Friday 26 March 2010

স্মৃতি হয়ে শুধু আছি ছবি হয়ে রয়ে গেছি

অনেকদিন ধরে লেখালেখি বন্ধ, নানা কারণ আর অকারণে। আজ কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু অভ্যাস চলে যাওয়াতে কোথা থেকে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারছি না কিংবা ভাবনাগুলোকে ঠিক গোছাতে পারছি না। অথচ অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। মনটা বিক্ষিপ্ত থাকলে, লেখার খাতায় আঁকিবুকি মনটাকে অনেকটাই শান্ত করে আনে। লেখালেখি আমার জন্য অনেকটা প্রার্থনার কাজ করে অনেক সময়।ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে সারাটাদিন ধরে। প্রচন্ড ব্যস্ততার জন্যই হয়তোবা।

এক সময় প্রতি বছর আমি বাড়ি ফিরে ছয় সপ্তাহের জন্য। এই ছয় সপ্তাহ আমাদের বাড়িটা অচল থাকতো। সেবা স্বনার্লী স্কুল ছাড়া বাড়ি থেকে বেড়োতো না কোথাও। ছাঁদে কিংবা বাসার সামনের ছোট পোর্চটাতে বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের সাথে ওরা সারা বছর বিকেলে খেলা করতো শুধু ঐ ছয় সপ্তাহ বাদে। একদিন অন্য ফ্ল্যাটের খালাম্মা আম্মির কাছে নালিশ নিয়ে এলেন, ওনার মেয়েরা কাঁদছে, কেনো সেবা স্বনার্লী বোন এলে একদিনও খেলতে যায় না। ওরা একা একা আর কতোদিন খেলবে? আমাদের জন্য যে ছয় সপ্তাহ চোখের নিমেষে কেঁটে যেতো, সে সময়টুকু ওদের জন্য হয়তো পাহাড়সম ছিল। সুমি ইউনিতে ক্লাশ শেষ হওয়া মাত্র বাড়িতে দৌঁড়। কোন আড্ডা বন্ধুর ডাকে সাড়া দিতো না, অনেক সময় ক্লাশও মিস করতো। আব্বু ভাইয়া যারা সন্ধ্যে পার না করে বাড়ি ফিরেন না তারাও রোজ দুপুরে বাড়িতে খেতে আসতেন। সবাই তাদের দৈনন্দিন কাজ কমিয়ে দিতেন, পরিবর্তন করে নিতেন শুধু আমি আছি বলে।

একটা সময় জীবনে যা অপরিহার্য ছিল আজ তার কথা মনেও পড়ে না। আমাদের পশ্চিমের টানা বারান্দায় ঝোলানো আমার দোলনাটার কথাটাই ধরি না কেনো? সকালে ঘুম থেকে ওঠে ওটাতে দুলে দুলেই আমাকে পড়তে হবে। গরমের ক্লান্ত দুপুরে কারেন্ট নেই, আমি বারান্দার দোলনায় দুলে দুলে সুনীল, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব কিংবা আশুতোষে মজ়ে আছি। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে দোলনাতেই ঘুমিয়ে থাকতাম। দোলানায় বসে পা দিয়ে জোরে ধাক্কা মেরে একবার শুরু করতাম, তারপর সামনে এগিয়ে গেলে, ধাম ধাম পিলারে লাথি মেরে চলত আমার দোলনা দোলা সারা বেলা। নিজের পা ক্লান্ত হলে পাশ দিয়ে যেই যাবে আব্বু আম্মি কিংবা ভাইয়া, আমার দোলনাটা দুলিয়ে দিয়ে যাও চিৎকারের আব্দার। আমার দোলনা আমার দোলনা করে বাড়ি মাথায় রাখতাম কেউ যেনো দোলনা নিয়ে পালিয়ে যাবে, এমন ভাব থাকতো আমার। অথচ দোলনা থাকলে বাড়িতে বাচ্চারা এসে প্রথমেই সেই দোলনায় চড়তে চায়। আমার চোখ মুখ বাঁচিয়ে সবাই সেদিকেই দৌড়াত। যখন আমি ছিলাম তখন আব্বু বকত, দোলনা কি ওড়ে যাবে, তুই এমন করিস কেনো? আর যখন আমি নেই, আম্মি আমায় গল্প করলেন, বাচ্চারা অবাধে এসে দোলনায় লুটোপুটি খায়। আব্বু হাটে দেখে কিন্তু সহ্য করতে পারে না। আম্মিকে একদিন বললেন, তুমি আমার মেয়ের দোলনাটা প্যকেট করে তুলে রাখো। আমার মেয়েকে পাঠিয় দিবো আমি এটা। আমার মেয়েটা তার লম্বা লম্বা পা তুলে সারা বেলা দোল খেতো, এখন অন্যেরা এসে এতে হুটোপুটি করে আমার ভালো লাগে না।

সেই ঘুম না আসা গরমের দুপুরগুলোতে হেটে হেটে আমি অমিয় চক্রবর্তীর অন্ত্রনীলা ঘুমাওনি জানি, কিংবা সুনীলের কেউ কথা রাখেনি, হুমায়ূন আজাদের আমি হয়তো খুব ছোট কিছুর জন্য মারা যাব, শামীম আজাদের সর্বসাধ্য মনে হলেও সকল কথা কইতে নেই আবৃত্তি করতাম। এক সময় একবিতাগুলো আমি মুখস্থ আবৃত্তি করতাম। এখন স্মৃতিতে ধূলো জমেছে, না বলতে বলতে আজ় আর কিছুই মনে নেই। অথচ আমার ছোট বোনেরা যারা আমার পাশে বসে পুতুল খেলতো তাদের এখনো মনে আছে। আমি গেলে তারা আবৃত্তি করে শোনায় আমায়। কি বিচিত্র মানুষের ভালোবাসা।

সেই সব দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি প্রচন্ডভাবে এখন মিস করি। একসময় যা কিছু সহজলভ্য ছিল, যার দিকে ফিরেও তাকাতাম না সেসমস্ত জিনিসের জন্য এখন আমার অন্তর আত্মা সারাবেলা কেঁদে ফিরে। প্রচন্ড ব্যস্ত এখন আমার দিনগুলো। এই দামি কর্পোরেট মূহুর্তে সবাই যখন ব্যবসা আর লাভ লোকসান নিয়ে ব্যস্ত, তখন দামি ইন্টেরিয়র দিয়ে সাজানো ডিজাইনার টেবল চেয়ারের ঘরে বসে হঠাৎ আমার বুকে চিন চিন ব্যথা শুরু হয়। কর্মব্যস্ত ঘরে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি কিছু সময়ের জন্য। আমার অতি সাধারন মধ্যবিত্ত শোবার ঘরটার জন্য মন আঁকুপাঁকু করতে থাকে। আমার সেই বিশ্রী পড়ার টেবলটা, যেটা বাংলাদেশের অতি সাধারন কাঠুরে কিংবা ছুতার তৈরী করেছেন, সেই চেয়ারটা যেটা কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার স্বাস্থ্যকর সার্টিফিকেট দেননি, কিন্তু আমি তাতে বসে গালে হাত দিয়ে আমার সমস্ত শরীর মনের ভার তাতে ছেড়ে দিতে পারতাম। বই সামনে নিয়ে পড়ার টেবলের সামনের জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে, নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কতোরকম বাস্তব অবাস্তব স্বপ্ন বুনতাম। তখনো ঢাকা শহর ভর্তি এতো আকাশ ছোঁয়া ইমারত হয়নি। জানালার ফাঁক গলিয়ে নীল আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলা যেতো অতি সহজেই।

কি পাগলের মতো একসময় সবকিছুতে আমি আমি আমি’র ছাপ দেয়ার জন্য উন্মত্ত হতাম। বিছানার এপাশটাতে আমি শোব, ডাইনীং এর এই চেয়ারটায় আমি বসবো, টিভি দেখার সময় এই সোফাটা আমার। দুবোনে একটা বাথরুম শেয়ার করতাম। সেটা নিয়েও কি ঝগড়া। ঠিক দুজনের দিনের একই সময় গোসলে যেতে হবে। সারাদিন বাথরুম ফাঁকা পরে থাকে কিন্তু সে সময় বাসায় কুরুক্ষেত্র। আম্মি কতো বকতো, কেনো আমার বাথরুমে যা, ঘাড় ত্যড়িয়ে জবাব দিতাম, কেনো আমি অন্যের বাথরুমে যাবো, এটা আমার বাথরুম। সবকিছু আমার, মোহর দেয়া। এখন এতো দূরে পরে আছি আমি, ঢাকায় থেকেও সুমি সপ্তাহে একদিনও বাসায় যাবার সময় পায় না নিজের সংসার সামলে। ফার্নিচারের মডেলের বিবর্তনে সেই খাট আর টেবলও বাড়িতে আর নেই। শুধু সেই মূহুর্তগুলো এই ব্রক্ষান্ডের কোথাও আটকে আছে। টাইম মেশিন চালু হলেই আবার ছুটে আসবে যেনো।

যদিও বাড়ি ছেড়ে আসার সময় আমার লাগানো মানি প্ল্যান্টের লতাগুলোর ওপর থেকে, ওয়ারড্রোবে যে অংশে আমার কাপড় থাকতো সে জায়গা থেকে, আমার বইয়ের তাক থেকে, দোলনা থেকে আমার স্বত্ব ত্যাগ করেই এসেছিলাম কিন্তু এখনো কেনো যেনো পুরোপুরি মন থেকে সবকিছু ত্যাগ করতে পারিনি বলে মনে হয়। বাড়িতে যেয়ে এটা ওটা ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ যখন কোন কিছু হাতে পরে যাতে বাংলায় আমার নাম লেখা, কিংবা কোন বৈশাখী মেলাতে আমার কেনা কোন শৌখীন জিনিস যার প্রয়োজন আজকে ফুরিয়েছে বলে স্টোরে ঠাসা আছে দেখতে পাই বুকের ভেতরটা শিরশির করে ওঠে। কোথাও আমি নেই কিন্তু তবুও যেনো কোথাও আছি। মা দেয়াল ভর্তি করে তাঁর মেয়েদের নাতি নাতনীদের ছবি সাজিয়ে রেখেছেন, সারাদিন হাটেন ঘুরেন আর দেখেন, যখন সাজানো সে ছবিগুলোর বাইরেও নিজের অস্তিত্ব টের পাই তখন কেনো এমন লাগে?
তানবীরা
২৬।০৩।২০১০

No comments:

Post a Comment