Wednesday 29 April 2015

আমাদের দেশ, আমাদের গল্প, আমাদের স্বপ্ন

নেদারল্যান্ডসে প্রাইমারী স্কুলের শেষের দুই ক্লাশে বাচ্চাদেরকে স্কুলে প্রেজেনটেশান (spreek beurt) করতে হয়। ল্যাপটপ, স্লাইড, প্রজেক্টর সব দেয়া হয়। বলা হয় তাদের পছন্দমত একটি বিষয়কে বেছে নিতে আর তার ওপর তথ্যমূলক প্রেজেনটেশান বানাতে। বাচ্চারা প্রায় পাঁচ-ছয় মাস সময় পায় কারণ স্কুল শুরু হলেই বছরের শুরুতে তাদেরকে সারা বছরের কারিকুলাম দিয়ে দেয়া হয় এবং সাধারণত তার কোন রদবদল হয় না। 

মেঘলাও তার কারিকুলাম পেয়েছে। তাকে বললাম কীসের ওপর এবছর প্রজেন্টেশান বানাবে। সে অনেক ভেবে ঠিক করলো, “chinchilla”, কারণ জিজ্ঞেস করতে বললো, তার খুব আদর লাগে এটাকে দেখলে। শুরু হলো, মায়েতে-মেয়েতে যুদ্ধ। আদর লাগে এ কারণে এর ওপর প্রেজেন্টেশান বানাতে হবে? আরো কোন তথ্যমূলক কোন বিষয় নির্বাচন করতে আমি বার বার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। মেঘলা ঘাড় ফুলিয়ে ফুলিয়ে বলে যাচ্ছে, এটা আমার স্কুল, আমার প্রেজেন্টেশান, তুমি এখানে ইন্টারফেয়ার করবে না, এটা আমার পছন্দ। 

বরাবরের মতো সামরিক কায়দায় বলতে হলো, তুমি আমার মেয়ে, তোমার সবকিছুতে কথা বলার অধিকার আমার আছে। এবং অবশেষে, মেঘ রাজী হলো মায়ের মনোনয়ন করা বিষয় “বাংলাদেশ” এর ওপর প্রেজেন্টেশান তৈরী করতে।

প্রথম প্রশ্ন কেনো বাংলাদেশ মামি?

একটা বাংলাদেশি মেয়ের সাথে আট বছর স্কুলে পড়ে, তোমার ক্লাশের কেউ বাংলাদেশ সম্পর্কে জানবে না, সেটা কী করে হয়?

ওরাতো জানে বাংলাদেশ, আমি প্রতিবার গরমের ছুটি থেকে ফিরে এসে ওদেরকে দাদাবাড়ি – নানাবাড়ির অনেক গল্প করি।

শুধু গল্প থেকে বাংলাদেশ জানলেতো হবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশকে চেনাতে হবে। জানাতে হবে, আমাদের দেশটির কথা, তুমি না জানালে কে জানাবে? সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব তোমার এখন, স্কুলে, ইউনিতে অফিসে যেখানেই যাবে বাংলাদেশকে নিয়ে কথা বলতে হবে তোমাকে। সেজন্য তোমাকেও দেশ নিয়ে অনেক পড়তে হবে, কী করে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ হলো।

পড়াশোনার কথা বললেই স্বাভাবিক ভাবে মুখে অমাবস্যা ভর করে। 

একুশে ফেব্রুয়ারী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বইমেলা, পহেলা বৈশাখ, হরতাল, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া এগুলো সে জানে। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে তার একটু গন্ডগোল পাকিয়ে যায়। সে নিজ দায়িত্বেই গুগল থেকে জানে, পাকিস্তান-বাংলাদেশ যুদ্ধ করেছে ১৯৭১ সালে, সে যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে। পাকিস্তানের ওপর বিরক্তিও নিজ থেকেই। শুধু গোল পাকিয়ে যায় একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বরের তারিখগুলো নিয়ে। কোনটা যেনো কোনটা ছিলো। অবশ্য তার কাছে অবশ্য পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে তার নিজের বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বাকি সব না জানলেও চলবে। 

তাকে বিষয় নির্বাচন করে দিয়ে, ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে দিতে হলো, বাংলাদেশের কোন কোন জিনিস প্রেজেন্টেশানে আসা জরুরী। ক্রিকেট আসতে হবে, পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ "সুন্দরবন" আসতে হবে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আসতে হবে, পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা সীবিচ "কক্সবাজার" সম্বন্ধে বলতে হবে আর যুদ্ধ নিয়ে বলতে গেলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি শেখ মুজিবর রহমান, সাহিত্যের জন্যে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরতো আসবেনই। সাথে আসবে বাংলাদেশের পতাকা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে, প্রেজেন্টাশানের শেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব নিয়ে সে ভয় পাচ্ছে,

সবকিছু যদি ঠিক ঠিক উত্তর দিতে না পারি, আমিতো সব জানি না মামি।

আমি অভয় দিয়ে বলেছি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তোমাকে প্রশ্ন করতে হলে, অন্যকেও বাংলাদেশ নিয়ে পড়তে হবে, জানতে হবে আর এখানেই তোমার প্রেজেন্টেশানের সার্থকতা। 

ভাবছিলাম ফেসবুকে লিখে বিদেশে কিংবা দেশে বাস করা সব বন্ধুদের জানাই কী করে আমাদের সবাইকে আমাদের গল্পটি দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি চেষ্টা করছি, আপনি করছেনতো? আমাদের দেশ, আমাদের গল্প, আমাদের স্বপ্ন, এভাবেই আমাদের বাচ্চারা জানবে, শিখবে আর বিশ্বের সবাইকে জানাবে।  

তানবীরা ২৯/০৪/২০১৫

4 comments:

  1. Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্যে

      Delete
  2. আপনি দারুন লেখতে জানেন।
    এই রকম অসাধারন একটা পোস্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আসা করি এই রকম পোস্ট আরও পাব। সময় থাকলে আমার e shopping সাইটে ঘুরে আস্তে পারেন।

    ReplyDelete