Thursday 29 November 2018

বনফুল

১.


আজকাল আমরা “অনুগল্প” কিংবা “পরমানু” গল্পতে খুব অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সময় কোথা আমাদের অনেক বেশি পড়বার? কত কি করার আছে, সময় বড্ড কম। আমরা অনেকে ভাবি ব্লগ কিংবা ফেসবুক আধুনিক সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই ঝরঝরে মেদহীন বর্ননায়, টু দ্যা পয়েন্ট লেখার প্রচলন করেছে। আসলে কি তাই? একটু পেছনে তাকালে ইতিহাস কিন্তু অন্যকথা বলে। বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প পড়তে পড়তে ভাবছি, অধুনা “অনুগল্প” এর পথ প্রদশর্ক তিনি কি? “লিপিকা”য় গ্রন্থিত করা কবিতা গুলো’র জন্যে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “গদ্য কবিতা”র পথ প্রদর্শক বলা হয় তাহলে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় নিসন্দেহে “অনুগল্প” এর দিক দিশারী।
আয়তনে হয়ত অধুনা অনুগল্পের কাছাকাছি কিন্তু বিষয়, বর্ননা আর তার শান দেয়া ধার, তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা যেগুলো আমাদের উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে আজও চরম বাস্তব। অনুগল্পের চেয়ে আয়তনে বড় নয় বটে – এত স্বল্প পরিসরে এত কঠিন বক্তব্য কিংবা বিদ্রুপ বা হাস্যরস অবিশ্বাস্য। আমরা আজকাল এত লেখা পড়ি, হোমফীড ভরা স্ট্যাটাস, নোট, বিভিন্ন সাহিত্যের গ্রুপ কিংবা দৈনিক পত্রিকা গুলোর সাহিত্য পাতাগুলোই ধরি না কেন, রাতে যখন ঘুমোতে যাই, কটা লেখা আমাদের পুরোপুরি মনে থাকে? কিন্তু বনফুল আপনার মাথায় ঘুরবে, ঘুরেই যাবে, আপনাকেও ঘোরাবে, বিশ্বাস হয় না? পড়ে দেখুন তবে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প নিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্যের আলোচনা।
[[[স্বপ্নে আর বাস্তবে, মানুষের আশা আর প্রাপ্তিতে যে অসামঞ্জস্য এবং সেই অসামঞ্জস্য সত্বেও মানুষ যে ভাবী জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলেছে, জীবন-দার্শনিকের কাছ তাও কম হাসির বিষয় নয়। “সুলেখার ক্রন্দনে”র কথা মনে পড়ছে। জ্যোৎস্নামদির গভীর রাত্রে স্বপ্নময় আবেষ্টনীর মধ্যে দুগ্ধফেননিভশয্যায় একটি ষোড়শী তণ্বীকে কাঁদতে দেখে কবিকল্পনায় প্রশ্ন জেগেছে, কেন এ ক্রন্দন? – পুত্রশোক? সিনেমায় না যেতে পারার অভিমান? শাড়ির পাড় পছন্দ করা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে মতভেদের পরিণাম? না কুমারী-জীবনের মধুর পূর্ব-রাগের স্মৃতিমথিত বেদনা? অমন চাঁদনীরাতে কৈশোরের সেই অর্ধ-প্রস্ফুটিত প্রণয়-প্রস্থান সহসা পূর্ণ- প্রস্ফুটিত হতে পারে না কি? দূরে “চোখ-গেল” পাখি অশ্রান্ত সুরে ডেকে চলেছে। সম্মুখের বাগানে রজনীগন্ধাগুলি স্বপ্নবিহবল-চারিদিকে জ্যোৎস্নার পাথার! এমন দুর্লভক্ষণে হারানো প্রেমের কথা মনে হওয়া কি অসম্ভব, না অপরাধ? কাল্পনিক যখন এমনি কল্পনার জাল বুনে চলেছেন তখন সুলেখার ক্রন্দনের সত্য কারণটি আবিস্কৃত হল। সুলেখা কাঁদছে দাঁতের ব্যথায়। - কল্পিত সত্যের সঙ্গে বাস্তব সত্যের কত তফাত!]]]


২.

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ, কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক-দাঁত ভাল থাকে। হঠাৎ একদিন একটা নূতন ধরনের লোক এল। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলে শুধু।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষী বউটির ঠিক এই দশা।
বনফুলের “নিমগাছ” গল্পটি পড়তে পড়তে বহুকাল আগে দেখা অর্পণা সেনের সিনেমা, “পরমা” চোখের পাতায় ভেসে উঠল। বলাই থেকে অপর্ণা, বদলায় নি কিছুই, জীবনের কঠিন বাস্তবতার কাছে, সব বিপ্লব কেমন যেনো হার মেনে যায়

No comments:

Post a Comment