Monday 7 December 2009

শিরোনামহীণ

শুক্রবারে অফিস অনেক চুপচাপ থাকে। মোটামুটি অনেকেই লং উইকএন্ড প্ল্যান করেন, আবার যারা পার্টটাইম কাজ করেন তাদের অনেকেরই পার্টটাইম ডে থাকে শুক্রবার। আমরা সাধারনতঃ উইকডেজে যে কাজগুলোর জন্য সময় পাই না সেগুলো নিয়ে বসি শুক্রবার। ফোন কল কম, লোকের আসা যাওয়া কম মানে বাইরের ডির্ষ্টাবেন্স কম। জট বেঁধে থাকা কাজগুলোর জটা ছাড়ানো হয় সেদিনটিতে। অনেক সময় আমরা মজা করে বলি প্রব্লেম সলভিং ডে।

সেরকম একটা সাধারন শুক্রবারই ছিলো গত শুক্রবারটি। আমাদের এক ক্লায়েন্ট আমাদের কাছে কিছু টাকা পাবেন, তিনি বলছেন তিনি বেশি টাকা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। এটা আমাদের নিত্যদিনের সমস্যা। ক্লায়েন্টরা ভাবেন বেশি দিয়েছেন। আমরা ভাবি না। তারপর সব হিসেব মিলানো হলে যদি দেখি সত্যিই কিছু ব্যালান্স আছে, ক্লায়েন্টকে জিজ্ঞেস করি, কি চাও? পয়সা ফেরত না পরের হিসাব থেকে এডজাষ্ট। যেহেতু এদেশে "খরিদ্দারকে রাজা বলা হয়" তার চাওয়াই আমাদের চাওয়া। এই ক্লায়েন্ট বললেন, ফেরত দিয়ে দাও, পরে আবার নতুন করে হিসাব শুরু করা যাবে। আমি বললাম, তথাস্তু। তোমার একাউন্ট ডিটেলস আমাকে তড়িৎবার্তায় জানাও আমি পয়সা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ক্লায়েন্ট ডিটেলস তড়িৎ বার্তা প্রায় সাথে সাথে পাঠালেও, একটি ডিজিট কোথাও ভুল টাইপ করেছেন। হয় একাউন্ট নম্বর নয় বিক কোড নয় সুইফট কোড। বার বার অন লাইন ব্যাঙ্ক আমাকে এরর দিচ্ছে আর বলছে ডিটেলস ম্যাচ করছে না। আমি আবার তাকে তড়িৎ বার্তা পাঠালাম ডিটেলসটা আবার দেখে দেয়ার জন্যে। এবার আর উত্তর আসে না আসে না প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে যাচ্ছে। আমিও এদিকে অধের্য্য হয়ে যাচ্ছি এটা ক্লোজ করে আমি অন্য কাজে যাবো। এমনিতেও শুক্রবারে সারাক্ষণ কাজ করতে ইচ্ছে করে না। অপেক্ষা করে থেকে ভাবলাম, যাক ফোনই করি। ফোনে ফাইন্যান্স অধিদপ্তরে লোকের কাছে, ডিটেলস চাইতেই তিনি তিক্ত গলায় আমায় জবাব দিলেন, "তুমি বিদেশি, তোমাকে আমি ডিটেলস দিবো না, ইউরোপীয়ান কাউকে ফোন করতে বলো আমি ডিটেলস দিয়ে দিবো।" আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও সাথে মজা পেলাম। বললাম, আমি তাহলে আমার বসকে এই প্রসঙ্গে কি আপডেট দিবো? ভদ্রলোক নির্বিচারে বলে দিলেন বলবে, আমি বিদেশিদের বিশ্বাস করি না।

আমি বিমলানন্দে এই ডায়লগ বসকে তড়িৎ বার্তায় পাঠিয়ে দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে গেলাম। বস তখন তার দুপুরের খাবার দাবার নিয়ে ক্যান্টিনে ব্যস্ত। একটু পর এসে আমাকে বলছেন, "আর ইউ ওকে'? বোধ হয় আমার চিঠি পড়ে খুব আত্মসম্মানে লেগেছে। সব সময়তো ভাব ধরে থাকেন ইউরোপীয়ানরা ভদ্রতার আর সভ্যতার পরাকাষ্ঠা। এইভাব যে এক ডয়েচ গর্দভ এভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিবেন, ভাবেনি হয়তো। আমি সাধারনঃভাবেই বললাম, আমি ঠিক আছি কিন্তু পয়সা দেয়ার কি করবে, তুমি ফোন করো তাহলে। তুমিতো খাটি ইউরোপীয়ান। বস রাগ সামলাতে সামলাতে বললো, পয়সার দরকার থাকলে ওরা ফোন করবে, ডিটেলস দিবে, আমাদের তরফ থেকে আর গরজ দেখানোর দরকার নাই। আর তুমি কেনো ওকে বললা না, সব ইউরোপীয়ানদের বিশ্বাস করা যায়? ইউরোপীয়ানদের মধ্যে চোর ছ্যাচ্চোর নেই?

আমি বললাম, কোম্পানীর শ্লোগান হলো "খরিদ্দার রাজা"। তার সাথে বেয়াদপি করে আমি আবার কোন ফ্যাসাদে পরবো? আস্তে আস্তে অফিসে দু একজন শুনল এ অপমানের কথা। আমার সাথে দরকার ছাড়া ভালো ব্যবহারের প্রলেপ দেয়া শুরু করলো। যেটা আমাকে আস্তে আস্তে মাত্রা ছাড়া ক্রুদ্ধ করে ফেললো। কিন্তু কিছু করার নাই। জীবন এনে এমন জায়গায় দাড় করিয়ে দিয়েছে, নিজের বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে, হাত পা নেড়ে খেলেও মানুষ করুণা করার অবকাশ পেয়ে যায়। আমি না দেখেও জানি আমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে লাল হচ্ছে। ভিতরের তাপের আভা এখন বাইরে দেখা যাবে। যাই নিতে পারি নিজেকে দুর্বল বা অসহায় কাতারে দাড় করিয়ে করুনা নিতে পারি না। তার আগেই যেনো মরে যাই। লড়ে যাচ্ছি লড়ে যাবো কিন্তু কোন ট্যাগিং কাতারে দাঁড়িয়ে তার সুবিধা নিবো না। অতি কষ্টে নিজের মনোভাব লুকিয়ে বাসায় ফিরেছি, "চোর" অপবাদ নিয়ে। শনিবারে কাছাকাছি থাকা এক বন্ধু এসেছে এমনিতেই সান্ধ্য আড্ডা দিতে। তার সাথে গল্পে গল্পে এটা বললাম সে আমাকে বললো, তোকে মুখে মুখে যারা সান্ত্বনা দিয়েছে অফিসে ইনক্লুডেড তোর বস, সবাই মনে মনে কি বলেছে জানিস? "ঠিক বলেছে, ঠিকি বলেছে"। বিদেশি মানেইতো চোর আবার কি?

আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে স্রোতের উল্টোদিকে নৌকা বাইতে বাইতে। অকারনেই মেজাজও লাগে খুব। সব কিছু ভেঙ্গে চুরে দিয়ে বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় কোথাও আগুন জ্বেলে কিংবা ভূমিকম্প করে কিছু ধ্বংস করে দিতে পারতাম। হয়ে যাক পৃথিবীর এক প্রান্ত তছনছ কিছু। আমি বাদামি বর্নের, এর মধ্যে আমার হাত কোথায়? আমি গরীব দেশে জন্মেছি, গরীব পিতার ঘরে জন্মেছি এটা কি আমার দোষ? আমিতো এগুলো নিয়ন্ত্রন করি নাই। যা আমার নিয়ন্ত্রনের মধ্যে ছিল না তার জন্যে কেনো আমাকে শাস্তি পেতে হবে সারা জীবন ধরে? এ শাস্তির শেষ কোথায় আর কবে? আগে সন্ত্রাসী, অপরাধীদের জন্য মন থেকে এক ধরনের ঘৃনা অনুভব করতাম। আজকাল কেমন যেনো একাত্মতা অনুভব করি। আগে অনেক সময় সংবাদপত্রে সন্ত্রাসীদের তাদের সন্ত্রাসী হওয়ার কারন নিয়ে কোন ফিচার থাকলে, এক ধরনের অবজ্ঞা আসতো মনের মাঝে, মনে মনে বলতাম, হু অপরাধের কারন জাষ্টিফায়েড করতে আসছে, কিন্তু অপরাধতো অপরাধই। তার আবার জাষ্টিফিকেশন কিসের? কিন্তু আজকাল মনে হয় কারণও হয়তো আছে। আস্তে আস্তে পিছনে যেতে যেতে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তখন আর যেতে না পারলে শুরু হয় প্রতি আক্রমন।

আমারো আজকাল মনে হয়, দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে আমার। যে অপরাধ আমার নয় তার শাস্তি আমি আর চাই না।

কাজী নজরুল ইসলাম মাথায় ভর করে থাকেন, মনে হয় সারাক্ষণ

লাথি মার ভাংরে তালা
আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা

তানবীরা
০৭.১২.০৯






No comments:

Post a Comment