Tuesday 15 December 2009

একজন সুবিধাবাদিনীর পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা

অফিসে অসম্ভব ব্যস্ত আর বিভিন্ন কারনে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত। বেশি ব্যস্ত থাকলে যা হয় কাজ হয় না বেশি কিন্তু ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব নিয়ে সারাক্ষন একটা অকারণ টেনশান হতে থাকে। বিভিন্ন কারনে অকারনে বিভিন্ন ওয়েবগুলোতে বেশি ক্লিক করা হয়। মন বসাতে পারি না, কি করলে ভালো লাগতো তাও জানি না। জীবন সব সময় এক রকম থাকে না জানি, কিন্তু যা যা জানি তাও সব সময় মন থেকে মেনে নিতে পারি না। মেনে নেয়ার ক্ষমতা নিয়ে আমি পৃথিবীতে আসিনি যদিও জানি তার সাথে আজ এটাও জানি একদিন সব দুঃখ কষ্ট সয়ে যাবে। মাঝখানে কটা দিন রক্তক্ষরণ হবে শুধু। কালরাত থেকে বিভিন্ন ব্লগে বিজয় দিবসের ওপর লেখা পড়ে যাচ্ছিলাম। সবাই যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। বর্তমান সরকার এ প্রতিশ্রুতি দিয়েই তরুন সমাজের ভোট বাগিয়েছেন। মনটা সেই নিয়েও ভাবছে। আসলে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে নাকি এজীবনে বিচার দেখে যেতে পারবো না।

আজকে এক কলিগের জন্মদিন ছিল। সে সকালে অফিসে “কফিব্রেড” নিয়ে এসেছে সবার জন্যে। খেতে বেশ ভালো অনেকটা আমাদের দেশের চালের গুড়ো আর গুড় দিয়ে বানানো পিঠার মতো। আমাদের কুমিল্লার ভাষায় বলে, “তেলের পিঠা”। রস থেকে পিঠা গুলো তুলে রাখলে যেমন পিঠার সারা গায়ে সাদা শুকনো চিনির গুড়ার মাখামাখি থাকে এ পিঠাতেও ঠিক তাই। “কফিব্রেড” হাতে নিয়ে মন উড়ে যায় ............। এখন শীতের সময়। সারা দেশ জুড়ে পিঠা খাওয়ার ধুম। মাইনাস ঠান্ডায় কৃত্রিমভাবে গরম করে রাখা অফিসঘরটিতে বসে ঢাকার ফুটপাতের পাশে বসে কোন এক রিক্সাচালক রঙ চঙে মাফলার সারা মুখে মাথায় জড়িয়ে হয়তো প্লাষ্টিকের ছোট প্লেটে ভাঁপা পিঠা খাচ্ছেন ভেবে দুচোখ ভিজে উঠলো। মন খারাপ থাকলে আমার এমনই হয়। সারাক্ষন যা মনে পড়ে তাতেই চোখ ভিজে যায়। কেউ তাকালে বলি, “সর্দি”। ভাবনা এখন রিক্সাচালক ছাড়িয়ে আমার বাড়ির উঠোনে।

আগে শীতের দিনে পিঠা দেখলে বরং বিরক্তই হতাম। কিন্তু এখন সমানে চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে আমার মেয়ের গালের মতো ফোলা ফোলা দুধ সাদা চিতোই পিঠা, নারকেল আর গুড় জর্জরিত ভাঁপা পিঠা, ছিটা পিঠা, কুৎসিত কদাকার মেরা পিঠা। যেটা দেখা মাত্র পিত্তি জ্বলে যেতো। এগুলো ভাবতে ভাবতেই লক্ষ্য করলাম আগের মতো বুকটা ফেটে চৌচির হচ্ছে না। বরং কলিগ যখন বললো, অনেক “কফিব্রেড” বেঁচে গেছে আরো কেউ নিতে চাইলে নিতে পারো। আমি যেয়ে আবার আর একটা ব্রেড নিলাম আর বেশ আনন্দের সাথেই খেলাম। দেশে কথা হলে যখন শুনি ওরা ভালো মন্দ খাচ্ছে আগের মতো বুকটা চৌচির হয় না, সামান্য একটু ব্যথা হয়েই থেমে যায়। সেদিন একজন ফোন করল বাংলাদেশে যাচ্ছে ছুটিতে তাই বিদায় নিতে। সেদিন সারাদিন আমার বালুশাই খেতে এমন ইচ্ছে করছিল যে, আমি ওকে বল্লাম “রস” নয়তো “সর” থেকে বালুশাই আনবে আমার জন্যে। আর ভাবলাম দেশে যেয়ে এবার এই মিষ্টি বানানোটা হাতে নাতে শিখে আসবো। কিন্তু রাতে শুয়ে মনে হলো, আজকাল এয়ার লাইন্সের যা অবস্থা, ধুত বেচারা লজ্জায় হয়তো কিছু বলতে পারেনি কিন্তু তাকে এ বেকায়দায় না ফেললেও চলতো। এখন দেশীয় জিনিসের আকাঙ্খা সহ্য সীমার মধ্যে এসে পড়েছে, এ কিসের লক্ষন ?

আজকাল কেমন যেনো নিজেকে অপাক্তেয় লাগে। বোধ হয় কোথাও আমার বাড়ি নেই ঘর নেই। এ মিছেই পথ চলা। যার কিছুই হয়তো সত্য নয়। বাংলাদেশে গেলে সব কিছুতেই প্রচুর শব্দ লাগে। মনে হয় সবাই অকারনে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলে। অনেক বেশী কথা বলে, মানুষের ভীড় বেশী। নেদারল্যান্ডসের নিজের বাড়ির একলা কোনটাকে তখন আবার খুব চাই। অথচ এক সময় এখানের এই মৃত্যুশীতল নীরবতা বুকে পাথর হয়ে চেপে থাকতো, কতোদিন মনে হয়েছে, এখুনি আমি দম আটকে মরে যাবো। মরার হাত থেকে বাঁচার জন্য জোরে টিভি চালিয়ে রাখতাম সারাদিন। একটা সময়ের পর ঢাকার যানজট অসহ্য লাগতে থাকে, মনে হয় কখন ফিরে যাবো ঐপারে? অসু্খ হয় নির্ঘাত দেশে যাওয়ার পরপরই। ডাক্তার আর ওষুধের বাহার দেখলে মনে হয় ফিরে যাই নেদারল্যান্ডস। পানি খাওয়ার সমস্যা, যেখানে সেখানে কার্ডে পে করার সমস্যা, ব্যাগে টাকা নিলে ছিনতাইয়ের সমস্যা, আবার জিনিসপত্র আকাশছোয়া দাম, মেয়েদের টয়লেটের সমস্যা ক্লান্ত মনটা তখন বলতে থাকে, ভালো লাগে না এবার ফিরে যাই। আবার বিজয় দিবসের ঢাকাকে কল্পনা করে, পহেলা ফাল্গুনের ঢাকাকে কল্পনা করে, একুশের ঢাকাকে কল্পনা করে কিংবা পহেলা বৈশাখের ঢাকাকে কল্পনা করে চোখের পানি ফেলি। তখন ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে ফেলে ঢাকা চলে যাই, যা হয় হোক। মায়ের হাতের রান্না, যত্ন সবকিছুর জন্যই মন ব্যাকুল থাকে।

তারমানে আমি সব জায়গার ভালোটা চাই, খারাপের সাথে থাকতে চাই না। আগে ঢাকা গেলে যখন বেশ অসুস্থ হতাম তখন আমার প্রাক্তন বস একবার বলেছিল, তুমি নিজেকে অনেক জোর করো তানবীরা। তুমি চাও বা নাও তুমি এখানে থাকতে থাকতে এখানের জল - হাওয়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছো। এখন দেশে যেয়ে তোমার অনভ্যস্ত সিস্টেমকে যখন হঠাৎ অনেক জোর দাও, তারা নিতে পারে না তুমি অসুস্থ হয়ে পরো। তখন আমার দেশপ্রেম তুঙ্গে থাকাতে বসের সাথে জোর গলায় বলেছি, কখনোই না, যেখানেই থাকি বাংলাদেশি আছি তাই থাকবো চিরকাল। আজকাল একটা অশুভ সত্যি চোরাগুপ্তা উঁকি দেয় আমার মনে, সে কি ঠিক বলেছিল নাকি সেদিন? বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে যখন সবকটি ব্লগে তুমুল লেখালেখি চলছে তখন আমি ভাবছি, “তাহলে কি আমার দেশপ্রেম সত্যিই কমে গেছে”? আমি কি তাহলে এতোদিনে সত্যি সত্যি সভ্য সমাজের সুশীল তৈরি হলাম?

এ সত্যটাও মানতে পারছি না।

তানবীরা
১৬.১২.০৯

2 comments:

  1. আপুনি আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালোও লেগেছে, আবার যখনই আপনার অনুভুতিগুলো স্বপ্নের ক্যানভাসে রঙতুলি দিয়ে নিজের মত করে আকার চেষ্টা করছি, একটা বিষন্নতা ক্রমশ আমাকে আবেগতাড়িত করছে। আপনারা এই দেশটাকে কত ভালোবাসেন। কত সুন্দরভাবে প্রতিনিয়ত অনুভব করেন। ওই সুদূর সাত সমুদ্দুর তের নদীর পাড়ে বসেও ভুলতে পারেন না ফেলা আসা স্মৃতিগুলো। দুধ সাদা চিতোই পিঠা, নারকেল আর গুড় জর্জরিত ভাঁপা পিঠা, ছিটা পিঠা, কুৎসিত কদাকার মেরা পিঠা। জানেন, আপনার লেখাটা পড়ে আমারও কান্না পেয়ে গেছে। প্রবাসীদের মত করে যদি দেশটাকে আমরাও ভালোবাসতে পারতাম! কত সুন্দরই না আমদের দেশ! কত সহজ সরল এই দেশের অভাবী দুঃখী হাসি খুশি মানুষগুলো। ভালো থাকবেন আপুনি।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো আপনার মন্তব্য পেয়ে। আসলে কোন জিনিসের উপলব্ধির গভীরতা বোঝার জন্য হয়তো তার থেকে দূরে যেতেই হয়।

    ভালো থাকবেন।

    ReplyDelete