Thursday 2 December 2010

অহনার অজানা যাত্রা (আট)

ভিন দেশে অচেনা পরিবেশে স্বল্প পরিচিত একটা ছেলের সাথে জীবন কাটানো অহনার জন্য সব সময় সোজা ছিলো না। একবার এখানের অনেক কিছু চিনেছি বুঝেছি ভেবে মানসিক যে শক্তি সে অর্জন করতো পর মুর্হূতেই অন্য একটা ঘটনায় সেটা উবে যেতো। আশা নিরাশার দোলায় সে দুলতো সারাবেলা। ছোটখাটো অনেক ঘটনা, যেগুলো বিশ্লেষন করলে কোন যুক্তিতেই হয়তো গুরুতর নয় কিন্তু সেগুলোও সে সময় মনে প্রচন্ড প্রভাব ফেলতে লাগলো। যার কারনে অনেক সময় আপাতঃ সামান্য ব্যাপারেও অহনা অনেক অস্বাভাবিক আর তার স্বভাবের চেয়ে অনেক বেশি রুক্ষ আচরন করে বসতো। একবার অহনা বাসে করে স্কুলে যাচ্ছিলো। বাসে খুব আনমনা ছিলো সে। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজের মনে আকাশ পাতাল সব ভেবে যাচ্ছিলো। যখন লক্ষ্য করলো তখন দেখলো বাস এক অজানা জায়গা দিয়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে অহনা পরের স্টপেজে নেমে, রাস্তার পাশের ফোন বুথ থেকে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে অর্নকে ফোন করে বললো, “আমি হারিয়ে গিয়েছি, আমায় নিয়ে যাও।“ অফিসে হঠাৎ অহনার এধরনের ফোন পেয়ে হতবিহ্ববল অর্ন ওকে বার বার জিজ্ঞেস করছিলো, কোথায় তুমি এখন, কোথায়? কোথায় তা কী সে জানে? জানলে আর হারাবে কেনো? অহনা কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি জানি না আমি কোথায় এখন, তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। এর মধ্যে পয়সা শেষ ফোন কেটে গেলো।

ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে শীতের সেই প্রায় অন্ধকার দিনে নির্জন সেই রাস্তায় অহনা দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন একা একা কাঁদলো। কেউ নেই তার পাশে। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার এই দেশগুলোতে কাজ ছাড়া সাধারণতঃ কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না। বাংলাদেশে যদি বাসস্ট্যান্ডে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতো নিশ্চয় তাহলে অন্ততঃ দেখার জন্য হলেও দশটা লোক দাঁড়িয়ে পরতো। এখন বিধি বাম আর এখানে বিধিই নেইতো আর তার ডান বাম। একটু পর যখন আর একটা বাস উলটো দিক থেকে ফিরছিল তখন অহনা বাস কাউন্টারে গিয়ে সেই বাসে উঠে পরলো। কার আশায় আর কতোক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবে। আধ ঘন্টা পর পর একখানা বাস যায়। এবার বেশ বড় বড় চোখ করে বাইরে তাকিয়ে অহনা হারিয়ে যাওয়ার রহস্যটা আবিস্কার করার চেষ্টা করতে লাগলো। দেখলো তার অসাবধানতায় বাসটা স্কুল ছাড়িয়ে বেশ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলো এবং জায়গাটা অপরিচিত বলে সে হারাবে কেনো এই লজিক্যাল চিন্তার বদলে অনেক বেশি ভয় পেয়েছিলো। ততোটা ভয় পাওয়ার আসলে কিছু হয়তো ছিলো না। অচেনা দেশ আর নতুন পরিবেশ অকারনেই ভয় খাইয়ে দেয়। এখন আর কি করবে, দেরীতেই স্কুলে ঢুকে, বাকি ক্লাশ করে বাড়িতে এলো সে। এসে দেখলো এন্সারিং মেশিনে বেশ কটি ম্যসেজ জমে আছে। বাটন টিপতেই শুনলো, অর্নের গলা। সে বাড়ি ফিরেছে কীনা তা নিয়ে অর্নের বেশ উদ্বিগ্ন গলা। বাড়ি ফিরেই যেনো ফোন করে জানায় বেশ কবার অর্ন তাকে সে তাগাদা দিয়ে রেখেছে।

ভিন্ন একটা পরিস্থিতি থেকে একা ফিরে এসে ফোনের ম্যাসেজ শুনে অহনার মাথায় রাগ চড়ে গেলো। সে অর্নকে কিছুতেই ফোন করে জানাবে না ঠিক করলো। একটু পরেই আবার ফোন বাজলো। মনে হলো সে বাড়ি ফিরেছে কিনা এটা চেক করার জন্য হয়তো অর্ন ফোন করেছে। তাই সে সারাদিন ফোন ধরবে না এটাও ঠিক করে ফেললো। অহনা এতো কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে পারলে অর্নও যাক কিছু টেনশানের মধ্যে দিয়ে। আর টেনশান না ছাই, সে এতো কাঁদলো কাটলো, অর্ন কি তাকে সাহায্য করতে কিংবা নিতে এলো। এতোক্ষন অহনার মধ্যে যতো ধরনের যুক্তি আর চিন্তা কাজ করছিলো না কেনো, মেশিনে অর্নের গলা পেয়ে সে যুক্তি চিন্তা সব অন্য স্রোতে বইতে শুরু করে দিলো। এতোবড়ো একটা বিপদে পরল সে কিন্তু অর্ন একটু এগিয়েও এলো না? এই ছেলের সাথে তাকে থাকতে হবে? কিছুই না করে তার জন্য, অফিসে বসে আরাম করে টেলিফোনের ফুটানী ঝাড়ছে। বিকেল পর্যন্ত অর্ন ফোন করে করে ক্লান্ত হলো, ম্যসেজের পর ম্যসেজ রাখলো কিন্তু অহনা গোঁজ হয়েই রইলো। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে অর্ন রেগে গেলো অহনার এই গোয়ার্তুমীর কারনে। তারপরো সে যতোই ব্যাখা করতে লাগলো, হারিয়ে গিয়েছি বলে ফোন রেখে দিলে, সে তাকে কোথায় খুঁজতে যাবে, কিভাবে? অর্ন জানে স্কুল কোথায় কিন্তু বাস রুট সে জানে না। সে জানে ড্রাইভ রুট, দুটো আলাদা। এতো বড়ো শহরের কোন পাশে খুঁজতে বের হবে তার একটা সামান্য ধারনাতো লাগবে নাকি? সারাদিন এতো টেনশান ক্রিয়েট না করে, অর্নকে তার জানানো উচিত ছি্লো সে ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছেছে। অফিসেতো অর্ন খেলতে যায় না, তাকে কুল মাইন্ডে কাজ করতে হয়। একেতো অর্ন কোন সাহায্য করেনি তার ওপর এসে আবার শুরু করেছে রাগারাগি!!!

প্রথমে অহনার হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে নীল হওয়ার ধকল, তারপর কোথাও কেউ নেই তাকে সাহায্য করার সেই মানসিক কষ্ট, আর এখন এই রাগারাগি তাকে বিধ্বস্ত করে ফেললো। কার দোষ আর কার না সেটা চিন্তা করার ক্ষমতাও উধাও হলো। সে আশপাশ ভুলে চিৎকার করে মা মা বলে কাঁদতে শুরু করে দিলো। অর্নও যেহেতু অনেক রেগে ছিলো সেও অহনাকে কিছু বলতে এলো না। কাঁদলে কাঁদো টাইপ ভাব। চিৎকার করে কান্নাকাটি করে কিছুক্ষন পর সে নিজে নিজে কিছুটা শান্ত হলো বটে কিন্তু এখানে আমার কেউ নেই। আমি একা, একান্তই একা এই ভাবনার একটা নিষ্ঠুর ছাপ তার মনের মধ্যে পার্মানেন্ট হয়ে গেলো। যা মানসিকভাবে অহনাকে অনেক দুর্বল করে ফেললো। একেইতো বাংলাদেশি সমাজে তার তেমন ঠাঁই নেই তারওপরে হারিয়ে গেলে খুঁজে নিয়ে আসারও কেউ নেই। রান্নাবান্না পুড়ে গেলে নষ্ট হয়ে গেলে অর্নের সোজা হিসেব ফেলে দাও। নতুন করে রাঁধো কিংবা কিনে খেয়ে নিবো এই হলো অর্নের সাহায্য। রান্নাটা ঠিক করে কি করে করতে হবে সেটা বলে দেয়ার মতো কেউ নেই। সংসারের টুকিটাকি ছোটখাটো কোন সমস্যায় আটকে গেলে নির্ভেজাল উপদেশ দিয়ে সাহায্য করবেন তেমন কেউ নেই তার পাশে। নতুন জীবনে তথা এই পুরো পৃথিবীতে সে নিজেকে প্রচন্ড একা মনে করতে লাগলো। আস্তে আস্তে বিষন্নতা গ্রাস করলো। বিষন্নতা মন থেকে শরীরেও প্রবেশ করতে লাগলো।

অহনার প্রায়ই জ্বর হতে লাগলো। ঠিক জ্বর নয় কিন্তু জ্বর জ্বর অনুভূতি, দুর্বল লাগা, ক্ষিধে না থাকা ইত্যাদি। তার গলা থেকে উচ্ছাস, প্রান ঝরে গেলো। টেলিফোনে তার গলার নিষ্প্রান স্বর তার বাবা মাকে দিন দিন উদ্বিগ্ন করতে লাগলো। ডাক্তার বিভিন্ন রকম পরীক্ষা আর ঔষধ দিয়ে নিশ্চিন্ত করলেন এই রোগ আসলে অহনার দেহের নয় মনের। সে প্রচন্ড হোম সিকনেসে ভুগছে। সে সুস্থ না হলে তাকে বিষন্নতার ঔষধ দেয়া হবে। এভাবে বেশ কয়েক মাস চললো। আবেগী অহনার মনে আবেগ আসতে সময় নেয় না কিন্তু যেতে অনেক সময় নেয়। কিন্তু তারপরো এক সময় সংসারের নানান কাজে, চাপে, উৎসবে অহনা মনের গ্লানি ভুলে আবার সামনের দিকে তাকাতে শুরু করলো। সময় হলো মহাষৌধ যা তার নিয়মে অনেক কিছুকে ম্লান করে দেয়। আপাতত ভাবি ভুলিয়ে দেয় কিংবা কষ্ট কমিয়ে দেয়। আসলে হয়তো তা নয়। কষ্ট আগেরটাই থাকে শুধু সহ্য শক্তি বেড়ে যায়। কিছু কিছু ধাক্কা মানুষকে অনেক সময় কিছুটা শক্ত করে তুলে। আরো অনেকেই এই পৃথিবীতে একা বেঁচে আছেন, বেশ লড়াই করে, শক্তভাবে সুন্দর ভাবে বেঁচে আছেন, আমাকেও থাকতে হবে এ কথাটা মনে মনে অনেকভাবে আওরে নিজেকে শক্তি দিতে চাইতো সে। কখনো কখনো তাতে কিছুটা শক্তি মনে সঞ্চয় হতোও বটে। কিন্তু ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে সরাসরি তারাহীন সেই নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকালে বুক ফেঁটে একটা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসতো, সব শক্তি উবে যেতো শুধু মনে হতো “একা আমি এতো দূরে, আমার নিজের পৃথিবী ছেড়ে।“

তানবীরা
০৩.১২.২০১০।


No comments:

Post a Comment