Tuesday 3 November 2009

ডিম কাহিনী

ডিম কাহিনী

এতো যত্ন করে পদ্মিনী মেয়েটাকে তবুও মেয়েটা দুদিন পর পরই অসুখে ভুগে। কি করে যে কি করবে মেয়েটার জন্য ভেবেই পায় না সে। এই ফিরিঙ্গী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আজকাল আর সে খুব একটা ভরসাও পায় না। তাই দেশ থেকে কুরিয়ারে ওষুধপত্র আনাচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফি সপ্তায় জ্বর আসছে। স্কুল কামাই হচ্ছে, পড়াশোনার বিরাট ক্ষতি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে যেতে ক্লান্ত পদ্মিনী। ডাক্তার আজকাল আবার ওষুধের সাথে তাদের প্রাত্যহিক খাবার দাবারে পরিবর্তন আনার উপদেশও দিচ্ছেন। নিরুপায় পদ্মিনী ভাবছে “ডিম” খাওয়াবে কি না শেষ পর্যন্ত। এমনিতে জয়িতা বেশ সুস্বাস্থ্যের হলেও বারবার জ্বরে পরে আজকাল চোখ মুখ বসে গেছে তার। খুব কাহিলও দেখায় তাকে। সামান্য খেলাধূলাতেই সে হাপিয়ে পরে, স্কুলের অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে সে আজকাল আর তাল মিলাতে পারে না।

পরীক্ষার মুখে মুখে জয়িতা যখন আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল, পদ্মিনী আর সহ্য করতে পারল না। শুদ্ধ নিরামিষী জীবনের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু ঘরে ঠাকুর আছেন, সিদ্ধান্ত নিলেইতো আর সেটার বাস্তবায়ন এতো সোজা না। ঠাকুরকে কি জবাব দিবে? তাই বাজার থেকে ডিম নিয়ে এলেও সেটা বাড়িতে ঢোকালো না। ডিম বাইরে গ্যারেজেই থাকল। অনেক ভেবে ঠিক করলো, গ্যারেজেই একটা ওয়াটার কুকার রেখে দিবে সে। সেখানে ডিম সিদ্ধ করে জয়িতাকে খাইয়ে, বাগানের গাছে পানি দেয়ার কলতলায় মেয়ের গা মুছিয়ে, জামা কাপড় ছাড়িয়ে, নিজেও পবিত্র হয়ে বাড়িতে ঢুকবে। বাড়ি ঢুকে সোজা দোতলায় স্নানের ঘরে চলে যাবে। তাতে অন্তত কিছুতা শুদ্ধতা থাকবে বাড়িতে। বাকিটা ঠাকুর বুঝে নিবেন, তিনি অন্তর্যামী। কি জ্বালায় পদ্মিনীকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো।

এতো ভেবে এই ফুলপ্রুফ পরিকল্পনা করা হলেও বাধা পড়লো অন্য জায়গা থেকে। ডিম সিদ্ধ করে, খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে গা গুলিয়ে বমি বমি লাগতে লাগলো পদ্মিনীর ডিমের গন্ধে। কি করে এখন? নিজের নাকে রুমাল বেঁধে জয়িতাকে নিয়ে বসল গ্যারেজে “ডিম” খাওয়াতে হবে। মায়ের এই নাকে রুমাল বাঁধা চেহারা আর চোখে ডিমের প্রতি এতো ঘৃনিত ভাব দেখে জয়িতাও ডিম খেতে পারছে না। তার কেমন যেনো লাগতে লাগলো। মুখে অরুচি নিয়ে দু কামড় দিয়ে, ওষুধ খাওয়ার মতো এই অপবিত্র জিনিস গিলতে গিয়ে জয়িতা বমি করে দিলো। কি করে পদ্মিনী এখন? ওয়াটার কুকারে আবার পানি গরম করে তার সাথে বাগানের কল থেকে ঠান্ডা পানি এনে মিশিয়ে মেয়ের গা গ্যারেজেই স্পঞ্জ করে দিলো। এই ঠান্ডা গ্যারেজে মধ্যে গা স্পঞ্জ করে জয়িতার সাথে সাথে আবার কেঁপে জ্বর এলো। রাতে জ্বর এতোটাই বাড়লো যে জয়িতাকে হাসপাতালে নিতে হলো।

ঠাকুরের আসনে টাকা মানত করে রেখে পদ্মিনী হাসপাতালে ছুটোছুটি করল মেয়ের জন্য। মানতের টাকায় ভগবান নিশ্চয়ই ভুলবেন সেই আশা বুকে রেখে। কদিন পরে জয়িতাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল পদ্মিনী। এখন জয়িতা কিছুটা সুস্থ কিন্তু বাড়িতেই আছে সে, বিশ্রামে। একা বিছানায় শুয়ে থেকে সে প্রায়ই ভাবে ডিমের মতো একটা অপবিত্র খাবারে ভগবান কেনো এতো ভিটামিন দিয়ে রাখলেন? স্কুলেও কি এই নিয়ে তাকে কম যন্ত্রনায় পড়তে হয়? যখনই স্কুলে ইষ্টার লাঞ্চ, কার্নিভ্যাল লাঞ্চ কিংবা এধরনের কিছু থাকে, সে বন্ধুদের টেবলে বসতে পারে না। ক্লাশে টেবল সাজানো হয় তিনটা। একটা বড় যেটাতে সবাই বসে হৈ হুল্লোড় করে খায়। আর ছোট ছোট দুটো। একটাতে হালাল খাবার থাকে সেখানে মোহাম্মাদ আর আমিন একা একা বসে খায়। আর একটায় সে একলা খায়। স্কুলে মায়ের খুব কড়া নির্দেশ দেয়া আছে, জয়িতারা নির্ভেজাল নিরামিষী। তার খাবারের প্রতি যেনো খেয়াল রাখা হয়। যদিও জয়ির খুবই ইচ্ছে করে বন্ধুদের পাশে বসে হৈ চৈ করে খেতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না, ছোঁয়া লেগে যাবে। এসব খাবারও খারাপ, তাদের ছোঁয়াও খারাপ।

এইযে রীতিকা তাদের বাড়িতে আসে। এতো ভালো বন্ধু জয়িতার কিন্তু তারপরও কি তাকে নিয়ে তার কম টেনশান? রীতিকার মা আর জয়িতার মা নীচে বসে গল্প করেন। তাদের মায়েরাও দুজন খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু জয়িতাকে তার মায়ের কড়া নির্দেশ দেয়া আছে ওপরে খেলার সময় রীতিকা যেনো কিছুতেই পূজার ঘরে না যেতে পারে। রীতিকারা কালীমা’র পূজা করে। মাছ খায় - মাংস খায়, মাগো ভাবলেই জয়ি’র গা গুলিয়ে ওঠে। কিন্তু রীতিকাটা অনেক দুষ্ট, ফাঁক পেলেই দৌড় দিয়ে পূজার ঘরে ঢুকে যাবে, যদিও ঠাকুরের আসন ছোঁয় না কিন্তু তাতে কি? ঐ সকড়ি খাওয়া শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকলেইতো জয়ি’র মাকে আবার সব শুদ্ধ করতে হয় গঙ্গাজলে। গঙ্গাজল কি আর এখানে পাওয়া যায়? প্রতিবার গরমের ছুটিতে ইন্ডিয়া বেড়াতে গেলে, মা নিয়ে আসেন প্লাস্টিকের বোতলে করে। কতো হ্যাঁপা। এইযে রীতিকার মা আসেন বাড়িতে, চা খান, সেই চায়ের কাপওতো মা সরাসরি রান্নাঘরে নিতে পারেন না। রান্নাঘরে ঠাকুরের ভোগের বাসন ধোয়া হয়, সেখানে কি সকড়ি লোকের ছুইঁয়ে দেয়া কাপ না ধুয়ে নেয়া যায়? মা প্রথমে সেটা টয়লেটে ধুয়ে সাফ করেন একদফা তারপর রান্নাঘরে নিয়ে ডিশওয়াশারে দেন। মাকে কতো বাড়তি খাটতে হয় এদের জন্য। কিন্তু রীতিকা ওর এতো ভালো বন্ধুযে, ও আসলেই জয়িতার মনটা ভালো হয়ে যায়। কেনো সকড়ি খাওয়া কোন মেয়েকেই ভগবান ওর প্রিয় বন্ধু করলেন সেটাও বুঝে পায় না জয়িতা।

সকড়ি খাওয়া পাপ কিন্তু রীতিকা দিব্বি সুস্থ স্কুলে যাচ্ছে, বন্ধুদের সাথে মজা করছে। কি করে সম্ভব? স্কুলের বেশীর ভাগ বাচ্চাই মাছ - মাংস খায় অথচ তারা সুস্থ থাকে। কিন্তু অসুখতো আসে পাপ থেকে, তাই না ? মাতো তাই বলেন, “ভগবানের শাস্তি”। ছোট মনে প্রশ্নগুলো ঘুরতেই থাকে কিন্তু তার জবাব পায় না সে। জবাব খুঁজতে খুঁজতেই মায়ের কথাগুলো বারবার কানে বাজে, “মাছ - মাংস ছোঁয়াও পাপ, খবরদার ওসবের পাশ দিয়েও হাটবে না।“ জয়িতা কি সেটা জানে না? ঠিক জানে। তাইতো সেদিকে ফিরেও দেখে না কিন্তু ছোট জয়িতার মনে তবুও অনেক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে।

*****এই লেখাটি নিতান্তই কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কারো সাথে এই লেখার কোন সর্ম্পক নেই।*****


তানবীরা
০৩.১১.০৯

4 comments:

  1. অসাধারন পেরিয়ে ১০০ মাইল, আমার দেখা এমন অনেক ঘটনা আছে আপু। খুব ভালো আর ঝরঝরে আপনার লেখাটা।আমরা যখন রাজশাহী মেডিকেল ক্যাম্পাসে থাকি, তখন আমার নিচতলায় এক আংকেল থাকত, আর তার নিচতলায় থাকত আরেক আংকেল। ইনারা সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত, কাজেই আজাইরা ত্যানা প্যাচানোর সময় নাই। ২ জনের স্ত্রীই গৃহিনী, ২ তলার জনের কোন কিছু নিচ তলার আন্টি স্পর্শ করত না, তার ভাষায় ২ তালার আন্টি নিচু জাতের। সেই সব দিনগুলো মনে পড়ে গেল আবার। লেখাটার লিংক দেবার জণ্যে অসংখ্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. দেশে নিজের গন্ডীতে বড় হয়েছি বলে তেমন ভাবে জীবনের এপাশটা আমার জানা ছিলো না। এটা আমার একদম "প্রবাসী" অভিজ্ঞতা বলতে পারো। ভাবতে অবাক লাগে মানুষের প্রতি এতো ঘৃনা নিয়ে মানুষ দিনের পর দিন বাঁচে কিভাবে?

    ReplyDelete
  3. আমার কিছু কথা বলার আছে এখানে,তানবীরা। এই যে নিরামিষ খাওয়া, এটা যতটা না ধর্মের কারণে তার থেকে বেশী সাংস্কৃতিক কারণে। শৈশব থেকে অভ্যস্ত হবার কারণেও কিছুটা-মানে বলছি এই যে মাছ মাংশ দেখলেই গুটিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। বুদ্ধিমান মানুষ এসব অনুভূতি গোপন করবে। আর যারা করতে পারবে না তাদের জন্য আমার মায়া হয়। এই কারণে যে তারা অন্যের খাদ্যাভাসকে সম্মান দেখাতে পারছে না। আমি আমার জীবনে কোনোদিন গরুর মাংস খাইনি (অভ্যাসের কারণে) সেইদিন পর্যন্ত, যেদিন আমার এক প্রতিবেশী ছেলের জন্মদিনে দাওয়াত করেছিল, ওদের মেন্যু ছিলো গরুর মাংসের বিরিয়ানী আর কোক। অনেক কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু খেয়েছিলাম, এই ভেবে যে, না খেলে দুই ধরণের সমস্যা হবে, এক ওরা অন্য কিছু খাওয়াতে চাইবে আমায়, সে এক ঝামেলা, দুই বাকী মানুষগুলোর সামনে নাটক উপস্থাপিত হবে।
    এখন এটা একটা স্পর্শকাতরতার বিষয়,কিছু মানুষ অন্যের স্পর্শকাতর জায়গাগুলি বোঝার ক্ষমতা রাখে না। সেইদিকটাকে আমি মমতা দিয়ে দেখি।

    ReplyDelete
  4. মনি, আমার কি মনে হয় জানিস, এই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা অনেক সময় "দ্রব্যের" সহজলভ্যটার ওপরেও অনেকটা নির্ভর করে। কোলকাতা বা গোয়ার লোকেরা প্রচুর মাছ খায় কারন সেখানে পাওয়া যায়। রাজস্থানে মাছ - মাংস নেই তাই তারা সব্জিভোগী। আমি শত শত বছর আগের কথা বলছি, আজকের কথা বলছি না। কিন্তু আমার আপত্তি "যারা খায় তাদেরকে ঘৃনা করার" এই মানসিকতায়।
    তোর সাথে আরো একটি ব্যাপারে মিল পেলাম আমার। আমিও সহসা কাউকে বলিনা, আমি খাইনা বা খাবো না। অন্যকে আপসেট করতে আমার ভীষন বাধে।
    "স্পর্শকাতর" জায়গাগুলো সবাই এড়িয়ে যাওয়াটাই ঠিক ?

    ReplyDelete