ঢাকার
মেয়র ইলেকশনের প্রচারণা দেখে মনে
হচ্ছে, মেয়র হচ্ছেন তাঁরা বুঝি শহর ঝাড়ু দেওয়ার জন্যে! কী
প্রতারণা দিয়ে এসব
ভদ্রলোকদের প্রচারণা শুরু! মেয়রদের কাজ শহর ঝাড়ু দেওয়া নয়, ঝাড়ু দেওয়ানো। ভয় হয়, মেয়র হয়ে তাঁরা মেথর বেচারার চাকরিটাই না খেয়ে দেন!
মেয়রের
খুব মিষ্টি ভাষান্তর করা হলো, ‘নগরপিতা’। তাঁর নগরবাসী সন্তানদের ভাল-মন্দ, সুবিধে-অসুবিধে দেখে শুনে রাখবেন
তিনি। পহেলা বৈশাখে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো, আজো তা নিয়ে প্রত্যেকদিন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে, কোন
একজন মেয়র পদপ্রার্থীকে আজও দেখা যায় নি সেখানে গিয়ে তাদের দাবিতে সামিল হতে
কিংবা কোথাও এই বিষয়ে তাদের কথা বলতে। এ ঘটনা দুর্ঘটনা কী মেয়রের আওতায় আসে না?
মেয়েগুলোকে নগরের আওতায় পড়ে না, নাকি
সেখানে মেয়র কিংবা মানুষ হিসেবে তাদের কোন বিবেক বা দায়িত্ববোধ কাজ করতে নেই শুধু
মৌখিক আলগোছে কথা না-বলে দৃঢ় দাবি কিংবা আন্দোলনের
সাথে একাত্ম হওয়ার জোরালো কণ্ঠস্বর কোথায়? আনুষ্ঠানিক নিন্দা জানিয়ে পত্রিকাতে
বিবৃতি দিয়ে একজন নগরপিতা কিছুতেই তার দায়িত্ব শেষ করতে পারে না।
সাভারে
এতো বড় নাটকীয় ব্যাঙ্ক ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলো এ
বিষয়েও তারা নিশ্চুপ। যেনো এসবের সাথে শহরের মেয়রের কোন সম্পর্কই থাকতে নেই। তাঁরা আছেন মুক্ত আকাশে পায়রা ওড়ানোর ধান্ধায়। তাই তাঁরা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝাড়ু মারা প্র্যাক্টিস করে
যাচ্ছেন। হয়তো কেউ কেউ বলতে পারেন সাভার সিটি কর্পোরেশানের আন্ডারে পরে না।
ঠিকাছে, তাও যদি হয় তারপরও জাতীয় ইস্যুতে প্রত্যেক সচতেন নাগরিকের দায়িত্ববোধ আর
বিবেকবোধতো কাজ করে।
আধুনিক
রাজনীতির প্রথম আর প্রধান ফর্মুলা হচ্ছে
সম্ভবত “গদির সাথে সেঁটে থাকো”। সরকারের যাঁরা যে-পদে আসীন
আছেন, সিটের সাথে পেছনটা সুপারগ্লু দিয়ে আটকে নিয়েছেন। যতো ঝড় ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, গদি
হিলা চলবে না। যা হয় হোক, দেশে, নগরে, তাতে আমার বা আমাদের কী আসে যায়? আমরা
সুস্থ, নিরাপদ থাকতে পারলেই হলো, গদি টিকে থাকাই আসল সত্য বাকি সব মিথ্যে।
পি এম
আগামী নির্বাচনের আগে সম্ভবত কোন ইস্যুতে মুখ খুলবেন না। সব ইস্যু জমিয়ে রাখছেন তিনি পরের নির্বাচন পার হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার
জন্যে। সম্ভবত ভবিষ্যৎ বংশধর তৈরি না-হওয়া
পর্যন্ত তিনি গদিতে সেঁটেই থাকবেন আর আমাদের প্রতি নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতির
ওপর প্রতিশ্রুতি গেলাবেন। মেয়ররাও সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা করে সামনে
এগোচ্ছেন, দেশের যা হয় হোক, তা নিয়ে তারা ভাবিত বা ব্যথিত নন আশা করি, ঝাড়ুপোঁচা ঠিক করে চললেই হলো। মানুষ যদি নিজের প্রাণ আর সম্ভ্রম নিয়ে
বেঁচে থাকতে না-পারে এই নগরে, তাহলে এতো ঝাড়ুপোঁচা কী জন্যে, কাদের
জন্যে?
দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু গণমাধ্যমের আয়োজনে আয়োজিত মেয়রপ্রার্থীদের
জবাবদিহিমূলক অনুষ্ঠানে হেভিওয়েট মেয়রপ্রার্থীরা আসছেন না, অনুপস্থিত থাকছেন নানা
অজুহাতে বা অজুহাত ছাড়াই। যাঁরা নাগরিকদের প্রশ্নের ও জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে ভয়
পান বা এসব অপছন্দ করেন, তাঁরা কিভাবে ভবিষ্যতে নাগরিকদের কাছে স্বচ্ছ থাকবেন বা
থাকার চিন্তা করবেন? তাঁরা লোকদেখানো সাইক্লিং, দৌড়, ঝাড়ু এসব স্টান্টবাজি করে
মিডিয়ার পাতায় পাতায় চাররঙা ছবি ছাপাতেই যদি উৎসাহী হন, তাহলে তাঁদের সততা,
আন্তরিকতা, নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না কেন?
সাম্প্রতিককালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে নৃশংস
নরহত্যার যে অমানবিক উৎসব হয়ে গেলো দেশজুড়ে, যেটা থেকে মহানগরগুলোও মুক্ত ছিলো না,
সেটার ব্যাপারে মহানগরের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবেন তাঁরা কিভাবে, যেখানে
রাজনৈতিকভাবে তাঁদেরই প্রার্থীরা নামছেন নির্বাচনে এবং এড়িয়ে যাচ্ছেন সেসব জঘন্য
হত্যাকাণ্ডের কথা? এতোদিন যাঁরা গণতন্ত্র গেলো, স্বৈরাচারী সরকারের পতন চাই বলে
ধুয়ো তুলছেন, তাঁরা এই সরকারের অধীনেই বা নির্বাচন করেন কোন মুখে? কোন আন্দোলনের
ফসল তাঁদের এই নির্বাচন কমিশনের বা সরকারের অধীনে নির্বাচনের নির্লজ্জতা? মানুষ
হানাহানি চায় না, একটু শান্তি চায়, একটু নিরাপদ নগর চায়, সন্তানদের শিক্ষার
সুব্যবস্থা চায়। এসবে সরকারবিরোধীদের যেমন মাথাব্যথা নেই, তেমনি সরকারের ব্যর্থতাও
একদম স্পষ্ট। এসব নিয়ে কোনো হবু নগরপিতার কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য কি আছে?
নির্বাচনের পর আবারো শুরু হবে না তো গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে মানুষপোড়ানোর মহোৎসব
আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থ ‘আপ্রাণ চেষ্টা’? নগরবাসীর পিতৃত্ব অর্জনে যাঁরা
হন্যে, তাঁরা নগরবাসীর নিরাপত্তার কথা কিছু কি ভাবছেন নির্বাচনের পরে?
ঢাকার সিএঞ্জি মিটার সমস্যা, যাতায়তের দুর্ভোগ,
বাচ্চাদের স্কুল কলেজে সিটের অভাব, ভাসমান। গৃহহীনদের বা ভিক্ষুকদের পুর্নবাসনের
ব্যবস্থা এসব নিয়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কী লেখা আছে? অলৌকিক কিছু লিখে তাক
লাগিয়ে ভোট আদায় নয়, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত
সমাধানের পরিকল্পনা চাই।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা গত প্রায় দশ বছরের ব্যাপক সমস্যা।
গত মেয়াদের নগরপিতার ব্যর্থতা আধা ঘন্টার বৃষ্টিতেই বিশ্রীভাবে চোখে পড়ে। তিনি আবারও
ভোট চাইছেন গতবারের ব্যর্থতা কাঁধে নিয়েই। নগরবাসী কি তাঁর কথায় কান দেবেন না পথের
দিকে তাকাবেন? চট্টগ্রামের জব্বারের বলিখেলার ঐতিহ্য শত বছরের পুরনো। এবং তার সাথে
লোকজ মেলাটারও, যা দেশের অন্যতম বৃহত্তর লোকজ মেলা। এবার চট্টগ্রাম পুলিশের বড়কর্তা
ঘোষণা দিয়েছেন, মেলা এবছর করা যাবে না। কারণ, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কারণে তাঁরা
নিরাপত্তা দিতে অক্ষম। এই অক্ষম প্রশাসনের দায়ভার রাষ্ট্রের, এবং এই গা-শিউরানো তথ্যের
দিকে আমরা দিনে দিনে এগিয়ে গেছি। কিন্তু, বাকি সব বাদ দিলেও এই মেলায় অংশগ্রহণকারী
শত নিরীহ, দরিদ্র, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীর কী হবে যাঁরা সারা বছর এই মেলার
জন্যে অপেক্ষা করেন এবং এবারও তাঁরা অনেকে এরই ভেতর পসরা নিয়ে ভিড় জমিয়েছেন মেলায় জিনিসপত্র
বিক্রি করবেন বলে? তাঁদের ভেতর কেউ কেউ সারা বছরই তাকিয়ে থাকেন এই মেলার দিকে, কারণ
এটাই তাঁদের সর্ববৃহৎ উপার্জনের উৎস। কোনো মেয়রপ্রার্থী কি তাঁদের পক্ষে একটি কথাও
বলবেন না কিংবা মুখ খুলবেন না বন্দরনগরীর শত বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন করার
বিপক্ষেও?
চট্টগ্রামে ব্যাটারি রিকশার ব্যাপারটা নিয়েও নানা
কোলাহল। আগের মেয়র সেটা তুলেই দিলেন, আরেকজন প্রার্থী সেটা থাকবে বলে ঘোষণা দিচ্ছেন,
মানে তাঁকে নির্বাচিত করলে। এটাও একটা ট্রাম্প কার্ড খেলার চেষ্টা। কিন্তু, যে-রিকশাগুলোর
সরকারি কোনো সংস্থার অনুমোদন নেই, যাদের ডিজাইনে সমস্যা, যেগুলোর কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে,
যারা অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ইচ্ছেমত, এবং ঢাকাতেও যেগুলো বন্ধ করা হয়েছে, সেসবের
ব্যাপারে কেউ কি নিজের খেয়ালখুশিমত সেসব চালু করার ক্ষমতা রাখেন? যানটির নকশা উন্নত
না-করে, বিদ্যুতের আইনি সরবরাহ নিশ্চিত না-করে কিংবা চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না-দিয়ে
শুধু ব্যাটারি রিকশা নামানোর ঘোষণা তো মূলত মানুষের সাথে প্রতারণা বা নতুন সমস্যার
রাস্তা খুলে-রাখা। নগরবাসীর জন্যে ব্যাটারি রিকশা একই সাথে দুর্ভোগ ও সুবিধের নাম।
কিন্তু, এটার দুর্ভোগ কমিয়ে সুবিধে বাড়ানোর ন্যায়সঙ্গত উপায়ের কথা কেউ ভাবছেন না কেন
কোনো নগরপিতৃত্বপ্রার্থী?
হে
নগরবাসী, ঠিক করুন, নির্বাচনে কী করবেন, কাদের নির্বাচন করবেন। তাঁরা আপনাদের পাশে থাকবেন কী থাকবেন না, কোন ইস্যুতে থাকবেন তা তাঁদের জিজ্ঞেস করুন, জেনে নিন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন কোন পথে যাবে বাংলাদেশ।
নির্বাচনের আগে রাস্তায় নেমে ঝাড়ু-দেওয়ার আইওয়াশ আর কত দিন? মেয়রের দায়িত্ব ও কর্তব্য কি কি সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ জেনে নিয়েই
সিদ্ধান্ত নিন, নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে যাবেন না বাড়িতে ভালোমন্দ খেয়ে দেয়ে দুপুরে টেনে ঘুম দেবেন।
তানবীরা
২৩/০৪/২০১৫
No comments:
Post a Comment