Sunday 23 January 2011

প্রেম ......... ঢাকা স্টাইল

কঙ্কাদের বাড়িতে আজ দারুন হৈচৈ চলছে, ‘সীমা’ পালিয়েছে। এতোদিন ধরে চোখে চোখে রেখেও কোন লাভ হলো না কঙ্কার মায়ের। পাখি শেষ পর্যন্ত ফুড়ুত করে উড়েই গেলো। এখন কি করে তাই নিয়ে সবাই দিশেহারা। ‘সীমা’ কঙ্কার মায়ের বাপের বাড়ির দেশ থেকে আনা লোক। সীমার বাবা মা ভাই বোন যাকে বলে সীমাদের পরিবারের সবাই কোন না কোন ভাবে কঙ্কার মায়ের বাপের বাড়ির কারো না কারো কাছে আছে। অনেক দিনের সম্পর্ক তাদের সাথে তাই ব্যাপারটাকে অবহেলা করার জোও নেই কঙ্কাদের পরিবারের, এক গ্রামের লোক, হোক গরীব কিন্তু এক গ্রামেরতো। গ্রামে যদি কথা রটে কঙ্কাদের বাসায় থেকে সীমার সর্বনাশ হয়েছে তাহলে আর গ্রামে মুখ দেখানো যাবে না, সবাই ছি ছি করবে। গ্রামেতো আর শত্রুর অভাব নেই তাছাড়া ভবিষ্যতে আবার লোকের দরকার হলে কথাটা বারবার উঠবে। আজকাল গার্মেন্টস আর গ্রামীন ব্যাংক হয়েতো পোয়া বারো। হয় বাড়ি বসে বসে হাস মুরগী পালবে নয় ঢাকা এসে চাকুরী করবে কিন্তু ঝিগিরি আজকাল আর কেউ করতে চায় না। বিশ্বস্ত লোক পাওয়াতো আজকাল সোনার হরিণের মতো দুষ্প্রাপ্য ব্যাপার। কঙ্কার মা একবার তার বড় ভাইকে মোবাইলে ফোন দিচ্ছেতো আর একবার মেজ বোনকে। দিশেহারা অবস্থা উনার যাকে বলে। বাবা পেপার মুখে নিয়ে ভয়ঙ্কর মেজাজ করে বসে আছেন। নিজেদের এমনিতেই শত ঝামেলা তারমধ্যে এসব উটকো ঝামেলা কারই বা পছন্দ হয়। নিজের হাজার কাজ ছেড়ে এখন কঙ্কার বাবাকে উটকো গৃহ কর্মীর সমস্যা নিয়ে বাড়ি বসে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। খোলামেলা কিছু আলোচনাও করতে পারছেন না, যা করছেন সব ফিসফিসিয়ে, মান সম্মানের ব্যাপার, বাড়িতে অন্য লোক আছে তারা না আবার পাঁচ কান করে ব্যাপারটা। পুলিশে খবর দেয়া উচিৎ হবে কিনা সেটা নিয়েও ভাবছেন, কথা বলছেন। পুলিশে খবর দিলে একদিকে যেমন বদনামের ভয় অন্যদিকে আবার খবর না দিলে আর ভয়ঙ্কর কিছু অঘটন ঘটে গেলে পুলিশতো তাদেরকেই ধরবে। সীমার মা-বাবাকে খবরটা দিবে কিনা সেটা নিয়েও কথা হচ্ছে। খবর পেলেই তারা হয়তো ছুটে এসে কান্না কাটি করে একটা সীন ক্রিয়েট করবে, তাদেরকেতো আর বোঝানো যাবে না যে এতে কঙ্কাদের বাড়ির কারো দোষ ছিল না বা হাত ছিল না, তাদের মেয়েই এজন্য দায়ী। তারা হয়তো তখন বলবেন যেখান থেকে পারো আমাদের মেয়ে এনে দাও। কঙ্কার মাও রাগে সমানে গরগর করে যাচ্ছেন, প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে উনার, উফফ সীমাকে পেলে ..... ফাজিল মেয়ের প্রেম করার সাধ আহ্লাদ একেবারে ঘুচিয়ে দেয়া যেতো।

ইট কাঠ পাথরে ঘেরা কঠিন শহর এই ঢাকা। এখানে কঠিন যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলে পিষে মানুষের বেঁচে থাকাই দায়। তার মধ্যে আবার প্রেম?!?! সেতো ধরতে গেলে অনেকটাই দূরের ব্যাপার, বড় লোকদের ফ্যাশন যাকে বলা চলে। ভোর সকালে সূর্য মামা উঁকি দেয়া না দেয়ার সন্ধিক্ষণ থেকে জেগে উঠে এই শহর ফেরীওয়ালাদের হাঁক ডাকে আর সেই নিশুতি রাত অব্দি জেগেই থাকে। একেবারে ঘুমায় না কখনই। রাত গভীরে হয়ত শহরের কোলাহল কমে কিন্তু দু একটি নিশিকন্যার আনাগোনা, কোন কাজে বাইরে আটকে পড়া লোকজনের গাড়ির হর্ন লেগেই থাকে। বড় নিষ্ঠুর শহর এই ঢাকা। এখানে কেউ কারো নয়। ছদ্মবেশী খুনী, প্রতারক আর ভেজালে ভরা। এই শহরে মানুষকে বিশ্বাস করা অনেক কঠিন, মানুষকে ঠকিয়ে খাওয়ার জন্য মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে মুখোশ পরে, নিষ্ঠুরতা আর প্রলোভনের ফাঁদ চর্তুদিকে। যন্ত্রদানব কোন দিকে না তাকিয়ে যেমন এক নিমিষে একজনকে পিষে ফেলে পেছনে না তাকিয়ে চলে যায় তেমনি মৌ - লোভী নারী দেহ পিয়াসী দানবেরও অভাব নেই এই শহরে। সুযোগ মতো কতো নিষ্পাপ নিরীহ মেয়েকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে, সর্বনাশ করে কেটে পড়ে। তবে এই শহরের লোক সবাই বেশ চালাক, কেউ ঠকতে চায় না, কোন কিছু কিনতে গেলে প্রথমে সেটা যাচাই করে নেয়, ভেজাল নয়তো আবার!?! দোকানদাররা আম থেকে শুরু মাছের কানকো সব রঙ দিয়ে মনোরম করে রাখে যাতে উপরটা পরিপাটি থাকে। নিয়তির পরিহাসে ভেজাল লোকে খাবারে খোঁজে, কাপড়ে খোঁজে, ঔষধে খোঁজে, আসল ভেজাল যে জায়গায় সেখানেতো কেউ হাত দেয় না। ভেজালতো বাসা বেঁধে আছে মানুষের অন্তরে, অন্যকে ঠকিয়ে খাওয়ার আকাঙ্খায়, লক্ষ্যে। এ সমস্ত জানা সত্বেও কিছু মানুষ তবু প্রেমে পড়ে, কোন দুর্বল মুহূর্তে কাউকে বিশ্বাস করে ফেলে। কতো অদ্ভুত পরিবেশে একজনের সাথে একজনের দেখা হয়ে যায়, কোন একক্ষণে ভালোও লেগে যায়, মনের লেনা দেনা হয়ে যায় হয়তো নিজেরই অজান্তে। তারপর এক এক জনের তৈরী হয় এক এক কাহিনী। কারোটা সুখের আবার কারোটা কষ্টের। শহরের বাড়িগুলো, রাস্তাগুলো জড়িয়ে আছে এমন অনেক নাম জানা কাহিনীর সাত পাঁকে। কিন্তু মায়াবতী ঢাকার রাস্তা সবার গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে, তাই পথ চলা পথিকেরা কখনই ঘটে যাওয়া সেইসব কাহিনীর খোঁজ পায় না। আর তাছাড়া দ্রুত পায়ে হেটে যাওয়া ব্যস্ত পথিকদের অতো সময়ই বা কোথায় দু দন্ড দাড়িয়ে অজানা অচেনা লোকের কাহিনী শোনার?

মধ্যবিত্ত ঢাকার ফ্ল্যাট বাড়িগুলো আজকাল বড্ড একটার উপর একটা গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে। জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখাতো আজকাল রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। যে যতোটা পাড়ছে পাশের বাড়ির গাঁ ঘেষে নিজের বাড়িটি তৈরী করছে। সবুজের ছোয়া বলতে গেলে আজকাল শুধু বারান্দার টব আর ছাদের বাগানেই আছে। বাড়ির সামনের এক ফালি বাগানের স্থান আজ গাড়ির গ্যারেজে কিংবা কনফেকশনারীতে রূপান্তর হয়ে গেছে। এক বাড়ির জানালা দিয়ে অন্য বাড়ির শোবার ঘর পর্যন্ত দেখা যায়, প্রাইভেসী ব্যাপারটা মহা দুর্লভের কাছাকাছি চলে গেছে প্রায়। কোন বাড়িতে কোন বেলা কি রান্না হচ্ছে, কোথায় স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হচ্ছে সব পাড়া শুদ্ধ লোক জানতে পারে, নিজস্ব বলে আর কিছু নেই। আলো বাতাস চলাচলের সমস্যা, ছোট বাচ্চারা যারা বেড়ে উঠছে তাদের জন্য এ ধরনের পরিবেশ কতো অস্বাস্থ্যকর সেই ভাবনা কারো মাথায় খেলে বলে তো মনে হয় না। এসব নিয়ে কঙ্কাদের পাশের বাড়ির সাথে রাগারাগি হয়েছে কঙ্কার বাবা - মায়ের আর ভাইয়ের। কঙ্কাদের বাড়ির একদম ধরতে গেলে গা ঘেষেই তারা তাদের বাড়ি তুলছেন যাতে কঙ্কাদের বাড়ির সবার ভীষন আপত্তি। প্রাইভেসী, আলো বাতাস সব নিয়েই তাদের সাথে কথা হয়েছে কিন্তু তারা নাচার। কোন কিছু নিয়ে জোরও করা যায় না, পাড়ার সব মাস্তান বাহিনী তাদের হাতে, আজকাল যারা বাড়ি তৈরী করেন প্রথমেই সেই পাড়ার মাস্তানদের হাত করে নেন। কার মনে কি আছে, কখন কিসের থেকে কি হয়, কে জানে এসব ভেবে আপাতত চুপ কঙ্কার বাবা - মা। ছেলে - মেয়ের জীবন, ভবিষ্যতের থেকেতো বাড়ি ঘর বড় নয় তাদের কাছে। তাই মুখে কিছু না বললেও পাশের বাড়ির প্রতি কঙ্কাদের এখন নন কোপারেশন মুভমেন্ট চলছে সব ব্যাপারে। এ সমস্ত ঘটনার মধ্যে দিয়েই পাশের বাড়ির একতলার ছাদ ঢালাই দেয়া হলো। ছাদে মিস্ত্রীরা আসা যাওয়া করতে লাগল এবং কঙ্কাদের বাড়ির ভেতর উঁকি ঝুকি দিতে লাগলো। কাহাতক আর এই গরমের মধ্যে প্রাইভেসীর জন্য সারা বাড়ির দরজা জানালা লাগিয়ে বসে থাকা যায়। এরমধ্যে লোড শেডিংতো আছেই। পর্দা টানলেও বাতাসের নাড়া চাড়ায় এবং লোকজনের হাটাচলায় সবসময়তো এক জায়গায় থাকেও না।

এ সমস্ত প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়েই কঙ্কাদের বাসায় থাকা কিশোরী মেয়ে ‘সীমা’ প্রেমে পড়ল পাশের বাসায় কাজ করতে আসা তরুণ এক রাজমিস্ত্রীর। সীমাকে রাখা হয়েছে ঘর-বাড়ি ঝাট-পাট দিয়ে পরিস্কার রাখা সহ বিভিন্ন ধরনের ফুট ফরমাশ খাটার জন্য। সীমা চৌদ্দ / পনর বছরের বেশ বাড়ন্ত গড়নের ছিমছাম দেখতে কিশোরী। গায়ের রং শ্যামলা হলেও মুখটা বেশ মিষ্টি দেখতে। কাজল দেয়া টানা টানা চোখের, বাড়তি মেদহীন ছিপছিপে দেহের, মেঘকেশী সীমাকে দেখলে এক নজরেই অনেকে পছন্দ করে ফেলবেন। তাছাড়া সারাক্ষণ টিভির সিরিয়াল দেখে আর বাড়ির আপাদের দেখে দেখে সাজগোজে বেশ পটুও সে। প্রায়ই এসে আপাদের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে পুরনো নেলপলিশ, টিপ, লিপিষ্টিক, ক্লিপ, ব্যান্ড নিয়ে যায় আর সাজেও ঠিক তেমনি করে যেমন করে বাড়ির মেয়েরা সাজে বা টিভিতে দেখে। হঠাৎ কেউ দেখলে গৃহ কর্মী বলে চিনবে না, ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাবে। টিপিক্যাল গৃহকর্মীর মতো যেনো না দেখায় সেজন্যও সীমারও চেষ্টার কোন অন্ত নেই। তবে কঙ্কাদের এসমস্ত দেখার এতো সময় কোথায়? কঙ্কা ভাইয়া ইউনিভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত, বাবা অফিস নিয়ে, মায়েরতো সংসারে ব্যস্ততার সীমা নেই। ‘সীমা শত্রু বাড়ির রাজমিস্ত্রীর প্রেমে মজেছে’ এই সংবাদটি যথাসময়ে পরিবেশন করল রান্না করার বুয়া, যিনি ‘সীমা’ র চেয়ে বয়সে বড়, স্বামী পরিত্যাক্তা এবং আপাতদৃষ্টিতে ‘সীমা’র চেয়ে সুরত এবং ফিটফাটে একটু পিছনেও। আর সংবাদটি কনফার্ম করলেন বাসায় কাপড় কাচতে আসা ছুটা বুয়া যিনি আশে পাশের অনেক বাসায় কাজ করেন বলে পাড়ার সমস্ত খবরে আপডেট থাকেন। তার সাথে কঙ্কাদের দারোয়ানও সেটা রিকনফার্ম করল, সেও নাকি ‘সীমা’কে পাশের বাসার রাজমিস্ত্রীর সাথে কথা বলতে দেখেছে। শুরু হলো প্রেমের পথের হাজারো বাঁধা। শুধু যারা বাঁধা দেয় তারা জানে না এমনি প্রেম যতো ভ্যাদভ্যাদাই চলুক বাঁধা পাওয়া মাত্র তাতে জোয়ার এসে যায়। আমার মনে হয় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ প্রেম মুরুব্বীদের আর সমাজের বাধা না পেলে এমনিতেই ভেঙ্গে যেতো। বাঁধা দিয়ে তারা তাতে গতির সঞ্চার করেন। শিল্পী সিনেমার কথাই ধরা যাক, উত্তম - সুচিত্রা জানতেনই না যে তারা বড় হয়েছেন, যতোদিন না সুচিত্রার মাতৃদেবী সেটি তাকে মনে করিয়ে দিলেন। মনে করিয়ে দেয়ার ফল হলো এই যে উত্তম - সুচিত্রা লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে দেখা করে প্রেম বাঁধালেন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরন করলেন। বাস্তব বাঙ্গালী সমাজেরও এই চিত্র। আজকালের সিনেমা সব ফালতু আর আগের দিনের সিনেমা দেখে শেখার অনেক কিছু আছে বলে মুরুব্বীরা বাচ্চাদের উপর গলা ফাটালেও নিজেরা কিন্তু কিছুই শেখেন না। শিল্পী, সাগরিকা। দ্বীপ জ্বেলে যাই তাদের হয়তো প্রত্যেকেরই পঞ্চাশবার করে দেখা আছে।

কঙ্কাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে লম্বা টানা বারান্দা বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা। সারা বারান্দায় ফুলের টব দিয়ে সাজানো, প্রায়ই কঙ্কা বারান্দায় হেটে হেটে পড়া মুখস্থ করে। বারান্দায় ঝোলানো দোলনাতে বসে চা খায়, রকিং চেয়ারে দুলে দুলে গল্পের বই পড়ে। জোছনা রাতে গরমের সময় ঠান্ডা মোজাইকের মেঝেতে বসে ভাইবোন সব একসাথে আড্ডা দেয়, আন্তাখসরী খেলে। লোডশেডিংয়ের রাতেতো এই বারান্দায়ই কঙ্কাদের সব ভাই বোনদের আশ্রয়স্থল বলা চলে। কঙ্কার ছোট বোনেরা মোজাইকের ঘরে পা ফেলে ফেলে এক্কা দোক্কা খেলে লাফিয়ে লাফিয়ে। এতো দিন পাশে বাড়ি ছিল না বিধায় কোন ধরনের সমস্যাই ছিল না, খোলা বারান্দায়ই ছিল সব ভাইবোনদের প্রাণ কেন্দ্র। কিন্তু এখন পশ্চিম দিক কুপোকাত করে বাড়ি উঠছে, আশ্রয় খোয়া যাওয়ায় সবাই মনক্ষুন্ন। এরমধ্যে প্রেমের প্রোগ্রেস হিসেবে দেখা গেল রাজমিস্ত্রী ছেলে লুঙ্গি ছেড়ে জীনস ধরেছে, স্পঞ্জের স্যান্ডেলের বদলে সে এখন চামড়ার স্যান্ডেল পরছে, হাতে ঘড়িতো আছেই আবার যখন কন্ট্রাক্টর না থাকে তখন চোখে রোদ চশমাও শোভা পায়। ছেলে নায়ক রাজ রাজ্জাকের মতো ফিটফাট হয়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে লাগল আর সীমাও দুই টাকা প্যাকেটের মিনিপ্যাক সানসিল্ক শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে এলোকেশী ববিতার ভাবভঙ্গী করে ঘুরতে লাগল। এতোদিন সীমার চুল লম্বা করার তাগাদা ছিল কিন্তু এখন সে কাচি নিয়ে কঙ্কার আর তার মায়ের পিছন পিছন হাটতে লাগল চুল কেটে দেয়ার জন্য। বাহারী ঢং এ ওড়না পরতে লাগল, পায়ে নুপূর। পরিবর্তন এতো প্রকট যে সবারই চোখে পড়ছিল। ওই ছেলের বেশীর ভাগ কাজই পড়তে লাগল তার বাড়ির পূর্ব পাশে আর সীমার কঙ্কাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে। সারা বাড়ি ঝাট দিতে মুছতে সীমার যতক্ষন সময় লাগে পশ্চিমের বারান্দা মুছতে সীমার ঠিক ততক্ষন কিংবা তারচেয়ে বেশি সময় লাগতে লাগল। এতোদিন ফুলের টবে চৌদ্দবার বলে বলে পানি দেয়াতে হতো এখন ঘুম থেকে উঠেই সীমা, সারা বাড়িতে কেউ উঠার আগেই পানির বালতি নিয়ে পশ্চিমের বারান্দায় দৌড় দেয়। আগে বলে বলে কঙ্কার মা যে টবের যত্ন করাতে পারতো না, সীমা সারাক্ষন এখন ন্যাকড়া নিয়ে সেই টবগুলোর আগা পাশতলা মুছতে লাগল, টবের গাছের গোড়া খুচিয়ে দিতে লাগল। পাশের বাড়ির কাজের ধূলো বালিতে পশ্চিমের বারান্দার টব নষ্ট হওয়ার বদলে আরো চকচক করতে লাগল। বরং বাড়ির অন্য যে দিকগুলোতে ধূলো থাকার কথা নয়, ঝাড় পোছের অভাবে সেদিকে ধূলো জমতে লাগল। ডাকলে সীমাকে খুঁজে পাওয়া ভার আজকাল, হয় সে পশ্চিমের বারান্দায় নয় সে তার ঘরে সাজ গোজ করছে। চুল খুলে চুল বাঁধছে কিংবা টিপ খুলে অন্য টিপ লাগাচ্ছে। কিন্তু রান্নার বুয়া সারাক্ষন শ্যেন দৃষ্টি রাখতে লাগল সীমার উপর। সীমা কতোক্ষণ পশ্চিমের বারান্দায় থাকে তার রিপোর্ট বিবি সাহেবকে সার্বক্ষনিক দিতে থাকে সে। ক্রিকেটের আপডেটের মতো বুয়ার আপডেট চলতে থাকতো। অসহ্য হয়ে কঙ্কার মা প্রস্তাব করলেন বারান্দায় মোটা চিকের ব্যবস্থা করা হোক যাতে কেউ কারো মুখ দেখতে না পায়। কতো আর কাউকে পাহারা দিয়ে রাখা যায়। সবাই মন খারাপ করে তাতে সায় দিলেও খ্যাক খ্যাক করে উঠল কঙ্কার ভাই। যখন পাশের বাড়ির ওদের দোতলার কাজ সম্পন্ন হবে তখন না চাইলেও তাদের বারান্দার কর্ম শেষ, সুতরাং যে কদিন খোলা মেলা হাওয়া উপভোগ করা যায় সেটাই ভালো। আর সীমার প্রেম সংক্রান্ত কারণে কিছুতেই বারান্দায় চিক আসবে না। ভাইয়ের কথা থাকতেই হবে কারণ ঐপাশে বাড়ি ওঠায় সবচেয়ে ভুক্তভোগী সে। ভাইয়ের ঘরের জানালা এবং দরজা দুটিরই সংযোগস্থল এই বারান্দা। তাই চিক পর্ব আপাততঃ বাদ গেলো।

চিক পর্ব বাদ যাওয়াতে অবশ্য কঙ্কারাও মনে মনে খুব খুশী হলো। একটু শ্বাস নেয়ার অবকাশ তবুও রইল এ বাড়িতে আপাতত। ভাইয়া বলাতে যেভাবে এটি এক কথায় স্থির হলো কঙ্কাদের শত কথায়ও তা স্থির হতো না। এই ব্যস্ত পুরুষ শাসিত ঢাকাতে যাবে তো কোথায় যাবে কঙ্কারা? পার্ক, লেকের ধার, সিনেমা হল, রাস্তার মোড় কোথাও তরুনীদের কোন স্থান নেই। বাইরের আড্ডা, আলো - বাতাস সব পুরুষদের এক চেটিয়া দখলে। ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরতে দেরী হলে অজানা সব বিপদ কল্পনা করে মা যেভাবে বারান্দা আর ঘর করেন, মনে যতো ইচ্ছেই থাকুক আর বন্ধুদের আড্ডা যত ভালোই লাগুক, মায়ের সেই চিন্তিত মুখটি মনে হলে কঙ্কা অস্থির পায়ে বাড়ি চলে আসে। বাইরে যাবেই বা কোন চুলোয়, এ সমাজে কি মেয়েদের বাইরে যাওয়ার কোন স্থান বা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আছে? একবার ইয়ার ফাইন্যাল শেষে সব বন্ধু এবং বান্ধবীরা মিলে ঠিক করলো পরীক্ষার মানসিক চাপ যেহেতু শেষ আজ সারাদিন ওরা টিএসসি তে এলোমেলো ঘুরে, মজা করে সেলিব্রেট করবে। বাংলা একাডেমীর সামনের জায়াগাটাতে একজন বন্দুকয়ালা তখন বেলুন আর বন্দুক নিয়ে প্রায়ই বসে থাকতেন। হাঁটতে হাঁটতে ওরা সেখান দিয়ে যেতে গিয়েই হুজুগে সবাই মিলে লাগল তার কাছে নিশানা পরীক্ষা করতে। যখন কঙ্কা তার টিপ পরীক্ষা করছিলো হঠাৎ মেয়েলী প্রখর ঘ্রাণ শক্তির কারণে পাশের দিকে তাকিয়ে দেখল একজন মধ্য বয়স্ক লোক কঙ্কাদের দিকে কিংবা ঠিক সেই মুহুর্তে কঙ্কার দিকেই চোখে তীব্র এক ঘৃনা নিয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কঙ্কার হাত কেঁপে গেলো। কি ছিল সেই দৃষ্টিতে? কঙ্কা খুব বখাটে মেয়ে যে হঠাৎ আনন্দের কারণে বন্ধুদের সাথে নিশানা পরীক্ষা করছে, সেই বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন সমবয়সী ছেলেও আছে? এই ধরনের তরুন সমাজের কারণে দেশ রসাতলে যাচ্ছে? জানে না কঙ্কা কিন্তু অনুভব করতে পারে সেই রকমই একটা কিছু যেনো ছিল তার চোখে। ক্রিকেট জয়, নোবেল জয়, আনন্দ মিছিল সব কিছুতে পুরুষদের অধিকার। তবে মেয়েরা একেবারে বাদ না, জানালা, বারান্দা কিংবা ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে দেখতেতো পাচ্ছেই। এই কি কম স্বাধীনতা? সৌদি হলেতো এই আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হতে হতো। নিজের বাড়িতেই বা কিসের স্বাধীনতা? আনন্দে জোরে চিৎকার দেয়া যায় না, পাশের বাড়ি থেকে শুনবে, লক্ষী, ভালো মেয়েরা জোরে কথা বলে, হাটে না, চিৎকারতো দূর কি বাত।

সব প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যেও সীমা আর মিস্ত্রী প্রেমের দুর্বার বন্যায় ভাসতে লাগল। দুজনের ছবির আদান প্রদান হতে লাগল। বিভিন্ন পার্বনে যখন কঙ্কাদের বাড়িতে ছবি তোলা হয়, তখন সীমাও সাজগোজ দিয়ে এসে দাড়িয়ে লজ্জা লজ্জা মুখ করে গলা নামিয়ে বলে, আপা, আমারে একটা ছবি তুলে দিবেন, বাড়িতে লইয়া যামু। তখন কঙ্কারা সীমাকে ছবি তুলে দিতো, ওদেরওতো একটা সাধ আলহাদ আছে। সে ছবি প্রিন্ট হয়ে আসলে ওদেরগুলো ওদেরকে দিয়ে দেয়া হতো। বাড়িতে নিয়ে মা-ভাই-বোনদেরকে দেখাবে, গল্প করবে। সেসব ছবিতো ছিলোই সীমার কাছে, সীমা বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে ছবি ছুঁড়ে দিলো পাশের বাসার উদ্দেশ্য কিন্তু বিধি বাম। ছবি পড়ল কঙ্কাদের বাসার সীমানার মধ্যেই। আর পড়বিতো পড় একেবারে দারোয়ানের ঘাড়ে যাকে বলে। দারোয়ান সেই ছবি নিয়ে উপরে এসে কঙ্কার মাকে ছবির ইতিহাস বলে গেলো সাথে দারোয়ান আবার এই খবরও দিয়ে গেলো যে মিস্ত্রীর সাথে কথা বলে সে জেনেছে যে সীমা নাকি ওই মিস্ত্রীকে নিজেকে এই বাড়ির মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছে। কঙ্কার মাতো এই কথা শুনে রেগে কাই। এতোবড় সাহস। মা কড়া করে দারোয়ানকে বলে দিলেন মিস্ত্রীকে যেনো সীমার আসল পরিচয় জানিয়ে দেয়া হয় এবং সীমাকে কোন কারণে নীচে দেখলে যেনো সাথে সাথে মাকে এসে খবর দেয়া হয়, সীমার নীচে নামা নিষেধ। দারোয়ান এতে বেশ খুশী হলো, মাঝে মধ্যে সবার চোখ বাঁচিয়ে নীচে বা ছাদে সে সীমার সাথে ফষ্টিনষ্টি করত, সে জায়গায় ভাগ বসাবে অন্য কেউ একি সহ্য করা যায়? রান্নার বুয়া আবার সেই আগুনে ঘি ঢাললেন এই বলে যে বাড়িতে কেউ না থাকলে সীমা কর্ডলেস ফোন নিয়ে বারান্দায় হাটাহাটি করে। মিউজিক সিষ্টেমে গান বাজায়। আর যায় কোথায় কঙ্কার মা সীমাকে এই মারেতো সেই মারে। মনিবের কাছে ঝার খেয়ে সীমার সব রাগ যেয়ে পড়ল রান্নার বুয়ার উপরে। বুয়াকে বলল সীমা, তুইতো কালো পেত্নী, বুড়ি তোর সাথেতো কেউ প্রেম করে না, সেই হিংসায় তুই আমার সাথে এমন করিস। রান্নার বুয়াও ছেড়ে দেয়ার পাত্রী না, তিনি বললেন, আমিতো তোর মতো বেহায়া নির্লজ্জ মেয়ে না যে ঘুরে ঘুরে ব্যাটাদের সাথে প্রেম করে বেড়াবো। আমার নিজের আর বংশের একটা ইজ্জত আছে না। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, পর্দা করি, তোর মতো বেহায়াতো না যে চুল ছেড়ে ছেড়ে বারান্দায় যাই। সীমা তেড়ে গেলো আবার, হ হ ইজ্জত আমার জানা আছে, জামাইতো লাথথি দিয়েছে, এখন এই চেহারা আর শরীর নিয়ে অন্য কাউকে পাস না সেটা বল। তোর মাথায় চুল আছে যে ছাড়বি, ঘুরবি? দ্যাখাতো একটাকে দ্যাখা যে তোকে পছন্দ করেছে কিন্তু তুই করিস নাই। এবার সীমা আসল জায়গায় ঘা বসিয়ে দিয়েছে। গ্রাম্য বেশবাস করে সারাক্ষন মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকা ভাঙ্গা চেহারার বুয়ার দিকে শহরের রাজমিস্ত্রীরা কেউ যে আকর্ষিত হয়নি সেটাতো ঠিকই। রান্নার বুয়া বিবি সাহেবকে ডেকে কান্নাকাটি, তার মতো ইজ্জতদার মহিলাকে সীমার মতো চূড়ান্ত ফাজিল মেয়ে এমন সব কথা বলে অপমান করা, কিছুতেই সে আর এই বাড়িতে থাকবে না, এখনই যেনো পাওনা দেনা মিটিয়ে তাকে বিদায় দেয়া হয়, রান্নার জন্য অন্য লোক দেখা হোক। রান্নার বুয়া জানতো কোথায় হাত দিতে হবে। কঙ্কার মা প্রেশারের রুগী, তিনি আগুনে যেতে পারেন না আর কঙ্কারা সব ভাইবোন পড়ছে। এ সময়ে এই বাসায় তিনি অসম্ভব একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তাকে ছাড়া এ বাসার গতি নেই। একটা সব জানা রেডী লোক পাওয়াতো আর সহজ কথা নয় আজকালকার বাজারে। সন্ধ্যাবেলা একথা শুনে কঙ্কার মায়ের মাথায়তো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, তিনি সীমাকে ডেকে বুয়ার কাছে মাফ চাইতে বললেন কিন্তু জেদী সীমা মাথা গোঁজ করে দাড়িয়ে রইলো, মাফ চাইলো না। আর কঙ্কার মা নিজেকে সামলাতে পারলেন না, দিলেন ধরে দু চার ঘা সীমার পিঠে বসিয়ে। কঙ্কার ভাই এসে তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলালো, মা কে নিয়ে গেলো। মা এমনিতেই প্রেশারের রুগী, উত্তেজনা তার শরীরের জন্য মোটেই ভালো না। সীমাও গেলো কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে আর বুয়া গেলো বীর দর্পে বিজয়ী মুখ নিয়ে রান্না ঘরে।

এ ঘটনার কিছুদিন পর এক ছুটির দিনে বেশ ভোরে কঙ্কার ঘুম ভেঙে গেলো। সারা বাড়ির সবাই তখন ঘুমে বিভোর, ছুটির দিনের আয়েশী ঘুম। ক্লাশের পড়াশোনার চাপে আজকাল আর গল্পের বই পড়ার সময়ই পায় না কঙ্কা। ভাবল ঘুম যখন ভেঙ্গেই গেলো শুয়ে না থেকে যাই একটু বই পড়ি। যেই ভাবা সেই কাজ, উঠে কঙ্কা হাত মুখে ধুয়ে চায়ের মগ নিয়ে বই হাতে বসার ঘরে যাচ্ছিল। দরজা জানালা খোলা দেখে আর রান্না ঘরের টুকটাক মৃদু শব্দে কঙ্কা বুঝতে পারল মা একবার উঠে ওদেরকে ডেকে দিয়ে গিয়ে আবার শুয়েছে। খুব সন্তর্পনে কঙ্কা যাচ্ছিল যাতে কারো ঘুম না ভেঙ্গে যায়। বসার ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই হঠাৎ অকারণে বারান্দার দিকে চোখ গেলো তার। তার ই.এস.পি বলছিল কিছু একটা ঘটছে ওদিকে। এগিয়ে যেয়ে দেখতে পেলো রাজমিস্ত্রী মজনু হাতে পাইপ নিয়ে দুলে দুলে ছাদের উপর ডাই করে রাখা ইট ভিজাচ্ছে, এমন ভঙ্গিতে ইট ভিজাচ্ছে দেখে জীবন বীমার এ্যাড এর কথা মনে পড়ে গেলো কঙ্কার। জীবন বীমার এ্যাডে যেমন করে বুড়ো বয়সে হাতে পাইপ নিয়ে ঠোটে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ফুল গাছে পানি দিতে দেখায়, মুখে থাকে সিগার, অনেকটা সেই রকমই ইটে পানি দেয়ার ভাব, এই ভঙ্গী দেখে কঙ্কার সন্দেহ হলো, মনে হলো এই ভঙ্গী এমনি এমনি না, নিশ্চয় কাউকে ইম্প্রেস করার ব্যাপার এরমধ্যে আছে। কঙ্কা আস্তে করে দরজা আর ওয়ালের সংযোগ স্থলের যে ফাঁকটা আছে, সেদিক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখল সীমা রান্নাঘরের বারান্দার সাথে এই বারান্দার যে সন্ধিস্থল সেখানে বসে কি যেনো একটা বাটছে। মসলা বাটা যে একটা আর্ট সেটা সেদিন প্রথম অনুধাবন করলো কঙ্কা। দুই হাতে শিলটাকে আলতো করে ধরে নৃত্যের ভঙ্গীতে একবার সীমার হাত দুটো উপরে উঠছে আবার নীচে নামছে। মনে হচ্ছিল রোমান্টিক কোন গানের কোরিওগ্রাফী হচ্ছে ‘গাঙ্গে ঢেউ খেলিয়া যায়, ও কন্যা মাছ ধরিতে আয়’। হাতের সাথে সাথে সীমার পুরো শরীর ছন্দময় ভঙ্গীতে উঠানামা করছিল পাটার উপর। খুব রোমান্টিক দৃশ্য। এই লীলাময় ভঙ্গিতে মসলা পিষা হচ্ছিল কিনা কে জানে, নাকি শিল শুধু পাটার বুক ছুঁয়ে মধুময় ভঙ্গীতে আসা যাওয়াই করছিল। কঙ্কা যেমন সন্তর্পনভাবে গিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই চলে এলো কেউ টের পায়নি। এই সাত সকালে কারো প্রেমময় অনুভূতি নষ্ট করতে তার কিছুতেই ইচ্ছে করলো না। কিন্তু প্রেমিক যুগল মজা টের পেলো আরো আধ ঘন্টা পরে। কঙ্কা ভেবেছিলো মা আবার শুয়ে পড়েছে কিন্তু না, মা মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে গেলো চেক করতে কি কি কতোদূর এগিয়েছে। আজকে ছুটির দিনে সবাই একসাথে আরামসে বসে বাসায় নাস্তা খাবে। তাই নাস্তার বিশেষ আয়োজন। রান্নার বুয়া যখন বললেন ছোলা এখনও বাটা হয়নি, হালুয়া তাই বসাতে পারেনি, মা গেলেন সীমার বাটাবাটি চেক করতে। এতোক্ষনেও এটুকু ডাল বাটা কি করে শেষ না হলো। মা যেয়ে দেখলেন সীমা সেই লীলায়িত ভঙ্গীতে শিল-পাটা নিয়ে খেলা করে যাচ্ছে। দূরে কোথাও রেডিওতে কোন সিনেমার প্রেমের গান বাজছে। রাগে মা জ্বলে উঠলেন, মায়ের চিৎকারে সাত সকালে সব কাক উড়ে যাওয়ার অবস্থা। একেতো ছুটির দিন পাড়াময় সব ঘুম নিঝুম শান্ত কোন, শব্দ নেই তারমধ্যে সাত সকালে মায়ের এই চিল চিৎকার। কঙ্কার ভাইয়া বিছানা ছেড়ে দৌঁড়ে উঠে গেলেন মাকে নিয়ে আসতে, মায়ের এক কথা ওকে আমি রান্না ঘরের বারান্দায় ডাল বাটতে দিয়ে এসেছি ও কোন সাহসে শিল-পাটা নিয়ে এই বারান্দায় এসে বসল। ভাইয়া মাকে শান্ত করার জন্য অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি দিয়ে বোঝাতে লাগল। কদিন পরেই ভাইয়া পাশ করে বেরোবে আর চাকরী মোটামুটি রেডি। সেজন্য ধুমসে কঙ্কাদের আত্মীয় স্বজন ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখছে। প্রায়ই আশে পাশের বাসার আন্টিরা এসে কঙ্কার মাকে খবর দিয়ে যায় যে আপনার ছেলের খোঁজ নিতে আজ একজন এসেছিলেন। ভাইয়া বুঝাতে লাগল তুমি যদি এভাবে চিৎকার করো মা তাহলে কি আমার জীবনেও বিয়ে হবে? পাড়ার লোক যখন বলবে ছেলের মা এমন খানে দজ্জাল তখন কোন বাবা প্রাণে ধরে মেয়েকে আমার কাছে দিবে? তুমি তোমার ছেলের ভবিষ্যতটা একবার ভাবো মা। ইত্যাদি নানান অকাট্য যুক্তির পর আস্তে আস্তে মা একটু শান্ত হলেন।

কিন্তু সীমা আর সেই রোমিও এই অপমান সহ্য করতে পারল না। পরদিন বিকেলে সীমা ছাদে কাপড় তুলতে গেছে, কাপড় নিয়ে সীমা আর আসছেই না। এমনিতে সীমা ছাদে গেলে যথেষ্ঠ দেরী করে, ছাদে যেয়ে প্রথমে এদিকে ওদিকে উঁকি -ঝুকি দিবে ঘুরবে, গান গাইবে। তা নিয়ে রোজ বকা ঝকাও খায় কিন্তু আজতো ঘন্টা পার হয়ে গেলো সীমা আসছে না। প্রথমে রান্নার বুয়াকে পাঠানো হলো সীমাকে ছাদ থেকে ডেকে আনতে আর এদিকে কঙ্কার মাতো বাসায় বসে গরগর করছিলই আজকে ও নামুক নীচে আমার একদিন কি ওর একদিন। বিকেলের সব কাজ পড়ে আছে ওদিকে মহারানীর দেখা নেই। কিন্তু বুয়া এসে খবর দিল ছাদ তন্ন তন্ন করে দেখে এসেছে কোথাও সীমা নেই। তখন দারোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হলো সীমা কি নীচে গেছে, দারোয়ান সেটা বলতে পারল না। তাছাড়া দারোয়ান আছরের নামাজ আদায় করতে কিছুক্ষণের জন্য মসজিদে গিয়েছিল, মেইন গেট তখন অরক্ষিত ছিল। দারোয়ানকে বলা হলো নীচে খুঁজে দেখতে। কিন্তু তখনও কারো মাথায় সীমা পালিয়ে যেতে পারে এ সম্ভাবনার কথা মনে হয় নি। এতো বড়ো দুঃসাহস সে করবে এটা তাদের সবার কল্পনার অতীত ছিলো। চিনে না জানে না কদিনের দেখায় কারো হাত ধরে চলে যাওয়ার মতো অসম্ভব ব্যাপার কে ভাবতে পারে? দারোয়ান নীচে দেখে এসে বলল, সীমা সেখানেও নেই। মা তখন বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটগুলোতে খুঁজে আসতে বললেন, অন্য ফ্লোরের মেয়েদের সাথেও সীমার বেশ সখ্যতা আছে যদি সেখানেও যেয়ে থাকে। নেই নেই নেই কোথাও নেই। কি করা এখন। বাসার সবার সব কাজ মাথায় উঠলো, সবাই মিলে সীমাকে খোঁজা চলল। এরমধ্যে রান্না ঘরের বুয়া জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল যে তার ঈদে পাওয়া নতুন শাড়ি সহ আরো দুখানা ভালো শাড়ি আর সেগুলোর সাথের ম্যাচিং ব্লাউজ, পেটিকোট আর তার নুতন স্যান্ডেল জোড়াও নেই। সীমা নিজের ভালো দুটো জামা নেয়ার সাথে সাথে বুয়ারগুলোও নিয়ে গেছে। পুরনো কি আধ পুরনো কিছু সাথে নিয়ে যায়নি। এ খবর পাওয়ার পর মোটামুটি বোঝা গেলো কি হয়েছে। এরমধ্যেই সন্ধ্যা নামলো, ভাইয়া বাড়ি ফিরলো সব শুনে গেলো পাশের বাসায় চেক করতে আসলেই কি সেই রাজমিস্ত্রীর সাথে গিয়েছে নাকি অন্য কিছু। সেই রাজমিস্ত্রির কথা সেখানে কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না তবে এটা ঠিক বিকাল থেকে তার দেখাও নেই। রাত কাটলো উদ্বেগ আর উত্তেজনা আর টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে। বাবা কিছুটা মায়ের উপর বিরক্ত মা কেনো আগে থেকেই টের পেলেন না। কিন্তু কতোদিন ধরেই মা বাবার সাথে বলছিলেন কোনদিন কোন অঘটন ঘটে যাবে, তার আগেই আমি ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে দায়িত্বমুক্ত হতে চাই। সেজন্য কঙ্কার নানুকে ফোন করে কঙ্কার মা আর একটা লোক যোগাড় করতেও বলে দিয়েছিলেন। হয়তো সেই থেকেই সীমা তক্কে তক্কে ছিলো। টেলিফোনেতো বড় রাখঢাক করে কথা বলা হতো না আর মা রেগে গেলে সীমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন বলে শাসাতেনও বটে।

পরদিন ভোর সকালেই কঙ্কার বড় মামা কঙ্কাদের বাড়ি এলেন। ঠিক হলো ভবিষ্যতের দায় এড়াতে পুলিশে খবর দিয়ে রাখাই ভালো যদিও চব্বিশ ঘন্টা না পার হলে পুলিশ মিসিং পার্সন নথিভুক্ত করে না। কঙ্কাদেরকে বলা হলো সীমার একটা ছবি খুজে রাখতে, থানায় যাওয়ার সময় লাগবে। আর সীমার বাবা মাকে বাড়ি যেয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আস্তে ধীরে খবর দেয়াটাই ভালো হবে এই ডিসিশন নেয়া হলো। ডিসিশন নিতে পেরে বাড়ির বড়রা একটু হালকা হলেন, বাড়ির গুমোট একটু কাটলো। জীবন যাত্রা স্বাভাবিক হতে লাগল। দুপুরে সবাই যখন একটু রিলাক্স খেতে বসেছে তখন ঝনঝন শব্দে ফোন বেজে উঠল। ফোন মাইই ধরলেন। আজকাল রাস্তার মোড়ে মোড়ে পি,সি,ও হওয়াতে ফোন আর কোন বড় ব্যাপার না। সীমা ফোন করেছে, ফোনে মাকে বলছে , আমারে মাফ সাফ কইরা দিয়েন, আমি ভালোই আছি, আমার স্বামীর সাথে, আমার জন্য খাস দিলে দোওয়া কইরেন আফনে। সামনে পেলে মা হয়তো সীমাকে কাঁচাই খেয়ে ফেলতো, বহু কষ্টে মা নিজেকে সংবরন করে সীমাকে জিজ্ঞেস করলেন এখন কোথা থেকে ফোন করেছিস? সীমা বলল এখন আমরা সিলট আছি, সত্যি বলল না মিথ্যা কে জানে। সীমা আবার বলল আপনি এট্টু ফোন কইরা আমার আব্বা - আম্মারে এই খবরটা দিয়েন আর খালুজানরেও কইয়েন আমার জন্য খাস কইরা দোয়া করতে। মা শুধু বলতে যাচ্ছিলেন তুই এভাবে না বলে চলে গেলি কিন্তু বেশী কিছু বলার আগেই সীমা লম্বা বিনীত ছালাম দিয়ে ফোন ডিসকানেক্ট করে দিল। ফোনের পরে পুলিশে যাওয়ার পরিকল্পনা আপাতত বাদ দেয়া হলো। আস্তে আস্তে যত দিন যাচ্ছিল আবিস্কার হচ্ছিল সীমা পালিয়ে যাওয়ার জন্য বহু দিন ধরেই তৈরী হয়েছিল। রান্নাঘরের শোকেস থেকে সীমা কিছু বাসনপত্র, গ্লাস সরিয়ে রেখেছিল, বিছানার চাদর, টেবিলের কাপড় এধরনের অনেক কিছুই নিয়ে পোটলা করে ছাদের কোথাও বা নীচে গ্যারেজের পাশে এদিক সেদিক লুকিয়ে রেখেছিল। এতো বড় সংসার থেকে কেউ চারটে কাচের বাসন বা গ্লাস কিংবা দুটো বিছানার চাদর সরিয়ে রাখলে খুব সহসা সেটা ধরার উপায়তো কিছু নেই। আর এই সমস্ত নিদারুন আর্কষণীয় তথ্যগুলো আবিস্কার করছিলেন বুয়া আর দারোয়ান। কিন্তু যাবার সময় হয়তো বেচারী সীমা তাড়াহুড়ায় সব জিনিস নিয়ে যেতে পারেনি। নতুন সংসারের স্বপ্ন ছিল তার চোখে, যেমন প্রত্যেক বাঙ্গালী মেয়েরই থাকে, সেই স্বপ্নকে সার্থক রুপ দিতেই পাখির মতো একটু একটু খড়কুটো একত্র করছিল। যাকে এখন চৌর্যবৃত্তির অপরাধের নামে আকা হচ্ছে।

এই নিষ্ঠুর শহরে প্রেম খুঁজে পাওয়াতো আর সোজা কথা নয়। কেউ যদি খুঁজেও পায় তার প্রেমের রাস্তায় আসে হাজারো বাধা। কারো প্রেম দেখার বা বোঝার কারো সময় বা আগ্রহ নেই। ফেলো কড়ি মাখো তেল এখানে হলো সেই কথা। কঠিন শহরের কঠিন প্রেম। আর তারচেয়েও কঠিন হয় তার পরিনতি। যদি রাজমিস্ত্রীকে পাড়ার লোক ধরতে পারত তাহলে তার কি হতো ভাবা যায় না আর সীমার পরিনতির কথাতো বাদই থাকলো। খবর শোনার পর সীমার বাবা মা কঙ্কাদের বাড়ি এসে অনেক আস্ফালন করলেন, মেয়েকে পেলে টুকরো টুকরো করে কেঁটে পানিতে ভাসিয়ে দিবেন, কি কুক্ষনে এমন কলঙ্কিনী মেয়ে জন্ম দিয়েছিলেন, আগে জানলে জন্মের মুহূর্তেই মেয়ের মুখে লবন ঢেলে মেরে ফেলতেন, মেয়ের সাথে চির জীবনের সম্পর্ক ছিন্ন ইত্যাদি ইত্যাদি। আস্ফালন শেষ হলে সীমার মা ডুঁকরে ডুঁকরে কেদে উঠলেন সন্তান বাৎসল্যের কারণে। সীমার বাবা মুখ গুজে, মাথা নীচু করে বসে রইলেন সারাটা সময়। কারো চোখের দিকে তাকালেন না, কারো সাথে কোন বাক্য বিনিময়ও করলেন না। হয়তো এমনটাই হবে সীমা ধারণা করেছিল সেজন্যই কি সীমা এই কঠিন শহর ত্যাগ করে অনেক দূরে চলে গেলো তার প্রেমের জীবনের সন্ধানে? কেউ তার প্রেমের কদর করতে পারবে না সেই জ্ঞান সীমার মধ্যেও হয়তো ছিল, তাই সবার থেকে দূরে নিজের জীবন খুঁজতে গেলো সে। হয়তো সেখানে প্রেমের অপরাধে তাকে দিন রাতের গঞ্জনা, অভিশাপ সহ্য করতে হবে না, সহ্য করতে হবে না মাস্তান বাহিনী কিংবা আত্মীয় স্বজনের হুমকি ধমকি। সারাদিন কাজের পরে কারো প্রেমময় চোখের দিকে তাকিয়ে সে ভুলে যাবে পরিশ্রমের ক্লান্তি। কারো সমুদ্রসম ভালোবাসা সীমার সারা জীবনের পাওয়া না পাওয়ার, দুঃখ বঞ্চনার হিসাবকে ভুলিয়ে অন্যকোন সুখের আঘোষের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। ভুলে যাবে অনেক কিছু না পাওয়া, দুঃখ, অপমান, বঞ্চনার ইতিহাস। বেরসিক ঢাকা আর যাই বোঝে না বোঝে কিন্তু মরার প্রেম বোঝে না।

তানবীরা হোসেন তালুকদার
০৭।০৬।০৭

Monday 17 January 2011

অহনার অজানা যাত্রা (এগারো)

সাইকেল চালানো শেখার পর থেকে অহনা সাইকেল নিয়ে বেশ ঘুরে বেড়াতো শহরের মধ্যে। সাইক্লিং সে খুব এনজয় করতো। আবহাওয়া অনুকূলে হলেই গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে, কান গলা মাফলারে প্যাঁচিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোত। এতে শরীর মন দুটোই চাঙ্গা থাকতো। অর্নও তাগাদা দিতো, সারাদিন বাড়ি বসে না থেকে বেরোলেই পারো। পার্কে হাটো কিংবা সাইক্লিং করো। মাঝে মাঝে দেশি কিছু খেতে ইচ্ছে করলে সিটির একমাত্র এশিয়ান শপ পাকিস্তানি দোকানে যেয়ে কিনে নিয়ে আসতো। বেশি বাজার হলে, বিশ কেজি চালের বস্তা, ডাল ইত্যাদি হলে গাড়িতে নিতে হয়, অর্নর সাথে যেতে হতো। ছোটখাটো আইটেম সে নিজেই নিয়ে আসতো। একদিন চমৎকার আবহাওয়া দেখে অহনা ভাবলো যাই একটু করলা, ভিন্ডি, লাউ সব্জি নিয়ে আসি। সাথে একটু ব্যায়ামও হয়ে যাবে। এসব দোকানে অনেকেই আড্ডা দেয়। অবৈধভাবে বসবাসকারীদের কাজের, কাগজের, টাকা পয়সার লেনদেনের মীটিং পয়েন্ট থাকে সাধারনতঃ এ দোকান ও রেষ্টুরেন্টগুলো। এখানেই দেখা যায় সাধারণত বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে কালো কাজের সন্ধান, বিদেশি মেয়েদেরকে কন্ট্রাক্টে বিয়ে করানোর জন্য পাত্রী যোগাড় আর তার জন্য পুলিশের চোখকে এবং আইনকে ফাঁকি দেয়ার একশ একটি উপায় আলোচনা ও ব্যাখা করা হয়। এই বাবদ টাকা পয়সার লেনদেন এবং মাঝে সাঝে মতান্তরে মারামারিও হয়ে থাকে।

মুখ চেনা পরিচিত কেউ থাকলে অহনা একটু কুন্ঠিত থাকে, তার সাজ পোষাক আর এ্যটিচ্যুড নিয়ে। কথায় কথায় লজ্জা পেয়ে লজ্জাবতী লতার মতো মিইয়ে যাওয়া স্বভাবতো তার নয়। এটাও একটা নেতিবাচক দিক বাঙ্গালী মেয়ের। এমনিতে এসব দোকানে সাধারণতঃ বাংলাদেশি, পাকিস্তানী মেয়েরা আসে না। ভারতীয়রা আসেন, তারা এসব তোয়াক্কা করেন না। আর ভারতীয়রা যে স্ট্যাটাস নিয়ে থাকেন তাতে পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশিরা তাদের ঘাটাতে সাহসও করেন না। হয়তো ভাবেন, এগুলোতো এমনিতেই ঐ দুনিয়ায় দোজখে পুড়বে, এগুলোকে পৃথিবীতে ঘাটাঘাটির দরকার কি? আর বাংলাদেশি, পাকিস্তানি কেউ আসলেও তারা থাকেন আকন্ঠ মোড়া ঘোমটা আর পর্দায়, স্বামীর পশ্চাতে। অহনার মতো জীন্স স্কার্ট পরা, একা একা ঘোরা মুসলমান সমাজের কলঙ্ক খুব কমই আছে এই শহরে। অনেক সময় তাকে একা দেখলে সর্বদা টুপি পরিহিত চাপ দাড়ি সম্বলিত ইসলামিক মাইন্ডেড পাকিস্তানি শপ ওনার তার চেহারা কুঁচকে রাখতেন। অহনা দেখলো না পরিচিত কেউ নেই আজকে। একদিকে কটা অল্পবয়েসী উপমহাদেশীয় ছেলে গুলতানি করছে। কোন দেশীয় সেটা ঠাহর করা মুশকিল। আফগানি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, বাঙ্গালী সবাই হিন্দী বলে, ভাঙ্গা কিংবা চোস্ত, যে যেমন পারে। তবে নেপালী, শ্রীলঙ্কান, আর বাংলাদেশিদের গায়ের রঙ সাধারণত ওদের চেয়ে বেশি গাঢ়ো হয়। অপরিচিত কিছু লোকজন কেনাকাটা করছেন। তেমন ভীড় নেই দোকানে কাজের দিন বলে হয়তো। এখানে দোকান পাটে ভীড় হয় ছুটির দিনে কিংবা অফিস আওয়ারের পরে।

যাদের বাজার হয়ে গেছে তারা দোকানের সামনে তাদের থামিয়ে রাখা গাড়িতে জিনিসপত্র তুলছেন। অহনা তার বাজার সাইকেলের ব্যাগে ভরছে। একজন বেশ কেতাদূরস্ত পোষাক পরা মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক বাজার করতে ও জিনিসপত্র গাড়িতে তুলতে তাকে লক্ষ্য করছিলেন হয়তো। হঠাৎ তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া? অহনা একটু অবাক হয়ে পরিস্কার গলায় উত্তর দিলো, নো, আই এ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ। ভদ্রলোক উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো, আপনি বাঙালী? অহনাও খুব খুশি হলো শুদ্ধ বাংলা শুনে। তারপর কথা হলো, তারা কিছুদিন ধরে এই শহরে আছেন, ফিলিপস নেদারল্যান্ডসে কাজ করেন। ভদ্রলোক তাদের কথা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় আছে কি করে ইত্যাদি। তারপর তার কার্ড অহনার হাতে দিয়ে খুব করে অনুরোধ করলেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। অহনা খুবই আনন্দিত হলো, আবার পূর্বের বাংলাদেশিদের সাথে মেশার অভিজ্ঞতা থেকে কুন্ঠিত, ভারতীয়দের সাথে মেশার কোন পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকায় কৌতূহলী। সে বাসায় এসে অর্নকে জানালো ফোনে এই ঘটনা। অর্ন শুনলো চুপচাপ, বললো ঠিকাছে ফোন করবো, যোগাযোগ করবো। তারপর ফোন করি করি করে আর করা হয়ে ওঠেনি, তারা ভুলে গেলো।

তার কিছুদিন পর একদিন শনিবারে অর্ন আর অহনা সিটি সেন্টারে বাজার করছিলো টুকটাক। ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই ভদ্রলোক আর তার পরিবারের সাথে দেখা হয়ে গেলো। স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে তিনিও এসেছেন বাজার করতে ছুটির দিনে। অহনা চিনতে পারেনি, ভদ্রলোকই চিনতে পারলেন প্রথমে। তিনি কলকলিয়ে ওঠলেন, তুমি কেনো ফোন করলে না? সরাসরি তুমিতে। সেদিন দুই পরিবারের সবার সাথে সবার সাথে আলাপ হলো। আলাপ জমতেই তারা পাশে ম্যাকে বসে কফি খেলেন একসাথে। বাসার ঠিকানা বদলাবদলি করে, পরবর্তী দেখার দিন ঠিক করে বিদায় নিলেন। অহনারা এক দুপুরে সেজেগুঁজে নিমন্ত্রন খেতে গেলো তাদের বাড়ি। তারা বেশ আন্তরিকভাবে রান্না বান্না করে প্রস্তূত ছিলেন এবং দুপুরের নিমন্ত্রন আড্ডায় আড্ডায় সন্ধ্যে পর্যন্ত গড়াল। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে অহনার জন্যে বিদেশ বাড়িতে অভূতপূর্ব এক লাইব্রেরীর খোঁজ পাওয়া গেলো। তাদের বিরাট কালেকশন ছিলো সিনেমা, বই, গানের। সত্যজিত রায়ের ধরতে গেলে পুরো কালেকশন, মৃনাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, হৃষিকেশ মূখার্জী। মহাশ্বেতা দেবী,আশাপূর্না দেবী, রবীন্দ্রনাথ, নীরেন্দ্রনাথ, সুনীল, বুদ্ধদেব, সমরেশের বইয়ের ভান্ডার আবার দাদা দিদি দুজনেই গান করতেন। সনু নিগম থেকে চিন্ময়, আদনান সামী থেকে সুচিত্রা মিত্রের সিডি আর ক্যাসেটের সম্ভারে তাদের বাড়ি পরিপূর্ন। তাদের বাড়িতে নিয়মিত কোলকাতা থেকে সানন্দা আসতো। দিদি আর সে মিলে প্রায়ই সানন্দার রেসিপি ট্রাই করতো।

ভারতীয় বাঙ্গালীদের জীবন যাত্রার মান এতো উন্নত ঢাকার থেকে যে সেটা চোখে পড়ার মতো চোখে পড়ে। প্রত্যেকটি খাবার দাবার, প্লেট গ্লাস, চেয়ার কুশন, বিছানা, জামা কাপড় সবকিছুতেই শিল্প। সাধারণ একটা খাবারকেও পরিবেশনের জন্যে এভাবে ডেকোরেশন করবে যে খাওয়া ছাড়াই খাওয়া হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, ঢাকার লোকজন মুম্বাইয়ের সিনেমা দেখে শাড়ি, কামিজ, জামা কাপড় কিনে কিন্তু কোলকাতার লোকেরা মুম্বাই ট্রেন্ড ফলো করেন না। তারা তাদের বিয়েতে তাদের ট্র্যাডিশনাল শাড়ি কাপড় ব্যবহার করেন। জড়ি, চুমকি জাতীয় কাপড় সাধারণত ক্যালকেশিয়ানকে ব্যবহার করতে দেখা যায় না। রাজস্থানী, পাঞ্জাবী, গুজরাটিরা করছেন হয়তো। অহনা গোগ্রাসে তাদের বাড়িতে গেলে ঘর সাজানো, ডিনার টেবল সাজানো, খাবার সাজানো, ড্রিঙ্ক সাজানোর পদ্ধতি সব গিলে গিলে শিখতে লাগলো। বাড়ির পর এ প্রথম সে কোথাও কি করে থাকতে হয় বা বাঁচতে হয় যাকে কখনো কখনো সুশীল ভাষায় আর্ট অফ লিভিং বলে শিখতে লাগলো। এবং নিজের মতো চেষ্টাও করতে লাগলো। কি করে বিভিন্ন রঙের সব্জির কম্বিনেশন করে সব্জি নির্বাচন করলে এবং এগুলোকে এক মাপে কাটতে পারলে মিক্সড ভেজ করার পর সুন্দর দেখায় সেটা সে দিদির কাছে প্রথমে লক্ষ্য করলো এবং নিজের মগজে ঢোকালো।

কোলকাতার লোকজনদের নিয়ে তার নিজের দেশে ও দেশের লোকজনদের কাছে অনেক ধরনের নেতিবাচক গল্প শুনেছিলো সে। কিন্তু সে সবের কিছুই অহনা তাদের মধ্যে দেখতে পেলো না। দু পরিবারে বেশ আন্তরিকতা গড়ে ওঠলো। এতোদিনে প্রবাসে মন খুলে গল্প করার মতো কাউকে পাওয়া গেলো। দিদি দিনের বেলায় শপিং এ গেলে কিংবা কোথাও এমনি ঘুরতে গেলে প্রায়ই ফোন করে অহনাকে সাথে নিয়ে যান। দাদা দিদি এর আগে সিঙ্গাপুর আর কানাডা ছিলেন, এখন হল্যান্ডে আছেন। এ সময়ে তাদের ইচ্ছে যতোটা সম্ভব ইউরোপ ঘুরে নেয়া, আবার কোথায় বদলি হয়ে যান। বাড়িতে অহনা মেয়ের মতো ছিলো, গৃহিনী হওয়ার পর মা শাশুড়ি কেউই সাথে নেই বলে, সে অনেক কিছুই জানতো না, শিখেনি। এই প্রথম কারো কাছ থেকে সে সত্যিকারের শিক্ষা পেলো কি করে সংসারকে সামলাতে হয়। এখানে জিনিসপত্র শেষ হয়ে গেলেই, কাউকে দোকানে পাঠানো যায় না, যা চিনি নিয়ে আয় কিংবা কাঁচামরিচ। কি করে বাজারের লিষ্ট রাখতে হয়, বেশি করে কিনে ফাষ্ট ইন ফাষ্ট আউট পদ্ধতিতে কাঁচামালের এক্সপায়ার ডেট দেখে স্টোর করতে হয় কিংবা সেল থাকলে নষ্ট হবে না এমন জিনিস সস্তায় অনেক কিনে রেখে সাশ্রয় করা যায় ইত্যাদি অনেক কিছু দিদি অনেকটা হাতে কলমে শিখিয়ে দিলেন।

দিদিদের ছেলে অহনার থেকে সামান্য বড়। তারা অনেকটা সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন তাকে। অহনা পারে না বা পারবে না বলে অনেক কিছু নিয়ে নার্ভাস থাকতো। দিদি এবং দাদা দুজনেই সমানে তাকে সাহস দিতেন। কমাস আগে দেশ ছেড়ে এসে সে এতো কিছু পারছে একা একা সেটাই অনেক তাদের চোখে। কিংবা তারা অনুপ্রেরনা দেয়ার জন্যেই বারবার বলতে লাগলেন। অহনার মধ্যে যা কিছু ভালো বা ইতিবাচক ছিল সেটাকে সামনে আনতেন বার বার করে। এতে অহনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্ম নিতে লাগলো আস্তে আস্তে না আমি পারবো। হয়তো সত্যজিতের পাঁচটা সিনেমার ক্যাসেট আনলো অহনা সে বাড়ি থেকে, সেগুলো দেখার পর, সেই সিনেমা নিয়ে, সিনেমার সমসাময়িক ঘটনা পারিপ্বার্শিকতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতো। শেখা, জানা, একে অপরকে সম্মান তিনটে জিনিস একই গতিতে চলতে লাগলো। দিদিদের কাছ থেকে সে বেনেলুক্স বাঙালী সমিতি প্রবাসীর খোঁজ পেলো। দিদিরা ধরলেন সামনের দুর্গা পূজার অনুষ্ঠানে অহনা অর্নকে যেতেই হবে। খুব ভালো অনুষ্ঠান হয় তাছাড়া এতো লোক আসে বিভিন্ন শহর থেকে, অনেকের সাথে আলাপ হবে। এভাবে এক জায়গায় মুখ গুঁজে পরে থাকলে চলবে কেনো? অহনা অত্যান্ত আনন্দিত হলো শারদীয়া সম্মেলনে যাওয়ার খোঁজ পেয়ে। সে দিনরাত অনুষ্ঠানের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

তানবীরা

১৭.০১.২০১১

ডিসক্লেমারঃ এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত কারো সাথে মিলে যাওয়া নিতান্তই দুর্ঘটনা।

Thursday 13 January 2011

অহনার অজানা যাত্রা (দশ)

অহনা রাগ দেখিয়ে ঘুমুতে গেলেও অর্ন হার মানতে রাজি ছিলো না। সে তার ভুল ঠিক করতে বদ্ধপরিকর হয়ে গেলো। হয়তো অর্নের সিক্সথ সেন্স কাজ করছিলো যে এই ঝাল এখানেই থেমে থাকবে না, অন্য অনেক জায়গায় গড়াবে। সারারাত সে অনেক ভাবে অহনাকে বুঝিয়ে মানিয়ে ফেললো। প্রায়ই দেখা যেতো কাল বৈশাখীর মতো ঝড় আসতো সংসারে। কথা নেই বার্তা নেই কোথা থেকে অনেক কালো মেঘ আর জোর দমকা হাওয়া, মনে হতো এই বুঝি সব ওড়ে গেলো। আবার আধ ঘন্টা কিংবা এক ঘন্টা টানা বর্ষন কিংবা ঝড়ের পর, চারধার সব ধোঁয়া পরিস্কার, নিরিবিলি ঝকঝকে রোঁদ। মাঝে মাঝে খটকা লাগতো আসলেই কি ঝড় হয়েছিল। প্রায় দেখা যেতো ঝড় বৃষ্টির পর স্নিগ্ধ রোদেলা পরিবেশে দুজন বেশ হাসিমুখে, পাশাপাশি শুয়ে নানান অর্থহীন গল্প করতে করতে বেশ আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক সময় গল্প করতে করতে রাত অর্ধেক পার হয়ে যেতো। পরদিন অফিস কিন্তু তারপরো বাঁধ না মানা কথার তোড়ে দুজনেই ভেসে যেতো। ঝড় আর রোদের মিশেলে কাটছিলো জীবন।

পরদিন অর্ন অফিস যাওয়ার সময় বারবার অহনাকে তাগাদা দিয়ে গেলো কিছু পছন্দ করে রাখতে সিটি সেন্টারে যেতে। অহনা খুব দ্বিধার সাথে জানতে চাইলো কতো বাজেট। অর্ন হেসে বললো কোন বাজেট নেই, এনি থিং ফর ইউ। তবুও অহনার দ্বিধা যায় না। এখানে এসে টাকা পয়সার ঝামেলার ব্যাপারটা সে ঠিক বুঝতে পারে না। অনেক সময় দেখা যায় প্রতিটি সেন্টের হিসেব অর্নকে করতে হচ্ছে। গাড়ি পার্কিং থেকে একটা কোকের জন্যেও। দু ঘন্টা গাড়ি পার্ক করলে হয়তো পাঁচ ইউরো দিতে হবে। অহনার কাছে ওটা পাঁচ টাকা। কিন্তু অর্ন ভাবছে পাঁচ ইন্টু নব্বই টাকা। শুধু অর্ন না সমস্ত সবাইকেই তাই করতে দেখে কম বেশি। তাছাড়া সংসারে শুধু সে আর অর্ন নয়, বাংলাদেশে অর্নের বাবা – মা পরিবার আছেন। অন্যান্য ছেলেদের মতো তারও দ্বায়িত্ব আছে তাদের প্রতি। নতুন সংসার, বউ আর বাবা মায়ের দ্বায়িত্ব নিয়ে অর্ন মাঝে মাঝে রীতিমতো হিমশিম খায় এটা তার নিজের চোখের দেখা।

এসব কারনে প্রায় স্বল্প পরিচয়ে অর্নের সাথে সংসার করতে এসে অহনা টাকা পয়সার দ্বিধাটা এখনো কাটিয়ে ওঠতে পারেনি। অর্নের কাছে কিছু চেয়ে নিতে কিংবা চাইতে তার খুবই সঙ্কোচ হয়। কোনটা বেশি চাওয়া হয়ে যাবে, অর্ন হয়তো মনে মনে তাহলে অহনাকে অন্যরকম ভাববে সেগুলো নিয়ে সে কুঁকড়ে থাকতো কিছুটা। আসলে দেশেতো তাকে চেয়ে চেয়ে তেমন কিছু পেতে হতো না। চাওয়া ছাড়াই অনেক কিছু পেতো। আর নিজের বাড়িতে কিছু চাইতেও তার তেমন সঙ্কোচ হতো না। টাকা পয়সার এতো কঠিন হিসাব নিকাশ তার কাছে অচেনা। বরং বাবা মায়ের কাছে তার বায়নার শেষ ছিলো না। একটা হাতে না পেতেই আর একটা শুরু হতো। বিদেশে আসা মানেই অহনার ধারনা ছিলো বেশুমার টাকা পয়সা খরচ, দামি ব্র্যান্ডেড জিনিসপত্র। অন্তত ইংরেজি সিনেমা দেখে তার তাই ধারনা হয়েছিলো। তখনো পর্যন্ত সে সিনেমা দেখেই জীবন সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতো। কিন্তু এটাতো হলো উলটা, গ্যাড়াকল। সিনেমা জাতীয় কিছুই নেই। বরং বজ্রকঠিন নিয়ম কানুন। পার্কিং এর বেশ সমস্যা সিটিতে। কোথাও গাড়ি পার্ক করতে হলে আধ ঘন্টা ঘুরতে হয় নইলে পুলিশ আর টিকিট। সিনেমায় সে কখনোই এসব দেখেনি। সেখানেতো সে দেখেছে যেখানে ইচ্ছে গাড়ি থামালেই হলো। এর থেকেতো বাংলাদেশই ভালো ছিলো।

সিটিতে যেয়ে সে বেশ কিছু দোকান পাট ঘুরে মোটামুটি একটা কিছু পছন্দ করে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরতেই আবার স্বামীর ফোন, গিফট পছন্দ করা হয়েছে কি না জানতে চেয়ে। সে জানালো করে এসেছে। তারপর আস্তে সুস্থে সে রেডি হয়ে অর্নের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। অর্ন সুন্দর দেখে বাইশটা বিরাট গোলাপ নিয়ে এলো তারজন্যে। তারপর দুজনে একসাথে আবার সিটিতে গেলো। অহনা পছন্দ করেছিলো সাদা পাথরের একটা দুল, পঞ্চাশ ইউরো দামের, তাই দেখে অর্ন বেশ হাসলো। সে বুঝতে পেরেছিলো হয়তো এর পিছনের কারন। তারপর বললো, আচ্ছা চলো আর একটা দোকানে যাই, আরো একটু দেখি। তারপর দুজনে গেলো বাইয়েনক্রোফে। সেখানে শুধু দামি ব্র্যান্ডের জিনিস বিক্রি হয়। অনেক দেখে টেখে অর্ন নিজেই অহনাকে মোনেটের গলার আর কানের একটা সেট কিনে দিলো। অহনার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম দাম দেখে। সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, কিন্তু বুঝতে পারছিলো আজ অর্ন প্রস্তূত হয়েই তাকে নিয়ে শপিং এ এসেছে। এমনকি তারা যখন বিল পরিশোধ করতে কাউন্টারে গেলো তখন সেলস ও্যমান ভদ্রমহিলা তাদেরকে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, তারা কি ভারত থেকে বেড়াতে আসা ট্যুরিষ্ট কি না, যারা এতো দামি কিছু কিনছেন।

উপহার পেয়ে অহনা প্রায় বাক্যহারা। প্রায়ই দোকান থেকে শপিং গাইড গুলো বাড়ির লেটার বক্সে ফেলে দিয়ে যায়। সে পাতা উল্টায় দেখে, এখানে দাগায়, সেখানে দাগায়। একটা জিনিস অহনার কাছে পরিস্কার হলো, এগুলো অর্ন তাহলে লক্ষ্য করে কিন্তু কিছু বলে না। বঊযে তার কাছে মুখ ফুটে চাইতে পারে না কিন্তু দেখে দেখে চোখের আশ মিটায় সেটা তার জানা ছিলো। দোকান থেকে বের হয়ে অর্ন বললো, পরে আবার এসে তুমি এর সাথে মিলিয়ে আংটি আর ব্রেসলেট কিনে নিও, একটা সুন্দর সেট হয়ে যাবে তোমার। আর ঐ দুলটা কি সত্যিই তোমার পছন্দ ছিলো নাকি? তাহলে তুমি ওটা অন্য সময় কিনে নিও। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে কথা শুনছিলো, বলে কি এই ছেলে, তার মাথার ঠিক আছেতো? বলবে না বলবে না করেও সে বলে ফেললো, এতো টাকা হঠাৎ এভাবে খরচ করে দিলে যে? অর্ন হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, তোমাকে কখনোতো ভালো কিছু কিনে দেয়া হয়নি, এতোদিন হলো তুমি এলে এখানে। এ উপলক্ষ্যে দিলাম। দিতেতো ইচ্ছে করে সব সময়, হয়ে ওঠে না। চলো এবার যাই খেতে। তারপর তারা একসাথে ইটালিয়ান এক রেষ্টুরেন্টে খেতে গেলো। বহুদিন পর তারা এ উপলক্ষ্যে বাইরে খেতে গেলো অহনার পছন্দের খাবার। অনেক মূল্য দিয়ে প্রতিটি জিনিস পেতে হতো বলে প্রতিটি জিনিসই ছিলো তখন অমূল্য। খুব সহজে জীবনে কিছু পেয়ে যাওয়াও বোধ হয় ঠিক না, তাতে জীবন তার আকর্ষন হারিয়ে ফেলে।

তানবীরা
১৩.০১.২০১১

Sunday 9 January 2011

আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে

http://ratjagapakhi.blogspot.com/2011/01/blog-post_05.html

http://www.amrabondhu.com/mir/2304


প্রতিটি দিন প্রতিটি মূহুর্ত কি লম্বা যায়। চব্বিশ ঘন্টা এতো লম্বা হয় কেনো তিতলি ভেবে পায় না। সপ্তাহের ছয়টা দিনকে তিতলির মাঝে মাঝে বছরের চেয়েও লম্বা মনে হতে থাকে। মনে হয় এ নিদারুন সপ্তাহ আর শেষ হবে না সায়ানের সাথে আর তিতলির দেখা হবে না। শুধু সায়ান যখন পাশে থাকে ঘড়িটা তখন উড়ে চলতে থাকে। এতো আনফেয়ার কেনো এই পৃথিবীটা। অপেক্ষার সময়টা এতো লম্বা আর .........। সায়ান পাশে থাকলে সেই ঘন্টাগুলো যেনো মিনিট থেকে সেকেন্ড - মাইক্রো সেকেন্ড হয়ে উড়ে যায়। কতো কি ভেবে রাখে, দেখা হলে সে সায়ানকে এটা বলবে ওটা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু ও সামনে এসে দাঁড়ালে এমন ঝড়ের কাঁপন শুরু হয়, সময় কোথা দিয়ে ওড়ে, ভেবে রাখা কিছুই আর মনেও থাকে না, বলাও হয় না। আর তিতলির মাথাটাকে সায়ানতো কাজও করতে দেয় না। হলে ফিরে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে তিতলির আবার রাগ হতে লাগলো। একটু দ্বিধায়ও পরে গেলো। রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে সে। বাবা মা তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন, অনেক বিশ্বাস করে তাই তাকে ঢাকা পড়তে পাঠিয়েছেন। এভাবে বন্ধুর হাত ধরে বেড়াতে যাবার কথা তাদের কানে গেলে তারা কি ভাববেন? বিশ্বাস ভংগের অভিযোগ আনবেন না তার বিরুদ্ধে?

তিতলির কি এটা ঠিক হবে? কিন্তু যখনই অপর পিঠটা ভাবছে, সায়ানের এতো কাছাকাছি কদিন থাকতে পারবে, অজানা একটা ভয় আর আনন্দ তাকে ব্যাকুল করে তুলছে। নিজের মনেই অনেকক্ষন নিজের যুক্তিগুলোকে সাজালো সে । সেতো পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে না, বেশ মনোযোগী ভালো ছাত্রী সে, ফার্ষ্ট ক্লাশ পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে তার। আর সায়ানের সাথে তার সম্পর্কটা একান্তই তার নিজের ব্যাপার। বাবা মায়ের মেয়ে হয়েছে বলে কি তার নিজের কোন পছন্দ থাকতে নেই। যুক্তিগুলো সাজাচ্ছে বটে কিন্তু নিজের মনই বলছে এগুলো ঠিক ততোটা জোরালো যুক্তি নয়। অস্থির লাগছে ভিতরটা। তিতলির দেরি দেখে ওদিকে সায়ান বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভিতরেই অধৈর্য্য হয়ে ওঠলো সে। চার পাঁচবার কল মিসড হবার পর ফোন ধরে বললো সে, আর আধ ঘন্টা জান, প্লীইইজ। সায়ান একটু ক্ষুন্ন হয়ে বললো, বাস কি তোর আমার জন্যে অপেক্ষা করবে নাকি? দ্রুত বাকি জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে ফেললো তিতলি তারপর ঢুকলো বাথরুমে। খুব ভালো করে গোসল সেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে খুব সাজাতে ইচ্ছে করছে সায়ানের জন্যে কিন্তু সাজগোঁজে অপটু সে আর কি করবে ভেবে পেলো না। সায়ানের কিনে দেয়া জীন্স আর ফতুয়া আর পছন্দের সুগন্ধী মেখে বেরোল।

সায়ান অপেক্ষা করছিলো হলের কাছাকাছি, তিতলি বেরোতেই ওকে টেনে নিয়ে সি।এন।জি ধরে বাস ডিপোর দিকে প্রায় উড়ে চললো। সি।এন।জিতে ওঠেই সায়ানের ধৈর্যহীন কন্ঠ বলে ওঠলো, মেয়েদের কেনো যে এতো দেরী হয়, বাস মিস করিয়ে দিচ্ছিলি প্রায়ই। তিতলির মধ্যে অচেনা একটা অনুভূতি কাজ করছে । চোখে পানি এসে যাচ্ছে, কেনো সে নিজেই জানে না। মুখ ঘুরিয়ে রাখলো, সায়ানকে তার চোখের পানি দেখতে দিতে চাইছে না। উত্তর না দিয়ে রাতের ঢাকা দেখতে থাকলো। সোডিয়াম আলোর নীচে রাতের ঢাকাকে অচেনা লাগে। বাসের টেনশনে তিতলির এই পরিবর্তন সায়ান লক্ষ্যই করলো না। বাস কাউন্টারে যেয়ে নিজেদের ব্যাগ তাদের হাতে তুলে দিয়ে ভাবলো সামান্য কিছু স্ন্যাকস খেয়ে নেয়া যাক। দুপুরে এতো দেরিতে খাওয়া হয়েছে দুজনেরই যে ভাত খাওয়ার ইচ্ছে কারোই নেই এখন। সায়ানের কাপোচিনোর প্রতি খুব দুর্বলতা আছে তিতলি জানে সেটা। সামনেই সুইস বেকারী তাই তিতলি সেখানে যেতে চাইলো। এই জন্যেই মেয়েটাকে এতো ভালো লাগে সায়ানের। ওর সামান্য থেকে সামান্য জিনিসের প্রতি তিতলির ভালোবাসা মাখা যত্ন অনুভব করা যায়। মুখে কখনো বলবে না, স্বীকারও করবে না যে, ওকে ভালোবাসে। বরং ঠোঁট উলটে বলে দিবে, আমার ঠেকা পড়েছে তোকে ভালোবাসতে। তিতলির এই ঠোঁট উল্টানো ভঙ্গীটা দেখতে এতো ভালো লাগে। সায়ান কাপোচিনো আর বীফরোল নিলো, তিতলি মাফিন আর কফি। খাওয়ার মাঝেই বাসের হর্ণ, দৌড় লাগালো দুজনে।

বাসটা বেশ নতুন, সীটগুলো বেশ ভালো। ডান পাশের রোতে মাঝের দিকে সীট পড়েছে দুজনের। রাতের বাসে বেশির ভাগ যাত্রীই ঘুমিয়ে আছেন। ঘুম নেই এই যুগলের। জানালা দিয়ে দুজন বাইরের দিকে তাকিয়ে তারা ভরা আকাশ দেখছে। প্রতিদিনের চেনা এই আকাশটা আজ খানিকটা যেনো অচেনা। রোজ যেনো আকাশটাকে ধূসর আর কালো লাগতো। আজ লাগছে খাপছাড়া গাঢ়ো নীল। মনে হচ্ছে পুরো আকাশ আজ চাঁদের প্রেমে মজে আছে। কাত হয়ে বেহায়া আকাশটা চাঁদের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে। জ্যোস্নার আলো বাসের জানালা গলে তিতলির মুখে এসে পড়েছে। আলো মাখা তিতলিকে অচেনা লাগছে সায়ানের। এই তিতলি তার পুরোই অদেখা। সায়ানের হাতের মুঠোয় তিতলির হাত। এতো মায়া এই চোখে আগে কোনদিন কি খেয়াল করেছিল সে? মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলার একটা তীব্র ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যদি কখনো এ সময় হারিয়ে যায় ভাবতেই সায়ান নিজের অজান্তে জোরে চেপে দিলো তিতলির হাত, তিতলি শব্দ করতে পারলো না শুধু নড়ে ওঠলো। তিতলি খানিকটা সহজ হয়ে ওঠেছে এখন। তিতলির কানের কাছে মুখ এনে সায়ান বললো, একটা গান গাইবি, প্লীইইজ? চোখ নেড়ে না করে সাবধানে সায়ানের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো সে। সায়ানের গায়ের গন্ধে একটা অচেনা মাদকতা সব সময়, যেটা তিতলিকে সারাবেলা মাতাল করে রাখে। এখন সে নিঃশব্দে চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে সায়ানের গায়ের গন্ধে ডুবে থাকতে চাইছে। ফিসফিস করে কথা বলে কিংবা গুন গুন করে গান করে এই নিঃশব্দতার সৌন্দর্য নষ্ট করতে চাইছে না।

কারো চুলের গন্ধ এমন পাগল পারা কি করে হয়, কোন ধারনাই ছিলো না সায়ানের। সব সময় তিতলির পাশে বসলে, তার গায়ের গন্ধের চেয়েও চুলের গন্ধ তাকে টানে বেশি। এতো কাছে এভাবে আর কোনদিন তিতলিকে পায়নি সে। সবার চোখ এড়িয়ে আস্তে করে তিতলির কপালে আর মাথায় তার ঠোঁট ছোঁয়ালো। সারা শরীরে এক অজানা কাঁপুনি টের পেলো তিতলি। সায়ানের হাতে রাম চিমটি বসালো তার লম্বা নখ বসিয়ে। তারপর মুখ তুলে মিষ্টি করে হাসলো সায়ানের চোখে চোখ রেখে। সায়ানের সারা পৃথিবী সেই হাসিতে দুলতে লাগলো। তিতলি আর পুরো পৃথিবী এক মোহনায় মিশে গেলো তার। তিতলির বুকে আবার ধ্রিম ধ্রিম মাদলের বাজনা শুরু হলো। মনে হতে লাগলো সময় যেনো এখানেই থেমে যায়, এ বাস যাত্রা যেনো কোনদিনই শেষ না হয়। ভোরের দিকে দুজনের কখন চোখ লেগে এসেছিলো টের পায়নি। স্বপ্ন আর বাস্তবে, বাস্তব আর স্বপ্নের ঘোরে রাস্তা কখন ফুরিয়ে গেলো টের পেলো না দুজনই। বাস যখন থামলো চারপাশে তখন নরম আলো পৃথিবীকে ছুঁয়ে দিয়েছে। চারপাশটাকে অন্যরকম স্নিগ্ধ লাগছে। ভোরের আলোয় এক ধরনের পবিত্রতা থাকে। এ আলো গায়ে মেখে নিজেকে কেমন যেনো শুদ্ধ শুদ্ধ মনে হতে থাকে।

বাস ডিপো থেকে বেরোতেই রিকশাওয়ালারা জেকে ধরলো, কোথায় যাবেন কোন হোটেল। ভীড়ে পড়তে ইচ্ছে করলো না এসময়। খুব সাবধানে তিতলির হাত ধরে ভীড় বাঁচিয়ে সায়ান ডিপো থেকে বের হয়ে আসলো। ঐতো দূরে ক্যাব দেখা যাচ্ছে। হাত নেড়ে ক্যাবকে ওদের দিকে আসতে বললো। তিতলি রাগ দেখিয়ে বললো, কেনো অযথা এতোটা খরচা করবি শুনি? রিকশায় আরামে চলে যেতাম। সায়ানের চোখে দুষ্টমির হাসি খেলা করে ওঠলো, হেসে বললো, ঠিকাছে চল না। রোজতো আর করছি না। তিতলি রাগতে গিয়েও হেসে ফেললো। খুব ইচ্ছে করছিলো সায়ানের কোঁকড়ানো চুল গুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতে। আজ প্রথমবারের মতো ওরা দুজন দুজনার এতো কাছে, ব্যস্ত নগরীর পরিচিত মুখ আর ভীড়কে ফাঁকি দিয়ে। জীবনটা এতো সুন্দর কেনো? নিজেকে চিমটি দিয়ে দিয়ে দেখছে, সব কি স্বপ্ন নাকি সত্যিই সে সায়ানের এতো কাছে আজ? যদি স্বপ্নই হয় তাহলে সে হাত জোড় করে প্রার্থনা করছে, এ ঘুম যেনো ভেঙ্গে না যায়, তার স্বপ্ন যেনো হারিয়ে না যায়। পাতালপুরীর রাজকন্যা হয়ে সে ঘুমিয়েই থাকুক, যাক হারিয়ে তার সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি। সে অন্ততকাল সায়ানের হাত ধরে হাটবে, দূর থেকে দূরান্তে।

তানবীরা
০৯.০১.২০১১

Thursday 6 January 2011

অহনার অজানা যাত্রা (নয়)

সরকারী এজেন্সি থেকে বাড়িভাড়া নেয়া যতো সোজা হবে ভেবেছিলো অহনা, দেখা গেলো ব্যাপারটা ততো সোজা আসলে না। সরকারের বাড়ি ভাড়া যেহেতু সরকারের ধারনা ন্যায্য, সেটা পাওয়ার জন্য লাইনও অনেক লম্বা। আর ওলন্দাজ অর্থনীতি আর সমাজনীতির মূল মন্ত্র হলো দুর্বলকে রক্ষা করো, আর সেটা করবে কারা, সবলরা। যাদের ট্যাক্সেবল বেতন গড়পড়তা বেতনের চেয়ে অনেক বেশি তারা কখনোই সরকারের বাড়ি ভাড়া নেয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন না। বেতনের উল্লেখ করাই আছে, কতো টাকা বেতন অব্ধি লোক বাড়ি ভাড়ার আবেদন করতে পারবেন এবং কে কোন ধরনের বাড়ির জন্য আবেদন করতে পারবেন। দেখা যায়, একজন নিম্ন আয়ের টার্কিশ কিংবা মরোক্কান ভদ্রলোক যার পাঁচখানা সন্তান আছে, সে আরামসে সরকারের কাছ থেকে একটা ছয় বেডরুমের বাসা নিয়ে আছে। আর একজন মাঝারি কিংবা উচ্চ আয়ের ডাচ ভদ্রলোক যার দুটি বাচ্চা, তিন রুমের একটা ছোট বাসায় আছে। মজার ব্যাপার হলো, তার যেহেতু পাঁচটি বাচ্চা, তার খরচ বেশি তাই সে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করবে কম, সরকার তাকে এইখাতে ভর্তুকী দিবে আর যার বাচ্চা কম তার কাছ থেকে সরকার বেশি ভাড়া আদায় করবে। মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তরা বাড়ি ভাড়া নেয়ার থেকে কেনায় বেশি আগ্রহী, তাহলে সরকার থেকে কিছুটা আয়কর মাফ পাওয়া যায়। তাই সরকারের কাছে সেই রেঞ্জের বাড়ির সংখ্যাও কম ভাড়ার জন্য।

এদেশে একারনে বিদেশীদের মধ্যে বাচ্চা নেয়ার প্রবনতা অনেক বেশি। ধরতে গেলে বিনা পয়সায় বিরাট একটা বাড়িতে থাকতে পায়। যাতায়াত, স্কুল, চিকিৎসা সর্বক্ষেত্রে সরকারের অনুদান পায়। বছরের শেষে ইনকাম হিসেব হয় তখন আরো অন্যান্য বাড়তি খরচের খাত প্রমান করতে পারলে, ইনকাম ট্যাক্সের একটি অংশ সরকার থেকে তারা ফেরত পায়। প্রতিটি বাচ্চা জন্মের পর সরকার এখানে বাচ্চাদের মাথা পিছু একটা মাসিক খরচ দেন, আঠারো বছর পর্যন্ত। বাচ্চার বয়স যতো বাড়ে, পয়সাও ততো বাড়ে। ডাচেরা যেহেতু উন্নত জীবন যাপন করেন, বাচ্চাদের পয়সা তারা বাচ্চাদের পিছনে খরচ করেন, রেষ্টুরেন্টে যান বাচ্চাদের নিয়ে, এ্যমুউজমেন্ট পার্কে যান, সিনেমায় যান, ভ্যাকেশনে যান, বাচ্চাদের নানা রকম দামী আধুনিক খেলনা কিনে দেন। কিংবা বাচ্চাদের নানা রকম এক্টিভিটিজের জন্য পয়সাটা খরচা করেন, সাঁতার শেখানো, হর্স রাইডিং, ড্রয়িং, মিউজিক কিংবা ডান্স। সরকারের ভর্তুকির পয়সায় তাদের কিছুই হয় না। উলটো নিজের পকেট থেকে একটা বড়ো খরচা বেরিয়ে যায়। আর বিদেশীরা সে পয়সাটা জমিয়ে দেখা যায় নিজ দেশে বাড়ি বানান বা ফ্ল্যাট কিনেন। অবৈতনিক শিক্ষার বাইরে খুব কম বিদেশীকেই দেখা যায় পয়সা খরচ করে বাচ্চাদের কিছু শিখাতে। ভারতীয়রা এখাতে বেশ পয়সা ব্যয় করেন কিন্তু মুসলমান বিদেশীরা সাধারণত অবৈতনিক মসজিদ আর স্কুলের বাইরে খুব একটা আগ্রহ দেখান না।

ওলন্দাজ নীতি মেনে অহনার বাড়ি ভাড়ার লাইনও আর শেষ হয় না। দিনরাত সে অপেক্ষায় থাকে কখন একখানা চিঠি আসবে। কিন্তু কোন খবর নেই। অহনার বাড়ি ভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে বাড়তি অনেক কিছু করার স্বপ্ন বাসি ফুলের মতো শুকিয়ে আস্তে আস্তে মুচমুচে হওয়ার পথে রওয়ানা দিলো। আবার বিষন্নতা ভর করতে লাগলো। বড়োই আটপৌঢ়ে জীবন এখানে। কাজ করো খাও, ঘুমাও আবার কাজে যাও। স্কুলে নানান জাতির লোকজন আসে। তাদের কারো সাথে একদিন বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গে আলাপ হতে, সে অহনার বোকামিতে খুবই অবাক হলো। সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠাতে গেলে এজীবনে সম্ভব না তার ইঙ্গিত দিয়ে সে বেশ কয়েকটা বাঁকা বুদ্ধি দিলো তাড়াতাড়ি ঘি খাওয়ার জন্যে। তার কাছ থেকে সে জানতে পেলো, সাধারন লিষ্টের বাইরে হাউজিং কোম্পানী একটি প্রায়োরিটি লিষ্ট মেইনটেইন করে। যাদের ইমার্জেন্সী বাড়ির প্রয়োজন তাদেরকে তারা আলাদাভাবে বিবেচনা করেন। যেমন, ডিভোর্স হচ্ছে এধরনের যুগল, প্রেগন্যান্ট যুগল, মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি বলে যদি ডাক্তারের সার্টিফিকেট আদায় করে জমা দেয়া যায় তাহলে দ্রুত একটা হিল্লে হওয়ার সম্ভবনা আছে। প্রায়োরিটিতে আসার পদ্ধতি শুনে অহনার কালো মুখ আরো জাম কালো হয়ে গেলো। ডিভোর্স বা প্রেগন্যান্সীর সম্ভাবনা আপাততঃ নেই আর অন্যান্য চোট্টা পদ্ধতি অবলম্বনে অর্ন কতোদূর রাজি হবে কে জানে। অহনা সাধারণ জ্ঞানে জানে অর্ন চুরির রাস্তায় হাটার লোক না।

অর্ন প্রথমে হাসলো অহনার স্কুল থেকে নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ন সব তথ্য শুনে। সে খুবই ধীর স্থির, সহসা কোন কিছু নিয়ে অস্থির হওয়ার মানুষ সে না। বউকে বললো, এসব চিন্তা ছাড়ো। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। নিজেকে তৈরী করো সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। বাড়ি যখন আমাদের নাম্বার আসবে তখনই পাবো, নইলে দুজনে মিলে যখন আয় করবো তখন তোমার পছন্দের বাড়ি কিনে নিবো। শুরুতে সবারই অনেক কিছু নিয়ে সমস্যা হয় কিন্তু আস্তে আস্তে সেগুলো সবারই ম্যানেজ হয়ে যায়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির আলোকে আপাত হিসাবে গড়পড়তা মধ্যবিত্তের চেয়ে বেশি স্বচ্ছলতায় ব্যবসায়ী পরিবারে বড়ো হওয়া অহনার পক্ষে কোন কিছু নিয়ে পরিকল্পনা করে ধৈর্য্য ধরে তার প্রতি আগানো একটা নতুন শিক্ষা। এ সম্পর্কে তার কোন ধারনাই নেই। চাহিবা মাত্র হাজির হওয়া আবহাওয়ার মানুষ সে জ়ানেই না কি করে কোন কিছুর জন্যে ধৈর্য্য ধরতে হয়। সে কিছুটা ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো যা অর্নকে বিরক্ত করলো। এতো অস্থির কেনো অহনা সেটা অর্নও বুঝতে পারে না। বাড়ি যখন হবে তখন হবে আর লন্ডন, প্যারিস কিছুতো পালিয়ে যাচ্ছে না। সবেতো জীবন শুরু হলো দুজনের। চুপচাপ পড়াশোনা করা আর ঘর সংসার করায় সমস্যা কি সেতো খুঁজে পায় না।

এরমধ্যে ঘুরতে ঘুরতে অহনার জন্মদিন এলো। সিনেমায়, নাটকে, গল্পের বইতে অহনা বউদের জন্মদিনে স্বামীদের সারপ্রাইজ দেয়ার অনেক ধরনের সিকোয়েন্স দেখেছে। মনে মনে তার প্রথম জন্মদিনে অর্নের কাছ থেকে সেধরনের কিছুই সে আশা করে রেখেছে। কিছুদিন আগেই অর্নের জন্মদিনে অহনা তার সাধ্যমতো ফুল, কেক, উপহার আর রান্না বান্নার সারপ্রাইজের চূড়ান্ত করেছে। জন্মদিনের দিনে দেখা গেলো কারো কিছুই মনে নেই। অর্ন স্বাভাবিক ভাবেই সকালে ঘুম থেকে ওঠে অফিসে গেলো এবং আর কোন খবর নেই। অনেকক্ষণ সে অপেক্ষায় থাকলো এই বুঝি অর্নের তরফ থেকে কিছু হলো কিছু হলো কিন্তু না, কিছুই না। তারজন্যে বছরের এই অত্যন্ত বিশেষ দিনটি খুবই সাধারণভাবে ঘড়ি টিকটিকিয়ে কেঁটে যেতো লাগলো মূহুর্ত, মিনিট আর ঘন্টা। অনেকদিন থেকে আঁকা স্বপ্নের এমন চুরচুর পতন অহনাকে মানসিকভাবে টুকরো টুকরো করে ফেললো। বিছানায় শুয়ে কেঁদে কেঁদে বিছানার বালিশ চাঁদর ভিজিয়ে ফেললো সে। আর কাকে বলবে সে এই কষ্টের কথা? লজ্জা আর অপমানের কথা? রাগে যন্ত্রনায় কাঁপতে কাঁপতে অত্যন্ত সাদামাটা কিছু রান্না করলো, অর্ন এলো খাওয়া দাওয়া হলো। অর্ন খেয়ালও করলো না খাবারের মেন্যু কেনো এতোটাই সিম্পল আজকে। সন্ধ্যের দিকে বাংলাদেশ থেকে অহনার বোনেরা ফোন দিলো। তারা প্রথমে ফোন করতে পারছিলো না আব্বু বাসায় এসে লাইন বুক করতে হবে পরে ভাবলো আরো একটু দেরি করি, অহনা অর্ন নিশ্চয় বাইরে খেতে টেতে গেছে।

ফোন প্রথমে অর্নের হাতেই পড়লো। অহনার বোনেরা ফোন ধরেই কলকলিয়ে অর্নকে জিজ্ঞেস করলো বাজিকে কি গিফট দিলেন? কোথায় খাওয়াতে নিয়ে গেলেন ভাইয়া? অর্ন প্রথমে বেশ বোকা হয়ে গেলো। কি ব্যাপার সেটা বুঝতেই তার অনেক সময় গেলো আর বুঝে সে কোন উত্তর দিতে পারলো না। অহনার বোনেরাও এঘটনায় যারপর নাই ব্যাথিত হলো কি করে কেউ বউয়ের প্রথম জন্মদিন ভুলে যেতে পারে। অর্ধ কান্না মিশ্রিত গলায় অহনা জন্মদিনের প্রায় শেষ প্রহরে তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথম শুভেচ্ছা জানলো। তার একটু পরই অহনার ছাত্র ভাই ফোন করলো ভারত থেকে, প্রানের চেয়ে প্রিয় বোনকে শুভেচ্ছা মালা জানাতে। তারা কার্ড পাঠিয়েছিলো সবাই কিন্তু তখনো সেগুলো অহনার হাতে এসে পৌঁছেনি। তখনো অহনা জানতো না কিছু কিছু কার্ড আর চিঠি বাংলাদেশ আর নেদারল্যান্ডসের মাঝখানে গুম হয়ে যায়, কখনোই হাতে পৌঁছায় না। অর্ন খুবই হতবুদ্ধি হয়ে অহনাকে জিজ্ঞেস করলো, আজ অহনার জন্মদিন সেটা কেনো সে তাকে জানালো না? অহনাও পালটা জিজ্ঞেস করলো, তাকেই কেনো যেয়ে অর্নকে জানাতে হবে যে তার জন্মদিন আজ? অহনার কাবিনে, পাশপোর্টে, সার্টিফিকেটে কোথাও তারিখটি কি লেখা নেই? না অর্নের নিজের কোন গরজের খাতায় পরে না অহনার জন্মদিন কবে সেটা জ়েনে নেয়া। অভিমানী অর্ধ কান্না এখন পুরো কান্নার দিকে ধাবিত হলো। ঢাকাতে বান্ধবী, কাজিন, ভাই বোনদের সাথে সে ঈদের খুশিতে জন্মদিন উদযাপন করতো।

ঈদেও এতো আনন্দ হতো না জন্মদিনে যা হতো। মনের মতো উপহার বাবা মায়ের কাছে থেকে, চাচা, মামা, দাদুর কাছ থেকে টাকা আর বান্ধবীদের কাছ থেকে ফুল সহ হরেক রকম উপহার সামগ্রী, খানাপিনা, মাস্তি কি না ছিলো। এখানে বাড়ি থেকে দশ হাজার মাইল দূরে একা নিভৃতে সে তার প্রথম জন্মদিন উদযাপন করলো। কোন কার্ড নয়, ফুল নয়, উপহারতো নয়ই। এর ওপর অর্নের জেরা। শ্বশুর বাড়ির জিজ্ঞাসাবাদে নাস্তানাবুদ অর্নও লজ্জায় কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিলো না। সে খুবই দুঃখ প্রকাশ করে বললো, জন্মদিন তারা একদিন পর সেলিব্রেট করবে এবার। কাল বাইরে খাবে, সিনেমা দেখবে এবং অহনাকে কিছু পছন্দ করে রাখতে, সে যা চাইবে তাই কিনে দিবে। অহনা যেনো রেডি থাকে, অর্ন অফিস থেকে তাড়াতাড়িই বেরোবে এবং অহনাকে তুলে নিবে। অহনা আর কোন গরজ দেখাতে রাজি না। তার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। জীবন যে সিনেমা না এটা রোজ রোজ তার চোখে চব্বিশ ঘন্টায় আট চল্লিশ বার আঙ্গুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবারের ঝগড়া যেকোন ইস্যুতে অর্নের আপার হ্যান্ড থাকে, অহনা বুঝে না, আবেগী কিংবা ইমম্যাচিওর। কিন্তু আজ অহনা বিজয়িনী, এবং হাতে নাতে ধরা অর্ন। তার বাবার বাড়ির কাছেও কি কষ্টে অর্ন তার বউকে রেখেছে সেই টুকু প্রকাশ হলো আজ। আপাততঃ সেই সুখ নিয়ে অহনা ঘুমাতে যাচ্ছে।

তানবীরা

০৬.০১.২০১১

Wednesday 5 January 2011

এলোমেলো প্রেমের গল্প



 http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=01e7ce791d50156967113e7790a4e069

তখন থেকে টেবিলের ওপর মোবাইলটা নেচে যাচ্ছে। হ্যা বেজে যাচ্ছে না নেচে যাচ্ছে। তিতলি বই খুলে বসে আছে বটে টেবিলে কিন্তু সেকি পড়ছে নাকি মোবাইলকে দেখছে বোঝা যাচ্ছে না। আনমনা প্রচন্ড শুধু সেইটুকুই বোঝা যাচ্ছে। তিতলি ভীষন রেগে আছে সায়ানের ওপর। সায়ান বিকেল থেকে সামান্য বিরতি দিয়ে দিয়ে ফোন করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে, কিন্তু তিতলি কিছুতেই ফোন ধরছে না। বাসায় যেনো কারো কানে না যায়, মোবাইলটাকে ভ্রাইব্রেশনে দিয়ে রেখেছে তিতলি। বিকেল থেকে কতো এসএমএস, কতো কাঁকুতি মিনতি সায়ানের, ফোনটা একবার তোল জান। না তিতলি তুলবেই না, গতো দুই দিন ধরে কি কম কষ্ট পেয়েছে সে যে এখুনি সায়ানের ফোন ধরতে হবে? সায়ানের সব সময় কাজের দোহাই, সে খুব ব্যস্ত। আর তিতলি? তিতলির কি সায়ানের ফোনের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। গতো দুদিন সারাক্ষণ মোবাইল চেক করেছে, নাই কোন ম্যাসেজ, নাই কোন মিসড কল। কাজ থাকলে কি তিতলিকে ভুলে যেতে হবে?
আজ তার সময় হয়েছে বলে কি আজই তিতলিকে ফোন তুলতে হবে। এ্যাহ কি আমার চাকুরীরে, ওনার ট্যুর পরেছে বসের সাথে। যেনো আর কেউ সরকারী চাকুরী করে না আর তাদের বসের সাথে ট্যুর পরে না। তাই বলে কি দু’মিনিটের জন্য কোন ফোন করা যায় না? অথচ সেদিন রাতে খালাতো বোনের বিয়েতে গেছে তিতলি। সারাক্ষণ ম্যাসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছে, কখন ফিরবে বাড়িতে, অন লাইনে আসবে না আজ সে? মায়ের চোখ বাঁচিয়ে লেডিস রুমে যেয়ে তিতলিকে রিপ্লাই করতে হলো, আজ দেরি হবে ফিরতে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। তখন কি আলহাদ সায়ানের, তুমি আমার দুচোখে ওড়ে এসে না বসলে আমার ঘুম আসে না জান। তার দুদিন পরেই এমন আচরন!! সায়ানকে ভীষন একটা শাস্তি দিতে ইচছে করছে তিতলির, ভীষন। কিন্তু তিতলির পৃথিবীতে এমন কোন শাস্তিই নেই যা তিতলিকে না আঘাত করে সায়ানকে করে। এই যে ফোন তুলছে না সায়ানের, তিতলির কি কম কষ্ট হচ্ছে, কম কষ্ট? দুদিন পরেই টিউটোরিয়াল, পনের নাম্বার তাতে, সামনে থার্ড ইয়ার ফাইন্যাল। তাতে যোগ হবে এই নম্বর কিন্তু আজ তিনদিন হতে চললো সে পড়ায় মনই দিতে পারছে না।
ক্লাশে বসে থাকে ঠিকই, লেকচার ঢুকে না কিছুই তার কান দিয়ে। সবার চোখ বাঁচিয়ে মাঝে মাঝেই সেল চেক করে, ম্যাসেজ এসেছে কিনা। সায়ানের সাথে ঝগড়া হলে সে ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত পারে না। মা বারবার জিজ্ঞেস করলেন আজ, ঐটুকু খেয়ে ওঠে গেলি? সামনে পরীক্ষা তাই বাঁচোয়া, নইলে বাসার সবাই ভাবতো কি হয়েছে তিতলির? কিন্তু তাতে সায়ানের কি? তারতো তিতলির মতো মনের ছাপ মুখে পড়ে না। সে মহানন্দে অফিস করে যায়। ভীষন কষ্ট হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে এখন, তিতলী নিজেকে সামলানোর জন্য পিসিটা অন করলো। ভাবলো কিছুক্ষণ গেম খেললে হয়তো মনটা একটু হাল্কা হবে। তারপর ঠিক করে মন দিয়ে পড়তে বসবে। করবে না করবে না ভেবেও কখন যেনো মেসেঞ্জারে লগ ইন করে ফেললো। আর যায় কোথা, সায়ান ওকে ধরে ফেললো। এই এক সমস্যা তিতলির, সায়ান পাশে থাকলে তার মাথা আর হৃদয় আলাদা ভাবে কাজ করে না। সায়ান তার মাথার বারোটা বাজিয়ে ফেলে। মাথা অফ হয়ে শুধু মন কাজ করতে থাকে তার। যেভাবেই হোক, যতো কান্ডই ঘটুক সায়ান তাকে ঠিক বুঝিয়ে ফেলবে। সে কিছুতেই আর রাগ করে থাকতে পারবে না।
তিতলি কেঁদে কেটে তারপর এক সময় আবার সব ভুলে যাবে। হাঁদা সায়ানটা এসে লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়ালে তিতলি ওর সাথে না যেয়ে কিছুতেই পারে না। কতো ভাবে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে, কোন দিকে তাকাবেই না সোজা লাইব্রেরীতে ঢুকবে আর বেড়োবে কিন্তু লাইব্রেরীর কাছাকাছি আসতেই তার অবাধ্য চোখ দূর থেকে কাকে যেনো খুঁজতে থাকে। সায়ান পাশে এসে খুব নরম গলায় যখন ডাকবে “জান, কেমন আছো” তখন তিতলি আর এড়াতে পারে না। সব ভুলে সায়ানের হাত ধরে সে ওড়তে থাকে। আর ভিতরে ভিতরে তিতলি জানে, সায়ানও জানে তার এই দুর্বলতার কথা। যখন অভিমানের তীব্রতা কমে যায় তিতলি অনেক সময় নিজেও খুঁজে পায় না কি নিয়ে সে এতো রেগে গেছিলো। হ্যা, তিতলি স্বীকার করে তার রাগের কারন গুলো হয়তো খুবই সামান্য কিন্তু এই পৃথিবীর সবার কাছ থেকে পাওয়া সব আঘাত সইতে পারলেও সায়ানের কাছ থেকে সামান্যের থেকে সামান্য অবহেলাটুকুও সে সইতে পারে না। এই পৃথিবীর কারো কাছে সে হয়তো কিছুই না কিন্তু কোথাও একজন আছে যার তিতলির গলা না শুনলে ভোর হয় না, তি্তলির ম্যাসেজ না পেলে যে ঘুমাতে পারে না, মন দিয়ে অফিস করতে পারে না। তিতলিকে ঘিরে কারো দিন ও রাত আবর্তিত হয়, এই অনুভূতিটা কি কম? শুধু এই অনুভূতিটাই তিতলিকে দিন রাত হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে।
মেসেঞ্জারে টুকটুক করে সায়ানের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে রাত তিনটা বেজে গেলো টেরই পেলো না তিতলি। সায়ান তাগাদা করলো ঘুমকাতুরে তিতলিকে শুয়ে পড়তে। সকালেই ক্লাশ আছে। ঠিক করে না ঘুমালে মন দিয়ে লেকচার শুনতে পারবে না। তিতলির পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই সজাগ দৃষ্টি তার। তার জন্যে যাতে তিতলির পড়া নষ্ট না হয় সেদিকে খুব খেয়াল রাখে সায়ান। কথা শেষ করে শুতে যাচ্ছে, মশারি গুঁজছে এমন সময় মোবাইলটা আবার নড়ে ওঠলো, সায়ান আবার। কৃত্রিম রাগ গলায় এনে তিতলি আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলো, আবার কি? নরম গলায় হাসতে হাসতে সায়ান বললো, ম্যাসেঞ্জারে কথা বলে কি মন ভরে? আজ তিন দিন হলো তোমার গলা শুনি না জান। তোমার গলা না শুনতে পেলে আমার কি রকম অস্থির লাগতে থাকে জানো না তুমি? এখন আমার সুন্দর ঘুম হবে, মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখবো তোমাকে নিয়ে। তিতলির গলা আবার ভরে এলো অভিমান, গতো দুদিন কি সেটা তোমার মনে ছিলো না? সায়ানের মতো অতো সুন্দর করে গুছিয়ে না বলতে পারলেও তিতলিরতো তাই হয়, সেটা কি সে বুঝতে পারে না? ভালোবাসা আর অভিমানের দোলাচলে এক মিষ্টি মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ঘুমাতে গেলো তিতলি।
তানবীরা
০৫.০১.২০১১

Tuesday 4 January 2011

সেন্ট মার্টিন (দুশো বছর পরে) {শেষ পর্ব}

খাওয়া দাওয়া শেষ করে একদল যাবেন ডিস্কোতে। সেখানে স্প্যানিশ, ল্যাটিন, হিন্দী, ইংরেজি গানের সাথে থাকবে কিছু লোকাল নাম্বার। সেন্ট মার্টিনকে ঘিরে বানানো। এল আর বি কিংবা দলছুটের বানানো ওওও উই আর গোয়িং টু সেন্টমার্টিন, কিছু থাকবে র‍্যাপ আর রিমিক্স। ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা কিংবা রুপবানে নাচে কোমড় দুলাইয়া। আর যারা নাচতে ভালোবাসেন না তাদের জন্য আছে ঝলমল আলো সজ্জিত ক্যাসিনো। সুন্দরী মেয়েরা সেখানে বসে থাকবেন আর চলবে সারা রাত গেম্বলিং। জ়্যাকপটের আশায় অনেকেই মন উজার করে খেলবেন, কেউ পাবেন কেউ পাবেন না। যারা প্রকৃতির খুব কাছে থাকবেন, অন্যকোন কিছুই তাদের চাই না তারা ক্যাম্প ফায়ার করে তার পাশে গোল হয়ে আকাশের চাঁদকে প্রেয়সী করে কবিতা লিখবেন। সেই আলো আধারিতে রাত যখন ভোরের দিকে যাবে সবাই হোটেলের দিকে ফিরবেন। বিছানায় গড়িয়ে প্রস্তূত হবেন পরের দিনের জন্যে। এতো কিছু করার আছে এখানে।

সকাল হতেই একদল বেড়িয়ে পড়বেন ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ কিংবা নিঝুম দ্বীপের সন্ধানে। বাহন থাকবে ওয়াটার ট্যাক্সী কিংবা সাম্পান। ছেঁড়াদিয়া দ্বীপের অনেকটাই সংরক্ষিত এলাকা। সমস্ত প্রবালে সবার মাড়ানো নিষেধ। পর্যটকরা নিজেরাও এব্যাপারে মারাত্বক সচেতন, ভবিষ্যতের জন্য সব বাঁচিয়ে রাখতে হবেতো। তবে কিছুটা এলাকা পায়ে হেটে দেখতে পারেন। আর বাকিটা দূর থেকে সবাই দেখবেন। এই দ্বীপে দুটো মাত্র স্যুভেনীয়’র শপ। তাতে নানা ধরনের প্রবাল পাওয়া যায় হ্যালো সেন্টমার্টিন কিংবা ওয়েলকাম টু ছেঁড়াদিয়া লিখা। প্রবালের টুকরো লাগানো ওয়ালপ্লেট, চাবির রিং ইত্যাদিও আছে। আর আছে চা-কফি, সামান্য স্ন্যাকস, রেষ্ট রুম পর্যটকদের সুবিধার জন্যে। গরমের দিনে আরো থাকে ঠান্ডা ডাব, কোক, আইসক্রীম। দ্বীপের মধ্যে বড়ো একটা টাওয়ারের মতো আছে। সেখানে চারপাশ দেখার জন্যে বড় বায়নোকুলার টাইপ মেশিন গুলো বসানো আছে। যেগুলোতে পাঁচশো টাকার কয়েন ফেলে চারদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমুদ্রের ও আশপাশের প্যানারোমা শোভা দেখা যাবে। শপগুলোর পাশে পাশেই আছে কোন ইঞ্জিনিয়ার / আর্কিওলজিষ্ট কবে কি ডেভেলাপ করেছেন, কতো সালে কোন কাজ শুরু করেছিলেন, তাদের মূর্তি ও তাদের জীবনী। সমুদ্রের - বাংলাদেশের আগের ও পরের ল্যান্ডস্কেপ, কে কবে কি উদ্বোধন করেছেন তার ছবি ও বিবরন দেয়া বিরাট বিরাট ফলকখানা। পর্যটকরা শটাশট এগুলো তাদের ক্যামেরায় বন্দী করতে শাটার টিপবেন।

ছেঁড়াদিয়া থেকে অনেকেই নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন। যদিও নিঝুম দ্বীপে ঢোকার প্রবেশ মূল্য অনেক কিন্তু এতোটা দূর যখন এসেছেনই এতোটা পয়সা খরচ করে তখন দেখে যাওয়াই যাক। এতো নাম শুনেছেন এই দ্বীপটির। পুরো দ্বীপটিই যেনো অভয়ারন্য। হরিণ, বানর আর শীতকাল হলেতো কথাই নেই নানা রকম নাম না জানা অতিথি পাখির ভীড়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখানে খুবই সজাগ। কোনরকম শব্দ দূষন করে এখানকার পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। দূর থেকে ছবি তোলা যাবে। তবে হরিণ – বানরের সাফারী ট্যুর খুবই দামি। সেফটি লকের গাড়িতে করে একসাথে দশজনের সাফারি কার যায় ঘন্টায় একটি। কিছুটা এলাকা উন্মুক্ত আছে বিনে পয়সায় দেখার জন্যে। পর্যটকরা তাতেই খুশি। কতোবার কতো সিনেমার দৃশ্যে এই জায়গাগুলো দেখেছেন তারা আর আজ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য ঘটেছে। বিরাট নীল সমুদ্রের পাশে বিস্তৃর্ন জুড়ে সবুজের মেলা। তাতে অবাধে চড়ে বেড়াচ্ছে নির্ভয় হরিণের দল, গাছে গাছে দুষ্ট বানর আর নাম না জানা পাখির কিচির মিচির। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে আর কি চাই?

এখানের ভ্রমন শেষ করে অনেকেই ছুটবেন আকুয়া ডাইভিং, বানজি জ়াম্পের জন্যে। অনেকদিন ধরে তারা অপেক্ষায় আছেন। প্রথম দশ মিনিট ট্রেনিং আনাড়িদের জন্যে তারপর খেলা। কেউ কেউ সার্ফিং ও সেইলিং করতে পারেন। যারা এ্যাক্টিভ কিছুতে আগ্রহী না তারা বীচে যেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছেন। কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা যাদের সাথে থাকবেন তাদেরতো সেই সুবিধে নেই। তারা বাচ্চাদের নিয়ে লাইভ একুরিয়াম দেখতে যেতে পারেন। সেন্ট মার্টিনের একটা পাশ জুড়ে আছে লাইভ একুরিয়াম প্লাস মিউজিয়াম। আলাদা টিকেট কাটলে দাম বেশি আর দুটোতে ঢুকার টিকিট একসাথে কিনলে একটু সস্তা। একুরিয়ামে বড় বড় তিমি, হাঙর এসে এমন ভাবে দেয়ালে তাদের লেজ দিয়ে মারবে যে মনে হবে এখুনি সব ধসে যাচ্ছে। আসলে কিছুই না, বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্যে শব্দ আর আলো দিয়ে এধরনের পরিবেশ বানানো হবে। ছোট ছোট গ্লাস দেয়া জায়গায় রঙীন সব মাছেরা তাদের লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে ভেসে বেড়াবে। অবাক চোখে শিশুদের সাথে তাদের বাবা মায়েরাও নাম না জানা এতো মাছ প্রথম বারের মতো চাক্ষুস চোখে দেখবেন।

মিউজিয়ামে আছে বিলুপ্ত সব মাছের মমি ও ছবি। কিছু থাকবে মাছের কাঁটা, কঙ্কাল, দাঁত। আর থাকবে বিলুপ্ত সব মাছের ইতিহাস ও বিলুপ্ত হওয়ার কারন। মিউজিয়াম দর্শন শেষ হলে অবশ্যই সমুদ্র স্নান। তরুন তরুনীরা হয়তো ন্যুড বীচে বাকিরা ফ্যামিলি বীচে। জলকেলী শেষ হলে তাজা মাছের বাহারে আহার। একটু গড়াগড়ি করে রোদের তেজ কমলেই যেতে হবে সেন্টমার্টিনের এ্যাট্রাকশন পার্কে। রোলার কোষ্টারে চড়লে নাকি দ্বীপের এ মাথা ও মাথা সবটাই দেখা যায় আর চড়কিতেতো কথাই নাই। দারুন দারুন জিলিপী ভাজা পাওয়া যায় সেখানে সাথে নানা ধরনের মুরালী, কদমা। এতো দূরতো সহসা আসা হবে না, তাই পার্কের মজা না নিয়ে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। পার্কটি এভাবে সাজানো যে ফটোগ্রাফীর আর্দশ স্থান। সুন্দর সুন্দর সব ছবি তোলা যায় এখানে।

শেষ সন্ধ্যেটি কাটবে নানা ধরনের উন্মাদনায়। যেতে ইচ্ছে করবে না অপার সৌর্ন্দযকে ছেড়ে কিন্তু জীবিকা ইচ্ছের বিরুদ্ধে টেনে নিয়ে যাবে। স্যুটকেস গোছাতে হবে সাবধানে। বেরোবার মুখে কঠিন চেকাপ। দ্বীপ থেকে অবৈধভাবে প্রবাল, রঙীন মাছ কিংবা হরিনের চামড়া জাতীয় কিছু ব্যাগে পাওয়া গেলে সাথে সাথে জরিমানা ও জেল। এধরনের চিন্তা অবশ্য সাধারণ পর্যটকদের মাথায় নেই। তারা জীবনের অন্যতম সুন্দর দুটো কিংবা তিনটে দিন এখানে কাটিয়ে তাজা ভালো লাগা মাথায় নিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হবেন।

তানবীরা

০৪.০১.২০১১

Sunday 2 January 2011

হ্যালো ২০১১

সারা বছর দেশের জন্যে মন খারাপ থাকে। ঘোলা আকাশ, শীত, ঠান্ডা, মন খারাপ করা অন্ধকার বরফে দেশের জন্য আরো অস্থির লাগে। এই অন্ধকারকে কিছুটা মৃদ্যু করতেই বুঝিবা ক্রীসমাসে সব শপিং মল, বাড়ি, রেষ্টুরেন্টে, রাস্তায় প্রচুর টুনি বাল্ব ব্যবহার করা হয়। ক্রীসমাস এখানে পারিবারিক উৎসব। সবাই বাড়ি ফেরেন, মা – বাবা, নানী – দাদীদের সাথে দেখা করেন। খুব নিরিবিলি চুপচাপ। রাস্তায় ধরতে গেলে কোন লোক দেখা যায় না ক্রীসমাস ইভ থেকে সেকেন্ড ক্রীসমাস ডে পর্যন্ত। সবাই জেগে ওঠে আবার থার্টি ফাষ্ট ইভে। ক্রীসমাসের থেকে অনেক বেশি আনন্দ, উৎসব এবং খরচ হয় এইদিনে। বারবার একটি লাইন মাথায় ঘুরে, আজ থার্টি ফাষ্ট, আজ পশ্চিমের ঘরে ঘরে আনন্দ। সন্ধ্যে থেকে চারধারে ঠুস ঠাস, ফুশ শব্দ সাথে আলোর ঝলকানি। প্রতিটি দিন যেমনই লাগুক, এই একটি দিন নেদারল্যান্ডসে আমার খুবই আনন্দের দিন। মনে হয় না খুব খারাপ নেই, বরং ভাবি ঠিকাছে। বারোটা এক মিনিটে কানে তালা লাগানো শব্দ করে চারপাশ থেকে আতশ বাজি পুরো আকাশটাকে ঢেকে দেয়। যতোদূর দৃষ্টি যায় সারা আকাশ কখনো লাল, কখনো সোনালী, কখনো সবুজ, কখনো বড় ফুল, কখনো কল্কা বা অন্যকিছু আকৃতি।

31st_2010 193

আগে খুব মন খারাপ হতো। এরা সারা দেশে যে পরিমান বাজি পোড়ায় আর শ্যাম্পেন ঢালে তাতে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের সারা বৎসরের হয়তো বাজেট হয়। আতশবাজি এখানে অনেক দাম। আসে চীন, তাইওয়ান থেকে। কিন্তু এখন আর এতো তীব্রভাবে মন খারাপ হয় না। আমাদের কপাল আমাদের কপাল। আমরা গার্মেন্টসে আগুন লেগে মারা পরবো, বিল্ডিং হেলে মরে যাবো, বাসে পুড়ে মরবো এই আমাদের ভাগ্য। ওরা নিরাপদে বাড়ি ফিরবে, সবাই মিলে কিছু শ্যাম্পেন এর ওর গায়ে ছিটাবে, কিছুটা খাবে, সারা আকাশ আলো করে পুরো পরিবার পাশের বাড়ি মায় পাড়ার সাথে প্রতিযোগিতা করবে বাজি পুড়াবে এটা তাদের ভাগ্য। যার যার ভাগ্য। তাই পুরো মন দিয়ে থার্টি ফাষ্ট নাইট উদযাপন করি। পুরো এলাকা ঘুরে ঘুরে প্রথমে কিছুটা সময় ফায়ার ওয়ার্কস দেখি আর বাকি সময় জানালার পর্দা সরিয়ে বসে থাকি, আকাশের রঙ বদলানোর খেলা দেখতে বড়ো ভালো লাগে। এক মূহুর্তের মধ্যে একটি বড় সংখ্যার পরিবর্তন মনের মধ্যে বিশেষ আর কোন অনুভূতি আনে না। তবে অকারন একটা ভয় থাকে, কেমন যাবে এই সংখ্যাটি? জীবন ধারাপাতে অনেক সংখ্যা অনেক সুখ দুঃখের দাগতো রেখেই যায়। তখন সামান্য সংখ্যাটি স্মৃতিময় বিশেষ সংখ্যায় রুপান্তর হয়ে যায়।

31st_2010 110

31st_2010 103

তবে থার্টি ফাষ্টের দুশমন সব দেশের পুলিশ। এবারো মাত্র তিনদিন আগে সরকার বাহাদুর আতশবাজি বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছেন। যদিও অনেকেই পাশের দেশ থেকে চোরাই আতশবাজি নিয়ে এসেছিলেন আগেই কিন্তু সাহস করে পোড়াতে পারেননি। উঠতি বয়সের যুবা শ্রেণীকে এদেশের পুলিশও চোখে চোখে রাখে এদিন। এরা মাত্রা ছাড়িয়ে পান করেন এবং অনেক জায়গায় হল্লাগুল্লা করার চেষ্টা চালান। যদিও পুলিশের গাড়ি পাড়ায় পাড়ায় টহলে থাকে তারপরো খাপ ছাড়া কিছু মারামারি ঘটে যায়। সাধারনতঃ বার আর ডিস্কোতে মারামারির স্বাধীনতা মিলে কিছুটা সময়ের জন্যে। আতশবাজি পোড়ানোর সময় চূড়ান্ত সাবধানতা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ঘোষনা দেয়া হয় বার বার টিভি রেডিওতে। তাসত্বেও কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যায়। হাসপাতালে সেদিন ইমার্জেন্সী বিভাগ সচল থাকে অনেক। বেশির ভাগ প্রাথমিক চিকিৎসায় ছাড়া পেলেও অনেকেই সারা জীবনের জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হন। অনেকেরই অংগহানি ঘটে। একটা জিনিসই শুধু ঘটে না। মেয়েদের ধরে টানাটানি করার সংস্কৃতিটা এখানে নেই। হয়তো ছোটবেলা থেকে একসাথে কো এডে পড়ে বলেই মেয়েদের প্রতি অশ্লীল আগ্রহ কম। মেয়েদের মধ্যে অবশ্য মেয়ে মেয়ে ভাবও কম। কিংবা এখানে একসাথে সবাই কুংফু, ক্যারাটে, জুডো শিখে বলে জানে ধরলে উলটো খেতে হবে। তাই প্রানের মায়ায় কেউ ট্র্যাসপাচ করেন না হয়তো।

31st_2010 235

31st_2010 086

এদিনে শপিং মলগুলোতে উপচে পরা ভীড় থাকে। স্টক ক্লিয়ার সেল শুরু হয়ে যায়। কেনাকাটার ধুম চলে। পে করার লাইন লম্বা হয়ে এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে চলে আসে। অনেক দেশে আবার বক্সিং ডেও থাকে। যদিও অর্থনীতিবিদদের মতে ২০১১ সাল ২০১০ সাল থেকেও কঠিন যাবে। কানাডা, এ্যমেরিকায় নাগরিকরা অধের্য্য হয়ে ওঠছেন আস্তে আস্তে। তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রান চান। অবস্থার পরিবর্তন না হলে সরকার বিরোধী আন্দোলন কিংবা জ্বালাও পোড়াও শুরু হতে পারে। পশ্চিমের সরকাররা অনেকটা হুমকিতে আছেন। আমি ভাবছি যুদ্ধ যখন হবেই তাহলে লেটস ফাইট ডিসুম ঢুসুম। ইয়েস, ওয়েলকাম ২০১১ এন্ড ফাইট টু সারভাইভ।

তানবীরা
০২.০১.২০১১

ফটো কার্টসিঃ তানভীর হোসেন বন্ধুবরেষু