Thursday 29 November 2018

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ফুলের মেলা

নেদারল্যান্ডসকে বিশ্বব্যাপী ‘টিউলিপের দেশ’ বলা হয়, যদিও এই ফুলটি ওদের নিজেদের নয়। এমন নয় যে ডাচরা এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়, ফুলের জন্য ভালোবাসা ওদের হৃদয়ের অনেক গভীরে অবস্থান করে।
এটাকে বিশদভাবে ব্যাখা করতে গেলে প্রথমে আমাদের সতেরশো শতাব্দীর আমাস্টার্ডামের খালের পাশের একটি বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে হবে। একজন ধনী সওদাগর একটি চেয়ারে বসে আছেন, তন্ময় হয়ে আছেন তার ভাবনায়। না, তার ভাবনায় ফুলেল ডিজাইনের কোন দেয়ালপেপার ছিলো না, ছিলো ফুলদানিভর্তি ফুল। যদিও আমরা এখন যে ফুলদানিটা দেখতে পাই সেটির সঙ্গে কিন্তু আগের সেই ফুলদানির কোনো মিল নেই।
যেটাতে ফুল থাকে সেটাতে একটি ফুটো থাকে, রঙ ও ছাঁদে প্রতিটিই আলাদা। আমরা যদি হরেক রঙের মিশ্রণে একটি রঙিন ফুলের তোড়া বলি, সতেরশো শতাব্দীতে এটিই ছিলো সর্বোচ্চ প্রশংসার জিনিস।
তখন থেকে, ফুলের প্রতি গভীর আবেগ ডাচ সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে উঠলো। অনেক ডাচ নাগরিক বাড়িতে টেবিলের ওপর এক গোছা ফুল না থাকলে সে বাড়িটিকে বসবাসের যোগ্য বলে ভাবেন না, এবং অনেকেই বসন্তে আর গ্রীষ্মে বাগানের ফুলের রঙ দিয়ে দঙ্গল না বাঁধিয়ে বিশ্রাম নেন না।
এমনকি কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে, এক গোছা ফুল নিয়ে যাওয়া ডাচদের রীতি, শুধু অনুষ্ঠানে বা জন্মদিনই নয়, ফুল এখানে প্রথাগত, খুবই নৈমিত্তিক ব্যাপার। ডাচরা ফুল নিয়ে একথাটি খুবই বলে, ফুলের বিজ্ঞাপনেও এই স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়।
ফুলচাষের এই নেশাকে অনুশীলন করতে অগুনিত ফুলের দোকানের প্রয়োজন। শুধু ফুলের জন্য এখানে আলাদা বিশেষ বাজার আছে, যদিও আমস্টার্ডামের বাজারটাই পৃথিবীবিখ্যাত কিন্তু উইটরেক্ট বাজারের পরিবেশ ভালো।
বসার ঘরে সাজিয়ে রাখার চেয়ে ফুলচাষের এই সংস্কৃতিতে তাদের উৎপাদন ও ব্যবসায়ী মনোভাব বেশি পরলক্ষিত হয়। ফুলের রাজ্য শাসনকারী উদীয়মান ব্যবসায়ী ও সওদাগররা নিজেরাও বিরাট পুষ্পপ্রেমিক। বিলিয়ন ইউরোর ওপরে ফুল ও ফুলের বীচি চাষের এই বাজারে প্রতি হাজার জনে দশ জন ডাচ নাগরিক জীবিকা নির্বাহ করেন। বেশির ভাগ উৎপাদনের লক্ষ্যই থাকে দেশের বাইরে রপ্তানি। প্রায় পাঁচ দশমিক চার মিলিয়ন ইউরো প্রতি বছর ফুল আর ফুলের চারা বিক্রি করে আয় হয়।
ফ্লোরাহল্যান্ড এর নিলাম হলো এই ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র, এটি ফুলের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিলাম কেন্দ্র। বিশ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় ফুল ও চারার নিলাম হয় এখানে, পাঁচ হাজার চাষীর হাতে উৎপন্ন প্রায় সাড়ে বারো হাজার বিলিয়ন চারা আর ফুল হাতবদল হয় এখানে। বড় স্তুপটি চলে যায় দেশের বাইরে। বলা হয়ে থাকে, সারা পৃথিবীতে যত ফুল ও ফুলের গাছ কাটা হয় তার অর্ধেক কাটা হয় হল্যান্ডে।
আলসমেয়ার এর ফ্লোরাহল্যান্ড হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুল বাণিজ্যকেন্দ্র। পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, ফুলের গেঁড় এর মাঠ দেখতে যাওয়া। ষোলশ শতাব্দীর শেষ থেকে নেদারল্যান্ডসে ফুলের গেঁড় উৎপন্ন করা হচ্ছে। পঁচিশ হাজার হেক্টরের বিশাল প্রান্তর রঙ-বেরঙের ফুলের গেঁড় দিয়ে যেনো মোজাইক করা আছে।
সবচেয়ে বেশি ফুলের গেঁড় করা হয় টিউলিপ, লিলি, নার্সিসাস, গ্ল্যাডোলিয়া আর হিয়াসিন্ট দিয়ে। ফুলগুলো ফুটে গেলে, ফুলের মাথাটা যান্ত্রিকভাবে কেটে ফেলা হয়, তাতে করে গেঁড়গুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফুলের গেঁড় রপ্তানি করে প্রায় সাতশো মিলিয়ন ইউরো আয় করা হয়। উত্তর আলকামার শহরের হার্লেম আর লাইডেন হলো গেঁড় চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
সাম্প্রতিক কোইকেনহোফ বাড়িটি- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুলের বাগান। প্রতি বছর মিলিয়নের ওপর পর্যটক আসেন ওখানে। ব্লুমকোরসোতে ফুল দিয়ে নতুন ধরনের বাহারি ডিজাইনের বিভিন্ন প্রতিকৃতি তৈরি করে কার্নিভাল এর মতো শোভাযাত্রা করে নর্ডওয়াইক থেকে হার্লেম যাওয়া এখানের প্রচলিত প্রথা। এধরনের ফুলের শোভাযাত্রা অবশ্য পুরো বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হতে থাকে। ওয়েস্টল্যান্ড- যেটা গ্রীন হাউজ চাষের কেন্দ্র ‘গ্লাস-সিটি’ বলে পরিচিত, সেখানে প্রতি গ্রীষ্মের ‘ভাসমান শোভাযাত্রা’ খুবই প্রশংসিত।
সবোর্পরি, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সারা বিশ্বে নেদারল্যান্ডস ফুলের জন্যে বিখ্যাত। বিশেষ করে টিউলিপ নেদারল্যান্ডসের সবকিছুরই প্রতীক। উনিশো আশি আর নব্বই দশকের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ফুটবলার রুড গুলিত, মার্কো ভান বাস্টেন আর ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড যারা এসি মিলানে খেলতো, তাদেরকে ইটালিতে ‘টিউলিপানি’ কিংবা ‘টিউলিপ্স’ নামে ডাকা হতো।
টিউলিপের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের এই একাত্বতাকে মূলধন করে ডাচ ব্যবসায়ীরা বিশ্বে আধিপত্য গড়তে চান, যেমন বিশ্বজুড়ে হোটেল গোল্ডেন টিউলিপের চেইন খোলা হয়েছে। যদিও, ডাচরা অন্যের আকর্ষণ নিজেরা জাঁকালো ভাবে প্রদর্শন করছে, কারণ টিউলিপ ওদের নিজেদের দেশিয় গাছ নয়, ষোলশ শতাব্দীতে তুর্কীর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে এটি আমদানি করা হয়েছিল।
এমনকি টিউলিপ শব্দটিও টার্কিস টুলব্যান্ড (টারবান) শব্দের অপভ্রংশ হয়ে আমদানি করা হয়েছে। ঘটনাক্রমে, আমদানিকৃত ফুল থেকে ডাচেরা সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নতুন ধরনের টিউলিপের চাষ করেন, যেগুলো সতেরশো শতাব্দীতে টার্কিতে খুব প্রশংসিত হয়।
নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ সত্যিকার অর্থেই প্রাণবন্ত ব্যবসার প্রতিকৃতি হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ষোলশ ছত্রিশ আর ষোলশ সাইত্রিশ সালে এত বেশি গেঁড় উৎপাদিত হয়েছিল যে অনেক মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়েছিলো এসব করতে গিয়ে। দুর্লভ গেঁড় এর চাহিদা অবশ্য আমর্স্টাডামের খালের বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পুরো পৃথিবীজুড়েই আছে।
অনেকের মধ্যে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ইয়ান ফান গোয়েন যিনি চিত্রশিল্পী ইয়ান স্টেইন এবং পোলাশ পোটারের শিক্ষক ছিলেন, তিনিও কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান। এখন আর ডাচেরা এত ঝুঁকির মধ্যে নেই, কারণ পৃথিবীর কোথাও এই সবচেয়ে বড় বাজারের চেয়ে সুলভ দামে ফুল বিক্রি হয় না।  
*মূল প্রবন্ধটি মারটাইন ড্যা রোই এর লেখা ‘দ্য ডাচ আই প্রিজ্যুম’ বই থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে। লেখাটি গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন লেখক। 

No comments:

Post a Comment