Wednesday 15 December 2010

ফাহমিদা নবীর সাথে কিছুক্ষন

বাসুগের আয়োজনে তৃতীয় বারের মতো “বাংলাদেশ ডে” উদযাপিত হলো নেদারল্যান্ডসে। এবারের আয়োজনের মূল আকর্ষন ছিলেন সুকন্ঠী গায়িকা “ফাহমিদা নবী”। বাসুগের পক্ষ থেকে তার সাথে করা কিছু একান্ত আলাপচারিতার অংশ বিশেষ পাঠকদের জন্য।

১. নেদারল্যান্ডসে এসে আমাদেরকে দেখে কেমন লাগছে?

এতোদূরে যদিও আপনারা অল্প সংখ্যক বাঙ্গালীই আছেন কিন্তু দেশের প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি, সংসস্কৃতির আপনাদের এতো টান, দেখে খুব ভালো লাগছে।

২. প্রবাসীরা অহরহ মাতৃভূমিকে ছেড়ে আসার যন্ত্রনায় পোড়ে, দেশের মানুষরা কি সেটা অনুভব করতে পারেন?

জ্বী বুঝতে পারেন। আপনারা অনেক কষ্ট করেন, তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবেন, এতোদূর থেকে তাদের সুখ সুবিধার কথা ভেবে টাকা পয়সা পাঠান, তারা সেটা অনুভব করেন।

৩. গানের হাতেখড়ি কি বাবার কাছেই?

না, ঠিক তা নয়। বাবা আমাদের জন্য ওস্তাদ রেখে দিয়েছিলেন, ওস্তাদ আমানউল্লাহ খান।

৪. কতো বছর বয়েস থেকে গান করছেন?

ঠিক মনে নেই। খুব ছোটবেলা থেকেই। জন্মের পর থেকেই বলতে পারেন

৫. কোন ধরনের গান গাইতে আপনি নিজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

মেলোডিয়াস। যাতে ভালো সুর আছে। হৈ চৈ গান আমার দ্বারা হয় না আর শ্রোতারা তা ঠিক গ্রহনও করেন না।

৭.বাবার প্রেরনাই কি গানকে পেশা হিসেবে নিতে উৎসাহিত করেছে?

না ঠিক তা নয়। আমার মাও ভালো গান করতেন। বাবার সম্মানটা আমার হয়ে কাজ করেছে। কিন্তু গানের প্রতি আমি নিজেই খুব টান অনুভব করতাম। ছোটবেলা থেকেই শাহনাজ রহমতুল্লাহ, আশা - লতার বাংলা গান শুনতাম। আমি নিজের মধ্যেই সুরের আনাগোনা টের পেতাম। সে জন্যই আমি গান করছি।

৮. বাবাকে খুব মনে পড়ে নিশ্চয়ই? বাবাকে নিয়ে মধুর একটি স্মৃতি আমাদের পাঠকদেরকে বলুন।

সব স্মৃতিই মধুর স্মৃতি। বাবা খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। স্বাস্থ্যগত কারনে মা বাধা দিতেন। প্রায়ই বাবা আমাদেরকে বলতেন, রুমা সুমা চল বাইরে থেকে হেটে আসি। তখন আমরা এ্যালিফ্যান্ট রোডে থাকি। বাসা থেকে কয়েক কদম হাটলেই সামনে মরণ চাঁদের মিষ্টির দোকান। বাবা আমাদের নিয়ে চলে যেতেন মিষ্টির দোকানে। বসে মিষ্টিত অর্ডার দিতেন। নিজেও খেতেন আমাদেরকেও খেতে সাধতেন। আমরা যদি সবটা না খেতে পারতাম, জিজ্ঞেস করতেন, কি রে খেতে পারছিস না ? আমাদের প্লেটে যতোটুকু থাকতো তাও খেতে নিতেন। অনেক সময় হয়েছে, দোকানে বসে থাকা অবস্থায় পরিচিত কাউকে পেলেন কিংবা অপরিচিত কেউ এসে বললো আপনার গান আমার ভালো লাগে নবী ভাই। তিনি তাদেরকে ডেকেও মিষ্টি খাওয়াতেন। তারাও যদি সবটা না খেতে পারতো তাদের প্লেটের অবশিষ্টাংশও বাবা খেয়ে নিতেন।

আর বাবা ছিলেন খুবই ভুলো মনের মানুষ। সব ভুলে যেতেন। বাড়িতে হয়তো কোন মেহমান এসেছেন, মা বললেন যাও দোকান থেকে মিষ্টি নিয়ে এসো। বাবা মিষ্টি আনতে গিয়ে দেখা গেলো আর ফিরছেন না। সন্ধ্যায় মেহমান এসেছিলো হয়তো, মা তাদের রান্না বান্না করে খাইয়ে বিদায় করেছেন। রাত এগারোটায় বাবা বাইরে থেকে ভক্তদের সাথে আড্ডা মেরে, গান গেয়ে টেয়ে, মিষ্টি খেয়ে দেয়ে ফিরেছেন। বাড়ি ফিরে মেহমানদের কথা মনে পড়েছে তার আবার।

৯. একজন গায়িকাকে বাংলাদেশের সমাজ কি চোখে দেখেন?

আমি আমার কথাই বলছি। খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। আমি যদি কাউকে কিছু বলি তারা আমার অনুরোধ রাখেন, কথা শুনেন। কিন্তু সেই সম্মান, শ্রদ্ধার আসন আমি নিজে দিনে দিনে তৈরী করে নিয়েছি।

১০. গানকে পেশা হিসেবে নিতে মেয়ে হিসেবে কোন সামাজিক কিংবা ধর্মীয় বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি?

আসলে বাবা - মা গান করতেন বলে আমি এমন একটা পরিবেশে বড় হয়েছি যে আমি এগুলোর সম্মুখীন হইনি। আর নিজে গান গাওয়ার আজকের এইযে অবস্থান সেটা আমি তিলে তিলে নিজেই তৈরী করে নিয়েছি।

১১. সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের মেয়েদের আজকের অবস্থান ব্যাখা করুন।

আজকে মেয়েদের অবস্থান হয়তো আগের চেয়ে ভালো কিন্তু আশাপ্রদ হওয়ার মতো কিছু না। শহরে কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেনীর মেয়েরা হয়তো সুযোগ পাচ্ছেন কিন্তু গ্রামে গঞ্জের সাধারণ মেয়েরা আজো তাদের অনেক ধরনের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

১২. জঙ্গীবাদ কি বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চার পক্ষে বাধাস্বরূপ? যেমন একুশে ফেব্রুয়ারী কিংবা পহেলা বৈশাখ?

অবশ্যই। ধর্ম একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার কিন্তু জাতীয়তাবাদের চেয়ে বেশি নয়। আজকে আমাদের পরিচয় কি বিশ্বে, আমরা বাঙ্গালী। আমাদের ভাষা আমাদের সংস্কৃতিইতো আমাদের পরিচয়।

১৩. গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কি?

বাবার গানের স্কুলটাকে আরো বড় করবো তাতে ভালো গান শেখানোর ব্যবস্থা করবো।

১৪. ধর্মনিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্বেও কবি “দাউদ হায়দার” ও “তাসলিমা নাসরিন” কেনো দেশে ফিরতে পারছেন না? আপনার অনুভব কি?

আমি এটাকে অত্যন্ত অমানবিক একটা ব্যাপার বলে মনে করি। কখনো কখনো ভাবি, আমরা কি এখনো আদিম যুগে পরে আছি যেখানে মানুষ চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালাতো? একটা মেয়েকে তার মা-বাবা, পরিজন থেকে দিনের পর দিন বিচ্ছিন্ন রাখা।

তাসলিমা ভুল বা অন্যায় কিছুতো বলে নাই যে তাকে নির্বাসন দিতে হবে। তাসলিমার বাবা মারা গেলেন একটি বারও মেয়েকে চোখের দেখা দেখতে পেলেন না, মায়ের অবস্থাও ভালো না। এটি অত্যন্ত অনৈতিক।

১৫. দেশের জাতীয় সমস্যাগুলোতে সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিবর্গের প্রতিবাদের কন্ঠস্বর সীমিত ও ক্ষীন থাকে, এর কারন কি?

এ কথাটা মোটেও ঠিক না তানবীরা। আমরা সমস্যাগুলো অনুভব করি এবং তার পাশেই থাকি। কিন্তু আমরা যখন এর একটা সমাধান করতে বা বলতে যাই, দেশের মানুষ সেটা নিতে চায় না। আমরা সাংস্কৃতিক ব্যাক্তি বিধায় তারা ভাবেন আমরা অতি আধুনিক। আমাদের সমাধানের ধরনটাও হয়তো “অতি আধুনিক” চোখেই তারা দেখে থাকেন। তারা অনুভব করেন না, একজন শিল্পী একই সাথে মা, স্ত্রী, মেয়ে সবই। তারাও বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যান হয়তো অন্যদের থেকে একটু আলাদা ভাবে।

অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ফাহমিদা।
তোমাকেও তানবীরা।

তানবীরা
১৪.১১.২০০৯

No comments:

Post a Comment