Friday 29 October 2010

মিলিনিয়াম দশকের ঢাকা-------- প্রবাসীনির চোখে

২০০০ সালে নতুন দশকের সাথে সূচনা হয় নতুন সহস্রাবব্দের। সারা পৃথিবী জুড়ে এনিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। নিরানব্বই – দুই হাজারে বাংলাদেশের অনেক দোকান পাটের নাম হয় এই অনুসারে। ঢাকার নিউমার্কেটে চলে আসে “মিলিনিয়াম বিরানী হাউজ”। নামকরনের এই ব্যাপারটি বাংলাদেশে ইউনিক। চায়নীজ রেষ্টুরেন্টের নাম ‘ম্যাকডোনাল্ডস”, চুল কাটার দোকানের নাম “কাসাব্লাংকা হেয়ার কাটিং”, জিগাতলায় আছে “সুনামী রেষ্টুরেন্ট”। যেকোন জিনিস যেকারনেই আলোচিত তার দ্বারাই কিছু না কিছু দেশে নামাংকিত। বুশ আর সাদ্দামের যুদ্ধের কারনে সে সময়কার জন্মানো প্রচুর ছেলে শিশুর নাম “সাদ্দাম”। আর একটি জিনিস আমার বাংলাদেশের খুব মনে ধরে রাস্তার দুপাশে মনোরম সব বিলবোর্ড। এ জিনিসটি আমি খুব একটা বাইরে দেখিনি দক্ষিন এশিয়া বাদে। পশ্চিমে থাকে খুবই ছোট সাইজের সামান্য বিজ্ঞাপন, কিন্তু প্রকট রঙ ব্যবহার করে, পেল্লায় সাইজের এই বিলবোর্ড একান্তই দক্ষিন এশিয়ার গৌরব।

এই গৌরবজ্জল সহস্রাবব্দের সূচনা হয়েছে বাংলাদেশে খুবই কলঙ্কজনকভাবে। থার্টি ফার্ষ্ট নাইট উদযাপন করতে অনেক ছেলেদের পাশাপাশি কিছু মেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বের হয়েছিল। সেখানে “বাঁধন” নামে এক তরুনীকে প্রকাশ্যে লান্থিত করা হয়। যার কারনে তার ব্যক্তিগত জীবন প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়, তার সেই সময়ের বাগদত্তা তাদের বাগদান ভেঙ্গে দেন। ২০১০ সালে অপরাধ প্রমানিত না হওয়ায় সেইদিনের সব অপরাধীকে আদালত মুক্তি দেন। সমন জারী করা সত্বেও একদিনও বাঁধন আদালতে আসেননি, শুনানীতে কিংব সাক্ষ্য গ্রহনে অংশগ্রহন করেননি। পৃথিবী জুড়ে যে সহস্রাবব্ধের সূচনা হয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে, সেখানে বাঁধন নিজের ওপর হয়ে যাওয়া অন্যায়টুকুর প্রতিবাদ করার সাহস পাননি নিজ দেশে।

এই দশকে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে তার ডাবল হ্যাট্রিক অর্জন করে বিশ্বজোড়া অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন থাকে। মধ্যবিত্তের জীবন ধারায় প্রভূত পরিবর্তন ও উন্নতি দেখা যায়। প্রায় বাড়িতেই রঙীন টিভি, ডীপ ফ্রিজ, এসির মতো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী সাধারন ঘটনায় পরিনত হয়। প্রায় সবার হাতে হাতেই মোবাইল। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার মোবাইল – টিভি এগুলো তখন মধ্যবিত্ত নয় নিম্নবিত্তের হাতে পৌঁছে গেছে। প্রায় প্রতি মধ্যবিত্ত ঘরেই কম্পিউটার বর্তমান। এবং আধুনিক জেনারেশন ব্যাপকভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহারও করছেন। আগের মতো সিদ্ধ করে পানি ছেঁকে ঢালার পরিবর্তে বাড়িতে বাড়িতে ফিল্টার মেশিনের প্রচলন হয়। ঢাকায় বসুন্ধরা - শর্পাস ওয়ার্ল্ড এর মতো শপিং মল এসেছে মধ্যবিত্তের জীবনে। সারা গুলশান – ধানমন্ডি ভরে গেছে বাহারী ইংরেজী, বাংলা নামের আধুনিক ও অভিজাত রেষ্টুরেন্টে। বিশ্ববিখ্যাত ফার্ষ্ট ফুড চেইন কেন্টোকী ফ্রাইড চিকেন, পিজা হাট তাদের বাংলাদেশের প্রথম দোকান খুলেন গুলশানে। বুমারস এর মতো রেষ্টুরেন্ট ছাত্র ছাত্রীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিংস বেকারী ব্রাউন ব্রেড নিয়ে আসেন ঢাকার বাজারে। আগে মাছওয়ালা, মুরগীওয়ালা শুধু বিক্রি করেই চলে যেতেন। এখন তারাও বাড়তি সেবা প্রদানে মনোযোগী হয়েছেন। বিক্রির পর মাছ – মুরগী কেটে দিয়ে যান। সারা দেশ জুড়েই ফার্মের মুরগী খাওয়ার প্রচলন হয় দেশি মুরগীর পাশাপাশি।

এই দশকে আবারো জলপাই রঙধারীরা প্রায় দুবছর দেশ শাসন করেন। বিদ্যুৎ সমস্যা প্রকট আকার ধারন করে এই দশকে। বিদ্যুৎ সমস্যা, পানির সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, অসহ্য যানজট নিয়ে চলেছে এই দশকের মধ্যবিত্তের জীবন। বিদ্যুৎ সমস্যার আপাত সমাধান বের করেন মধ্যবিত্তরা আইপিএসের মাধ্যমে। শনির আখড়ায় ২০০৬ সালে অতিষ্ঠ এলাকাবাসি তাদের জনপ্রতিনিধিকে ধাওয়া করেন এক পর্যায়ে। বাংলা ভাই নামের এক সন্ত্রাসীর উত্থান ঘটে এবং হাজার নাটকের মাধ্যমে তাকে সরকার গ্রেফতার দেখিয়ে এই নাটকের আই ওয়াশ সমাপ্তি ঘটান। একযোগে ৬৩টি জেলায় বোমা বিস্ফোরনের ঘটনাও এদশকেই ঘটে। ২১শে আগষ্ট ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ঘটনার তদন্ত কাজ চলছিল। তবে এই দশকে বংগবন্ধু হত্যা মামলার আসামীদের সাজা হয় আর জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়। রমনা বটমূলে নতুন বছরের প্রথম প্রহরে সন্ত্রাসীরা বোমা হামলা করে। বোমা বিস্ফোরন, বিল্ডিং ধ্বসে মৃত্যু, অগ্নিকান্ডে মৃত্যু, হত্যা সর্বোপরি অপমৃত্যুর হার এই দশকে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়ায়। যারই অপমৃত্যু হোক না কেনো, যেকোন কারনে তার সুবিচার পাওয়া বাংলাদেশে অসম্ভব এটাও এই দশকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

আনিসুল হকের লেখা আর মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী এর পরিচালনায় ব্যাচেলর নামক ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয় মধ্যবিত্ত দর্শকদের কাছে। ব্যাচেলর সিনেমার ভাষারীতির দ্বারা তরুন সমাজ ব্যাপক প্রভাবিত হন। প্রমিত ভাষার পরিবর্তে উঠতি লেখকরাও ফারুকী ভাষা ব্যবহারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। নগর জীবনে, স্কুল কলেজে, নাটকে, সিনেমায় এই ভাষাটির প্রচলন শুরু হয়। সুশীল সমাজে এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের জীবনের কোথাও এই ভাষারীতিটি রয়ে যায়। তিশা, শ্রাবন্তী, তিন্নি, প্রভা, অপূর্ব, শাহেদ, হাসান মাসুদ, অপি করিম এরা এসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রী। আনিসুল হকের লেখা ধারাবাহিক ৬৯, ৫১, দৈনিক তোলপাড় মধ্যবিত্তের কাছে ব্যাপক প্রশংসা পায়। সেই সময় নাটকেরও গ্রুপ তৈরী হয়। হুমায়ূন আহমদের গ্রুপ, সালাহউদ্দিন লাভলু গ্রুপ, আনিসুল হক গ্রুপ ইত্যাদি। প্রত্যেক গ্রুপের কিছু ফিক্সড অভিনেতা অভিনেত্রী ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ মানেই শাওন, সালাহউদ্দিন লাভলু মানেই তানিয়া আর ফারুকী মানেই তিশা। এ সময়ের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক ছিল ৪২০, লাবন্যপ্রভা, রঙের মানুষ।

লেখালেখির জন্য ব্লগ মাধ্যমটিও ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সামহোয়ারইন নামক বাংলা ব্লগটি প্রথম বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতিষ্ঠিত ব্লগ। অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক সাংবাদিক প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি অন্তর্জালেও লেখালেখি শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, হাই ফাইভ, অর্কুট, টুইটার, গুগল বাজ এগুলোর বিশদ ব্যবহার ঢাকাবাসী শুরু করেন। মোবাইলের মাধ্যমে অন্তর্জাল ব্যবহার করাও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এসময়। মিলা, তিশমা, আনুশেহ, শাহরিয়ার জয়, অর্নব, বাপ্পা, পার্থ, হাবিব, বালাম, তপু, তাহসান এরা সেসময়ের জনপ্রিয় গায়ক গায়িকা। দেশি কাপড় ব্যবহার করে দেশে তৈরী পোশাক তখন তারকাদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। ফ্যাশন হাউজ রঙ, ড্রেসিড্যাল, ইনফিনিটি, স্মার্টেক্স, বাংলার মেলা, মায়াসীর, দর্জি, মান্ত্রা এরা নিজেদের ডিজাইনের স্বাতন্ত্র্যের কারনে মধ্যবিত্তের মন কাড়েন। মধ্যবিত্তকে ভারত থেকে বাংলাদেশমুখী করে তুলেন এই ফ্যাশন হাউজগুলো। অনে্কে বিয়ের উৎসবের জন্যেও দেশি ফ্যাশন হাউজের ওপর নির্ভর করতে লাগলেন। পাটিয়ালা সালোয়ার নামক অনেক কুচি দেয়া পাঞ্জাবী সালোয়ার ২০০৪ – ২০০৫ এর দিকে খুব জনপ্রিয় ছিল। আবার সেই সময় ওপরে কলার তোলা বান্টি বাবলী কামিজের ডিজাইনও হট কেক ছিল। যদিও বিভিন্ন সময় ভীর জারা থ্রীপিস, লাক্ষৌ চিকেনের কাজ করা থ্রীপিস, চুন্দরী থ্রীপিস, কটকী থ্রীপিস ঘুরে ঘুরে ফ্যাশনে ছিলো। এ সময়ে কিশোরী তরুনীদের কাছে জীন্স ফতুয়া বেশ জনপ্রিয় ছিল। আধুনিক ছেলেরা অলঙ্কার পরা শুরু করেন এ দশকে। হাতে নানা ধরনের ব্রেসলেট, গলায় মালা সহ অনেককেই দেখা যেতো। অনেক ছেলেই রঙীন পাঞ্জাবী ও ফতুয়া পরতেন।

গয়নায়ও আসে যুগান্তকারী পরিবর্তন। হাল ফ্যাশনের গয়নার পরিবর্তে আগের দিনের ভারী ভারী সেকেলে গয়নার ডিজাইন বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রুপোর গয়নায় সোনার জল দিয়ে তাতে নানা রঙের ম্যাচিং পাথর বসিয়ে মেয়েরা পরতে লাগলো। সোনার বদলে রুপো হয়ে ওঠলো মধ্যবিত্তের অলংকার। বিয়ের সাজেও আগের মতো প্রচুর ফেস পেন্টিং বাদ গেলো। হাত ভর্তি করে কনুই পর্যন্ত মেহেদী দেয়া হতো বিয়ের কণেদের। অনেকে পায়েও দিতেন। কনেরা লালের পাশাপাশি অন্য রঙের কাপড়ের ব্যবহার শুরু করলেন বিয়েতে। অনেক সময়ই দেখা যেতো বর কনে রঙের সামঞ্জস্য করেই কাপড় পরেছেন। বরদের শেরোয়ানী, পাগড়ী প্রভৃতিতে মুম্বাইয়ের লেটেষ্ট মডেলের ছাপ দেখা যেতো। বিয়েতে আলাদা আলাদা কোনে ছেলে মেয়েকে আলাদা করে বসানোর পরিবর্তে, বরকনেকে পাশাপাশি চেয়ারে বসানোর রেওয়াজ শুরু হলো। গায়ে হলুদে গান নাচের প্রচলন হয় ব্যাপক ভাবে। মধ্যবিত্ত মেয়েরা প্রচন্ড ত্বক, রুপ সচেতন হয়ে ওঠে সে সময়। প্রায় প্রতি পাড়ায় মোড়ে বিউটি পার্লার দেখা যেতো এসময়টায়। অনেক মধ্যবিত্ত মেয়েরা নিজেরাও এ ব্যবসার প্রশিক্ষন নিয়ে বিউটি পার্লার চালাতে উদ্যেগী হন, তাতে করে বিউটি পার্লার মানেই চায়নীজ কিংবা হংকং এ ধারনাটা পালটে যায়। ক্লান্তিময় নগরজীবন থেকে অব্যহতি পেতে অনেকেই ঈদের ছুটি ছাটায় সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা কিংবা সুন্দরবনে বেড়াতে যেতেন।

মোবাইলের ব্যবহারের কারনে কিংবা অন্তর্জালের সহজ লভ্যতার জন্যেই হোক আশঙ্কাজনকভাবে পরকীয়া প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। এজন্য অনেকে সন্তানের জীবন নিতেও পিছপা হননি। সাহসী কিছু ছেলে মেয়ে এসময় লিভ টুগেদার করতেন। ইভ টিজিং এর ঘটনায় মেয়েদের আত্মহত্যার হার যেকোন দেশের যেকোন কালের রেকর্ড ছাড়ায়। কিন্তু সবচেয়ে আর্শ্চয্যের ব্যাপার হলো এনিয়ে সুশীল সমাজ বিশেষ করে মহিলা মহল একে বারেই চুপচাপ ছিলেন। তাদেরকে কোন ধরনের মানব বন্ধন, প্রতিবাদ সভা, নিদেন পক্ষে পত্রিকায় দু একটা কলাম লিখতেও দেখা যায়নি।

২০১০ সালের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টে পূর্ববর্তী সরকার থেকে পাওয়া ১৬৮ কাঠা আয়তনের সুরম্য প্রাসাদ থেকে সেনাবাহিনী বের করে দেন। জননেত্রী কেনো সেনাবাসে থাকবেন এবং প্রচন্ড ধনী হওয়া সত্বেও কেনো তিনি সরকারী সম্পদ এখনো ভোগ দখল করবেন এই ছিল তখনকার সবার যুক্তি। ২৯শে নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ে তিনি আইনি লড়াইয়েও হেরে যান এবং বাড়িটির দাবী তাকে আপাতত ছাড়তে হয়।

তানবীরা

৩০।১০।২০১০

No comments:

Post a Comment