Thursday 29 November 2018

স্ট্যাপহোর্স্ট---দ্যা_আননোউন_স্টোরি

“নেদারল্যান্ডস”– যাদের নিয়ে প্রবাদ আছে, “গড ক্রিয়েটেড দ্যা আর্থ, বাট দ্যা ডাচ ক্রিয়েটেড দ্যা নেদারল্যান্ডস”। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে, সমুদ্র থেকে দেশ রক্ষাই করে নি শুধু, একের পর এক পোল্ডার তৈরী করেছে। পানি সরিয়ে, ভূমি বের করে নতুন নতুন শহর বানিয়ে চলছে, আজও কাজ চলছে, শেষ হয় নি। মানুষ বাড়ছে, সমুদ্র থেকে ভূমি বেশি প্রয়োজনীয়, তারা ভূমি বাড়িয় চলছে। সমুদ্রের পাশের ঐদিক গুলোতে ড্রাইভে গেলে এত ভাল লাগে, মানুষের জয়, বিজ্ঞানের জয়, প্রযুক্তির জয়, হার মানে নি মানুষ প্রকৃতির কাছে, নিয়তি বা ভাগ্য বলে মেনে নেয় নি, থেমে যায় নি তারা।

ছোট এই দেশটিতে হাজার হাজার “এক্সপার্ট” এর আনাগোনা। যদিও এখানে কারখানা বলতে তেমন কিছু নেই, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন, রুটি, ডিম, দুধ, মাংস এগুলো বাদ দিয়ে দিলে ধরতে গেলে বাকি সব আমদানী করা হয় বাইরে থেকে। প্রায় সব ধরনের শিল্প-কারখানাই নিম্ন মজুরীর দেশ, এশিয়া, আফ্রিকা, সাউথ এমেরিকাতে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সাথে সরিয়ে দেয়া হয়েছে আইটি ফার্ম, ফাইন্যান্স এগুলোও। ব্যাঙ্গলোর, পুনে, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড কোথায় নয়, একমাত্র শ্লোগান “খরচ বাঁচাও”। তাহলে এত এক্সপার্ট এখানে কি করে? শুধুই রয়ে গেছে, “রিসার্চ এন্ড ডেভেলাপমেন্ট”, নতুন নতুন প্রযুক্তির পেছনে মরিয়া। তারপরও বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত মজবুত ছোট এই দেশটি যাদেরকে মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া ভার।

এখন কেউ যদি বলে, নেদারল্যান্ডসে একটি শহরতলী আছে যেখানে আজও মানুষ ঔষধে বিশ্বাস করে না, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে না, ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাকে তাদের জীবন চলে। শহরতলী’র গন্ডী ছেড়ে অনেকেই বাইরে বের হয় না। ওর মধ্যেই জীবন কাটায়, কাজ করে, বেঁচে থাকে। আধুনিক সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওরা নিজেদের রাজ্যে নিজেরা আছে নিজেদের মতো। বিশ্বাস করা যায়? গল্পের মতো শোনালেও, গল্প নয়, সত্যি। 

স্টাপহোর্স্ট – একটি গ্রামের নাম যেখানে লোকজন “ঘৃণা করতে ভালবাসে”, তারা তাদের শেকড় আকড়ে ধরে থাকতে পছন্দ করে। আধুনিক ডাচ সমাজ হয়ত তাদের বিভিন্ন রকম সামাজিক ভাতা, সেক্স আর ড্রাগস এর প্রতি উদার মনোভাবের জন্য বিখ্যাত কিন্তু আমস্টার্ডাম থেকে আশি মাইল উত্তরপূর্বে কেউ যদি যায়-সেখানে এক অন্য পৃথিবী। এখানের লোকজন সব ধরনের বীমা, সামাজিক ভাতা আর তাদের ভাগ্যের ওপর হস্তক্ষেপ করাকে প্রত্যাখান করে। টেলিভিশন দেখাকে অধর্মীয় মনে করে, এড়িয়ে চলে।

এই গ্রামের মুখপাত্র ইয়ান উইলিয়াম স্টক বলেন, গোটা নেদারল্যান্ডস জুড়ে স্টাপহোর্স্ট এর এমন একটা ছবি যে সবাইকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। পুরো ডাচ জাতি, সমকামিতা, যন্ত্রণাহীন মৃত্যু, গর্ভপাত সব কিছুর প্রতি উদার শুধু স্টাপহোর্স্ট বাদে। আধুনিক সংশোধিত ডাচ সমাজ থেকে দূরে তিনশ হাজার মানুষ নিয়ে, দ্যা বাইবেল বেল্ট গোষ্ঠী উত্তর ওস্টব্রুঘ এর উর্ক শহরে, দক্ষিন পশ্চিম থেকে একশ বিশ মাইল দূরে, আলাদা একটি সমাজ গঠন করেছিলো। চৌদ্দ হাজার অধিবাসী নিয়ে প্রোটেস্টান্ট ধর্মে অগাধ আস্থা রাখা একটি কৃষিকাজ ভিত্তিক গ্রামের নাম “স্টাপহোর্স্ট”। নেদারল্যান্ডসে বাইবেলে অবিচল আস্থা রাখা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি তারা। এখনো মেয়েদেরকে চাষীদের ঐতিহ্যবাহী লম্বা স্কার্ট, ফুল ছাপা ব্লাউজ পরে মাথায় টুপি লাগিয়ে গ্রামের সাতটি চার্চের সামনে প্রতি রোববারে তাদের ঘরের পুরুষদের সাথে হাঁটতে দেখা যায়।

পনেরশ বাষট্টি সালে একজন খুব ধার্মিক ব্যক্তি লুথেরানিজাম (Lutheranism) এবং কালভিনিজাম (Calvinism) বিশ্বাস এর মাঝামাঝিতে একটি মিশ্র ধর্ম আবিস্কার করেন, যার মূল কথা ছিলো, নিয়তিকে মেনে নিতে হবে, বিশ্বাসীকে ভুগে ভুগে তার সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। আর এই বিশ্বাসের নাম “হাইডেলবার্গ ক্যাটেসিজাম” – যা নিয়ে স্টাপহোর্স্ট এর মানুষ বেঁচে আছে। অন্যান্য দেশের মত ডাচ রাজনীতিতেও ধর্ম বিরাট ভূমিকা রাখে। ডাচ রাজনীতিতে একটি শব্দ আছে “স্টাপহোর্স্ট ফ্যাক্টর”। কট্টরবাদী বিশ্বাসীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদে সবসময় পাঁচ ভাগ আসনে জয়ী হয়। 

স্টক বলেন, বহু বছর আগে অনেক অনেক ডাচ গ্রাম এই রকম ছিলো, এখানে ঐতিহ্য অনেক দিন ধরে চালু রয়েছে কারণ এই গ্রামের অধিবাসীরা সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। গ্রামের বেশীর ভাগ অধিবাসীই পুরনো ঐতিহ্যের কারণে, সরকারের সামাজিক ভাতা নিতে অনিচ্ছুক, সরকারকে কর প্রদানেও তাদের অনীহা। তারা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্যে নিজেরাই অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে। কারো বাড়ি পুড়ে গেলে, প্রতিবেশীরা নতুন বাড়ি বানিয়ে দেয়। কেউ মারা গেলে আত্মীয়রা তার কফিন বানিয়ে দেয়। স্টাপহোর্স্ট এর ঐতিহ্য হলো, একজন কৃষক মারা গেলে তার জমি ছেলেদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যেসব ছেলেরা উত্তরাধিকার সূত্রে জমি পাবে না, সে অন্যদের জমির পেছনে নিজের খামার বাড়ি বানিয়ে নেবে। এই কারনে সেখানকার চাষের জমি গুলো খুব সরু আর লম্বা – পনেরশ বাই চল্লিশ মিটার। আদিতে এগুলো একশ পঁচিশ মিটার প্রশস্ত ছিল। এ অঞ্চলের কৃষকেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী লো স্যাক্সন এর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এই গ্রামের বাড়ির জানালা-দরজা সব সবুজ। এখন যে বাড়ি গুলো দেখা যায় তার বেশীর ভাগই আঠারশো পঞ্চাশ সাল থেকে উনিশো দশ সালের মধ্যে তৈরী করা হয়েছিল।

এ গ্রামের অনেক অধিবাসীই ওষুধ খায় না এমন কি টিকাও নেয় না। তারা বিশ্বাস করে অসুস্থতা হলো ঈশ্বরের শাস্তি আর সুস্থতা তার পুরস্কার। উনিশো একাত্তর সালে পোলিও মহামারীর সময় স্টাপহোর্স্ট বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। উনচল্লিশ জন পোলিও আক্রান্ত হয়েছিল যাদের বেশীর ভাগই শিশু। অনেকেই প্রতিষেধক নিতে অস্বীকার করে, পাঁচ জন মারা যায় আর তের জন শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। শতকরা বিশ জন টিকা ছাড়াই রয়ে যায়। WHO স্টাপহোর্স্ট এবং নেদারল্যান্ডসের এ ধরনের কয়েকটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে ঘোষনা করে। ইউরোপের মধ্যে জন্মহার এখানে সবচেয়ে বেশী। মোট উর্বরতার হার (total fertility rate, TFR) এখানে দুই দশমিক সাত, দুই হাজার তিন সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটা চতুর্থ সর্বোচ্চ।

অন্যান্য বাইবেল আশ্রয়ী গ্রামের মত স্টাপহোর্স্ট ও এখন রুপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এই ছবির মত সুন্দর গ্রামের দৃশ্যটি ক্রমশঃ পরিবর্তন হচ্ছে। জমি আস্তে আস্তে দুর্লভ হয়ে উঠছে আর যতই দিন যাচ্ছে তরুণ – তরুণীরা শহরের কল কারখানায় কাজের সন্ধান করছে। দু’বছর আগে গ্রামে একটা চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে, ধর্মীয় শিক্ষা ক্রম হ্রাসমান, এখন বড়রা বাড়িতে ছোটদের এই শিক্ষা দিচ্ছে। চাষীদের ঐতিহ্যবাহী জামা আজকাল কেউ পরে না বললেই চলে। গরমের সময় পর্যটকদের এড়াতে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা থেকে নিজেদের বিরত রাখে। স্টক এর ভাষায়, অন্যান্য সাধারণ গ্রামের মত আমরা এখন শুধুই একটি গ্রাম। শতকরা মাত্র চল্লিশ ভাগ অধিবাসী এখন কৃষক। দীর্ঘ দিনের অধিবাসী শতকরা ষাট জন, আর শতকরা তিন ভাগেরও কম মানুষ এখন অতিরিক্ত ধর্ম বিশ্বাস করে। কিন্তু গ্রামটিকে এখনও ঐতিহ্যই শাসন করে।

উনিশ বছরের কার্লো স্পাইক যে এ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করে বড় হয়েছে, তার মতে, একজন প্রকৃত স্টাপহোর্স্টার হতে হলে, তোমার দাদা এবং পর দাদাকেও এই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করতে হবে, নইলে তুমি প্রকৃত স্টাপহোর্স্টার নও। গ্রামের অনেকেই কার্লোকে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আজও অনেক মান্যগন্য করে।


তথ্যসূত্রঃ অন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment