Monday 30 March 2020

অন্তর মম বিকশিত কর

করোনা”কে উপলক্ষ্য করে নানারকম ভিডিও, মীম ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। কিছু উপদেশমূলক, কিছু শিক্ষনীয়, কিছু ফান আর কিছু অবমাননাকর। আজকে একটা অবমাননাকর ভিডিওর কথা বলবো। একজন বেশ বয়স্ক মুরুব্বী শ্রেণীর ভদ্রমহিলা “করলা” নিয়ে অনেককিছু শুনছেন বলে এখন “করলা” খান না। ক্যামেরার পেছনে যে আছে তিনি বেশ হেসে হেসে তাকে দিয়ে এটি তিন-চার করে বলাচ্ছেন, ভদ্রমহিলা দেখছেন তাকে নিয়ে মজা হচ্ছে, ক্যামেরাও রেকর্ড হচ্ছে কিন্তু তিনি নিরুপায় তাই ইচ্ছে না থাকলেও হেসে হেসে একই কথা বলে যাচ্ছেন, সায় দিয়ে যাচ্ছেন।


এখানে আসলে একজন অসহায় মানুষ যাকে ঐ বাড়িতে হয়ত কাজ করে কিংবা সাহায্য নিয়ে থাকতে হবে তার নিরুপায়তাকে ভিডিও করা হয়েছে, এটা কোন ফান নয়, অন্তত আমি পাই নি। ঐ বয়সী মুরুব্বী আমার আপনার পরিবারে, আশেপাশে নিশ্চয় আছে, যারা করোনাকে “করলা” না ভাবলেও, করোনা নিয়ে আমার আর আপনার চেয়ে হয়ত কম জানে, কিংবা মনের ভুলে করোনাকে, “করোলা” বলেও ফেলেছে দু’চারবার। আপনি ঐটার ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপ করেন তো। কানের গোড়ায় ঠাটিয়ে দুটো দিয়ে রক্ত বের করে দেবে। আপনি ঐ ভদ্রমহিলার মেঝেতে বসা অবস্থানটাকে ভিডিও করেছেন, আপনি চেয়ারে বসেন সেই সুযোগটা নিয়েছেন, দ্যাটস ইট।


বাংলাদেশ সরকার “লকডাউন” ঘোষনা করার পর ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে পরিবারমুখী মানুষের ভীড়। সংকটে আপনজনের পাশে থাকার তাড়না তো চিরন্তন। প্রবাসীরাও হয়ত সেই প্রেষণা থেকেই বাড়ি ফিরেছিলেন। সারাজীবন পরিবারে জন্যে খেটেছেন, এই বিপদের দিনে তাদের কাছে ফিরবেন না তো ফিরবেন কোথায়? যাই হোক, মুহূর্তে সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলো, সাথে বিভিন্ন টিকাটিপ্পনী। হ্যাঁ বটেই, পরিবার ছেড়ে তো থাকেই সেসব শ্রেণি পেশার লোক যাদের অবলীলায় গালি দেয়া যায়। আমরা যারা গালি দিতে পারি তারা মোটামুটি সবাই পরিবার নিয়েই বাস করি। সাথে সরকারের “কান্ডজ্ঞানহীনতা”র সমালোচনা। মানলাম সরকার কান্ডজ্ঞানহীন, সরকারের উচিৎ ছিলো প্রথমে দেশ জুড়ে “কার্ফিউ” ঘোষনা করে তারপর “লকডাউন” করা। কিন্তু আমি আর আপনিই কতটা দায়িত্বশীল? দেশ জুড়ে এই মহামারী মোকাবেলা করা কি সরকারের একার দায়িত্ব? আমার-আপনার কোন দায়িত্ব নেই? আমাদের দায়িত্ব কি শুধু ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা করা আর জনগনকে গালি দেয়া? গালি দিয়ে বিপ্লব হয় না। বিপ্লব করতে হলে, মাঠে নামতে হয়, ঐ মানুষ গুলোর পাশে দাঁড়াতে হয়, তাদের কাঁধে কাঁধ রেখে, চোখে চোখ রেখে তাদের বেদনা জানতে আর বুঝতে হয়। আপনি যেতে পারতেন স্টেশনে, বোঝাতে পারতেন এতে কি ক্ষতি হতে পারে, নামতেন রাস্তায়, নামেন মাঠে, ঘাটে কিংবা বন্দরে -----



অভিজিত রায় খুন হওয়ার পর বিডি নিউজ থেকে প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ডাঃ অজয় রায়ের একটি সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছিল, জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাবা আর ছেলে দুজনেই সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন, সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন, কে বেশি সফল? (স্মৃতি থেকে লিখছি, হুবহু না’ও হতে পারে)

অজয় রায় স্যার জবাব দিয়েছিলেন, অবশ্যই আমি, আমি লড়েছি রাজপথে। অভির যুদ্ধ ছিলো কলম দিয়ে। রাজপথে লড়াই করতে অনেক বেশি সাহস আর শক্তি লাগে, কলম সেই বিপ্লব আনতে পারে না।

আমিও স্যারের মত বলবো, মানুষকে ভালবাসলে রাস্তায় নামেন, গালি দিয়েন না। যদিও অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে জানি, ওয়েল কর্নসার্নড বলেই আমার বন্ধুরা এভাবে তাদের টেনশান প্রকাশ করেছে, কিন্তু একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলে হয়ত নিজেই অনুভব করবেন, দিজ মাইট নট বি দ্যা প্রপার ওয়ে।

এই যে ক্ষমতাসীন ভদ্রমহিলা, দুই মুরুব্বীকে কানে ধরিয়ে সর্গবে তার মোবাইলে তা ভিডিও করছেন। যা দেখে আমাদের সবার বিবেক নড়ে গেছে, ছিঃ ছিঃ করছি। এই ভদ্রমহিলা আকাশ থেকে টুপ করে বাংলাদেশে পরে নি। উনি আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অংশ, আমাদের মানসিকতার প্রতিফলন। রিকশাচালক, গৃহকর্মীদের তুই তোকারি করা, গায়ে হাত তোলা, অবলীলায় মাটিতে বসানো, গালি দেয়া, আমাদের মানবিকতাবিহীন শ্রেণি বিন্যস্ত সমাজের তিনি একজন প্রতিনিধি মাত্র। আমাদের লুকানো মুখোশের একটি নির্লজ্জ প্রকাশ।

আগে নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করি, হয়ত দেখবো, চারপাশ খানিকটা এমনিই বদলে গেছে … বদলানো শুরু হয়েছে

No comments:

Post a Comment