব করা যায়। তাহলে ধর্ম কি ভালোবাসারও ওপরে থাকে? জানে না নিশি কিন্তু মন মানতে চায় না।

তানবীরা ০৮.১২.০৯

No comments:

Post a Comment