Thursday 1 November 2018

মীটু


পৃথিবী জুড়ে ছুটে চলা “মী টু” এর ধাক্কা অবশেষে বাংলাদেশেও লেগেছে। সাহসী কেউ কেউ লিখছেন, তাদের এতো দিনের বয়ে চলা যন্ত্রণার কথা। মেয়ে মাত্রই আমরা জানি, সেসব স্পর্শ, চাহনী, নিপীড়ন, নিগ্রহের কথা। এটা বৈশ্বিক সমস্যা, বাংলাদেশের একার নয়। ছোট সে বয়সে বিশ্ব জুড়ে মেয়েরা, অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চা ছেলেরা এই নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যায় বলেই, এত “এওয়ারনেস” ভিডিও, প্রবন্ধ সমস্ত লেখা হয়, প্রচারণা চালানো হয়। মানুষের মধ্যে বিবেক এবং চেতনা জাগরনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ছোটবেলায়, মা ভীষণ পাহারা দিতেন, বকা দিতেন, এদিক গেলি কেন? ও ডাকলেই যেতে হবে, তখন বিরক্ত হতাম, মা এত সন্দেহ করে, পাহারা দেয়, আজ জানি, বিশ্ব জুড়ে মা মাত্রই পাহারা দেয়, সবাই সন্তানের “ওয়েলবিং” নিয়ে কনসার্ণ। বহু বছর আগে এই নিয়ে লিখেছিলাম “সাবধানতাঃ সন্তানের জন্যে”, ফেসবুক ও ব্লগের কল্যানে তখন এই লেখাটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু হায়, এত সাবধানতার পরেও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

প্রতিবার যা হয়, এবারও তাই হচ্ছে, “মী টু” নিয়ে বাংলাদেশে দুটো পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে, এক পক্ষ ভিক্টিমদের পাশে আর অন্য পক্ষ ভিক্টিমদের ব্যবচ্ছেদ করছে, তাদের জামা-কাপড়, চাল-চালন, কেনো গেছিলো, এত দিন পরে কেন, এত বছর কোথায় ছিলো ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ বলছেন, “মী টু” ধরতে গেলে, কারো, বাবা-চাচা-দাদা ও বাদ যাবে না। এই পয়েন্টটাতে অবশ্য আমিও একমত। “মী টু” এই জেনারেশনই থাকা ভাল, বাবা-চাচা-দাদা’দের ধরলে “মী টু-টু দ্যা পাওয়ার টেন” এ চলে যাবে। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি এর সাক্ষী, আমাদের ইতিহাস, যৌতুকের কারণে বউ পুড়িয়ে মারার ইতিহাস, তালাক দেয়ার ইতিহাস, একাধিক বিয়ে করার ইতিহাস, সতীদাহের ইতিহাস। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, কেশব চন্দ্র সেন এরকম হাতের আঙুলে গোনা দু’চার জনকে ছেড়ে দিলে পূর্ব পুরুষদের কারো ইতিহাসই উইম্যান ফ্রেন্ডলি নয়। ধর্মের কাহিনী গুলোও যদি ধরি, সীতার বনবাস, সীতার অগ্নিপরীক্ষা, দ্রৌপদী’র বস্ত্রহরণ, বিবি মরিয়মের নিগ্রহ, কিংবা বিবি আয়েশা’র (রাঃ) সত্বীত্বের পরীক্ষা কোনটাতেই নারীর গৌরবের কিছু নেই, সবই অবমাননার ইতিহাস।

পয়ত্রিশ বছর আগে পৃথিবীতে “মী টু” কনসেপ্ট ছিলো না। কেউ মুখ খুলতো না। এখনও মুখ খুলে কেউ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। নেদারল্যান্ডসের বেস্ট সেলার লেখক, সাস্কিয়া নোর্ট তার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “স্ট্রমবলি”তে তের বছর বয়সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া “মী টু” লিখেছে ২০১৭ সালে। তাতে তার ছেলে তাকে রোজ অপমান করে, মা তাকে ধিক্কার দেয়, কেন লিখতে গেলো এতদিন পরে আবার এসব। পয়ত্রিশ বছর পরে মুখ খুলে যে মানুষটা চরিত্র ব্যবচ্ছেদের সম্মুখীন হচ্ছে দিনরাত, পয়ত্রিশ বছর আগের কথাটা ভাবুন, প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষের বিরুদ্ধে নিতান্ত একজন নাবালিকা যার ধরতে গেলে কোন সহায়-সম্বল কিংবা পরিচয় নেই। বাঘা বাঘা মানুষেরা আজ তাকে যেভাবে পেড়ে ফেলছে তখনকার পরিস্থিতি ভাবুন।

এখন কথা হলো, এত দিন হয়েছে বলে, চির জীবনই একই থাকবে, বদলাতে দেবো না কিছু? বাবা-চাচা-দাদা’রা অন্যায় করেছেন বলে, সব অন্যায় জায়েজ হয়ে যাবে! প্রতিবাদ হবে না? পরিবর্তন চাইবো না? তাহলে আদিম যুগে ন্যাংটো হয়ে থাকা, শিকার করে পশু পুড়িয়ে খাওয়া থেকে, আজ এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ফেসবুকে তর্ক করা কি, পরিবর্তন, বদল না সেই সনাতনতা? “মী টু” বাংলাদেশের জন্যে না, যারা বলছেন, তারা কোন সোশ্যাল প্যারামিটারে সেটা মেপে বলছেন, সেটা অবশ্য জানাননি। আইফোন টেন এক্স, বিএমডব্লু গাড়ি, লিভাইস এর জীন্স, কেভিন ক্লাইন এর টি শার্ট, মাইকেল কোরস এর পার্স সবই বাংলাদেশের জন্যে শুধু সামাজিক কোন পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্যে নয়! মজার তো বটেই। সামাজিক পরিবর্তন বাংলাদেশের বাইরের সারা পৃথিবীর জন্যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের মত বাংলাদেশ যে কোন পরিবর্তনের আওতামুক্ত থাকবে।

আলোচিত “শাজনীন” হত্যা’র ঘটনা হয়ত আমরা অনেকেই ভুলে যাই নি। গুলশানে নিজের বাসায়, নিজের ঘরে খুন হয়েছে শাজনীন। শাজনীন রাত পোশাকেও ছিলো না, বাইরেও যায় নি কাউকে প্রলুব্ধ করতে, যারা মেয়েদের চরিত্র ব্যবচ্ছেদ করতে ব্যস্ত, দয়া করে জানান, শাজনীন এর “মী টু’ এর ব্যাখা কি হতে পারে? তাসলিমা মুন শেখ তার “পাথরনদী কথন” বইতে লিখেছেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়ার সময়, পরিচিত এক পরিবারকে রূপাদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়, তাদের মেয়েটির পরীক্ষা, তাদের কোথাও থাকার জায়গা নেই এই কারনে। রূপা’র সাথেই মেয়েটি রাতে শুয়েছে, সেই বিছানায়, আশ্রিত সেই মেয়েটির ভাই, বোনের পাশে শুয়ে থাকা, ঘুমন্ত রূপার গায়ে হাত দেয়। এই “মী টু”র ব্যাখা জানতে চাই। রূপা সালোয়ার-কামিজ পরেই শুয়েছিলো, কোন উত্তেজক রাত পোশাকে নয়। কুঙ থ্যাঙ লিখেছেন, তার পরিচিত বোনটি এপেন্ডিসিটাইস এর অপারেশনে বিছানায় শুয়ে, স্যালাইন হাতে, প্রতি রাতে তাকে ইন্টার্নী ডাক্তারদের হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে হাসপাতালে, সেই অসুস্থ মেয়েটি কি কি পন্থা অবলম্বন করে ইন্টার্নী ডাক্তারদের তার দিকে আমন্ত্রণ করেছিলো কে জানে। “মী টু” এর ব্যবচ্ছেদকারীরা এর ব্যাখা দিতে পারবেন। অজস্র এরকম উদারহণ লিখতে পারবো, কিন্তু দরকার আছে কি? আমরা কি নিজেরাই জানি না, নিজেদের কথা?

“মী টু” এর দরকার আছে কি নেই, সেটা সময় বলে দেবে। এক সময় পৃথিবীর কোন প্রান্তেই মেয়েরা স্কুলে যেতো না, চাকুরী করতো না, দশ চড়ে রা করতো না, কিন্তু প্রয়োজন সব বদলে দেয়। “মী টু” এর চেয়েও শক্ত কোন ঝড় সময়ের প্রয়োজনেই হয়ত তৈরী হবে। আমরা চাই কিবা না চাই। তাই বরং সমস্যাকে ঢেকে না রেখে, চলুন সেটাকে স্বীকার করে নিয়ে, সমাধানের দিকে কিংবা নিদেনপক্ষে পুনরাবৃত্তি রোধের কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সেই দিকে সবাই হাতে হাত ধরে আগাই। কথায় আছে, “সমস্যা চিহ্নিতকরণ” সমাধানের দিকে আগানোর প্রথম পদক্ষেপ।

সবশেষেঃ বাংলা ব্যাকরণ পড়েছিলাম, “যিনি রাজা তিনিই ঋষি” – এই লাইনটির সাথে অবশ্য চলমান “SAD” বিতর্কের কোন সম্পর্ক নেই।


তানবীরা
০১/১১/২০১৮
 



No comments:

Post a Comment