Tuesday 5 October 2010

৭০ এর ঢাকা ---- মধ্যবিত্তের চোখে

আজকাল মনে হয় পুরো দস্তুর প্রবাসী হয়ে গেছি। সারাক্ষন পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই ঢাকা গেলে। পরিবর্তন কাঁদায়, নতুন জিনিস বিরক্ত লাগে। বাড়ি গেলে এঘর ওঘর ঘুরে ভাইজির স্তুপ করা খেলনার মাঝে নিজের শৈশব খুঁজে ফিরি। চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি পরা দাদু বসে থাকতেন সারা বেলা জায়নামাজের ওপর, পাবো না জেনেও তার মমতা খুঁজি, আমার নিজের হাতে লাগানো মানিপ্ল্যান্টের চারাটাকে খুঁজে বেড়াই যেটা কখনো আমার পড়ার টেবিলের ওপর কখনোবা শুধুই জানালার ওপর ঝুলতো। কারন আমার দুমাস পর পর ঘরের আসবাবপত্র টানাটানি না করলে কেমন যেনো বন্দী বন্দী লাগতো। কখনো খুঁজে ফিরি মায়ের কাছে বাতিল হয়ে যাওয়া সেই পুরনো দিনের শোকেসটা। পুরো কাঠ আর কাঁচের সম্বনয়ে চার তাকের জিনিসটি যেটি আমার বই রাখার সম্পত্তি ছিল বহুদিন। বই কিনে আমার নাম লিখে তাতে মালিকানার ছাপ লাগিয়ে তারপর পড়ে কাঁচের মধ্যে সাজিয়ে রাখা। দস্যু বনহুর থেকে সাতকাহন, মেমসাহেব থেকে শেষের কবিতা কি না ছিলো তাতে, কতো গর্বিত ভঙ্গীতে সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। কালের বিবর্তনে সেসব কালের গর্ভে।

সেই সময় অনেকক্ষন দাদুর হাত পা টিপে দিলে মাঝে মাঝে চার আনা পয়সা পাওয়া যেতো। হাত পা টিপতে টিপতে সেই পঁচিশ পয়সায় মাকে ফাঁকি দিয়ে নিষিদ্ধ দ্রব্য কি কি খাওয়া যাবে তার স্বপ্ন দেখতাম। মুদি দোকানে প্লাষ্টিকের প্যাকেটে ঝোলানো পাঁচ পয়সার হজমী, কালো রঙের এক রকমের ঝাঝালো পাউডার যেটা মুখে নিলে এক ধরনের অম্ল ঝাঝা স্বাদ পাওয়া যেতো। কাঁচের বোয়ামের মুখ শক্ত করে আটকানো টিনের ঢাকনা দিয়ে আর তাতে লাল গুড়ের সন্দেশ, আর সাদা গুড়ো দুধের কিছু একটা পাওয়া যেতো যার নামও সন্দেশ ছিল, যার ডানার যতো সম্ভব পাঁচটি বুটি দেয়া থাকতো। আরেকটি বস্তু ছিল নানা বর্ণের মানে রঙ করা, ছোট ছোট বল বল মিষ্টি খেতে যাকে বলতাম আমরা টিকটিকির ডিম।

দুপুরে মা চাচীদের ঘুমের সময় আসতো কটকটিওয়ালা। লোহার বা টিনের বাক্সে থাকতো সেই পদার্থ। খালি হরলিক্সের বোয়াম কিংবা আচারের বোয়াম দিয়ে হলুদ রঙের একটা আপাতঃ শক্ত পদার্থ পাওয়া যেতো মিষ্টি স্বাদের। গরমে ছিল লাল, কমলা কিংবা সবুজ রঙের পানি আইসক্রীম যা খেলে জীহবা, ঠোঁট সব রঙীন হয়ে যেতো। আর বাবা চাচাদের সাথে বেড়াতে গেলে দামী বেবী আইসক্রীম যা দুধ আর চিনি দিয়ে বানানো হতো।

ভট ভট শব্দের একটি খেলনা বাজিয়ে আসতো খেলনাওয়ালা। তার কাঁধে বাঁশের মাচার মতো কিছুতে খেলনাগুলো ঢুকিয়ে নিয়ে। সিলভারের হাড়ি পাতিলের সেট, প্লাষ্টিকের পুতুল মেয়েদের জন্যে। ছেলেদের জন্যে প্লাষ্টিকের পিস্তল, নানারকমের মুখোশ, আর থাকতো প্লাষ্টিকের এক ধরনের ফুল যা হাতে নিয়ে দৌড় দিলে বনবন ঘুরতো। সেই ছিলো মধ্যবিত্ত বাচ্চাদের খেলার জিনিস। এছাড়া কিছু খেলাধূলা ছিলো যেগুলো খেলতে সেই অর্থে কোন উপকরনের দরকার হতো না। খোলা একটা উঠোন হলেই হয়ে যেতো। ছোয়াঁছুয়ি, বরফপানি, সাতচারা, বউচি, গোল্লাছুট, কানামাছি, রুমালচোর, টিলু এক্সপ্রেস, বিউকুইক প্রভৃতি।

বাংলা সিনেমায় তখন যতোসম্ভব বিউটি কুইন শাবানা, ববিতা, কবরীর দাপট যাচ্ছিল সাথে নায়ক রাজ রাজ্জাক কিংবা এ্যাংগরী ইয়াংম্যান ফারুক, উজ্জল ছিলেন। সাদাকালো সিনেমার যুগ তখন। নয়নমনি, অবুঝমন, রংবাজ এর মতো সিনেমার যুগ তখন। বিটিভিতে তখন মাসে একটা বাংলা সিনেমা দেখানো হতো, সেদিন পাড়া জুড়ে সাজ সাজ রব থাকতো। যাদের বাড়িতে টিভি আছে তাদের বাড়ি সেদিন আলাদা ঝাড়পোচ করা হতো রাতের শো’র জন্য।বাচ্চারা দিনে ঘুমিয়ে নিতো যাতে রাত জেগে সিনেমা দেখতে পারে। কিন্তু টিভি কতৃপক্ষ বেশি রাতে সিনেমা শুরু করে, মাঝে খবর আর বিজ্ঞাপন দিয়ে সিনেমা এতো দেরীতে শেষ করতো যে বাচ্চাদের পক্ষে সিনেমা শেষ করা সম্ভব হতো না কখনোই। তবে সন্ধ্যে বেলায় তখন বাচ্চাদের জন্য “সেজান”, “কুমকুম” টাইপ কার্টুন সিনেমা ছিলো।

তখন টিভি চলতো বিকেল পাঁচটা থেকে রাত বারোটা অব্ধি। বিটিভিতে সপ্তাহে একটি নাটক প্রচার হতো আর হতো মাসে একটি বিশেষ নাটক, যেটিকে বলা হতো এ মাসের নাটক। সুর্বনা – আফজাল, মিতা – আল মনসুর, ফেরদৌসী মজুমদার – আবদুল্লাহ আল মামুন এরা ছিলেন সে সময়ের হার্টথ্রব। তবে সুর্বনা আফজালের চেয়ে জনপ্রিয় কোন জুটি সেসময় ছিল না। কালো স্যুটকেস, রক্তের আঙ্গুরলতা, রক্ত করবী নাটকগুলো সে সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ইংরেজী সিরিয়ালও ছিল তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক উম্যান, হাওয়াই ফাইভও দেখার জন্য সবাই সোমবার, মংগলবার গুনে গুনে অপেক্ষা করতেন।

বাংলা গানের মেইন স্ট্রিমের দখলে ছিলেন তখন সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশীদ আলম, আব্দুল জব্বার, বশির হোসেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ছিল বিধায় তখন দেশাত্ববোধক গান খুবই জনপ্রিয় ছিল। ফ্যাশন কুইন রুনা লায়লা গাইতেন নদীর মাঝি বলে এসো নবীন কিংবা লক্ষ প্রানের বিনিময়ে এনেছি সোনার বাংলাদেশ। সাবিনা ইয়াসমিন আসতেন ও আমার সাত কোটি ফুল দেখোগো মালি কিংবা মাঝি নাও ছাইরা দেরে মাঝি পাল উড়াইয়া দে নিয়ে। তবে রুনা লায়লার গাওয়া চটুল গান “বাড়ির মানুষ কয় আমায় তাবিজ করেছে” ও প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সে সময়। পপ গানে ছিলেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাজমা জামান প্রমুখ। সে সময়ের কিছু জনপ্রিয় গান, এমন একটা মা দেনা, মামনিয়া মামনিয়া, চুমকী চলেছে একা পথে, হৈ হৈ রঙীলা রঙীলা রে, অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায় প্রভৃতি।

আরো ছিলেন গাটরী কাঁধে লেইসফিতা, কাঁচের বাক্স কোমড়ে কাঁচের চুড়িওয়ালী আর ঝাঁপি হাতের বেদেনী। যাদের কখনো বাড়িতে ডাকা নিষেধ ছিল। ওরা যাদু মন্ত্র করে বাড়ি থেকে সব নিয়ে যায়। বেদেনীরা শিঙ্গা লাগাতো, কাজটা কি আমি জানি না কিন্তু এই বলেই শব্দ করে ডাকতো। মা – চাচীরা ঘুমিয়ে গেলে দুপুরে গেটের বাইরে গৃহকর্মীরা চুড়িওয়ালী থামাতেন, বাছাবাছি করতেন, সেই চুড়ির ঝুড়ির দিকে কতো দিন তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থেকেছি।

সারা ঢাকা জুড়ে মধ্যবিত্ত এলাকায় টিনশেড একতলা বাড়ির ছড়াছড়ি ছিল। আর বাড়ি ভর্তি ফুল আর ফলের গাছ। প্রতিটি বাড়ির আশে পাশে চড়ে বেড়াচ্ছে হাঁস – মুরগী। বাড়ির সামনের দিকে টিনের চালে বোগেনভিলিয়া আর পেছন দিকে পুঁই – লাউ লতিয়ে থাকতো। অনেক বসার ঘরে একটি সাদা কালো টিভি, কারো কারো বাড়িতে ল্যান্ড লাইনের ফোন যার নাম ছিল তখন টিন্ডটি আর কারো কারো ডাইনীং এ ছিল একটি মাঝারী সাইজের ফ্রীজ যার ওপরটা ডীপ আর নীচের অংশ টুকু নরম্যাল। স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের প্রতিচ্ছবি।

তানবীরা

০৫.১০.০১০

আপডেট

০৬.১০.১০

কৃতজ্ঞতাঃ টুটুল ভাই

No comments:

Post a Comment