Sunday 26 December 2010

সেন্ট মার্টিন (দুশো বছর পরে)

মুখবন্ধঃ ২০০৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর সেন্ট মার্টিনে ছিলাম দুদিন। আরো থাকার খুবই ইচ্ছে ছিলো কিন্তু নিরন্তর ব্যস্ততা দিলো না আমায় অবসর। “ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড” এ ধরতে গেলে প্রায় রিমোট অঞ্চলে যেয়ে আমার মন প্রশান্তিতে ভরে ছিলো। গাড়ি নাই, কারেন্ট আসে মাত্র দু এক ঘন্টার জন্যে, গরম পানি নাই, মোবাইলের নেট ওয়ার্ক নাই, ল্যাপটপ নাই, ফেসবুক নাই, ব্লগ নাই আহা কি শান্তি কতোদিন পর। এই মুগ্ধতার রেশ বহুদিন আমার মনে ছিলো আরো বহুদিন থাকবে আমি জানি। আমি স্বভাবগত ভাবেই ক্ষ্যাত টাইপের মানুষ, বহুদিন বিদেশে থেকেও ক্ষ্যাতত্ব ঘুচে নাই। কয়লা ধুলে যা হয় আর কি। আমার কেনো যেনো ওয়েল এ্যরেঞ্জড ভ্যাকেশেনের থেকে এসব খাওয়ার ঠিক নাই, শোওয়ার ঠিক নাই টাইপ ভ্যাকেশন খুব ভালো লাগে। নীল দিগন্ত নামে এক রিসোর্টে গেছি রিসোর্ট দেখতে, পাশে লেকমতো কেটেছে তারা তাতে দেখি সাপ দৌড়াদোড়ি করে খেলছে, পানির ওপর থেকে দেখে প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেলো। আমি খুশি হয়ে অন্যদের দেখাতে, তারা চেহারা বাংলা পঞ্চম করে রিসোর্ট বাতিল করে দিলো, বেক্কল আমি আবার ধরা।

কিন্তু সেই চাঁদনী রাত, রিসোর্টের বারান্দা থেকে শোনা সমুদ্রের গর্জন, আর প্রায় গ্রাম্য লোকদের কন্ঠে শোনা অতি আধুনিক গান, “মনে বড়ো জ্বালারে পাঞ্জাবীওয়ালা”, পাশে কয়লায় বারবিকিউ হচ্ছে, নানা রকমের তাজা সামুদ্রিক মাছ, যান্ত্রিক আমার জীবনের জন্য একটি অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্য। একটা ঝড় এলে আমাদের আর কেউ কোনদিন খুঁজ়ে পাবে না এই অনুভূতি ছিলো স্বর্গীয় আমার কাছে। অনেকদিন ভেবেছি আচ্ছা সেন্ট মার্টিনটা কি অযত্নে বাংলাদেশে পরে রয়েছে। এখানের লোকজন টুকটুক করে বার্বেডোজ, সেসেলস, মরিশাস, ইবিজা আইল্যান্ডে ছুটিতে যায়। সেন্ট মার্টিনটা বাংলাদেশে না হয়ে যদি পশ্চিমের কোথাও হতো তাহলে সেটা দেখতে কেমন হতো? সময় আর আলসিতে লেখা হয়ে ওঠে নাই এ ভাবনাগুলো এতোদিন। সেদিন শনিবার রাতে আয়োজন করে সিনেমা দেখতে বসলাম “নাইট এট দি মিউজিয়াম” এডভেঞ্চার কমেডি মুভি। ছবিটা দেখে আবারো “এমন হলে কেমন হতো” লেখাটা লেখার ইচ্ছাটা কুটকুট করতে লাগলো মনে। এবার তাই লিখেই ফেললাম।

আচ্ছা “সেন্ট মার্টিন” দ্বীপটি যদি ইউরোপে হতো তাহলে আমরা কিভাবে সেখানে যেতাম? কিংবা আজ থেকে দুইশ বছর পর আমরা কিভাবে সেন্ট মার্টিন যাবো? সবচেয়ে সস্তার উপায় সম্ভবত থাকতো, “শাটল ট্রেন”। টেকনাফ থেকে মাটি খুঁড়ে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত সমুদ্রের নীচ দিয়ে ট্রেন রাস্তা বানানো হতো। গাড়ি নিয়ে শাটলে ওঠে যাবে লোক, গাড়ি প্রতি ৫০০০ টাকা। কিছু দেখতে পাবে না, গরীবের বেশি দেখাদেখির দরকার নাই। সমুদ্রের এদিক থেকে গাড়ি নিয়ে ডুববে, ঐদিক থেকে ভুস করে ওঠবে। আধ ঘন্টায় সেন্ট মার্টিন। যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত তারা যেতে পারবেন বোটে। “ডিজিটাল কেয়ারি সিন্দাবাদ”, কিংবা “দি রয়্যাল ঈগল এক্সপ্রেস”। নীচে সবাই গাড়ি রেখে, ওপরে ডেকে যেয়ে বসবেন। দু – ঘন্টার জার্নি। দিনের বেলা গাড়ি প্রতি ১০.০০০ হাজার টাকা আর রাতের বেলা গেলে ১৮.০০০ হাজার টাকা। রাতের বেলা নীচে থাকবে নিকষ কালো সমুদ্র, ওপরে খোলা নীল আকাশ, আকাশের সারা গায়ে ফুটে থাকবে অসংখ্য দুধ সাদা বেল ফুলের মতো তারা, পূর্নিমা হলে “নিশি রাত সাথে নিয়ে তার বাঁকা চাঁদ”। তার সাথে মৃদ্যু মন্দ ঠান্ডা বাতাস, সুদূরে চারপাশ নীরব নিঝুম, ঝিম ধরা। অসহ্য একটা ভালো লাগায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এখুনি মরে যাচ্ছি এমন একটা অনুভূতি হবে। এগুলোতো ফ্রী হতে পারে না। তাই রাতের ট্রিপ দামি।

বোটে থাকবে রেষ্টুরেন্ট লাং লীং লাংলা, এর মধ্যে পাওয়া যাবে সেট মেন্যু। ফ্রায়েড রাইস প্লাস প্রন টেম্পুরা আর ভেজটেবল কারি ৩৫০০ টাকা প্রতি প্লেট, ড্রিঙ্কস এক্সক্লুডেড। কিংবা প্লেইন নাসি উইথ সুইট এন্ড সাওর বিফ বল উইথ স্পিনাচ ইন থাই সস ৩০০০ টাকা প্রতি প্লেট। পাশের সাউথ ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে পাওয়া যাবে মাশালা দোসা ১৫০০ টাকা অথবা শাহি পানির উইথ রুমালি রুটি ১৮০০ টাকা প্রতি প্লেট। লাচ্ছি আর জিরা পানি অর্ডার দিলে বানানো হবে তাজা তাজা। আর অবশ্যই থাকবে পকেট ফাঁকা কিন্তু পোজপাজিয়া ষ্টুডেন্টদের জন্য কফি কর্নার। এক কাপ চা/কফি ১৫০ টাকা, দুটো সমুচা কিংবা রোল ৫০০ টাকা, ক্লাব স্যান্ডউইচ ৩০০ টাকা । সফট ড্রিঙ্কস ২৫০ টাকা প্রতি ৩০ সিএল এর বোতল। বড়লোকেরা যাবেন প্লেনে চেপে। ফরেনাররা যাবেন ফার্ষ্ট ক্লাশে নইলে ফার্ষ্ট ক্লাশ ফাঁকা যাবে, কারন বাংলাদেশের অতি বড়লোকেরা সেন্ট মার্টিন যান না তারা যান সিঙ্গাপুর। আর ঘুষ খাওয়া কিংবা সদ্য এক্সিকিউটিভ, সিইও পদে পদোন্নতি পাওয়া বড়লোকেরা যাবেন ইকোনোমী ক্লাশে বউকে সঙ্গে করে। ফার্ষ্ট ক্লাশ ৬৫.০০০ হাজার টাকা আর ইকোনোমী ৪০.০০০ টাকা। প্লেনে তারা হালকা/ফুলকা স্ন্যাকস/ড্রিঙ্কস পাবেন কারন এতো কাছের ফ্লাইটে মিল দেবার নিয়ম নেই।

সেন্ট মার্টিন পৌঁছানোর পর বেশির ভাগ সবাই চলে যাবেন আগে থেকে ইন্টারনেটে বুকিং দেয়া রিসোর্টে কিংবা হোটেল ও মোটেলে। বেশির ভাগ হোটেলেই সুইমিং পুল, সাওনা, জিম ও ডিস্কো আছে। দিনের বেলা সব চলছে চলবে ঢিলেঢালা। কেউ কেউ গায়ে লোশন মেখে সমুদ্র স্নান করবেন, কিংবা সাঁতার, ডাইভিং, বাঞ্জি জাম্প, সেইলিং, সার্ফিং। যারা পরিবার কিংবা বান্ধবী নিয়ে যাবেন তারা সৈকতে বসে বালির রাজপ্রাসাদ বানাবেন আর ভাংগবেন, পরদিন আবার বানাবেন। জমে ওঠে দ্বীপ সন্ধেবেলা থেকে। রোদের তাপ কমে গেলে সবাই তাদের বেষ্ট আউটফিটে বেরোবেন। ডিস্কোগুলোও তাদের লাল নীল নিয়ন বাতি জ্বালিয়ে দিবে। মাঝে মাঝে কেউ যখন দরজা খুলে ঢুকবে কিংবা বেরোবে তখন হালকা আওয়াজ পাওয়া যাবে, “মনে বড় জ্বালারে পাঞ্জাবীওয়ালা”র সুরের। তখনো ডিস্কো সব ঢিলাঢালা থাকবে। ভীড় থাকবে রেষ্টুরেন্ট আর বারবিকিউ ক্যাফেগুলোতে। বড় বড় লবষ্টার, তেলাপিয়া, রুই, ইলিশ একদিকে গ্রীল হবে অন্যদিকে খাসির রান, মুরগী। সাথে ফিলার হিসাবে আলু, আপেল, ভুট্টা, বেগুন, টম্যেটো। দ্বীপের অথরিটি ট্যুরিষ্টদের জন্যে খোলা আকাশের নীচে বারবিকিউ এর সুন্দর ব্যবস্থা রেখেছেন। একসাথে দু’শ লোক বারবিকিউ করতে পারবেন কিন্তু তারপরো এখানে সমুদ্রের পাড়ে এতো ভীড় হয়ে যায়, আগে থেকে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, জায়গা দখল করার জন্যে। গ্রীল দেয়া আছে, বাকি কয়লা, প্লেট – গ্লাস, মাছ – মুরগী সব নিজেকে যোগাড় করে নিতে হবে। তাতেও সমস্যা নেই, কাছে অনেক সুপারমার্কেটের এরকম রেডি প্যাকেজ আছে মিট প্যাকেট ফর টু কিংবা ফিশ প্যাকেজ ফর ফোর ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনেকেই মাংসকে পুড়তে দিয়ে নিজে গিটার নিয়ে বসে পরবেন। পাশ থেকে গান ভেসে আসবে, “ঐ দূর পাহাড়ে লোকালয় থেকে দূরে, মন কেড়েছিলো এক দুরন্ত মেয়ে সে কবে……”। গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে গান শুনবেন। কেউ কেউ তার সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীকে জড়িয়ে ধরে সামান্য নাচবেন। এ জায়গাটুকু মাছ – মাংসের গন্ধে, গানে, চুড়িং টুংটাং, ফিসফাস, কাপড়ের খসমস, হঠাৎ কেঁদে ওঠা শিশুর শব্দ, আধো হাসি আধো কথায় ভরে থাকবে। যারা ভীড় ভাট্টা পছন্দ করেন না তারা কাঁচ দেয়াল ঘেরা বারবিকিউ রেষ্টুরেন্টে চলে যাবেন তাদের পার্টনারকে নিয়ে। কাঁচ ভেদ করে কোন গন্ধ কিংবা শব্দ তাদের কাছে পৌঁছুবে না। মৃদ্যু আলোয়, খুব কম ভলিউমে বাজবে সেখানে রবির সেতার কিংবা বিটোফোন বা মোর্জাৎ। ক্রিষ্টালের গ্লাসে ফ্রেঞ্চ কিংবা ইটালিয়ান – স্প্যানিশ ওয়াইনের সাথে ওয়েল সার্ভড ডিনার সারবেন তারা।

(চলবে)

তানবীরা
২৭.১২.২০১০.

No comments:

Post a Comment