Monday 11 October 2010

৮০ এর ঢাকা ---- মধ্যবিত্তের চোখে

যা হারিয়ে যায় জীবন থেকে তা চিরতরেই হারিয়ে যায়। এলেবেলে শৈশব, আড়ি দেয়া সেই সব বন্ধুরা, প্রেমময় সেইসব মুহূর্ত, প্রেমিকের ঘামে ভেজা উষ্ণ হাত, বলা না বলা কথার সেই ক্ষন, চিরচেনা শহর, ঝিম ধরা দুপুর, মন কেমন করা গোধূলি বেলা, মন উদাস করা বৃষ্টি, সূর্য তারা সব। পরে থাকে পাহাড়সম স্মৃতি আর এক বুক ব্যাথা। এক সময় জীবন হয়ে ওঠে স্মৃতির রেলগাড়ি।

আশির দশকে আমরা স্কুলে টিফিন খেতাম ক্রীমরোল, বাটারবন, বনরুটি ইত্যাদি। ক্রীমরোল খেতে খুবই ভালো ছিল। আমি এখনো ঢাকাতে গেলে ক্রীমরোল খাই। নিউমার্কেট আর পান্থ পথের সুইস বেকারীতে পাওয়া যায়। বাটারবন আমার কোনদিনও পছন্দ ছিল না, খাচ্ছি খাচ্ছি কিন্তু শেষ হতো না। রঙীন কাগজে মোড়া টফি পাওয়া যেতো যেটা সম্ভবত চকলেটের চেয়ে দাম বেশি ছিল। টফির গায়ে ঘর ঘর ডিজাইন কাটা থাকতো। আজ অব্ধি আমার প্রিয় মিল্ক ভিটা চকলেট দুধ আশিতেই বোধহয় প্রথম ঢাকার মার্কেটে আসে। মিমি চকলেট খুব খেতাম কিন্তু সেটা কি আশির দশকে প্রথম এসেছিলো? নিউমার্কেটে তখন একটা দুটো করে খাবারের দোকান খোলা হচ্ছিল। আজকের মতো এতো রোল আর বার্গার তখন ছিল না, তখন ছিল ফুচকা, চটপটি, লাচ্ছি, জিলিপী, পেষ্ট্রি জাতীয় খাবার আর কাঁচের বোতলের কোক। আশির দশকের মধ্যভাগে যোগ হয় পোলার আইসক্রীম। আমরা আগে যে চকবার খেতাম তার উন্নত মডেল। পোলারের আগে ছিল মিল্ক ভিটার ইগলু ।

তবে আশির দশকের প্রথম দিকে তিতাসের কিংবা ছায়ানীড়ের কেক, বিস্কিট, বাটার, আর শেষদিকে কুপারসের কেক ও স্ন্যাকস বেশ জনপ্রিয় ছিল। আর ছিল স্নো হোয়াইটের কোন আইসক্রীম। ভ্যানিলা আর চকলেট ফ্লেভারে পাওয়া যেতো। বাড়ি থেকে সব সময় ভেবে যেতাম যেভাবেই হোক দুটো খাবো, কিন্তু এতো বড়ো থাকতোযে একটাই শেষ করতে পারতাম না। কোন আইসক্রীম খেতে যাওয়া তখন এক ধরনের আউটিং এর মধ্যে পরতো। অনেক ধরনের আনন্দ জীবনে ছিল যেগুলো আজকের ছেলে পেলের কাছে হাস্যকর মনে হবে। রানী এলিজাবেথ একবার বাংলাদেশে আসবেন দুদিনের জন্য। তার খাবার আসবে সিঙ্গাপুর থেকে, আরো কি কি সব ব্যাপার। সারাক্ষন ইত্তেফাক পেপার আর টিভিতে এই নিয়ে খবর হচ্ছে। আমাদেরকে যে খবর আকর্ষিত করলো তাহলো রানী আসা উপলক্ষ্যে সমস্ত রাস্তা কার্পেটিং করা হবে। রাস্তা কার্পেটিং কি বস্তু তখন আমরা জানি না। কিন্তু রানী আসবেন। নার্সারী রাইমস মনে পরে সারাক্ষন, পুষি ক্যাট পুষি ক্যাট হোয়ার হ্যাভ ইউ বীন? আই হ্যাভ বীন টু লান্ডান টু লুক এট দা কুইন। আমাদের প্যাচরা প্যাচরীতে বিরক্ত হয়ে রাতের দশটায় আব্বু গাড়ি বের করে আমাদের নিয়ে এয়ারপোর্ট রওয়ানা হলেন কার্পেটিং দেখাতে। আমরা পুরো পরিবার মানে আম্মি, আব্বু, তখনের আমরা তিন ভাইবোন, সাথে আমার দুই খালাতো বোন এক খালাতো ভাই আর খালাম্মা। আমরা সবাই ঐ টয়োটা করোলা ডিলাক্সের মধ্যে কোথায় জায়গা হয়েছিলাম এখনো আমি তার হদিস পাই না। তখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। জীবন তখন খুবই সহজ সরল ছিল। আমরা সারা রাস্তা লাল কার্পেট খুঁজতে খুঁজতে এয়ারপোর্টের খুব কাছ থেকে মনঃক্ষুন্ন হয়ে ফিরে এলাম। যতোই আব্বু বুঝান আসলে কার্পেটিং মানে কি আমাদেরতো মন মানে না।

ইত্তেফাক তখন খুবই নামকরা প্রতাপশালী পত্রিকা ছিল। ছোটদের আকর্ষন ছিল দাদুভাইয়ের রোববারের পাতা। তবে সামরিকজান্তার বিপক্ষে প্রথম যায় যায় দিন বেশ চলেছিল। তখন যায় যায় দিন সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। শিশু বলে মাসিক একটি পত্রিকা বের হতো, নবারুন ছিল। আর ছিল সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক রহস্য পত্রিকা, কিশোর পত্রিকা। মায়েদের ছিল বেগম নামের একটি মাসিক পত্রিকা। সিনেমা কিংবা অন্যান্য আইটেমের বাহার ছিল বিচিত্রা নামক সাপ্তাহিকটিতে। আশির দশকের শেষের দিকে আনন্দ বিচিত্রা বের হতো পাক্ষিক, তারা প্রথমে ফটো সুন্দরী আইডিয়াটি নিয়ে কাজ করেন, যাতে নুসরাত ইয়াসমিন টিসা প্রথম ফটো সুন্দরী হন। আমাদের হাতে হাতে ঘুরতো রুশ দেশের উপকথা, সিন্দাবাদের বানিজ্য যাত্রা, নন্টে ফন্টের কীর্তি টাইপ জিনিসগুলো। সাধারন জ্ঞান বাড়ানোর জন্য তখন বাচ্চাদের আর একটা জিনিস গিলানো হতো তার নাম ছিল বাংলাদেশ ও বিশ্বের ডায়েরী ভবেশ রায় সম্পাদিত। সাতটি আশ্চর্যের নাম, সাতটি উপমহাদেশ কিংবা পাঁচটি মহাসাগরের নাম এগুলো থাকতো সেই বইয়ে। উন্মাদ তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল।

আশির দশক পুরোটাই ধরতে গেলে ছিল সামরিক শাসন। জিয়া – এরশাদ। যদিও আমি মাত্র দুই দশক বাংলাদেশের বাস করেছি। সামরিক আর অসামরিক শাসনের কোন তফাৎ আমার জীবন যাত্রায় আমি অনুভব করি নাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাহা বাহান্ন তাহাই কেমন করে যেনো পয়ষট্টি হয়ে যায়। বিটিভিতে শুধু সেট বদলায়। প্রথম ছিল এরশাদ – রওশন সেট, তারপর এলো খালেদা সেট আবার হাসিনা সেট। তবে সেসময় বাংলাদেশে ইসলামীকরন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধানে ইসলাম আসে, সাপ্তাহিক ছুটি শনি রবিবার বদলে শুক্রবার করা হয়। একটাই আনন্দ ছিল অল্প কিছুদিন পর পর হ্যা ভোট না ভোট, এই নির্বাচন সেই নির্বাচন হতো। আর সেই উপলক্ষ্যে টিভিতে সারা রাত ভরে ভালো ভালো অনুষ্ঠান হতো। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় এরশাদের স্বেচ্ছাচার শিশুকিশোরের মনেও প্রভাব রেখেছিলো। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এরশাদবিরোধী মিছিল সংস্কৃতিতে সামিল হয়েছিলো গুডবয় ধরণের কিশোরতরুণও। সামরিক শাসকদের আরো একটি বড় অবদান ছিল সার্ক আর সাফ গেমস। সার্ক উপলক্ষ্যে ভালো ভালো ভিনদেশি সিনেমা দেখতে পেতাম, গান শুনতে পেতাম।

খেলাধূলার সামগ্রীতেও আসে তখন বেশ পরিবর্তন। তিতাসে তখন ছয়শ – আটশ টাকায় বড় বড় পুতুল পাওয়া যেতো। যার মুখ থেকে চুষনী বের করে নিলে ওয়া ওয়া শব্দে কাঁদতো সেই পুতুল। ব্যাটারীতে চলতো সেসব খেলনা। চাবি ঘুরালে বাঁদর ঢোল বাজায়, ট্রেনের লাইন পেতে ব্যাটারীতে চলা ট্রেন ইত্যাদি, গেমস ওয়াচ। যদিও ক্যারাম, লুডু তখনো প্রধান খেলনা। আবার অনেক বাড়িতেই তখন এক্যুরিয়াম পেতে মাছ পোষা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বস্তুবাদের চর্চা বোধহয় তখন থেকেই মধ্যবিত্তকে আক্রমন করছিলো। আবাহানী আর মোহামেডানের ফুটবল ছিল মধ্যবিত্তের একমাত্র বিলাস। বাড়িতে বাড়িতে পতাকা টানানো হতো দুদলের। সর্মথকদের মারামারি ঠেকাতে ষ্টেডিয়ামে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হতো। ঢাকায় ফাইন্যাল খেলার দিন সাজ সাজ রব পরে যেতো। সালাহউদ্দিন তখন তারকা, লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপনে তাকে দেখা যেতো।। সবাইকে আমরা জিজ্ঞেস করতাম, আবাহানী না মোহামেডান?

আশির দশক থেকে আমরা আস্তে আস্তে স্মার্ট হতে শুরু করি। আমাদের গান বাজনায় আসে লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন, সুরে ছন্দে গায়কীতে। বিদেশি সাংস্কৃতিকেও সাদরে আমন্ত্রন জানিয়ে ঘরে নিয়ে আসি। নাজিয়া জোহেবের ডিস্কো দিওয়ানে শুনিনি কিংবা মুগ্ধ হইনি এমন শিশু আমরা খুব কমই ছিলাম। স্কুলের পিকনিকে নাচিনি এই গানে সেই প্রজাতিও বোধহয় বিরল। এটা বোধহয় আশির প্রথম দিকের ঘটনা, মাঝের দিকে মাইকেল জ্যাকসন আসেন ঢাকায় তার জাষ্ট বীট ইট, জাষ্ট বীট ইট নিয়ে। তাতে ভাইয়াদের ব্রেক ড্যান্স করার কসরত দেখেছি। তবে সেই সময় শোয়েব – কুমার বিশ্বজিত, তপন চৌধুরী আর শুভ্র দেবও খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। আজ থেকে বারোটি বছর, তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে, মন শুধু মন ছুঁয়েছে কিংবা কৃষ্ণচূড়ার ছায়ে ছায়ে নির্জন পূর্নিমা রাতে ক্যাসেটে, টিভির ফিলারে সারাক্ষন বাজতো। আর অনেক মেয়েরাও তখন বোধ হয় রুনা লায়লাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতেন, নেচে নেচে আধুনিক গান গাইতেন। পিলু মমতাজ আর সাবা পন্নীর কথা এখনো মনে পরে। একদিনতো চলে যাবো গানটি কিংবা বন্ধু আমার ওগো প্রিয় তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল। সাবা পন্নী অবশ্য তার অত্যাধুনিক সাজের জন্যও আলোচনায় আসতেন বার বার। ফীডব্যাক, সোলস এদের কনসার্ট মধ্য আশির পরে অভিজাত হোটেলের বাইরে সাধারন জনগনের কাছে আসতে শুরু করলো বাংলা গানের মাধ্যমে। প্রথম দিকে তারা বোধহয় ইংরেজী গানই শুধু গাইতেন। তবে আশির শেষের দিকে ব্যান্ড সংগীতের চূড়ান্ত বিস্ফোরন ঘটে বাংলাদেশে। যার যা ছিল তাই নিয়েই নেমে পরেছিলেন ব্যান্ড বাজাতে।

আমাদের চলচিত্রও তখন পিছিয়ে নেই। সাদাকালোর পরিবর্তে রঙীন ছবি চলে তখন প্রেক্ষাগৃহে। শাবানা, ববিতাকে পাশ কাটিয়ে তখন আছেন চোখে তিন খানা পাপড়ি শুদ্ধ অঞ্জু ঘোষ, ফাইভ ষ্টার হোটেলের ওয়েটারদের ড্রেস পরা ওয়াসিম। আধুনিক ক্যারাটে নিয়ে রুবেল। গাড়ি পোড়ানো কিংবা ওপর থেকে লাফ দেয়া ইংলিশ টাইপ সিনেমার জন্য ববিতা, সোহেল রানা। মিষ্টি মেয়ে সুচরিতা কিংবা দুষ্ট ছেলে ইলিয়াস কাঞ্চন। সিনেমা দেখার জন্য তখন কতো কেঁদেছি কেটেছি। কিন্তু সবাই এক ধমক মেরে অঙ্ক বই কিংবা ইংলিশ গ্রামার বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছে কিন্তু সিনেমা আজো দেখা হয়নি। একবার এক সিনেমা এলো দূরদেশ, সবাই দেখলো আর আমরা কতো কাঁদলাম কিন্তু হায়……। অনেক কিছু মনে করতে পারি না আজকাল তাই ভেবেছিলাম ছোটবেলার কথা এখন ততো মনে নেই কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম সিনেমা পার্টটা বেশ মনে আছে। বিটিভির ছায়াছন্দের কল্যানে গানগুলোতো দেখতাম। গোগ্রাসে গিলতাম। আজো মনে পড়ে চ্যালেঞ্জ নামে একটা সিনেমায় ম্যাক্সি পরা ববিতার হ্যাল্লো হ্যাল্লো হ্যাল্লো একটা গানের কথা, সুচুরিতার আঁখি মিলন সিনেমার আমার গরুর গাড়ি গানের কথা্……।। আশির শুরুর দিকে ছুটির ঘন্টা, পুরস্কার, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী সিনেমাগুলো মধ্যবিত্ত দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আর শেষের দিকে বেদের মেয়ে জ্যোস্না বোধহয় ব্যবসায়িক সাফল্যের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে।

ঢাকায় তখন আস্তে আস্তে মধ্যবিত্তের ড্রইং রুমে রঙীন টিভি, ভিসিআর ঢুকছে। বাংলা সিনেমা দেখতে যাওয়া নিষেধ বটে কিন্তু বাসায় হিন্দী ফ্লিম দেখা হচ্ছে। ওয়াসিম দেখা নিষেধ কিন্তু জিতেন্দ্র ওপেন। অঞ্জু ঘোষ থার্ড রেট কিন্তু জয়াপ্রদা বা শ্রীদেবী চালু। নাগ – নাগিনী টাইপ সিনেমা ভদ্রলোকেরা দেখে না কিন্তু নাগিন দেখে। মাওয়ালি আমার ছোটবেলায় দেখা প্রিয় সিনেমা ছিল। জিতু আঙ্কেল আমার প্রথম ক্রাশ। কতো টিফিনের ঝালমুড়ির পয়সা আমার গিয়েছে জিতু আঙ্কেলের ভিউকার্ডের পিছনে। জাষ্টিস চৌধুরী মামনিয়া পম পম গানটা আহা। কিংবা তোফা বা সংযোগ। এমনিতে সিনেমা দেখা নিষেধ হলেও গ্রাম থেকে কেউ আসলে কোন কাজে তারা শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানার সাথে সাথে একটু ভি।সি আরও দেখতে চাইতো। আর আমরা থাকতাম এই অপেক্ষায়। ভুজুং ভাজুং দিয়ে মাওয়ালি কিংবা ডিস্কো ড্যান্সার লাগিয়ে দিতাম। কিংবা কখনো কুলীর লাম্বুজী লাম্বুজী বলো টিংকুজী।

বিটিভিও তখন দারুন ফর্মে ছিল। দুর্দান্ত জনপ্রিয় সব ধারাবাহিক নাটক হতো টিভিতে প্রতি মংগলবার বাংলা খবরের পরে। ঢাকায় থাকি, সকাল সন্ধ্যা, এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি সবই আশির দশকের ফসল। হুমায়ূন আহমেদ নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান তখন। আগে ঈদে ছিল সবসময় আমজাদ হোসেনের লেখা ও অভিনীত নাটক স্পেশাল। সে সিংহাসনও তার কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদ কেড়ে নেন। ঈদের নাটক চলে যায় হুমায়ূন আহমেদের দখলে। আমজাদ হোসেনের ভাড়ামি শেষ হয়ে শুরু হয় হুমায়ূন আহমেদের ভাড়ামি যদিও প্রথম দিকে প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু একই অস্ত্র ব্যবহার করে করে যক্ষতিতা করে ছেড়েছেন তারা দর্শকদেরকে। সে সময় একটি এ্যাড হতো টিভিতে, যতো সম্ভব এ্যাডটি আফজাল হোসেনের বানানো ছিলো, পিয়ারসন্স এর এ্যাড। রু রু রু মিউজিকের তালে একদল সাদা ঘোড়া দৌড়াত। আজো স্মৃতিতে সেই ভালো লাগার রেশ রয়ে গেছে। ফজলে লোহানী পরিচালিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান “যদি কিছু মনে না করেন” এর হাত ধরে আসে “ইত্যাদি”। দ্যা ফল গাই, ম্যাকগাইভার আর থান্ডার ক্যাটস ছিল আমাদের সেই সময়ের আরো কিছু উজ্জল মাইল ফলক। চার্লিস এঞ্জেলস হতো বোধহয় সোমবারে, আমরা অনেকেই তখন তাদের মতো নিজেদেরকে ভাবতে চাইতাম, সাব্রিনা, ফারাহ ফসেট, তাদের চুলের স্টাইল তখন ঢাকায় বেশ জনপ্রিয়। মুভি অফ দ্যা উইকে আসতো ভালো ভালো সব ইংরেজি সিনেমা। ছোটদের জন্য ডাবল ডেকার, থ্রী স্টুজেস, বিল কসবি শো ছিল দারুন উপভোগ্য। শুক্রবার সকালের ফ্যামিলি টাইজ ছিলো দুর্দান্ত আকর্ষণ। মাইকেল ডগলাস ছিলেন আকর্ষনের একটা উল্লেখযোগ্য উৎস।

ঢাকায় তখন মেয়েরা বেশ ফ্যাশন সচেতেন হয়ে উঠছেন। নতুন নতুন বেশ পার্লার খোলা হচ্ছে। উৎসবে হাল ফ্যাশনের চুল কাটা, চুল বাঁধা চলতো। রেখা তখন অনেক মেয়েদেরই হার্ট থ্রব। রেখার মতো জামা বানানো, চুল বাঁধা, হাতে চুড়ি পরা কিংবা জয়াপ্রদার ব্লাউজের ডিজাইন দিয়ে ব্লাউজ বানানো তখন ঢাকাতেও বেশ চালু ছিল। আশির দশকের শুরুতে ছেলেরা তখনও বেলবটম পরতো, মেয়েরা ছোট চিপা কামিজ বিশাল ঢোলা সালোয়ার। ছিয়াশি সাতাশির দিকে ব্যাগি স্টাইল গ্রাস করে নেয়া পুরো দেশ। ঢাকার পুরো বাজার ভারতীয় কাপড়ে তখন সয়লাব থাকা সত্বেও কিছু কিছু সাহসী দেশ প্রেমিক দেশীয় কাপড় ব্যবহার করে নিজেরা ফ্যাশন হাউজ করার উদ্যোগ নেন। মধ্য আশিতে পুরো ধানমন্ডি জুড়ে ইষ্ট ওয়েষ্ট ডিসপ্লে, পুষ্প, বো-মোনড, পার্বনী, বুননের পদচারনা ছিল যা দেশের অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখে সাথে সাথে দেশীয় ফ্যাশনকে মধ্যবিত্তের দরজায় আনে ও জনপ্রিয় করে তুলে। এ সমস্ত ফ্যাশন হাউজের মধ্যে আড়ং সবচেয়ে সফল আর সর্ববৃহৎ বলা চলে।

সমস্ত সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকায় তখন রুপচর্চার টিপস দেয়া শুরু হলো। আটা, ময়দা, বেসন, লেবু, মধু, টমেটো, শসা সব কিছু দেয়া থাকতো মুখে মাখার জন্য। চোখ বড় হলে আর চোখ ছোট হলে কোথা থেক কাজল আঁকতে হবে সেগুলোও লিখে দেয়া শুরু করলেন এক্সপার্টরা। সমস্ত ঢাকা জুড়ে তখন চার তলা, পাঁচতলা বাড়ি ওঠার হিড়িক লেগে গেলো। বাড়ির সামনের পিছনের বাগান ছেটে দিয়ে সেখানে গ্যারাজ তৈরী হলো। বিকেলে ছাঁদে বেড়ানোর কিংবা ঘুড়ি ওড়ানোর একটা রেওয়াজ হলো। যেটাকে অনেকে আবার অশুদ্ধ ভাষায় টাংকি নামেও ডেকে থাকেন। তখন টেলিফোনে কলার আইডির যন্ত্রনা ছিল না, মাঝেই মাঝেই ফোনের উৎপাত হতো। উৎপাত দু তরফ থেকেই হতো। এটা একটা চালু মজার গেম ছিল। বান্ধবীরা একসাথে হলেই আমরাও ফোন টেনে এনে হাবিজাবি সব নাম্বারে ফোন করে উল্টোপাল্টা সব কথা বলতাম। নিজেদের পছন্দের তারকা, খেলোয়ারদের রঙীন সব ভিউকার্ড জমানোর তখন রেওয়াজ ছিল। আজাদ প্রোডাক্টস এর ঈদকার্ড ও অন্যান্য গ্রীটিংস কার্ড তখন বাজারে বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বন্ধু বান্ধবকে কার্ড দেয়া তখন একটা ফ্যাশন হয়ে ওঠল।

তানবীরা
১২.১০.১০

No comments:

Post a Comment